মাক্সিম গোর্কি
কুঁজো বললে, ‘ধন্যবাদ।’ শিক্ষকের প্রতি তার আচরণ ছিল যেন এক পরিণত বয়সীর শুষ্ক অমায়িকতার মতো, ‘কিন্তু সোশ্যালিস্ট কি বস্তু?’
বড়ো জোর ওরা হল সাধারণভাবে আলসে আর দিবাস্বপ্ন প্রিয়, মনের দিক থেকে পঙ্গু, ঈশ্বর সম্পত্তি, অথবা স্বজাতি সম্পর্কে কোনো চিন্তাভাবনা নেই।’
ওর শিক্ষকের। জবাব দিত সবসনয়েই খুব সংক্ষিপ্তাকারে এবং যে জবাব তার স্মৃতির মধ্যে গেঁথে বসত যেন পেভমেন্টের মুক্তি। ‘মুড়ি হলেও কি মনের দিক থেকে পঙ্গু হতে পারে?’
‘নিশ্চয়ই…’
‘ছোটো মেয়ে?’
‘হ্যাঁ। ব্যাপারটা হল জন্মগত…’
শিক্ষকেরা ওর সম্পর্কে বলত:
‘অঙ্কে ওর বিশেষ মাথা নেই, কিন্তু নীতিকথা সম্পর্কে ওর আগ্রহ খুব বেশি…’
ওর দিদি যখন জানলে যে শিক্ষকদের সঙ্গে ও বসে বসে আলাপ করে, তখন বললে, ‘তুই বড়ো বেশি বকিস।’
‘আমার চেয়ে ওরা বেশি বকে।’
‘ঈশ্বরের কাছে তুই তো তেমন মন দিয়ে প্রার্থনা করিস না…’
‘ঈশ্বর কি আমার কুঁজ সারিয়ে দেবে…’
অবাক হয়ে দিদি চেঁচিয়ে উঠল, ‘বটে! এই সব কথা মাথায় ঢুকেছে দেখছি।’
দিদি ঘোষণা করলে, ‘এবারের মতো ক্ষমা করলাম, কিন্তু এ সব চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দে, বুঝেছিস?’ ‘বুঝেছি।’
মেয়েটি তখन नाना পোষাক পরতে শুরু করেছে, আর ছেলেটির বয়ন হয়েছে তেরো। সেটি দিন থেকে কুঁজোটা তার দিদিকে বড়ো আলাতে শুরু করলে।
ভাইয়ের কারখানা-ঘরে ঢুকলেই দিদির পায়ের কাছে, ঘাড়ে, নাখায় কি হাতের ওপর কাঠ, তরুন কি হাতিয়ার পত্র না পড়ে প্রায় যেত না। কুঁজো অবশ্য সবসময়েই একটা হুঁশিয়ারি দিয়ে উঠত:
‘সামলে।’
কিন্তু সবসময়েই সে হুঁশিয়ারি হত ঠিক একমুহূর্ত দেরি করে, এবং প্রায়ই জখম হতে হত দিদিকে।
একবার, যন্ত্রণায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে দিদি রাগে বিবর্ণ হয়ে ছুটে গিয়েছিল তাইয়ের দিকে।
‘বিটকেল কোথাকার, ইচ্ছে করে তুই এ সব করিস’, বলে থাপ্পর মেরেছিল কুঁজোটার মুখে।
সে থাপ্পর খেয়ে ছেলেটা তার নড়বড়ে পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে উল্টে পড়ে গিয়েছিল। তারপর মেজের ওপর বলে কোমল করে বলেছিল:
‘কি করে ভাবলি ইচ্ছে করে করেছি। আমাকে তো তুই ভালোবাসিস। ভালোবাসিস না?’
ছেলেটার চোখে মুখে না ছিল চোখের জল, না কোনো রাগের চিহ্ন।
যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে পালিয়ে গিয়েছিল দিদি। পরে ফিরে এসেছিল মাপ চাইতে। বুঝিয়ে বললে:
‘এ রকম তো তুই আগে কখনো করিসনি কি না…’
‘আগে তো আমার এসব জিনিস ছিল না’, তাই জবাব দিয়েছিল শান্তভাবে; হাত নেড়ে দেখিয়ে দিয়েছিল তার গোটা ঘরখানা: তার কোণে কোণে স্তূপ করা তত্ত্বা, দেয়ালের পাশে জুতোর মিস্ত্রির টেবিল, বেদ মেশিনের উপর উচু করা কাঠ, সব কিছুই এলোমেলো। মতো রাজ্যের এই রাবিশ এনে ঢুকিয়েছিস কেন?’ সন্দেহ আর বিরক্তি নিরে দিদি জিগ্যেস করেছিল তার চারিপাশে চেয়ে।
‘দেখিস না কি হয়।’
বানাবার কাজ তার আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। খরগোসের জন্যে একটা বাসা বানিয়েছিল ছেলেটা, ককরের জন্যে একটা খাঁচা, তারপর এখন কাজ করছিল একটা নতুন ধরণের ইদুর-কল বানাবার জন্যে। দিদি তার কাজের অগ্রগতি লক্ষ্য করে চলছিল সোৎসাহে। ঝাওয়ার সময় মা-বাপের কাছে গর্ব করে ভাইয়ের সাফল্যের কথা জানাত। তারিফ করে মাথা দোলাত বাপ। বলত: ‘ছোটো ছোটো জিনিস থেকেই তো সব শুরু। এমনি করেই তো হয়।’
আর মা তার মেয়েটিকে আলিঙ্গন করে ছেলেকে উপদেশ দিত: ‘দিদি তোর জন্যে কিন। করেছে তা জানিস তো?’
‘জানি।’ জবাব দিত কুঁজোটা।
ইঁদুর-কলটা বানানো শেষ হয়ে গেলে, কুঁজো তার দিদিকে ডেকে এনে বিদঘুটে যন্ত্রটা দেখালে।
বললে, ‘খেলনা নয় কিন্তু, এটাকে পেটেন্ট করে নেওয়াও চলে। দ্যাখ না কি সহজ, অথচ কি জোর। আঙুলটা এখানে রাখ তো।’
দিদি আঙুল ছোয়ানো মাত্র কি একটা ছুটে গেল। চেঁচাতে লাগল মেয়েটা, আর কুঁজো তার পাশে লাফাতে লাফাতে বিড়বিড় করতে লাগল:
‘এ হে, ভুল হাতটা ভুল হাতখানা…’
মুটে এব যা তারপর চাকর-বাকরেরা। ইদুর-কলাটা ভেঙে তাঁরা দেখে যাওয়া নীল খাধুগটা খালাস করে মুজিত অবস্থার বয়ে নিয়ে চোর যেয়োটিকে।
সেই দিন সন্ধ্যের দিদি ভাইকে ডেকে পাঠিয়ে জিগ্যেস করলে: ইচ্ছে করে তুই এটা করেছিস। আমার ওপর তোর ভারি রাগ। কিন্তু কেনা’
পুঁজটা দুলিয়ে শাস্ত মৃদুস্বরে ভাই বললে?
‘তুল হাতটা দিয়ে তুই ওটা ছুয়েছিলি, তাছাড়া আর কিছু নয়।’ ‘মিথ্যে কথা।’
‘কিন্তু… তোর হাতখানা বিচ্ছিরি করে দিয়ে আমার কি লাভ? তাছাড়া, যে হাতটা দিয়ে তুই আমাকে মেরেছিলি, ওটা তো সে হাতখানাও নয়…’
‘সাবধান করে দিচ্ছি, পঙ্গু কোথাকার, আমার কাছে চালাকি মারতে আসিস না!…’
‘তা জানি।’ ভাই স্বীকার করলে।
ওর কোনাচে-কোনাচে মুখখানা যথারীতি একই রকম শান্ত, চোখ দুটো চিন্তিত। ও রাগ করছে কিংবা মিছে কথা বলছে বিশ্বাস করা কঠিন।
এর পর থেকে দিদি তার ঘরে অত ঘন ঘন যাওয়া বন্ধ করলে। মেয়েটির হাসিখুশি বন্ধুরা আসত তাদের বাড়িতে, ঝকমকে রঙের গাউন পরে। বড়ো বড়ো এবং ঈষৎ ঠাণ্ডা কাঠিন্যভরা ঘরগুলোতে তারা আলগোছে ভেসে বেড়াত, আর ছবি, মূর্তি, ফুল আর সোনার মোড়া অলঙ্কার পাতি সব যেন কোমল হয়ে উঠত তাদের পেয়ে। মাঝে মাঝে ভাইয়ের ঘরখানায় ও নিয়ে আসত তাদের বন্ধুদের, গোলাপী নখের ছোটো ছোটো আঙুলগুলো ওরা বাড়িয়ে দিত কেতামাফিক, কুঁজোর হাতটা ছুঁতো আলতোভাবে পাছে বুঝি তা ভেঙে যায়। অতি সয়েহে ওরা কথা কইত ওর সঙ্গে, আর হাতিয়ারপত্র, আঁকা-জোকা, কাঠ আর কার্ডের চটার স্তূপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা কুঁজোর দিকে ওরা চেয়ে দেখত সবিস্ময়ে কিন্তু বিনা আগ্রহে। কজো জানত, মেয়েগুলো তাকে বলে ‘আবিষ্কারক’, এবং যাতে বলে, তার ব্যবস্থা দিদিই করে রেখেছিল। ওরা সকলেই আশা করত, ভবিষ্যতে দে এমন একটা কিছু করবে, যাতে তার বাপের নাম ধন্য হয়ে যাবো দিদিই তার সে করৎ পিনবরতা বলে বেড়াত একেবারে দৃঢ়নিশ্চিতভাবে। ‘ও দেখতে কুৎসিত বটে, কিন্তু ভারি চালাক।’ প্রায়ই বলত মেয়েটা। উনিশ বছরে পড়েছিল দিদি, পানিপ্রার্থীও একজন ছিল, এমন সময় ওদের মা-বাপ দুজনেই মারা গেল জলে ডুবে। সখের নৌবিহারে গিয়েছিল ওরা, কিন্তু একটা আমেরিকান জাহাজের মাতাল সারেঙের পাল্লায় পড়ে ধাক্কা খেয়ে নৌকাখানা ডুবে যায়। দিদিটির কথা ছিল নৌবিহারে যাবার, কিন্তু দাঁতের ব্যথায় যাওয়া হয়নি। মা-বাপের মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে দাঁতের ব্যথা ভুলে মেয়েটি ঘরময় ছোটাছুটি করে কাঁদতে লাগল, হাত কচলাতে লাগল।
‘না, না এ হতে পারে না। হতে পারে না।’
দরজার পরদাটা গায়ে জড়িয়ে কুঁজো ভাইটা চৌকাটের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলে দিদিকে, তারপর কুঁজটা দুলিয়ে বললে:
‘বাবার শরীরটা তো বেশ মোটা আর ফাঁপা ফাঁপা ছিল, কি করে ডুবল বুঝতে পারছি না…’
শুনে দিদি চেঁচিয়ে উঠল, ‘চুপ কর বলছি! কারো জন্যে তোর একটুও ভালোবাসা নেই!’
ও বলবে, ‘মিষ্টি কথা কি করে কইতে হয় তা যে আমি জানি না।’
বাপের লাস খুঁজে পাওয়া যায়নি। যার মৃত্যু হয়েছিল জলে ভেসে যাবার আগেই। হায়ের লাসটা নিয়ে আসা হয়েছিল। কফিনের মধ্যে মহিলা শুয়ে রইল ঠিক তেমনি ভাবে, যেমন ছিল সে তার জীবনকালে- বুড়ো গাছের মরা ভালের মতো শুকনো আর ভঙ্গুর।
মায়ের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া হয়ে যাবার পর ঠাণ্ডা ধুসর চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে শোকার্ত কঠিন গলায় দিদি বললে, ‘তুই আর আমি এবার একা পড়লাম। চালানো কঠিন হবে আমাদের পক্ষে। আমরা কিছুই তো জানি না, অনেক লোকসান করে ফেলব হয়ত। এক্ষুণি যে বিয়েও করে ফেলব তারও জো নেই ছাই!’
‘ওহ্ হো।’ মন্তব্য করলে কুঁজো।
‘ওহ্ হো’ মানে কি?’
কুঁজো এক মুহূর্ত ভাবলে। তারপর বললে:
‘আমরা একা পড়লাম।’
‘কথাটা বলছিস এমন ভাবে যেন ভারি খুশি হয়েছিস।’
‘কিছুতেই আমি খুশি হই না।’
‘সেইটাই খুবই আফসোসের কথা। জীবন্ত মানুষের মতো তুই একটুও নোস্।’
সন্ধ্যেবেলায় মেয়েটির প্রেমাস্পদ আসত তার সঙ্গে দেখা করতে। ছোটোখাটো চেহারার একটি হাসিখুশি লোক, কটা চুল, গোল রোদে পোড়া মুখ, ঝুপড়ি মোচ। সারা সন্ধ্যে লোকটা অনবরত হাসত, এবং এমনি করে সারা দিনটাও যে সে হেসে যেতে পারত, তাতে সন্দেহ ছিল না। পাকা কথা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল ওদের, শহরের সবচেয়ে শান্ত ও পরিচ্ছন্ন সেরা একটা রাস্তায় বাড়ি তৈরি হচ্ছিল ওদের রবো। নতুন বাড়িটার কাছে কথো কখনো যেত না বাড়িটা দিয়ে ভইলড়নাও সে পছন্দ করত না। দিদির ভাবী বর তার আংটি এরা খুদে ক্ষুদে গোল গোল হাত দিয়ে ওর কাঁধে চাপড় মেরে হায়ত, এবং হাঁ-নখ ভরা ক্ষুদে ক্ষুদে দাঁতগুলো বার করে বলত। *এক বার গিয়ে তোমার দেখে আসা উচিত, ছোলার বলো?
নানা অছিলায় কুঁজোলি অনেকদিন তাতে আপত্তি করে এসেছিল, কিন্তু শেষ কালে একদিন সে রাজী হল। দিদি আর দিদির প্রেমাস্পদের রঙ্গে গেল সেই নতুন বাড়ির কাছে। বাড়ি তৈরির জন্য বাঁধা যাচা বেয়ে পুরুষ দুজন উঠে গেল ওপরে, কিন্তু ওপর পর্যন্ত পৌছিয়েই ওরা পড়ে গেল নীচে। ভাবী বর পড়ল খাড়া নিচে, চুনের জলার মধ্যে, আর একটা বেরিয়ে আসা খোঁচায় পোষাক আটকিয়ে গিয়ে কুঁজোটা খুলতে লাগল শূন্যে। রাজ-মিস্ত্রিরা ওকে উদ্ধার করে নামিয়ে আনল, হাত আর পা মচকিয়ে যাওয়া ছাড়া ‘ওর বেশি কিছু হয়নি। কিন্তু ভাবী বরের পিঠের শিরদাঁড়া ভেঙে পাঁজরা ফেটে বেরিয়ে গিয়েছিল।
ভিরমি যেতে শুরু করল দিদি। মাটির ওপর লুটিয়ে নখ দিয়ে মাটি আঁচড়িয়ে শাদা শাদা ধূলো ওড়াতে লাগল মেয়েটা। তারপর অনেক দিন ধরে কেঁদেছিল মেয়েটা, প্রায় এক মাসেরও বেশি, এবং তারপর থেকে ওর চেহারা হতে লাগল ঠিক ওর মায়ের মতো, পাতলা হাড্ডিসার; গলার স্বরে দেখা দিল ঠিক সেই নিষ্প্রাণ সেঁৎসেঁতে ধ্বনি।
‘তুইই আমার দুর্ভাগ্যের কারণ।’ দিদি বলত।
আর নিঃশব্দে মাটির দিকে চেয়ে থাকত কুঁজোটা।
কালো পোষাক পরা শুরু করলে দিদি, ভুরু দুটো কুঁচকে থাকত সর্বসময়, ভাইকে দেখলে এত জোরে দাঁতে দাঁত চাপত যে ফুটে উদ্ভুত গালের হাড়। দিদিকে এড়িয়ে থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করত ভাই, নিজের আঁকা-জোকা নিয়ে পড়ে থাকত চুপ করে, একলা। এমনি করেই ওরা কাটালে, তারপর যেদিন থেকে ভাই সাবালক হল সেদিন থেকে ওদের দুজনের মধ্যে শুরু হয়ে গেল প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা। এই যুদ্ধের উত্তেজনায় ওরা ওদের সমগ্র জীবন সঁপে দিলে, পারস্পরিক অপমান আর লাঞ্ছনার দৃঢ় বাঁধনে ওরা বাঁধা পড়ল।
যেদিন ছেলেটি সাবালক হয়েছিল, সেদিন যে দিদিকে বলেছিল কর্তৃত্বের সুরে:
‘দুনিয়ায় জ্ঞানী যাদুকরও নেই, উপকারী পরীও নেই, আছে শুধু লোক। তাদের কেউ খারাপ, কেউ বোকা- দয়াধর্ম সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় তা নিছক রূপকথা। কিন্তু আমি সেই রূপকথাকেই সত্যি করতে চাই। তুই কি বলেছিলি একদিন মনে আছে: বড়োলোকের বাড়িতে সবাইকেই হয় সুন্দর হতে হবে, নয় বুদ্ধিমান? বড়োলোকের শহরেও সব কিছু সুন্দর হওয়া উচিত। শহরের বাইরে জমি কিনে আমি তাই একখান বাড়ি তৈরি করছি, তাতে থাকব আমি এবং আমার মতো যারা বিকলাঙ্গ তারা। এই শহর থেকে তাদের আমি সরিয়ে নিয়ে যাবো সেখানে, কেননা এখানে বাস করা তদের পক্ষে ভারি কষ্টের, তোদের মতো লোকের সৌন্দর্যবোধ ওদের দেখে ক্ষুণ্ণ হয়…’
‘না।’ দিদি বললে, ‘খবর্দার না! পাগলামি পেয়েছিস!’ ‘কিন্তু এতো তোরই কথা।’
ওরা তর্ক করলে ঠাণ্ডাভাবে, যুক্তি তুলে, ঠিক যেমনভাবে তর্ক ভরতে পাবে শুধু তারা, যারা পরস্পরকে ঘৃণ্য কবে এবং ঘৃণ্য চেপে প্রতীক প্রযোজন বোধ করে না।
‘আমি ঠিক কবে ফেলেছি।’ ও বললে। দিদি বসলে, ‘আমি ঠিক করিনি।’
ইজটা উচু করে ও চলে গেল। কয়েকদিনের মধ্যেই দিদি জাদব, ও জমি কিনেছে, ভিত খোঁড়া হচ্ছে, ইট, পাথর, লোহা, জাই বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গাড়ি গাড়ি।
‘এখনো খোকা আছিস নাকি তুই?’ দিদি জানতে চাইল, ‘এটাও একটা খেলা ভেবেছিস, না?’
ও জবাব দিলে না।
সপ্তাহে একদিন করে দিদি চলে যেত শহরের বাইরে, ছোট একটা ঘোড়ার গাড়ি করে। শুকনো হাড্ডিসার পিঠটা টান করে গগর্বে বসে গাড়ির শাদা ঘোড়াটাকে সে চালাত নিজে, আর যেখানে খাড়ি উঠছিল সেই জায়গাটা দিয়ে যাবার সময় আস্তে করে দিত গাড়ির গতি, ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত, মাংসের মতো লাল লাল ছটগুলো শরীরের রগের মতো লোহার কড়িবর্গার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আর স্নায়ুতন্তর মতো থাকে থাকে বসছে হলুদ রঙা কাঠগুলো। দূর থেকে চোখে পড়ত মাচার ওপর ছড়ি হাতে কাঁকড়ার মতো গুটি গুটি হাঁটছে তার ভাই, মাথায় একটা দলামোচড়া টুপি, মাকড়সার মতো সর্বাঙ্গ ধূলি-ধূসর। ওর নজরে পড়েছিল, ভাই বাড়ি ফিরলে, মুখখানা তার সজীব হয়ে উঠত। কালো চোখ দুটো হয়ে উঠত আগের চেয়ে কোমল আর পরিষ্কার।
ও বলেছিল, ‘আমি বলছি, এটা আমার একখান দারুণ আইডিয়া। এতে আমাদের মঙ্গল, তোরও মঙ্গল! কিছু একটা গড়ে তোলার মতো চমৎকার জিনিস আর নেই, হনে হচ্ছে শীগগিরই নিজেকে বেশ স্বনী বলে ভাবতে পারব এব…
“সুধী।’ প্রতিবুনি কবে দিদি তার বিকলাদ শরীরটার দিকে তাকালে একটা বিচিত্র দৃষ্টি নিয়ে।
‘খ্যা, হখী। জানিস, যে লোকগুলো কাজ করে, তারা আমাদের চেয়ে একেবারে তফাত, ওদের দেখে অদ্ভুত অদ্ভুত সব তাবনা মনে আসে। বাজ-মিস্ত্রি হলে কি সুন্দরই না হত, কয়েক ডজন বাড়ি তৈরি করেছি যে শহরে তার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে কি ভালোই না লাগত। মজুরগুলোর মধ্যে বেশ কিছু সোশ্যালিস্ট আছে। বেশ ধীর স্কির গোছের লোক ওরা, আর মর্যাদা-জ্ঞানও বেশ টনটনে, এ কথা মানতেই হবে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের আশেপাশের লোকগুলো সম্পর্কে আমরা কি অয়ই না জানি…’
‘কি অদ্ভুত সব কথা।’ মন্তব্য করলে দিদি।
দিনের পর দিন কুঁজোটা আরো সজীব আরো মুখর হয়ে উঠতে লাগল।
দিদিকে যে বললে, ‘আসলে তুই যা চেয়েছিলি, তাই ঘটতে চলেছে। আমি হবো সেই জ্ঞানী যাদুকর, শহর থেকে বিকলাঙ্গদের যে সরিয়ে নেবে। ইচ্ছে করলে তুইও একটা উপকারী পরী হতে পারিস। জবাব দিচ্ছিস না যে?’
সোনার ঘড়ির চেনটা নিয়ে খেলা করতে করতে দিদি বলেছিল, ‘পরে এ নিয়ে কথা হবে।’
একদিন তাই তার সঙ্গে এমন এক সুরে কথা কইলে, যা দিদির কাছে একেবারে নতুন।
তুই আমার যা ক্ষতি করেছিস, তার চেয়ে হয়ত তোর ক্ষতি তাদি করেছি বেশি…’
অবাক হয়ে গেল দিদি। আমি- ক্ষতি করেছি তোর।’
‘শোন, দিব্যি নিয়ে বলছি, তুই আমাকে যতটা দোষী বলে ভাবিস ততটা দোষী আমি নই! আমার পা দুটো খুব শক্ত নয়, তাই সেদিন হয়ত আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে থাকব, কিন্তু সেটা ইচ্ছে করে করিনি, বিশ্বাস কর। তার চেয়ে বরং অনেক বেশি দোষ করেছিলাম সেদিন, যে হাত দিয়ে তুই আমাকে মেরেছিলি সেটাকে বিকৃত করে দেবার চেষ্টা করে…’
দিদি বললে, ‘থাক ও সব কথা!’
‘পরস্পরের প্রতি আমাদের আরো সদয় হওয়া উচিত।’ অস্ফুট জ্বরে বললে কুঁজো, ‘দয়ামায়া জিনিসটা নেহাৎ স্বপ্ন নয়, আমার মনে হয় তা সম্ভব…’
শহরের বাইরে বিরাট বাড়িখানা তৈরি হতে লাগল আশ্চর্য তাড়াতাড়ি, উর্বরা মাটিকে আবৃত করে বাড়িখানা উঁচু হয়ে উঠল সেই আকাশের দিকে, যার রঙ সবসময়েই ধূসর, সবসময়েই যেখানে বৃষ্টি আসন্ন।
একদিন একদল সরকারী অফিসার এল জায়গাটা দেখতে। তারা দালানটাকে পরীক্ষা করে দেখল, নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কি আলাপ করলে, তারপর হুকুম দিলে, কাজ বন্ধ করতে হবে।
চিৎকার করে উঠল কুঁজো, ‘এ তোর কীর্তি।’ আক্রোশে দিদির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে তার লম্বা লম্বা সবল হাত দুটো দিয়ে গলা চেপে ধরল ওর। কিন্তু কোথা থেকে যেন লোকজন এসে ওকে ছাড়িয়ে দিল।
দিদি বললে, ‘দেখুন, আপনারা, সত্যিই সত্যিই ও বিস্তৃত প্রতিষ্ক। ওর দরকার অভিভাবকের অধীনে থাকা। ব্যাপারটা শুরু হয় বাধ্য হারা যাবার পরেই, বাবাকে ও ভয়ানক ভালোবাসত। বাড়ির চাকর-বাকরদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন, ওরা সকলেই ওর রোগের কথা জানে। এ নিয়ে ওরা কখনো কিছু বলেনি, তার কারণ ওরা হল ভালোমানুষ লোক, এ বাড়িতে ওদের অনেকেই ছেলেবেলা থেকে মানুষ, তাই এ বাড়ির মান ওরা নষ্ট করতে চায়নি। আমাদের দুর্ভাগ্যের রাখাটা আমিও চেপে রেখেছিলাম, কেননা ভাইটি উন্মাদ, এ কথা তো আর বড়ো গলা করে জাহির করার নয়…’
এ কথা শুনে মুখ নীল হয়ে গেল কুঁজোটার, কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল চোখ দুটো। কথা বলার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে যে শুধু যারা ওকে ধরে রেখেছিল তাদের আঁচড়াবার চেষ্ট। করতে লাগল নিঃশব্দে। দিদি বলে চলল:
‘এই সর্বনেশে বাড়ি তোলার কথাই ধরুন না কেন, বাড়িখানাকে আমি শহরকে দিয়ে দিতে চাই বাবার নামে একটা মানসিক রোগের হাসপাতাল করার জন্যে…’
এই পর্যন্ত শুনে একটা বিকট চিৎকার করে কুঁজোটা মুছিত হয়ে পড়ল। লোকজন ওকে নিয়ে গেল ধরাধরি করে।
যত তাড়াতাড়ি ও শুরু করেছিল, তত তাড়াতাড়ি বাড়িখানাকে শেষ করে ফেললে দিদি। বাড়িখানা যখন সম্পূর্ণ হল, তখন প্রথম রোগী হিসাবে সে পাঠালে তার ভাইকেই। সাত বছর সে ওখানে ছিল-অক্ষম পঙ্গু হয়ে পড়ার পক্ষে সময়টা যথেষ্ট। সেখানে তার মানসিক আতঙ্কের ব্যাধি দেখা দিল। ওদিকে দিদিরও বয়স পেরিয়ে গিয়েছিল, মা হওয়ার আর কোন আশা রইল না তার।
এবং তারপর দিদি যখন দেখলে, যে ভাই খতম হয়েছে, আর কখনো সে ভালো হবে না, তখন ভাইটিকে যে নিয়ে এল নিজের তত্ত্বাবধানে।
আর তাই ওরা ফিরছে বিশ্বভ্রমণ করে, দুষ্টিহীন পাখির মতো ঠেকছে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়, সব কিছুর দিকেই তাকাচ্ছে এক নিষ্প্রাণ নিরানন্দ চোখ মেলে কিন্তু নিজেদের ছাড়া কোথাও কিছুই ওদের চোখে পড়ার নয়।
Leave a Reply