শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৪ পূর্বাহ্ন

ওকে গাইতে দাও (পর্ব-১৮)

  • Update Time : শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

মণীশ রায়

তাপস বেরিয়ে পড়েছিল। সে ওর মালিবাগের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই তপতীর ফোন,‘ তুমি কোথায় ?’

‘কেন ?’

‘সৃষ্টি ফোন করেছে। ওরা বিপদে। তাড়াতাড়ি আস। ’

তাপস আর দাঁড়ায় না। এক ছুটে ফ্ল্যাটে এসে স্ত্রী তপতীকে নিয়ে ছুটে আসে স্কুলে।

রওশন আরার  কক্ষের বাইরে  দাঁড়ানো সৃষ্টি , তুষ্টি ভেতরে।

তাপস-তপতী ভেতরে পা দিতেই তিনি চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন ওদের দিকে। চোখে পাওয়ারের চশমা। গায়ের রং ফর্সা । তবে চেহারা জুড়ে একরাশ বিরক্তি, দেখলেই মেজাজী বলে মনে হয়।

ওদের দেখে এতটুকু সৌজন্য দেখালেন না। বরং তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন,‘ আপনারা তুষ্টির মা-বাবা ? মা-বাবা  কিভাবে হতে হয় তা জানেন ? ’

আচমকা এ প্রশ্নে ওরা হতভম্ব। তাপস বলে ওঠে,‘ কী হয়েছে ম্যাডাম ?’

‘কী হয়নি সেটা বলেন ? আপনার মেয়ে মোবাইল নিয়ে স্কুলে আসে যায়। আমরা সিসি টিভিতে দেখতে পেয়েছি। পরে চার্জ করে এই মোবাইলটা পেয়েছি ওর কাছ থেকে। ছিঃ। ’

তাপস চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। পাশে তুষ্টির চোখ বেয়ে অবিরল কান্না ঝরছে। ওর ফর্সা চেহারা লাল হয়ে আছে। মেয়েটা তাকাতে পারছে না ওদের দিকে। প্রচÐ অপরাধ বোধে নুব্জ হয়ে পড়েছে সে। মাঝে মাঝে হেঁচকি দিয়ে উঠছে।

তাপস আচমকা প্রথম ধাক্কাটা সামলে নেয় কয়েক সেকেÐের ভেতর। এরকম ঘটনার ভেতর বহুবার ওকে যেতে হয়েছে। কতবার যে বাইয়ারদের কাছ থেকে চূড়ান্ত বিবেচনায় ওর মালমাল ফেরত এসেছে। তখন ওর বুক চাপড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করত। একটা-দুটো আর্টিকেলে খুত ধরা পড়ায় পুরো লটটাই বাতিল বলে গণ্য। এতদিনের শ্রম আর বিনিয়োগ সব এক লহমায়  অর্থহীন ও  বৃথা প্রমাণিত হল। বুক ফেটে যেত কষ্টে, তবু কাঁদতে পারেনি। নিজেকেই সামলে নিতে হয়েছে সব। যত ক্ষতি হউক, শেষ পর্যন্ত ওকেই ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছে।

সেসব ভেবে নিজেকে শক্ত করে তাপস। রওশন আরার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করে,‘স্কুলে মোবাইল আনতে নেই, এটা তো প্রথম শুনলাম। আপনি কি গার্জিয়ানদের এসএমএস দিয়ে জানিয়েছেন?  একটা সামান্য মোবাইল এনেছে বলে তাকে আপনি এভাবে মানসিক নির্যাতন করতে পারেন না। এটা বাড়াবাড়ি।’ বেশ কর্কশ শোনায় তাপসের কণ্ঠস্বর, বের হয়ে আসতে চাইছে  নিজের ভেতরে জমানো  একরাশ উষ্মা ও ক্ষোভ।

মহিলা প্রথমে সামান্য ভড়কে যায় ওর কথায়। পরক্ষণে তীব্র রাগ ও ক্ষোভ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর,‘ আপনি পিতা হয়ে এটি সাপোর্ট দিচ্ছেন ? একটি মেয়ে স্কুলে এসে মোবাইল দিয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ করছে Ñ আর আপনি একে সমর্থন দিচ্ছেন ? ছিঃ ! ’ এমনভাবে বলছেন যে মনে হচ্ছে, এ জগতে কেউ কোনোদিন প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলেনি, তিনি নিজে তো ননই।

এবার পাশে বসা এক মহিলা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। বললেন,‘ আপা, এ ধরনের মা-বাবার জন্যই ছেলে-মেয়েরা উচ্ছন্নে যায়। এদের হাজার বলেও কিছু হবে না। বাদ দেন, কথা বলে লাভ নেই।’ মুখ ঝামটা দেন মহিলা।

প্রধান শিক্ষিকা চোখ লাল করে টেবিলে বসা মহিলার দিকে তাকান। চশমার ফাঁকে আঁকানো নির্লোম ভুরু দুটো  তার  কুঁচকে থাকে ।

রিতার এধরনের মন্তব্য তাঁকে যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতে সাহায্য করে। মুখে বলেন,‘ কি বল রিতা ? এদের এমনি এমনি ছেড়ে দেব ? এই যে শুনুন, আপনার মেয়ের টিসি তৈরি হচ্ছে। দয়া করে একটুখানি বসে সেটি নিয়ে যাবেন । আপনার আরেকটি মেয়ে আছে আমাদের স্কুলে । ওকে নিজে থেকে নিয়ে গেলে খুশি হই। আমরা বহুকষ্টে এই স্কুলটির সুনাম ধরে রেখেছি। এক-দুটো মেয়ের জন্য আমরা স্কুলের অন্য মেয়েদের বিপদে ফেলতে পারব না। আমাদের সোজা কথা।’

তাপস নিজের মেজাজ আর ধরে রাখতে পারে না। ওর পরিচিতির বহর একেবারে কম নয় ; সে-ও বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল কোনকালে। বড় ব্যবসায়ী হবে বলে সে এ পেশা বেছে নিয়েছে। নইলে চাকরি চাইলে সে-ও অবলীলয়ায় এরকম একটি চেয়ার দখল করতে পারত।  একটা সামান্য কারণের জন্যে ওর মেয়েকে টিসি দিয়ে দেবে ?

সে চেঁচিয়ে উঠল,‘ এটা ঠিক হচ্ছে না ম্যাডাম ?’

‘আগে নিজের মেয়েকে শিক্ষা দিন। পরে স্কুলকে ন্যায়-অন্যায় বুঝাতে আসবেন। ’ মুখ ফিরিয়ে নের রওশন আরা।

‘একটা মোবাইল রাখার জন্য আপনি ওকে শো-কজ করতে পারেন। সতর্ক করতে পারেন। সরাসরি টিসি দিয়ে দেবেন ? মগের মুল্লুক ?’

‘শাট আপ।’ মহিলা চীৎকার দিয়ে ওঠেন ,‘বাজে কথা কম বলবেন। আমরা যা করবার করব। আপনি বেরিয়ে যান।’

‘না। আপনি যা খুশি তা করতে পারেন না। স্কুলটা আমাদের টাকায় চলে। আপনাদের বেতন-ভাতা আমরা দিয়ে থাকি। স্বৈরাচারী মন নিয়ে কোন ডিসিশন আপনি নিতে পারেন না।’ তাপস রাগে-দুঃখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। একটা সামান্য মোবাইল রাখার জন্য এতবড় শাস্তি ? কিছুতেই সে মানতে পারছে না। এত আদরের মেয়েটাকে ওরা এভাবে শাস্তি দিচ্ছে ? হু-হু করে উঠছে মন।

তপতী এতক্ষণ চুপ করেছিল। এবার সে হাঁউমাঁউ করে কেঁদে ওঠে ; বারবার করে ছুটে যায় রওশন আরার পা জড়িয়ে ধরতে । ওর একটাই চাওয়া Ñ মেয়েটাকে এবারের মতো যেন ক্ষমা করে দেয়া হয়।

কিন্তু মহিলা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে তপতীর কথায়,‘ কোন ক্ষমা-টমা নেই। আপনাদের মতন মা-বাবাদের একটা শিক্ষা হওয়া উচিৎ। মেয়ে স্কুলে এসে লেখাপড়া না করে হাতে মোবাইল নিয়ে বেলেল্লাপনা করে বেড়ায় আর মা-বাপ তার হয়ে সাফাই গাইতে আসে হেডমিসট্রেসের রুমে। বেরিয়ে যান? গেট লস্ট ? ’

তাপস উচ্চৈঃস্বরে উত্তর দেয়,‘এজন্য আপনারা দায়ি। আমার মেয়ে এরকম নয়।’ কখন  যে ওর চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরতে শুরু করেছে তা সে টেরই পায় নি। এ যেন চোখের জল নয়, রক্তবিন্দু।

তুষ্টি এবার ছুটে আসে বাবার দিকে। তাপসকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে,‘ বাপি, এদের কিছু বলে লাভ নেই। ওরা তোমার কথা শুনবে না। ওরা নিষ্ঠুর ! ’ বলে ওকে টানতে টানতে কক্ষের বাইরে নিয়ে যায়।

ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই স্তম্ভিত। নিজেদের কাঙাল বলে মনে হচ্ছে।  গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তাপসের। না পেরে গজরাতে থাকে।

প্রধান শিক্ষিকার অফিস থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে ওরা। তপতী-তাপসের দুপাশে ওদের দুই কন্যা তুষ্টি-সৃষ্টি। ওদের দৃষ্টির ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছে পরাজিত অসহায় মানুষের একধরনের গøানির চিহ্ন। কারও চোখের দিকে কেউ তাকাতে পারছে না। সংক্রামক রোগের মতো অপরাধবোধ ওদের যেন গ্রাস করে ফেলছে।

একটু পরই অফিস-পিয়ন এসে টিসি ধরিয়ে দেবে হাতে। অথচ এ  স্কুলটা একসময় ওদের বড় আপন ছিল। এর প্রতিটি কৃতিত্ব ওরা পুরো পরিবার মিলে ভাগ করে নিত। টেলিভিশনে স্কুল সম্পর্কে সামান্য একটি সংবাদ ভেসে উঠলেও ওদের দু-বোনের গর্ব ও আনন্দের সীমা থাকত না। সেই আনন্দ ধরে রাখতে না পেরে ওরা চেঁচিয়ে উঠত,‘ বাপি-মামণি, আমাদের স্কুল দেখাচ্ছে। তাড়াতাড়ি আস। ’

সেই স্কুলইটাই এখন শত্রæর প্রাঙ্গন বলে মনে হচ্ছে ওদের কাছে। যে যাচ্ছে সামনে দিয়ে, সে-ই কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে দেখছে ওদের। মনে হচ্ছে, ওরা সবাই সব জানে। স্কুলে একটি মোবাইল নিয়ে আসবার জন্যে এতো অপমান ? যত ভাবছে তত দিশাহারা হয়ে পড়ছে তুষ্টি। মাথা ভনভন করে ঘুরছে।

এপ্রিলের নিঃসঙ্গ আকাশে একটা চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। পাখিটা কি পথভ্রষ্ট ?  চোখভরা জল নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে তুষ্টি। সহসা কড়ই গাছের আড়াল থেকে টিয়া দুটো ডেকে ওঠে, টুই টুই।

নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না তুষ্টি। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে  ধীর পায় সে ছাদে উঠে পড়ে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024