শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৫ পূর্বাহ্ন

ওকে গাইতে দাও (শেষ পর্ব)

  • Update Time : সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

মণীশ রায়

সৃষ্টি হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে,‘ বাপী, দিদি কোথায় ? ’

চমকে ওঠে ওরা সবাই। এতক্ষণ মেয়েটা ওদের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল আর বলছিল,‘ বাপী ওরা বড় নিষ্ঠুর। কথা বলে লাভ নেই। চল’।

সেই মেয়েটা কোথায় ? তপতীর বুকটা ধড়াস করে ওঠে অজানা শঙ্কায়। চিৎকার দিয়ে মেয়েকে ডেকে ওঠে,‘তুষ্টি মা, তুমি কোথায় ? এই পোড়া স্কুলে তোরে আর রাখব না। কথা দিচ্ছি, অন্য স্কুলে ভর্ত্তি করে দেব। মা, তুই কোথায় ?’ পাগলিনীর মতো ছুটতে থাকে এদিক সেদিক।

ঘটনার আকস্মিকতায় তাপসও হতভম্ব। কী করবে বুঝতে পারে না। তপতীর পিছু পিছু হন্তদন্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়। বড় আদরের মেয়ে এই তুষ্টি। হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল ? প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে কেউ নেই। আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না ওকে। তাহলে কোথায় সে?

তপতীর মতো তাপসও গলা ফাটিয়ে মেয়েকে ডেকে ওঠে,‘ মা, তুমি কোথায় ? তুষ্টি মা, কোথায় তুমি ?’

আর ঠিক তখনি ধপাস করে বিকট একটি আওয়াজ হল। মনে হল সবকিছু কেঁপে উঠল তাতে।

পুরো স্কুল চত্বর জুড়ে হৈ-চৈ। কে যেন ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছে। রওশন আরা রুম থেকে বেরিয়ে সেদিকেই ছুটে গেল। যাবার সময় ভুরু কুঁচকে একবার তাকাল ওদের দিকে। যেন প্রশ্ন করছে মহিলা, এখনও এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন ? যান নি ?’

রওশন আরার পিছু বেশ কজন শিক্ষক-শিক্ষিকাও ছুটে যাচ্ছে অকুস্থানের দিকে। অফিসরুমের কর্মচারিবৃন্দও ছুটে বেরিয়ে এল। এমন বিকট শব্দ তাহলে কিসের ?

কে ঝাপিয়ে পড়ল ছাদ থেকে মাটিতে? হতভম্ব তাপস-তপতী চমকে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে বলে উঠল,‘তুষ্টি কোথায় ?’ বুকের ভেতর অনুশোচনার তীব্র দাবানল ; সব পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। কে ঝাপ দিল ছয়তলার ছাদ থেকে ?

দুজনার পা আর সরছে না। মনে হচ্ছে কেউ শিকল বেধে রেখেছে ওদের পায়।

তবু প্রাণপনে ওরা ছুটে গেল শব্দ লক্ষ্য করে। চোখের সামনে আবোল-তাবোল ভয়াল সব দৃশ্য ভাসছে। মাথার ভেতর যতসব রক্তাক্ত অনুভূতি।

যেখানে ভিড়, সেখানে এসে ওরা থামল। কণ্ঠ থেকে কথা বের হচ্ছে না। জিহŸা শুকিয়ে কাঠ। শরীর নিস্পন্দ। তাপস শক্ত হাতে সৃষ্টির কব্জি ধরে রাখে। মনে হচ্ছে , সে মাটিতে পড়ে যাবে।

তবু কণ্ঠে সমস্ত জোর এনে এক ছাত্রীকে তাপস প্রশ্ন করল,‘ কী হয়েছে মামণি ওখানে ? কেউ কি আত্মহত্যা করেছে ?’

মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল,‘ না, না। কোথায় ? একটা নারকেলের ডাল ভেঙে পড়েছে। দারোয়ন মামার হাত খানিকটা কেটে গেছে। ’ বলে মেয়েটি রঙ্গ দেখতে ভিড়ের ভেতর ঢুকে পড়ল।

এসময় পিছন থেকে আচমকা তুষ্টি বলে উঠল,‘তোমরা এখানে ? আমি তোমাদের খুঁজে মরছি। চল ?’

প্রচন্ড আবেগে তাপস-তপতী একসঙ্গে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে,‘ কোথায় ছিলি এতক্ষণ? আমরা তোকে খুঁজে খুঁজে হয়রান ?’

‘জল খেতে গেছিলাম ক্যান্টিনে ? ’ স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয় তুষ্টি। ওর উত্তর শুনে ফিক করে হেসে ওঠে ছোটো বোন সৃষ্টি।

ওরা যখন স্কুল গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় তখন ওসমানের ফোন আসে তাপসের মোবাইলে।

তাপসকে সে বলে ওঠে,‘ দোস্তো, মহিলা আমার কথা শুনতে চাইছে না। এক কাজ কর। মহিলার একটা কোচিং সেন্টার আছে বেনামে। ওখানে তুই মেয়েকে ভর্তি করে দে। ফল পাবি ভাল। যেখানে যে ভাও। কি বলিস ?’

সঙ্গে সঙ্গে তাপসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সে দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দেয়,‘ একটা ভালো স্কুল খুঁজছি। এ স্কুলে আর নয়।’

‘এরকম স্কুল তো তুই পাবি না দোস্তো ? সব একই রকম। ’

‘তবু খুঁজে দেখি। পাবো তো অবশ্যই। আজ না হয় কাল। একদিন না একদিন শিশুবান্ধব স্কুল হবে দেখিস। আদর্শ স্কুল আমরাই গড়ে তুলবো, দেখিস। ’ বেদনার ছায়া মিশে থাকে তাপসের কথার পরতে পরতে।

ওসমান ওর বন্ধুকে চেনে। এ দেশের বড় ব্যবসায়ী হবে বলে শেষ পর্যন্ত কিছুই হতে পারেনি। এখনও জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তবু আত্মাভিমান কমে না। মনে মনে ‘বেচারা’ সম্বোধন করে একধরনের করুণা প্রকাশ করে ওসমান।

এসময় নিজেকে বড় ভাগ্যবান বলে মনে হয় ওসমানের। কেননা নিজের পিঠাপিঠি দুটো ছেলেই কানাডায় আন্ডার-গ্র্যাজুয়েশন কোর্সে পড়াশুনো করছে। ওর স্ত্রীর দূর সম্পর্কের এক খালার তত্ত¡াবধানে আছে ওরা। শুধু মাসে মাসে ডলার কেটে  টাকাটা পাঠালেই হল।

এছাড়া দুশ্চিন্তা বলে আর  কিছু নেই !

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024