শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৪ পূর্বাহ্ন

জীবন আমার বোন (পর্ব-৫৩)

  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০২৪, ১২.০০ পিএম

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

রঞ্জুর ব্যাপারে তাকে সতর্ক থাকতে হবে, ঢিলে দেওয়া চলবে না, জটিল কাটাকুটিতে ভ’রে যায় থোকার মন। অশ্বারোহী তাতারের মতো ধুলো উড়িয়ে তুমুল হেষারবে দিগ্বিদিক প্রকম্পিত ক’রে মেয়েদের বয়ো আসে না। ভিতরে ভিতরে নিঃশব্দে কখন যে হানাদার বয়েস এসে কালার কানায় ছলাৎছল চলকে ওঠে তার কোনো হদিশ পাওয়া যায় না। যেমন বেলী। এমনিতে আলস্যময় ঘুমের মতো চোখের পাতায় পাতায় জড়িয়ে আছে সব, হঠাৎ একদিন এমন দুষ্কর্ম ক’রে বসলো যে সকল ধারণার ভিত পর্যন্ত ন’ড়ে গেল। বোঝা গেল বড় হ’য়ে গিয়েছে বেলী, তার বয়েস হয়েছে।

বয়স না হ’লে সাহস দেবে কে, বাহবা পাবে কার কাছ থেকে? বয়েসের এই উন্মত্ত হাততালির ক্রমবর্ধমান পরিণতির নামই লুলু চৌধুরী; দুনিয়াসুদ্ধ উচ্ছনে গেলেও নিজের উদগ্র বয়সের কাছে নিজেকে তুঙ্গ ক’রে তোলার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হবে না তখন, এ এক ধরনের বন্য হিংস্রতা, লোমশ মনোবৃত্তি, তিন কোটি তেত্রিশ লক্ষ স্তনভারাক্রান্ত দামাল লুলু চৌধুরী হার্ডল রেসের তীব্র প্রতিযোগিতায় বিশ্বময় ক্যাঙ্গারুর পালের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলেছে, আর তাদের পায়ের তলায় প’ড়ে নাকমুখ দিয়ে সমানে গলগল ক’রে রক্ত তুলছে রঞ্জ!

খোকা ক্লান্ত হ’য়ে পড়ে। কি অবসাদ ঝিঁঝি ঝিনঝিনে শরীরে! বিতৃষ্ণা, -এতো বিতৃষ্ণা কেন, আকাশ ঝামরে ঢল নামছে বিতৃষ্ণার। রামপুরার দিকে বাঁক নিলো রিকশা।

রাস্তার মাঝখানে ট্রাফিক আইল্যান্ডের উপরে সদ্য বাঁধানো একটি কবর; কয়েকদিন আগে একজন ছাত্রকে এখানে নির্মমভাবে হত্যা করেছে কাণ্ডজ্ঞানহীন সৈন্যরা। সিলকের কাপড়ে বড় বড় লাল অক্ষরের একটি লেখা কবরের উপরে ফরফর ক’রে উড়ছে-‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ নিদারুণ চিত্ত-চাঞ্চল্যে ভিতরের নিস্তরঙ্গ হ্রদ ঘুলিয়ে উঠলো খোকার। সারা দেশ চামুণ্ডার মতো রক্তলোলুপ জিভ বের ক’রে রেখেছে, রক্ত দাও, রক্ত দাও, আর রক্ত দাও। কবিতার একটি বই বেরিয়েছে কয়েক মাস আগে, তারও নাম, ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’, জোর ক’রে দেওয়া নাম। রেসকোর্সের মিটিং-এর যে ভাষণ, সেখানেও ওই একই কথা, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো–‘

এদেশের বৃষ্টির পানিতে আর ফসল ফলবে না, ফসল ফলাতে হ’লে বৃষ্টির বদলে চাই রক্ত। পুষ্পকুঞ্জ শুকিয়ে যাবে যদি তার গোড়ায় রক্ত না ঢালা হয়। এদেশের কেউ কবিতা পড়বে না যদি তা রক্তে লেখা না হয়। ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’ কিংবা ‘লাল ঢাকা রাজপথ, লাল ঢাকা রাজপথ এই হ’লো গান, কেবলমাত্র এইসবই গাওয়া হবে।

লেবু, ময়না, নুরুদ্দিন, মুরাদ, লুলু চৌধুরী, বেলী সবাইকেই কি রক্ত দিতে হবে? কতোখানি রক্ত? নখ কাটতে গিয়ে যতোখানি, না একটা হাত বাদ হ’য়ে গেলে যতোটা ঝরে? নাকি গলাকাটা রক্ত, ফায়ার ব্রিগেডের নলের পানির মতো হলহলিয়ে বগবগ ক’রে যা বেরিয়ে আসবে!

রিকশার উপরে খোকা দুলতে থাকে।

আমাকেও দিতে হবে?

রঞ্জুকে?

আমাকে রঞ্জুকে, রঞ্জুকে আমাকে?

যদি না দিই?

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024