স্কেটস, বগলে ছেলেটা-১২
কিছু লোকের জন্মই হয় কেবল এক জায়গায় বসে থাকার জন্যে। তাদের মূলমন্ত্র হল: তন্নিষ্টেই মোক্ষ। আবার কিছু লোক আছে যারা অস্থির। ডেস্কের সামনে তারা ছটফট করে, ঘণ্টা পড়া পর্যন্ত তারা বসে থাকতে পারে না ক্লাসে, লাইনে দাঁড়াতে হলে তাদের কষ্টের আর শেষ থাকে না। এই ধরনের লোকই হয় পর্যটক আর নির্মাণকর্মী, গুপ্ত-সন্ধানী বা ডাকপিয়ন। তাদের মন্ত্র চরৈবেতি, গতি, পরিবেশের পালাবদল।
স্কেট্স্ বগলে ছেলেটা পড়ে এই ধরনের লোকের দলে।
কেন তাহলে শহরের হাসপাতালে ভর্তি’র ঘরে সে বসে আছে চুপচাপ, ছটফট করছে না? পা দোলাচ্ছে না, তবলা বাজাচ্ছে না হাসপাতালের শাদা বেঞ্চিটায়? কিন্তু তার মানে মোটেই এ নয় যে সে শান্ত। ছটফট করছে তার চিন্তা। কী হচ্ছে অপারেশনে? বাতিউকভের লাগছে, নাকি অবেদনিক ইনজেকশন দিয়েছে তাকে?… নিশ্চয় তাহলেও লাগছে বৈকি।
মনের মধ্যে তার অপারেশন ঘরের ছবি ভেসে ওঠে। ভাবে যেন নিজেই সে শুয়ে আছে অপারেশন টেবিলে। চেষ্টা করছে যন্ত্রণা সইতে… মনে পড়ে একবার গ্রীষ্মে সে পেরেকে পা দেয়, পায়ে জুতো ছিল না। বেশ গভীরে ঢুকে যায় ক্ষতে আইওডিন লাগানো পেরেকটা। প্রথমটা তেমন লাফাতে থাকে। এরপর ব্যথাটা দাঁড়ায় ভোঁতা আর একটানা।
প্রায় দৈহিকভাবেই যন্ত্রণাটা যেন সে টের পায়। জুতোর ভেতর পা তার নড়ে ওঠে।
তবে বাতিউকভের নিশ্চয় লাগছে আরো বেশি।
হঠাৎ ছেলেটা মনে মনে পৌঁছে যায় এক শহরের কাছে, দৃপ্ত তার নাম (ঈগল)। ওপর থেকে সে তাকিয়ে দেখে স্তেপ। ছাঁচোর গর্তের মতো সব জায়গায় ট্যাঙ্কবিধ্বংসী কামানের ট্রেন্ড: চারপাশে কাঁচা মাটির ঢিপ। স্তেপ বেয়ে আসছে সব ফ্যাসিস্ট ট্যাঙ্ক, দেখতে হলদে হলদে কাছিমের মতো। ধীরে ধীরে কাছিমগুলো এগিয়ে আসছে ছাঁচোর গর্তগুলোর দিকে। ওরেল দেখতে পায় সে ছাঁচোর গর্তগুলোর ওপর আগুনের ঝলক। ট্যাঙ্করিংসী কামান গোলা দাগছে ট্যাঙ্কে। একটা ট্যাঙ্ক থেমে গেল। গাঢ় কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে তা থেকে। ছড়িয়ে পড়ছে ধোঁয়াটা। ঘাসের ওপর দিয়ে গিয়ে তা ঢেকে ফেলছে কাছিম আর ছাচ্যের গর্তগুলো। তলে কী হচ্ছে এখন আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু ধোঁয়ার মধ্যে ঝলসাচ্ছে ট্যাঙ্কবিধ্বংসী কামানের ঝলক, যেন কালো মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ।
ছেলেটার মনে হয় সে যেন মাটি দিয়ে হাঁটছে, ধোঁয়া সরাচ্ছে দুই হাতে। গাঢ় ধোঁয়া, জলের মতো, অসুবিধা হচ্ছে হাঁটতে। কালচে মাটি। পোড়া-পোড়া গন্ধ তাতে, বাতিউকভের দেরাজে পুরনো ফৌজী পাইপটার মতো।
এই তো বাতিউকভের কামান… বাতিউকভ নিজে। রোগা, বর্তমান বাতিউকভের ছোটো ভাইয়ের মতো দেখতে। গায়ে তার বোতাম-খোলা ফৌজী শার্ট… গোলা দাগছে কামান। প্রতি বার গোলা দাগের পর একটু করে যেন গুড়ি মারছে কামানটা, পিছিয়ে আসছে নলটা, যেন লুকতে চাইছে, তারপর কী ভেবে
আবার ফিরে আসছে আগের জায়গায়। আর বাতিউকভ চে’চিয়ে যাচ্ছে: ‘ফায়ার! ফায়ার!’
বাতিউকভ যত জোরে চে’চায়, ততই প্রচণ্ড হয়ে ওঠে গোলাবর্ষণ।
‘ফায়ার!’ চে’চায় বাতিউকভ। ঠোঁট থেকে তার আগুন বেরয়। আগুন গিয়ে লাগে ট্যাঙ্কে। পুড়ে যায় ট্যাঙ্ক।
কিন্তু পরের ট্যাঙ্কটা গোলা মারে। পড়ে যায় বাতিউকভ। উল্টে যায় কামান। ঘাসের ওপর পড়ে আছে বাতিউকভ। মুখ ফ্যাকাশে, মাথায় টুপি নেই। ফেল্ট বুটে রক্ত… না, না, ফেল্ট বুট নয়, চামড়ার হাই বুট… বাতিউকভ অনেক বড়ো আর ভারি, কিন্তু ছেলেটা তাকে একাই বয়ে নিয়ে যায়… নিজের দেহ দিয়ে সে তাকে ফ্যাসিস্ট ‘ফের্ডিনান্ডের’ শেলের টুকরো থেকে আড়াল করে রাখে। জোরে জোরে ঢিপ-ঢিপ করে তার বুক। ভর্তি’র গোটা ঘরটা জুড়ে তা বাজে। শান্তি নেই ভর্তি’র ঘরে।
রুগ্ণ, আত’ লোকেদের আনা হয় এখানে। আপন লোকেদের জন্যে লোকে এখানে দুশ্চিন্তা করে।
অপেক্ষা করে আছে ছেলেটা। বসে আছে একই জায়গায় স্থির হয়ে। কিন্তু ভাবনা ওর অস্থির। স্কেটিং, শহরটা, নিজের বাড়ি সব এখন তার মুছে গেছে মন থেকে। আছে শুধু জখম যোদ্ধা। হুকুম চালাচ্ছে সে ছেলেটার ভাবনার ওপর, সে ভাবনা একমাত্র তারই বশীভূত।
Leave a Reply