শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৪ পূর্বাহ্ন

নীলের বিশ্বায়ন – নীল ও ঔপনিবেশিক বাংলায় গোয়েন্দাগিরি (পর্ব-৪৫)

  • Update Time : সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪, ১০.০০ পিএম

পিয়ের পল দারাক ও ভেলাম ভান সেন্দেল

অনুবাদ : ফওজুল করিম


এভাবে নীল চাষের জমি দু’শ্রেণীতে বিভক্ত। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক একজন নীলকর যদি বছরে ৯০০০ বিঘা (৩ হাজার আরপেন্টস) জমিতে নীল চাষ করতে চায়ন তাহলে তাকে কাজ শুরু করতে হবে ২১ হাজার বিঘা জমি নিয়ে তাহলে সে কাজ শুরু করবে ২১০০০ বিঘা (৭০০০ আরপেন্টস) জমি নিয়ে। প্রথম বছর সে কর্ষণ করবে মাত্র ২ হাজার বিঘা জমি। এর মধ্যে বীজ বপন করা হবে মাত্র ১০ কর্ষণ করবে জমিতে আর ১০০০ আরপেন্ট জমি ফেলে রাখা হবে অনাবাদী। ফেলে রাখা এই জমিতে বীজ বপন করা হবে আগামী বছর। তাহলে প্রথম বছরে বীজ বপন করা হল ১০০০ আরপেন্টস জমিতে। দ্বিতীয় বছরে যে ১০০০ জমি ফেলে রাখা হয়েছিল তাতে বীজ বোনা হবে, আর ফেলে রাখা ১০০০ আরপেন্টস জমি কষর্ণ করা হবে। আর তৃতীয় বছরে তার আগের বছর যে ১০০০ আরপেন্টস জমি ফেলে রাখা হয়েছিল তাতে চাষ করা হবে। তাহলে তৃতীয় বছরে নীলকর চাষ করল ৩০০০ আরপেন্টস জমি। বছরে তাহলে সে ফসল পাবে ৩০০০ আরপেন্টস জমির। নীলচাষ করা হয় বছরে দু’বার, তাহলে তৃতীয় বছরে তার পাওয়া উচিত:

১। প্রথম বছরে যে ১০০০ আরপেন্টস জমিতে নীল বোনা হয়েছিল তার থেকে মোটামুটি ফলন। তৃতীয় বছর থেকে নীলের ফলন কমতে থাকে বলে নীলের ফলন খুব বেশি নয়।

২। দ্বিতীয় বছর যে ১০০০ আরপেন্টস বোনা হয়েছিল তা থেকে দু’টি ভাল ফসল। এর কারণ হল দ্বিতীয় বছরে নীলের ফল থাকে বেশি।

৩। তৃতীয় বছরে যে ১০০০ আরপেন্টস বোনা হয়েছিল তার প্রথম ফসলের ফলন পাওয়া যাবে মোটামুটি। আর দ্বিতীয় ফসলের ফলন হবে প্রচুর।

নীলের ফলপ্রসূ জীবন মাত্র তিন বছর, তাই প্রথম বছরের জন্য ১০০০ আরপেন্টস যথেষ্ঠ বলা যেতে পারে। তাই তৃতীয় বছর আরও ১০০০ নীল গাছ লাগাবার জন্য ভূমি কর্ষণ করে রাখা হয়। প্রথম বছরের ১০০০ আরপেন্টস-এর জমি পতিত রাখতে হয় চতুর্থ বছরের জন্য।

নীল গাছের ফলনশীল জীবন মাত্র তিন বছর। তাই প্রথম বছরের ১০০০ আরপেন্টস থেকে ফসলের পরিমাণ হবে কম। অতএব, তৃতীয় বছর ১০০০ আরপেন্টস জমি কর্ষণ করে পরের বছর বীজ বপনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। প্রথম বছরের ১০০০ আরপেন্টস-এর স্থান নেবে এই জমি, কারণ এই জমি আবার ফেলে রাখতে হবে চার বছরের জন্য।

তাই, পরপর তিন বছর যাবত যে জমি ফলদায়ক ছিল তাকে ভবিষ্যতে কাজে লাগাবার জন্য প্রতি বছর নীলকরকে ১০০০ আরপেন্টস জমি কর্ষণ করে বীজ বপন করতে হবে। পঞ্চম বছরে গিয়ে তার মোট ৭০০০ আরপেন্টস জমির মধ্যে ফসল পাবে ১০০০ আরপেন্টস থেকে। এভাবে সে প্রথম বছরে যে ১০০০ আরপেন্টস জমিতে আবাদ করেছিল সেখানে ফিরে যেতে পারবে। এ চার বছর এই জমিকে বিশ্রাম দেওয়া হল। এখন আমরা ভাল ফসল আশা করতে পারি। এভাবে নীলের আবাদ করা হলে নীল গাছ ছয় থেকে আট ফিট উচ্চতার হতে পারে। বঙ্গদেশে নীল গাছের এই উচ্চতা মোটেও সম্ভব নয়। বঙ্গদেশে মাটির উৎপাদনী শক্তি বছরে যা নষ্ট হচ্ছে প্রতি বছরে বন্যায় জমিতে পলি পরে তা আবার ফিরে আসছে। এভাবে পালাক্রমে চাষ করা হলে দেখা যাবে হিন্দুস্তানের জমি বঙ্গদেশের জমির মতই ফলপ্রসূ।

এই দুই অঞ্চলের নীলের চাষাবাদের এই পার্থক্য বিস্ময়ের উদ্রেক করে। কিন্তু আমরা যদি হিন্দুস্তানের জমিতে লবণ উপাদানের কথা চিন্তা করি এবং বঙ্গদেশের জমির বার্ষিক বন্যার ফলে জমিতে পলি পরার কথা বিবেচনা করি তাহলে আর বিস্ময়ের উদ্রেক হয় না। দ্বিতীয়তঃ যে পনেরো মাস জমি অনাবাদী থাকে তখন বারবার জমি কর্ষণ করা হয় (সাধারণত আট থেকে দশ বার), হিন্দুস্তানী জমির এই সুবিধা দশের জামি কৃষিকাজ বঙ্গদেশের মত বিকশিত না হলেও তা বাংলাদেশের চেয়ে বঙ্গদেশের পায় না। উন্নততর। এর কারণ, বীজ বপনের আগে অধিক বার লাঙ্গল দেওয়া হতে পারে। উন্নতর লাঙ্গল দিয়ে গভীরভাবে মাটি কর্ষণও হতে পারে, অথবা বীজবপনের আগে জামি ভেঙে দেওয়ায় হতে পারে অথবা বীজ ছিটানোর নৈপুণ্যের জন্যেও হতে পারে। বঙ্গদেশের চেয়ে হিন্দুস্তানের লাঙ্গল ভারি, এতে হলরেখা হয় গভীর। ইউরোপীয় লাঙ্গলের মত।

উত্তর ভারতে ক্ষেতে জলসেচন খুব ব্যয়বহুল ব্যাপার। বিশেষভাবে নীলচাষের মত বিস্তৃত চাষাবাদের ক্ষেত্রে। সেখানে এক বিঘা জমি চাষের খরচ দেড় টাকা। বীজ বপনের মওশুম এসে গেলেও যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে নীলকরদের মধ্যে নীলের জমিতে জলসেচের বিবেচনা করেন।

কেউ কেউ অবশ্য আপত:দৃষ্টিতে মনে হয়, বঙ্গদেশে নীলচাষের চাইতে হিন্দুস্তানে নীল চাষ ব্যয়বহুল। প্রথমতঃ হিন্দুস্তানে নীলের আবাদ করতে গেলে জমি লাগে অনেক বেশি। দ্বিতীয়তঃ হিন্দুস্তানে জমির দাম তিন চার গুণ বেশি। আবার বঙ্গদেশে জমি নিড়ানোর খরচ আছে। অথচ জমি ফেলে রাখতে হয় বলে নিড়ানোর ব্যয় নেই।

হিন্দুস্তান ও বঙ্গদেশের মধ্যে জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। স্থানীয় পরিবেশের ভিন্নতার জন্যে এই পার্থক্য। যেমন, হিন্দুস্তানে জলাধার থাকে দুটি থেকে তিনটি আর বঙ্গদেশে বারোটি থেকে তিরিশটি। হিন্দুস্তানে বঙ্গদেশের মত নৌকা দিয়ে নীল বহন করতে হয় না। হিন্দুস্তানে নীল বহন করা হয় বলদের গাড়িতে এবং এগুলো চলেও দ্রুত গতিতে ও কম সময়ে। এ সব দিক বিবেচনা করে এটা বলা যায় যে বঙ্গদেশের চাইতে হিন্দুস্তানে নীলচাষ সুবিধাজনক। এতে ঝুঁকি কম ব্যয় সমান ও উৎপাদিত মালের গুণাগুণ প্রায় একই রকম।

কিন্তু নীল প্রক্রিয়াজাত করার ব্যাপারে একথা খাটেনা। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া হিন্দুস্তানে নীল প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা একেবারে সেকেলে। এই কারণে কসমোড়র উৎকৃষ্ট নীলের তুলনায় হিন্দুস্তানের নীলের দাম হয় অর্দ্ধেক অথবা এক চতুর্থাংশ। এমনও হয় যে হিন্দুস্তানের নীল পড়ে থাকে অবিক্রীত। এর ফলে গত কয়েক বছর ধরে হিন্দুস্তানের নীলকররা বঙ্গদেশের নীল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির অনুসরণ করে বাংলাদেশের মত ফল পাচ্ছে। তাদের নীল বঙ্গদেশের নীলের মতই দাম পাচ্ছে। এর ফলে এটা বোঝা যায় মাটির প্রকৃতি বা নীলের বিভিন্নতার জন্যই যে এ রকমটা হচ্ছে তা নয় আসলে প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রেই পার্থক্যটা এসে যায়। এমন আছি হিন্দুস্তানে কি করে নীল প্রক্রিয়াজাত করা হয় তা না বলে শুধুমাত্র বঙ্গদেশে কিভাবে নীল প্রক্রিয়াজাত করা হয় সে সম্পর্কে বলছি।

বাংলাদেশে নীলের প্রক্রিয়াজাতকরণ

কারখানায় নীল পৌঁছলেই সেগুলো রাখা হয় ঢালু জলাধারের কাছে। জলাধারগুলো তৈরি একটি নির্দিষ্ট মাপে। তবে, এগুলো হয় বিভিন্ন আকারের। এগুলো হয় খোলা আকাশের নিচে এবং ঢাকনা ছাড়া। গাঁটবাঁধা অবস্থায় ঢালু জলাধারের দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে নীল গাছের বোঝাগুলো রাখা হয় একটার পর একটা প্রথমটার পর দ্বিতীয়টা। গোটা জলাধারে যাতে নীলের পাতা ছড়িয়ে থাকে সেজন্যে এভাবে রাখা হয়। ছড়িয়ে থাকলে পাতাগুলো ভেজাতে ও গ্যাঁজাতে সুবিধা।

নীল আনা হলো

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024