বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:২৮ অপরাহ্ন

প্রকৃতিবিদের কাহিনী (কাহিনী-০৭)

  • Update Time : রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

পিওতর মান্তেইফেল

সাহসী আর ভীরু

পশুদের সম্পর্কে চলতি প্রবচন ও কাহিনী থেকে আমাদের অনেকের ধারণা যে বাঘ-সিংহ খুব সাহসী, গাধারা বোকা, শুয়োর বড়ো নোংরা, খরগোসেরা ভীরু। কিন্তু প্রচলিত এই মতগুলো সর্বদাই সঠিক, মোটেই এমন নয়।

মস্কো চিড়িয়াখানার নতুন এলাকাটায় খুব ছোট্ট একটা ছাগল-ছানা কেমন করে যেন গিয়ে পড়ে উসুরি বাঘেদের খোঁয়াড়ে। প্রকাণ্ড এই জানোয়ারগুলো আগে কখনো ছাগল-ছানা দেখে নি। নির্ভয়ে ছানাটা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে তারা আত্মরক্ষার ভঙ্গি নেয়। ছাগল-ছানাটা কিন্তু মায়ের খোঁজে নিশ্চিন্তে এগিয়ে যায় তাদের দিকে। ওরা কিন্তু গর্জে, দাঁত বার করে সরে সরে যায় ছানাটার কাছ থেকে। দেয়ালের সঙ্গে সে’টে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে, চোখ কচকে, আতঙ্কে গর্জন করে এই ডোরাকাটা শ্বাপদগুলো থাবা দিয়ে ছানাটাকে তাড়াতে শুরু করে। তাদের একটা দৈবাৎ আঘাতে মারা যায় ছানাটা।

কিন্তু এর পরেও বাঘগুলো অনেকখন ভয়ে ভয়ে ঘোরাফেরা করে, শোঁকে, ছোট্ট নিষ্প্রাণ দেহটার কাছে যেতে সাহস পায় না। উচ্চপ্রশংসিত বাঘের সাহস এই রকমও হয়! অথচ রোজ সকালে চিড়িয়াখানায় ঘোড়ায় টানা গাড়িতে যখন জন্তুদের খাবার দেওয়া হয়, তখন কান নামিয়ে বাঘেরা গুড়ি মেরে এগোয় ঘোড়ার দিকে, কাঁপ দেবার উপক্রম কারে থমকে যায় একেবারে পরিখার কাছে, ওটা লাফিয়ে যাওয়ার সাধ্যি তাদের নেই।

চিড়িয়াখানায় এসে অনেকে দেখে অবাক হয়েছে যে এখানকার অ্যাকোয়ারিয়মে ক্ষিপ্র পাইক মাছের পাশেই নির্ভয়ে সাঁতরাচ্ছে সোনালী রঙের ছোটো ছোটো মাছ। কিন্তু আসলে ওটা ছোটো মাছটার সাহসের ব্যাপার নয়। খোলা জলে দাঁতালো পাইক খায় সাধারণত রূপোলী আঁশের মাছ, সোনালী মাছে সে অনভ্যন্ত, তাই বহুদিন তাকে ছোঁয় না। পুকুরের জলের কার্পের ওপরেও নদীর জলের পাইক আক্রমণ করে অতি কদাচিৎ, নদীর ছুটন্ত জলে এ রকম মাছ সে দেখে নি। এবং প্রবচনে যাই বলুক, এ কার্প নিশ্চিন্তে নিদ্রা দিতে পারে পাইকের পাশেই।

মস্কো চিড়িয়াখানার বিরাট আট মিটার লম্বা জালি-আঁকা পাইথন সাপটাকে সাধারণত খেতে দেওয়া হয় শাদা শুয়োরের বাচ্চা; বন্দী অবস্থায় এই রঙটায় সে অভ্যন্ত হয়ে গেছে বহুদিন। এ রকম ছানা পেলে সে তার দেহের প্রচণ্ড পাকে সঙ্গে সঙ্গেই তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলে, তারপর নাকটা থেকে শুরু করে গোটাগুটি তাকে গিলে খায়। কিন্তু প্রকাণ্ড এই সাপটার খোপে যদি দেওয়া যায় ছোপ-ছোপ রঙের শুয়োর-ছানা, তাহলে তাকে সে ছোঁয় না শুধু নয়, নিজেই কুণ্ডলী পাকিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষার ভঙ্গি নেয়।

একবার ল্যাপ্ল্যান্ডের এক সংরক্ষিত ঘন বনে হঠাৎ ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে একটা বাদামী ভালুক আক্রমণ করে শিকারবিদ গ. গ. শুবিনকে। সদ্য একটা এক হরিণ মেরেছিল ভালুকটা, সেটা রক্ষার জন্যে সে শুবিনকে স্কি থেকে চিৎপাত করে ফেলে দাঁত দিয়ে জোরে তার পা কামড়ে ধরে। শুয়ে শুয়েই শুবিন ট্রিগার ঠিক করে নিয়ে গুলি চালায়, কিন্তু মিসফায়ার করে সেটা। তাহলেও ভালুকটা তক্ষুনি লাফিয়ে সরে যায়। ট্রিগার চালাবার অনভ্যস্ত ধাতব খট্ শব্দটায় ভয় পেয়ে যায় সে। বাঁ নলের গুলিতে গুরুতর জখম হয়ে সে উধাও হয়ে যায় তাড়াতাড়ি।

আফ্রিকায় সিনেমা-অভিযানে যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁরা সিংহের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাতের গল্প বলেছেন। সিংহ যে মাঠে আছে, বাতাস যদি সেখান থেকে বইত এগিয়ে আসা অভিযাত্রী মোটরের দিকে, তাহলে সিংহ মানুষকে আসতে দিত তার অনেক কাছাকাছি। কিন্তু বাতাসের দিক বদলালেই সিংহ মানুষের গন্ধ পেয়ে চম্পট দিত। এ থেকে এই ব্যাপারটা সমর্থিত হয় যে আরো অনেক জন্তুর মতো সিংহও চোখে দেখার চেয়ে গন্ধ শুকে আন্দাজ করে বেশি।

এবার যাকে নিয়ে প্রবচন গড়ে উঠেছে সেই গাধা। সত্যিই কি সে অত হাঁদা? যে ঘটনাটা এখন বলব তাতে ও ব্যাপারে সন্দেহ জাগবে।

মশা, ডাঁশ প্রভৃতি রক্তচোযারা জজ্বালালে অধিকাংশ গৃহপালিত পশুর মতো গাধাও লেজ নাড়ে, গা ঝাড়া দেয়। একবার মধ্য এশিয়ায় দেখি, কুকুরের একটা রক্তচোষা-মাছি নিয়ে একটা ফক্কড় ছেলে সেটাকে বসিয়ে দিলে গাধার গায়ে। লোমের ওপর এই এ’টুলির মতো কাঁটটার অস্তিত্ব টের পেয়ে গাধাটা গড়াগড়ি দিতে লাগল মাটিতে, জালিয়ে-মারা শক্ত চ্যাপ্টা মাছিটাকে সে যেন তাতে করে পিষে ফেলতে চাইছিল। ছেলেটা কিন্তু ক্ষান্ত হল না, আরেকটা অমনি মাছি খুজে নিয়ে সেটাকে ফের গাধার পিঠে বসাবার জন্যে চুপিচুপি এগুতে লাগল সে। কটাক্ষে মাছিটার দিকে তাকিয়ে গাধাটা দ্রুত ছুটে আসে এবং পেছনের পায়ের খুর দিয়ে চাঁট মেরে পাজিটাকে নালার গর্তে ফেলে দেয়। নির্বুদ্ধিতা থেকে এমন মহড়া নেওয়া যায় না!

প্রবচনে বলে ‘খরগোসের মতো ভীরু’। অথচ খরগোস কিন্তু বরং সাহসাঁই। অনেকেই বোঝেন না যে অস্তিত্বের সংগ্রামে দ্রুতগতি খরগোসকে বাঁচায় তার পা। অত জোরে ছুটতে না পারলে নানান হিংস্র পশু তাকে শেষ করে দিত অনেক আগেই। খরগোসের দ্রুত গতি হল তার আত্মরক্ষার প্রধান উপায়। যাকে বলা হয় পড়ি- মরি দৌড়, সেভাবে খরগোস কখনো ছোটে না। রেকর্ড গতিবেগ সে দেখায় কেবল চূড়ান্ত ক্ষেত্রে, সাধারণত নিজের শক্তি বাঁচিয়ে চলে। যেসব শিকারী কুকুর খুব জোরে দৌড়তে পারে না, তাদের কাছ থেকে খরগোস পালায় তাড়াহুড়ো না করে, পাশ ফিরে ফিরে লক্ষ্য করে কুকুরকে। কিন্তু রুশী উল্ফ-হাউন্ডে তাড়া করলে অন্য ব্যাপার। এদের দৌড়ের ক্ষিপ্রতা খরগোসের সমান বা বেশি। সেক্ষেত্রে খরগোস চূড়ান্ত গতি বাড়ায়, কুকুরের হাত এড়াবার পরেও ছুটে যায় আরো দু’-তিন কিলোমিটার। এটা ভীরুতা নয়, শত্রুর হাত থেকে বাঁচার অন্য কোনো উপায় নেই তার।

আস্কানিয়া-নোভা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে একবার দেখেছিলাম, অল্পবয়সী একটা ঘোড়া মাথা নিচু করে শুকতে শুকতে যাচ্ছিল স্তেপ দিয়ে। হঠাৎ তার নাকের কাছেই রেগে লাফিয়ে উঠল একটা খরগোস, সামনের পায়ের নখ দিয়ে তাকে আঁচড়ে দিলে। লাফিয়ে সরে গেল ঘোড়াটা, খরগোস তার আগের জায়গাতেই রয়ে গেল। আরেকবার দেখেছিলাম, কুকুরদের তাড়া থেকে পালিয়ে তিনটে খরগোস নির্ভয়ে ভেড়ার পালের মধ্যে ঢুকে গিয়ে আত্মরক্ষা করল।

তবে কুকুরের কাছ থেকে খরগোস সব সময়ই পালায়, এমন নয়। শীতের চাঁদিনী রাতে মাঝে মাঝে দেখা যায় সঞ্জী-বাগানে নিশ্চিন্তে বাঁধাকপির গোড়া চিবুচ্ছে খরগোস, শেকলে বাঁধা কুকুরের ডাকে তার কিছু এসে যাচ্ছে না, অথচ দিনের বেলায় এই কুকুরটাই একরোখার মতো তাড়া করেছিল তাকে। আহত খরগোসকে অসাবধানে কান ধরে তুলতে গিয়ে তার থাবার জোর টের পেতে হয়েছে একাধিক শিকারীকে; পেছনের পায়ের ধারালো নখে শিকারীর গায়ে গুরুতর ক্ষত করেছে কম নয়। খরগোস যখন নিজের প্রাণ বাঁচাতে যায়, তখন তার সঙ্গে লড়াইয়ে শিকারী পাখি মারা পড়েছে অনেক। ঈগল পাখির আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে খরগোসকে মাটিতে শুয়ে পড়ে পেছনের জোরালো থাবার নখ দিয়ে বিশাল হিংস্র পাখির নাড়ি-ভংড়ি বার করে দিতে দেখেছে কিছু কিছু শিকারী।

নিশ্চয় কিছু কিছু পর্যবেক্ষকের চোখে পড়েছে কিভাবে কোনো কোনো কুকুর সন্তর্পণে এড়িয়ে চলে মুরগীকে। তার অর্থ, ছেলেবেলায় কোনো সময় ছানা-পোনা রক্ষায় ক্ষিপ্ত মুরগীর ঠোকর খেতে হয়েছিল সে কুকুরকে। যত আশ্চর্যই লাগুক, এমনকি মুরগীও একটা শক্তিশালী বড়ো জানোয়ারের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারে চিরকালের জন্যে।

আমাদের দক্ষিণ-স্তেপবাসী কামেনকা নামের ছোটো ছোটো ফুর্তিবাজ নাচুনী পাখিগুলোর ব্যাপারটাও কম মজার নয়। কামেনকারা বাসা পাতে সূলিক মুষিকদের পুরনো পরিত্যক্ত বিবরে। বড়ো হয়ে ওঠা সুস্লিকরা নিজেদের মা-বাপের বাসা ছেড়ে এসে প্রায়ই এইসব পুরনো বিবর দখল করতে চায়। সংঘাত বাধে তখন। সুস্লিক কিন্তু তার বাসার কাছে ঘে’ষলে ছোট্ট এই পাখিটা নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর ওপর, এমনকি তার পিঠে উঠে, কান কামড়ে ধরে, পিঠে চেপে ঘোরে স্তেপ এলাকা। এই রকম বার কয়েকটা সংঘাতের পর গর্তের কাছে কামেনকা দেখলে তরুণ সুস্লিক আর সেদিকে যায় না।

আফ্রিকার উটপাখিদের কথাও একটু বলা যাক। এদের সম্বন্ধে গল্প আছে যে ভয়ে তারা বালিতে মুখ গুজে থাকে। শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় বিশাল এই পাখিটা হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। উটপাখির পায়ের লাথি ঘোড়ার খুরের চাঁটের চেয়েও জোরালো। কিন্তু একটা লাঠির ডগায় টুপিটা উচু করে তুললেই সে পিছিয়ে যাবে। উটপাখি কেবল তাদেরই আক্রমণ করে যারা লম্বায় তার চেয়ে খাটো।

কিছু কিছু জন্তুর ভিত্তিহীন খ্যাতি-অখ্যাতির এ কাহিনী শেষ হবে না যদি ‘নোংরা’ শুয়োরের কথা না বলি। একান্ত সঙ্গত কারণেই আামরা বলতে পারি যে শুয়োর অতি পরিচ্ছন্নতাপ্রিয় জীব। যেসব রাষ্ট্রীয় ও যৌথ খামারে শুয়োরের জন্যে ভালো যত্নের ব্যবস্থা আছে, সেখানে তারা নিজেদের থাকার জায়গাটি বেশ গুছিয়ে রাখে, অবশ্য-অবশ্যই মলমূত্র ত্যাগের জায়গাটা করে দূরের একটা আড়ালে। গরম লাগলে শুয়োর চান করে নিতে চায়, আর পথে স্নানঘরের বদলে জল-কাদা থাকলে তাদের আর দোষ কাঁ?

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024