মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
লুলু চৌধুরী বললে, ‘আপনি কিন্তু পলিটিক্যালি চিন্তা করছেন।’
খোকা বললে, ‘যাকগে যাক, খামোকা এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনো লাভ নেই। আসল কথা আমার মতো অপদার্থকে দিয়ে আপনাদের কোনো লাভই হবে না।’
‘দু’একদিনের ভিতরই বাজারে শেয়ার ছাড়া হচ্ছে–‘
খোকার মনে পড়লো মুরাদের কবিতা সঙ্কলনের কথা। সে হেসে বললে, ‘ভালো সময়ই বেছে নিয়েছেন আপনারা–‘
লুলু চৌধুরী বললে, ‘কোনো তাড়াহুড়ো নেই, আপনি ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন সবকিছু, কিছু শেয়ার কেনার জন্যেও তৈরি থাকুন।’
কোনো উত্তর দিলো না খোকা, এটা এমনই একটি বিষয় যা নিয়ে কথা বাড়ানোর আগ্রহ তার বিন্দুমাত্র ছিলো না! এছাড়াও লুলু চৌধুরীর প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সে অপ্রিয় দ্বিধাদ্বন্দ্বের ফেরে পড়েছিলো। লুলু চৌধুরীর এই হামলে পড়া উৎসাহের গায়ে যে রঙের আবরণই থাকুক না কেন, খোকা সেটাকে সহজভাবে নিতে পারে না। সন্দিগ্ধচিত্তে কেবল সে নিজের বিচার বিবেচনাকে তলব করতে থাকে!
‘লিখছেন নাকি কিছু?’ হঠাৎ জিগ্যেশ করলে লুলু চৌধুরী। খোকার মনে হালো লুলু চৌধুরীর গলার স্বর জর্জেটের আঁচলের চেয়েও স্নিগ্ধ মধুর, কিন্তু পিছলে পড়া।
‘কে বললে আপনাকে আমি লিখি?’
‘এক সময় আপনি লিখতেন, মুরাদের মুখে শুনেছি, দেখলেও বোঝা যায়। আপনার চেহারা কবির–‘
খোকা বললে, ‘মুশকিলে ফেললেন। আমার তো ধারণা ছিলো খুন করার পরই মানুষের চেহারা খুনীর হয়, তার আগে নয়। কবিদের মধ্যে আপনি কাকে কাকে দেখেছেন?’
‘খুব প্যাঁচালো মানুষ আপনি–‘
‘আপনার ধারণা ভুল। এক সময় মাথায় গুবরে পোকা ঢুকেছিলো ঠিকই, ঐ পর্যন্তই; সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না, আপনার কোম্পানির
ঐ কাজের মতোই–‘
‘বৈরাগী হ’য়ে যাবেন নাকি শেষ পর্যন্ত?’
‘চাইলেও হ’তে দেবেন আপনারা।’
‘তার মানে, আপনি আমার বন্ধু হচ্ছেন?’
‘সে তো এখনোও।’
‘মনে হচ্ছে না আমার–‘
খোকা হেসে বললে, ‘আপনার একদম ধৈর্য নেই!’
লুলু চৌধুরী বললে, ‘আপনি বোধহয় মেয়েদের খুব ঘেন্না করেন?’
‘মেয়েদের ঘেন্না করা যায়?’
‘কেন যাবে না, এটা মনের ব্যাপার, ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার; এ রোগে তো অনেকেই ভোগে–‘
”আমার এ রোগের বালাই নেই। গোটা নারীজাতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা অপরিসীম–‘
‘মানে আপনার কাছে তারা ঠাট্টার বস্তু!’
‘সেটা নির্ভর করে সম্পর্কের ওপর। ধ’রে নিতে পারেন এ ব্যাপারে আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই, যাকে বলে কোরা, অশিক্ষিত–
‘আশ্চর্য কথা! অথচ আপনার চেহারা একজন প্রেমিকের–‘
খোকা বুঝলো কয়েকটি অলীক শাখা-প্রশাখায় ভিজে বাতাসের ঝাপটা লাগছে, শিউরে উঠছে বর্শাফলকের মতো তীক্ষ্ণ কিছু পাতা। ফলে কোমল মূর্ছা তার যাবতীয় ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে কিছুক্ষণের জন্যে বিবশ ক’রে দেয়।
সে হেসে বললে, ‘গালমন্দের একটা নিজস্ব ভাষা আছে আপনার।’
Leave a Reply