শ্রী নিখিলনাথ রায়
মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলায় রাজসাহী নামে এক একটি পরগণা দৃষ্ট হয়, এবং তাহাও উদয়নারায়ণের জমীদারির অন্তর্ভূত ছিল। ফলতঃ তাঁহার জমীদারি যে পদ্মার উভয় পারে বিস্তৃত ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। বিশেষতঃ মুর্শিদাবাদে তাঁহার জন্ম হওয়ায়, এতদঞ্চলের রাজস্ব তাঁহার দ্বারায় সংগৃহীত হইত। জমীদারগণের প্রতি অত্যন্ত অবিশ্বাস থাকায়, নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ কতিপর আমীন নিযুক্ত করিয়া, তাঁহাদের দ্বারা রাজস্ব আদায় করিতেন। কেবল দুই একজন কার্য্যদক্ষ জমীদারের প্রতি অনুগ্রহ করিয়া নবাব রাজস্ব সংগ্রহের ভার তাঁহাদের উপর অর্পণ করিয়াছিলেন। রাজা উদয়নারায়ণ তাঁহাদের অন্যতম। বহুদূর বিস্তৃত জমীদারি অবাধে শাসন করায় এবং শাসনকার্য্যে অত্যন্ত সুনাম থাকার, নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ তাঁহার প্রতি প্রথমে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন।
নবাব মুর্শিদকুলী যাঁহার উপর সন্তুষ্ট হইতেন, তিনি যে কিরূপ উপযুক্ত লোক, তাহা বলা বাহুল্য মাত্র; কারণ তাঁহার ন্যায় চতুর, হপ্ন- বুদ্ধি ও কার্যাকুশল ব্যক্তি বাঙ্গলার নবাবদিগের মধ্যে বিরল বলিয়া ঐতি- হাসিকেরা উল্লেখ করিয়া থাকেন। উদয়নারায়ণের সৌভাগ্য, যে তিনি মুর্শিদকুলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারিয়াছিলেন। উদয়নারায়ণ নবাব- কর্তৃক ভার প্রাপ্ত হইয়া প্রাণপণে আপনার কার্য্য করিতে লাগিলেন; দিন দিন তাঁহার কার্য্যদক্ষতা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, বাঙ্গলার সমস্ত জমীদারগণের মধ্যে তাঁহারই নাম বিখ্যাত হইয়া উঠিল। নবাব আরও সন্তুষ্ট হইলেন। এই সময়ে উদয়নারায়ণের জমীদারির মধ্যে কিঞ্চিৎ গোলযোগ উপস্থিত হয়। নবাব তাহা অবগত হইয়া, উদয়নারায়ণের সাহায্যার্থে জমাদার গোলাম মহম্মদ ও কালিয়া জমাদার নামে দুই জন • কাৰ্য্যদক্ষ সেনানীকে নিযুক্ত করিলেন, তাহাদের অধীন দুই শত সুশিক্ষিক অশ্বারোহী সৈঙ্গ ছিল।
উক্ত দুই জনের প্রতি এইরূপ আদেশ দেওয়া হয় যে, তাহারা রাজার অধীন থাকিয়া সম্পূর্ণভাবে তাঁহার আদেশ প্রতিপালন করিবে; যখনই যাহা আবশ্যক হইবে, উদয়নারায়ণের আদেশ প্রাপ্তি মাত্র তন্দ্দণ্ডেই তাহা সম্পাদন করিবে। সৈন্তগণ রাজসাহী প্রদেশের চতুর্দিকে গোলযোগ নিবৃত্তি করিতে লাগিল; যে যে স্থলে গোলযোগের সম্ভাবনা ছিল, অল্পকাল মধ্যে সেই সেই স্থলে শান্তি স্থাপিত হইল। রাজা উদয়নারায়ণের শাসনে এবং গোলাম মহম্মদের কার্যনিপুণতায় রাজসাহী বাঙ্গলার সকল জমীদারির আদর্শ হইয়া উঠিল। অন্যান্য জমীদারগণ উদয়নারায়ণের পথানুসরণের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ইহাতে নবাবও তাঁহাদিগের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যলক্ষ্মী চিরদিন কাহারও প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন না। এই গোলাম মহম্মদ হইতেই উদয়নারায়ণের ভাগ্যলক্ষ্মীর অন্তর্ধানের সূচনা হইল। গোলাম মহম্মদের কার্য্যদক্ষতায় উদয়নারায়ণ এতদূর সন্তুষ্ট হইলেন যে, তিনি তাহাকে অত্যন্ত প্রিয় জ্ঞান করিতে লাগিলেন। এইরূপ অযথা বিশ্বাস হওয়াতেই তাঁহার অধঃপতনের সূত্রপাত হয়।
গোলাম মহম্মদের জন্য উদয়নারায়ণ ক্রমে ক্রমে দুর্ভাগ্যের ঘোর আবর্তনে নিপতিত হইলেন। গোলাম মহম্মদ এতদূর কার্যকুশল ছিলেন, যে রাজা তাহাকে বিশ্বাস না করিয়া থাকিতে পারিতেন না। তাহার অধ্যবসায় ও উৎসাহে রাজসাহী প্রদেশে উদয়নারায়ণের জমীদারি বদ্ধমূল হইতেছিল, সুতরাং গোলাম মহম্মদ যে তাঁহার প্রিয়পাত্র হইবে, ইহা আশ্চর্য্যের বিষয় নহে। উদয়নারায়ণ ও গোলাম মহম্মদের ক্ষমতার দিন দিন বৃদ্ধি হওয়ায়, নবাব মুর্শিদকুলী অত্যন্ত চিন্তান্বিত হইলেন। তিনি মনে ভাবিলেন, উদয়নারায়ণ যেরূপ উপযুক্ত রাজা, তাহাতে গোলাম মহম্মদের ন্যায় কার্য্যকুশল যোদ্ধা তাঁহার সহায় হওয়ায় • পরিণামে ঘোর বিপ্লবের সম্ভাবনা। সুতরাং নবাব তাদের প্রতি…………।
Leave a Reply