শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৪৬ অপরাহ্ন

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ২৪ তম কিস্তি )

  • Update Time : সোমবার, ১ এপ্রিল, ২০২৪, ১২.০০ পিএম
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

জলের সমুদ্র নয়, আরও উন্মাদ হৃদয়-সমুদ্রের কলরবে মাঝারাত্রি পার না হলে হেরম্বের ঘুম আসে না। তবু আজ প্রত্যুষেই তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের প্রয়োজন আছে কিন্তু ঘুম আসবে না, শুয়ে শুয়ে সে কষ্ট ভোগ করার চেয়ে উঠে বসে চুরুট ধরানোই হেরম্ব ভাল মনে করল। কাল গিয়েছে কৃষ্ণা চতুর্দশীর রাত্রি। আনন্দের পূর্ণিমা নৃত্যের পরবর্তী অমাবস্যা সম্ভবত আজ দিনের বেলাই কোন একসময়ে শুরু হয়ে যাবে।

হেরম্ব উঠে গিয়ে জানালায় দাঁড়ায়। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বাগানের অপর প্রান্তে আনন্দ ফুল তুলছে। দেখে হেরম্বের খুশী হয়ে ওঠার কথা, কিন্তু আগামী সমস্ত দিনটির কল্পনায় সে বিষণ্ণ হয়েই থাকে। দিনের বেলাটা এখানে হেরম্বের ভাল লাগে না। উৎসবের পর সামিয়ানা নামানোর মতো নিরুৎসব কর্ম-পদ্ধতিতে সারাদিন এখানকার সকলে ব্যাপৃত হয়ে থাকে, হেরম্বের সুদীর্ঘ সময় বিরক্তিতে পূর্ণ হয়ে যায়। সকালে মন্দিরে হয় ভক্ত- সমাগম। লাল চেলী পরে কপালে রক্তচন্দনের তিলক এঁকে মালতী তাদের বিতরণ করে পুণ্য, অভয় চরণামৃত এবং মাদুলি। চন্দন ঘষে, নৈবেদ্য সাজিয়ে প্রদীপ জ্বেলে ও ধূপধুনো দিয়ে আনন্দ মাকে সাহায্য করে, হেরম্বকে খেতে দেয়, অনাথের জন্য এক-পাকের রান্না চড়ায় আর নিজের অসংখ্য বিস্ময়কর ছেলেমানুষী নিয়ে মেতে থাকে। ফুলগাছে জল দেয়, আঁকশি দিয়ে গাছের উঁচু ডালের ফল পাড়ে, কোঁচড়ভরা ফুল নিয়ে মালা গেঁথে গেঁথে অনাথের কাছে বসে গল্প শোনে।

হেরম্বের পাকা মন, যা আনন্দের সংস্রবে এসে উদ্বেল আনন্দে কাঁচা হয়ে যেতে শিখেছে, খারাপ হয়ে যায়। সে কোনদিন ঘরে বসে ঝিমায়, কোনদিন বেরিয়ে পড়ে পথে।

জগন্নাথের বিস্তীর্ণ মন্দির-চত্বরে, সাগর সৈকতের বিপুল উন্মুক্ততায়, আপনার হৃদয়ের খেলা নিয়ে সে মেতে থাকে। মিলন আর বিরহ, বিরহ আর মিলন। দেয়ালের আবেষ্টনীতে ধূপগন্ধি অন্ধকারে বন্দী জগন্নাথ, আকাশের সমুদ্রের দিকহীন ব্যাপ্তির দেবতা। পথে কয়েকটি বিশিষ্ট অবসরে সুপ্রিয়াকেও তার স্মরণ করতে হয়। কাব্যোপজীবীর দৈহিক ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবারণের মতো এক অনিবার্য বিচিত্র কারণে সুপ্রিয়ার চিন্তাও মাঝে মাঝে তার কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। এই বাড়ি আর বাগানের আবেষ্টনীর মধ্যে সে যতক্ষণ থাকে, পর্যায়ক্রমে তীব্র আনন্দ ও গাঢ় বিষাদে সে এমনি আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, যে তার চেতনা আনন্দকে অতিক্রম করে সুপ্রিয়াকে খুঁজে পায় না। পথে বার হয়ে অন্যমনে হাঁটতে হাঁটতে সে যখন শহরের শেষ সীমা সাদা বাড়িটির কাছে

পৌঁছয়, তখন থেকে:শুরু করে তার মন ধীরে ধীরে পার্থিব বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে। সে স্পষ্ট অনুভব করে, একটা রঙিন, স্তিমিত আলোর জগৎ থেকে সে পৃথিবীর দিবালোকে নেমে আসছে। ধূলিসমাচ্ছন্ন পথ, ছ’দিকের দোকানপাট, পথের-জনতা তার কাছে এতক্ষণ ফোকাস-ছাড়া দূরবীনের দৃক্তপটের মতো ঝাপসা হয়েছিল, এতক্ষণে ফোকাস ঠিক হয়ে সব উজ্জ্বল ও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। পৃথিবীতে সে যে একা নয়, শোণিত-সুরা-সন্তপ্ত হৃদয় নিয়ে জীবনের চিয়ন্তন ও অভিনব সুখস্থঃখে বিচলিত অসংখ্য নরনারী যে তাকে ঘিরে আছে, এৈই অনুভূতির শেষ পর্যায়ে জীবনের সাধারণ ও বাস্তব ভিত্তিগুলির সঙ্গে হেরম্বের নূতন করে পরিচয় হয়। স্বপ্রিয়া হয়ে থাকে এই পরিচয়ের মধ্যবর্তিনী-কান্তা, রৌদ্রতপ্ত দিনের ধূলিরুক্ষ কঠোর বাস্তবতায় একটি কাম্য পানীয়ের প্রতীক।

কোনদিন বাইরে প্রবল বর্ষা নামে। মন্দির ও সমুদ্র জীবন থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে মিলিয়ে যায়। ঘরের মধ্যে বিছানো লোমশ কম্বলে বসে আনন্দ ঝিনুকের রাশি গোনে এবং বাছে, ডান হাত আর বাঁ হাতকে প্রতিপক্ষ করে খেলে জোড়-বিজোড়। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে হেরম্ব চুরুট খায় আর নিরানন্দ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আনন্দের খেলা চেয়ে দেখে। এই বিরহ-বিপন্ন বিষন্ন মুহূর্তগুলিতেও তার যে দৃষ্টির প্রখরতা কমে যায় তা নয়। আনন্দের স্বচ্ছপ্রায় নখের তলে রক্তের আনাগোনা তার চোখে পড়ে, অধরোষ্ঠের নিগূঢ় অভিপ্রায়ের সে মর্মোদ্‌ঘাটন করে, কপালে ছেলেখেলার হারজিতের হিসাব- গুলিকে গোনে। ঘরের আলো বর্ষার মেঘে স্তিমিত হয়ে থাকে।

আনন্দ শ্রান্তস্বরে বলে, ‘কি বৃষ্টিই নেমেছে? সমুদ্রটা পর্যন্ত বোধ হয় ভিজে গেল।’

হেরম্ব কথা বলে না। আনন্দের বর্ষা-বিরাগে তার দিন আরও কাটতে চায় না।

চুরুটের গন্ধে আনন্দ মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকাল। হেরম্ব ভাবল, আনন্দ হয়তো হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকবে। এখন বাগানে যেতে অস্বীকার করার জন্য হেরম্ব নিজেকে প্রস্তুত করছে, আনন্দ মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, যার সুস্পষ্ট অর্থ, এখন হেরম্বর বাগানে যাবার দরকার নেই: দূরত্বই ভাল, এই ব্যবধান। হেরম্ব চুরুটটা ফেলে দিয়ে সরে গেল। কাছাকাছি না গেলে চাওয়া-চাওয়িও এখন না হলে চলবে।

গামছা কাপড় নিয়ে হেরম্ব খিড়কির দরজা দিয়ে বার হয়ে বাড়ির পূর্বদিকের পুকুরে স্নান করে এল। বাড়িতে ঢুকে দেখল, বাগান থেকে ঘরে এসে আনন্দ অনাথের কাছে গল্প শুনতে বসেছে। হেরম্বও একপাশে বসে পড়ল। গল্প শোনার প্রত্যাশায় নয়: অনাথের বলা ও আনন্দের শোনা দেখবার জন্য।

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ২৩ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ২৩ তম কিস্তি )

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024