সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।
দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..
দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।
দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।
দিবা রাত্রির কাব্য
মানিক বন্দোপাধ্যায়
অনাথ আজ মেয়েকে নচিকেতার কাহিনী শোনাচ্ছে।
-‘তন্ত হি নচিকেতা নাম পুত্র আস। বাজশ্রবসের নচিকেতা নামে এক পুত্র ছিল। একবার এক যজ্ঞ করে বাজশ্রবস নিজের সর্বস্ব দান করলেন। দক্ষিণা দেবার সময় হলে নচিকেতা-স হোবাচ পিতরং তত কস্মৈ মান্দাস্ত- তাঁতি, আমায় কাকে দেবেন? নচিকেতা তিনবার এ প্রশ্ন করলে বাজশ্রবস রাগ করে বললেন, তোমায় যমকে দেব।’
হেরম্ব মৃদুস্বরে বলল, ‘যম নয়, মৃত্যুকে।’
আনন্দ বলল, ‘তফাত কি হল?’
হেরম্ব বলল, ‘উপনিষদে মৃত্যু শব্দটা আছে।’
আনন্দ তার এই বিন্ধ্যার পরিচয়ে মুগ্ধ হল না। বলল, ‘তারপর কি হল বাবা?’
হেরম্বের মনে হয়, আনন্দ তাকে অবহেলা করেছে। তার অস্তিত্বকে আনন্দের এ পরিপূর্ণ বিস্মরণ। বাগানে আনন্দের ঘাড় নাড়া ধরলে এই নিয়ে দু’বার হল। সকালের শুরু দেখে আজকের দিনটি হেরম্ব একটি মোটামুটি নিরানন্দের মধ্যে কাটিয়ে দেবারও আশা করতে পারে না।
এদিকে মালতী এসে নচিকেতার কাহিনীতে বাধা জন্মায়। ‘তারপর কি হল বাবা? কচি খুকীর মতো সকালে উঠে গপ্পো গিলছিস্?
স্নান-টান করে মন্দিরটা খোল না গিয়ে! কাজের সময় গল্পো কি?’ অনাথ বলে, ‘এমনি করে বুঝি বলতে হয়, মালতী?’
‘কি করে বলব তবে? একটা কাজ করতে বলার জন্যে পেটের মেয়ের কাছে গলবস্ত্র হতে হবে?’
অনাথ চুপ করে যায়। আনন্দ স্নানের উদ্দেশ্যে চলে যায় পুকুরে। তার পরিত্যক্ত স্থানটি দখল করে বসে মালতী। হেরম্বের মনে হয়, সেও বুঝি অনাথের কাছে গল্পই শুনতে চায়। যে-কোন কাহিনী।
হেরম্বের আবির্ভাবে এদের দু’জনের সম্পর্কে বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটেনি। অনাথের অসঙ্গত অবহেলার জবাবে মালতীর স্বেচ্ছাচারিতা যেমন উগ্র ছিল তেমনি উগ্র হয়েই আছে। কিন্তু তার সমস্ত রুক্ষ আচরণের মধ্যে একটি পিপাসু দীনতা, ক্ষীণতম আশ্বাসের প্রতিদানে নিজেকে আমূল পরিবর্তিত করে ফেলবার একটা অনুচ্চারিত প্রতিজ্ঞা হেরম্ব আজকাল সর্বদা আবিষ্কার করতে পারে। বোঝা যায় অনাথের প্রতি মালতীর সমস্ত ঔদ্ধত্য অনাথকে আশ্রয় করেই যেন দাঁড়িয়ে থাকে। অপরিচ্ছন্নতা আমদানি করেছে, অনাথের গায়ে তার নিজের জীবনে সে যে স্কুল নমুনাগুলি লেপন করে দেবার চেষ্টার মধ্যে যেন তার একটি প্রার্থনার আর্তনাদ গোপন হয়ে থাকে, আমাকে শুদ্ধ কর, পবিত্র কর। অনাথের নিরুপদ্রব নির্বিকার ভাব মাঝে মাঝে হেরম্বকেও বিচলিত করে দেয়। সময় সময় তার মনে হয়, এও বুঝি এক ধরনের অসুখ। জ্বর যেমন উত্তাপ বেড়েও হয় কমেও হয়, এরা দু’জনে তেমনি একই মানসিক বিকারের শান্ত ও অশান্ত অবস্থা দুটি ভাগ করে নিয়েছে।
কখনো কখনো এমন কথাও হেরম্বের মনে হয় যে, অনাথের চেয়ে মালতীরই বুঝি, ধৈর্য বেশী, তিতিক্ষা কঠোরতর, অনাথের আধ্যাত্মিক তপস্তার চেয়ে মালতীর তপস্তাই বেশী বিরাম-বিহীন। অনাথের বিষয়ান্তরের আশ্রয় আছে, অন্যমনস্কতা আছে, যৌগিক বিশ্রাম আছে,-মালতীর জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গতি নিরবচ্ছিন্নভাবে একনিষ্ঠ। অনাথকে কেন্দ্র করে সে পাক খাচ্ছে। অনাথ তার জগৎ, অনাথ তার জীবন, অনাথকে নিয়ে তার রাগ দুঃখ হিংসা ক্লেশ, অনাথ তার অমার্জিত পার্থিবতার প্রস্রবণ, তার মদের নেশার প্রেরণা। অনাথকে বাদ দিলে তার কিছু থাকে না।
হেরম্বকে চোখ ঠেরে মালতী গম্ভীর মুখে অনাথকে বলল, ‘কাল এক স্বপন দেখলাম। তুমি আর আমি যেন কোথায় গেছি-অনেক দূর দেশে। পোড়া দেশে আমরা দু’জন ছাড়া আর মানুষ নেই, রাস্তায়-ঘাটে, ঘরে-বাড়িতে সব মরে রয়েছে।’
অনাথ বলল, ‘ভুলেও তো সৎ চিন্তা করবে না। তাই এরকম হিংসার ছবি দ্যাখো।’
মালতী এ কথা কানেও তুলল না, বলে চলল, ‘স্বপন দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেছে বাপু, যাই বল। আচ্ছা চল না আমরা দু’জনে একটু বেড়িয়ে আসি ক’দিন? ওদের কন্ঠি-বদলটা চুকিয়ে দিয়ে যাই, ওরা এখানে থাক। তুমি আমি বিন্দাবনে গিয়ে ঘর বাঁধি চল।’
মালতীর গাম্ভীর্যকে বিশ্বাস করে উপদেশ দেবার ভঙ্গীতে অনাথ বলল, ‘এখনও তোমার ঘর বাঁধবার শখ আছে, মালতী? বনে যদি যাও তো চল।’ মালতী তার আকস্মিক বিপুল হাসিতে অনাথের ক্ষণিকের অন্তরঙ্গতা চূর্ণ করে দিল। বলল, ‘কেন, বনে যাবার এমনকি বয়েসটা আমার হয়েছে শুনি? রাধাবিনোদ গোঁসাই কণ্ঠি-বদলের জন্য সেদিনও আমায় সেধে গেল না? মেয়ে টের পাবে বলে অপমান করে তাড়িয়ে দিলাম, ডাকলেই আবার আসে। তোমার চোখ নেই তাই আমাকে বুড়ী দ্যাখো! নাকি বল, হেরম্ব? আমি বুড়ী?’
হেরম্বকে সে আবার চোখ ঠারল, ‘রাধাবিনোদ গোঁসাইকে জান হেরম্ব? মাঝে মাঝে আমায় দেখতে আর সাধতে আসে-লক্ষ্মীছাড়া ব্যাটা। চেহারা যেমন হোক, পয়সা আছে। সেবাদাসীর খাতিরও জানে বেশ-শৌখিন বৈরেগি কিনা।
Leave a Reply