শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-১৬)

  • Update Time : শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১.০০ পিএম

শ্রী নিখিলনাথ রায়

 

মসজেদের পশ্চাতে অর্থাৎ পশ্চিমদিকে সদররাস্তা; রাস্তা হইতে মজেদের দক্ষিণপার্শ্বে একটি পথ দিয়া মজেদের সম্মুখে উপস্থিত হইতে হয়। মজেদ পূর্ব্বমুখে অবস্থিত। প্রবেশদ্বারে উঠিতে হইলে, চৌদ্দটি বৃহৎ সোপান অতিক্রমের প্রয়োজন। এই সোপানাবলীর নিয়ে, একটি ক্ষুদ্র • প্রকোষ্ঠে মুর্শিদাবাদের স্থাপয়িতা ইতিহাসখ্যাত মুর্শিদকুলী খাঁ অনন্ত- “নিদ্রায় নিদ্রিত। যাঁহার শাসনে সমগ্র বঙ্গভূমি সন্ত্রস্ত হইয়াছিল, এক্ষণে তিনি সোপানাবলীর নিম্নস্থ অন্ধতমসাবৃত গহ্বরে শয়ান রহিয়াছেন। উত্তরদিকে একটিমাত্র দ্বার, সেইদ্বার প্রায় রুদ্ধ থাকে; সময়ে সময়ে ক্ষণকালের জন্য উন্মুক্ত হয় মাত্র। দ্বারের পরই একটি ক্ষুদ্র গৃহ, তাহার পশ্চাতে সমাধিপ্রকোষ্ঠ; সেই ক্ষুদ্রগৃহ ও সমাধি-প্রকোষ্ঠের মধ্যে আর একটি দ্বার, এ দ্বারের কোন কপাট নাই। কষ্টিপ্রস্তরগঠিত চৌকাট ‘দ্বারা দ্বারটি নির্মিত। প্রকোষ্ঠমধ্যে শ্বেতবস্ত্রমণ্ডিত সমাধি নানাবিধ কারুকাৰ্য্যসমন্বিত মালাশোভিত হইয়া আছে। লোকে আপনাদিগের মনস্কামনা সিদ্ধির জন্য সমাধির উপর এই সমস্ত মালা নিক্ষেপ করিয়া যায়। এই অন্ধকারময় প্রকোষ্ঠে রাত্রিকালে একটি মাত্র দাপ আপনার ক্ষীণ শিখা বিস্তার করিয়া থাকে। সমাধির তত্ত্বাবধানের জন্য একট লোক নিযুক্ত আছে।

সোপানাবলীর উপরে একটি প্রকাণ্ড তোরণ দ্বার; তোরণ-দ্বারের উপর দ্বিতল নহবতখানা এবং তোরণ-দ্বারের পূর্ব্বসীমা অর্থাৎ সোপানাবলীর অব্যবহিত পর হইতে আরম্ভ করিয়া মজেদের পশ্চাদ্ভাগ পর্যন্ত একটি বিশাল চত্বর। চত্বরটি সমচতুরস্র, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ১১০ হস্তেরও অধিক হইবে। মজেদ, তোরণ, সমস্তই এই চত্বরে অবস্থিত। তোরণ পার হইয়া প্রায় ৮০ হাত পরে মজ্জদ; মজদ ও তোরণের মধ্যস্থিত বিশাল প্রাঙ্গণ জঙ্গলে পরিপূর্ণ। কেবল তোরণ হইতে মজ্জেদে যাইবার কৃষ্ণপ্রস্তর-মণ্ডিত পথটি আজিওীর হইয়া থাকে। চত্বরের পশ্চিমদিকে পঞ্চগম্বুজবিশির বিরাটু মজেদ অস্থাপি দণ্ডায়মান খকিয়া কালের আঘাত সহ করিতেছে। মক্কেদের ভিত বসিয়া যাওয়ায় খিলানকরা গম্বুজগুলি বিদীর্ণ হইয়া গিয়াছে। গম্বুজ পাঁচটি ব্যতীত চারিকোণে চারিটি ক্ষুদ্র মিনার ছিল। তাহার দুই একটি এখনও বর্তমান আছে। মজেদটি ইষ্টক-নিশ্চিত। ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র বাঙ্গলা ইষ্টক জমাইয়া কিরূপে এই বিশাল পঞ্চগম্বুজের খিলান নিম্মিত করা হইয়াছিল, তাহা মনে করিতে গেলে আশ্চর্য্যান্বিত হইতে হয়।

মজেদটি দৈর্ঘ্যে ৮৯/৮৭ হাত হইবে, এবং প্রন্থে ১৬ হাতেরও অধিক। গম্বুজগুলির ধাতুনিম্মিত চূড়া আজিও তাহাদের পতনোন্মুখ মস্তকে শোভা পাইতেছে। মঙ্গেদের প্রবেশদ্বারে প্রকাণ্ড কৃষ্ণপ্রস্তর- নিৰ্ম্মিত চৌকাঠ। দ্বারের উপর এক খণ্ড কষ্টি প্রস্তরে ফারসী ভাষায় এইরূপ লিখিত আছে,-“আরবের মহম্মদ উভয় জগতের গৌরব; যে ব্যক্তি যাঁহার দ্বারের খুলি নহে, তাহার মস্তকে ধূলিবৃষ্টি হউক।” ঢাকার সায়েস্তা খাঁর কন্যা পরীবিবির সমাধিমন্দিরেও ঐরূপ লিখিত আছে। মঙ্গেদের মধ্যস্থলে পশ্চিমদিকের ভিত্তিতে কলমী লেখা। ইহার উত্তর ও দক্ষিণ পার্শ্বের জানালা দুইটি আজিও বাঙ্গলার পূর্ব্ব শিল্পের পরিচয় দিতেছে। অনেকগুলি গম্বুজ ভাঙ্গিয়া যাওয়ায় উপর হইতে ক্রমাগত ইষ্টক খণ্ড পতিত হইতেছে। এই মদে মধ্যে প্রবেশ করিতে মনে ভীতির সঞ্চার হয়। কেবল কপোত ও মধুমক্ষিকাগণ আপনাদিগের উপযুক্ত আবাসস্থান বিবেচনায় মজ্জদটিকে অধিকার করিয়া রাখিয়াছে এবং নীরব ও নির্জন স্থানে সময়ে সময়ে আপনাদিগের কণ্ঠস্বরে আপনারাই মুগ্ধ হইয়া থাকে।

চত্বরের চারিপার্শ্বে মোসাফের ও কারীদিগের (কোরাণাধ্যায়ী) জন্য বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহ ছিল। ‘গৃহ- গুলি সমস্তই খিলানের, একটিতেও তীর বরগা নাই। এখনও তাহাদের এখনও তাহাদের ভগ্নাবশেষ নয়ন পথে পতিত হইয়া মুর্শিদকুলী খাঁর বিশাল কীর্তির পরিচয় দিতেছে। মজদের পশ্চাদ্ভাগের উত্তরপশ্চিম ও দক্ষিণপশ্চিম কোণে দুইটি অত্যুচ্চ অষ্টকোণ মিনার যেন গগনস্পর্শ করিবার জন্য দণ্ডায়মান রহিয়াছে। উত্তরপশ্চিমের মিনারে যাইবার সুবিধা নাই; তাহার চারি • দিক ভীষণ জঙ্গলে আবৃত। দক্ষিণপশ্চিমের মিনারে উঠিতে পারা যায়। সর্পগতিতে ৬৭ টি সোপান অতিক্রম করিয়া মিনারের চূড়াতলে উঠিতে হয়। মধ্যে মধ্যে আলোক ও বায়ু প্রবেশের দ্বারও আছে। মিনারটি প্রায় ৪০ হস্ত উচ্চ হইবে; চূড়াতল হইতে ভূমি পর্যন্ত অংশ প্রায় ৩০ হস্ত। এই চূড়াতলে দাঁড়াইয়া পশ্চিমদিকে দৃষ্টিপাত করিলে, মুর্শিদাবাদ নগরের এক সুন্দর দৃশ্য নয়নপথে পতিত হয়।

 

 

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-১৫)

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-১৫)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024