সারাক্ষণ ডেস্ক
তাঁদের লড়াই চলে নিত্যদিন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে তো রয়েছেই। বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরূপ প্রভাবে তাঁদের জীবনযাত্রা ক্রমাগত স্থবির হয়ে যাচ্ছে। তবু লড়াই থামে না। তাঁদের পরিশ্রমে সেই স্থবির জীবন ফিরে পায় ছন্দ। পটুয়াখালীর কাটাখালী দ্বীপের এসব মানুষের মধ্য থেকে ১২ জন নারীকে নিয়ে কাজ শুরু করেন মনিকা জাহান বোস। তাঁর উদ্যোগে ঢাকার কেনেডি সেন্টারের আয়োজনে “চলমান”, শীর্ষক এক প্রদর্শনীর শুরু হবে ১ লা মার্চ থেকে। এ প্রদর্শনী চলবে আলোকি, শালা গ্যালারী (১ম তলা), ২১১ গুলশান – তেজগাঁও লিঙ্ক রোডে। প্রদর্শনীতে আছে সেই ১২ জন নারীর নকশা করা শাড়ি। শাড়িগুলোয় ছাপচিত্র নকশার পাশাপাশি তাঁরা নিজেরা লিখেছেন তাঁদের জীবনসংগ্রামের গল্প। লাল, কালো বিভিন্ন রঙের সুতি শাড়িতে তাঁরা করেছেন ফুলেল নকশা। শাড়িতে আছে তাঁদের নাম, কেউ আবার শাড়িতেই জানিয়েছেন দেশের প্রতি ভালোবাসার কথা।
মনিকার জন্ম ইংল্যান্ডে। তারপর থিতু হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। কাটাখালীর মতো এলাকার খবর তিনি কীভাবে জানেন? জানেন কারণ, মানুষ নাকি শেকড়ের টানে দেশে ফিরে। মনিকা দেশে ফিরেছিলেন শাড়ির টানে। শাড়ির টান! সেটা আবার কী রকম? উত্তর খোঁজার আগে আগুনমুখা থেকে উড়াল দিয়ে চলুন পটোমাক নদীতীরের ওয়াশিংটন ডিসিতে। ১৯৮৪ সালে মনিকার মা নূরজাহান বোসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় সংহতি। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি-আমেরিকান নারীদের গড়া এই অলাভজনক সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র নারীদের সহায়তা।
শিল্পী এবং জলবায়ু ও পরিবেশবাদী আন্দোলন কর্মী মনিকা জাহান বোস-এর একক প্রদর্শনী “চলমান” প্রদর্শিত হবে আলোকির দ্যা নেইবারহুড আর্ট স্পেস শালা গ্যালারীতে । প্রদর্শনীর উদ্বোধন, আগামী ১লা মার্চ বিকেল ৪ ঘটিকায়। ইউ. এস. স্টেট ডিপার্ট্মেন্টের আর্ট ইন এম্বেসিস প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ও আমেরিকার সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের লক্ষ্যে মনিকা জাহান বোস এবার ঢাকায় এসেছেন। এবং দীর্ঘ নয় বছর পরে তিনি আবার বাংলাদেশে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। প্রদর্শনীটি অভূতপুর্ব স্থাপনা শিল্পের সংমিশ্রনে নির্মিত, যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্ল্যেখযোগ্য নতুন আঙ্গিকের তিন চ্যানেল ভিডিও উপস্থাপনা, রঙ্গীন জলপ্রপাতের অনুকরনীয় শাড়ির স্থাপনা শিল্প। এ সকল উপস্থাপনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও নারীদের আখ্যান। রুক্সমিনি রিকভানা কিউ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে সৃজিত এই প্রদর্শনী চলবে আগামী ১লা – ৯ মার্চ , প্রতিদিন বিকেল ৩ -৯ ঘটিকা পর্যন্ত।
শিল্পী মনিকা জাহান বোস প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে চলেছেন ‘শাড়ির মাঝে জীবনগাথা’ শিল্প প্রকল্প নিয়ে, যেখানে শাড়ি, চলচিত্র এবং কৃতকলার মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেন নারী, খাদ্য ও প্রকৃতির উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এই প্রদর্শনীটি তার সেই যাত্রার খন্ডচিত্র। মনিকা তার মায়ের গ্রাম পটুয়াখালীর বড়বাইশদিয়া দ্বীপের কাটাখালী গ্রামের কৃষাণীদের নিয়ে এক যুগেরও বেশী সময় ধরে কাজ করে চলেছেন, একই সাথে কাজ করে চলেছেন তার বর্তমান বাসস্থান ওয়াশিংটন ডি. সি. সহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মানুষের সাথে। এই শাড়িগুলো যে ব্লক দিয়ে রাঙ্গানো হয়েছে সেই ব্লকগুলো শিল্পী নিজেই ডিজাইন করেছেন, একই সাথে সমন্বয় করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের সৃষ্ট লেখা ও চিত্রকর্ম।
মনিকা জাহান বোস বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে প্রায় বিধ্বস্ত এই পৃথিবীতে আমরা যখন ক্রমাগত সংগ্রাম করে চলেছি টিকে থাকার, তখন আমাদের প্রয়োজন শিল্পের মাধ্যমে আশাবাদী ও গোষ্ঠীবদ্ধ হবার। শাড়ির মাঝে জীবনগাথার মাধ্যমে, আমি চেষ্টা করেছি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংরক্ষন করার সাথে সাথে সেই সব গল্পগুলোর উপরে আলোকপাত করার যেগুলোর মূল কারন জলবায়ু বৈষম্য।“
তত্ত্বাবধায়ক রুক্সমিনি বলেন, “এই প্রানবন্ত ও কাব্যিক প্রদর্শনীতে মনিকার অদম্য সৃজনিশক্তি ও কাজের প্রতি তার আন্তরিক একাগ্রতা স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। বিভিন্ন কৃতকলা ও স্থাপনা শিল্পে তিনি বার বার একই শাড়ি ব্যবহার করেছেন। শুধুমাত্র শিল্প ক্ষেত্রে নয় বরং আমাদের জীবনযাত্রাতে উপাদানের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও পুনঃব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তোলার প্রতিকী রূপে। তার এই অভাবনীয় নিবেদনের মাধ্যমে, তিনি আমাদের ভোগ্য পণ্যের অযাচিত ব্যবহার কমিয়ে পুনঃব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনুপ্রানিত করেন।”
শিল্পী বেশকিছু জনসংযোগমূলক প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছেন, যার মাঝে রয়েছে ২৯ শে ফেব্রুয়ারীতে চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল ১০ ঘটিকায় তার কথোপকথন। একাধিক কর্মশালা করার উদ্দ্যেশ্যে তিনি কাটাখালি গ্রামে গিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি দ্যা নেইবারহুড আর্ট স্পেস এবং পাড়ার সহযোগে কড়াইল এলাকার মহিলাদের নিয়ে একটি কমিউনিটি কর্মশালা করার পরিকল্পনা করেছেন।
মনিকা জাহান বোস সম্পর্কে কিছু কথাঃ
মনিকা জাহান বোস একজন বাংলাদেশী-আমেরিকান শিল্পী যিনি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেন। তিনি পেইন্টিং, প্রিন্ট মেকিং, ফিল্ম, কৃতকলা এবং স্থাপনা শিল্প মাধ্যমে সচ্ছন্দ্যে বিচরন করেন। তিনি সামাজিক দ্বায়বদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিত থেকে কো-ক্রিয়েটেড কর্মশালা, শিল্পকর্ম, অস্থায়ী ইনস্টলেশন এবং কৃতকলার মাধ্যমে জলবায়ু, জাতিগত, লৈঙ্গিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মত বিষয় নিয়ে কাজ করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার কাজ প্রদর্শন করেছেন (২২টি একক শো, ৫টি আউটডোর পাবলিক আর্ট প্রজেক্ট এবং ২৫ টিরও বেশি কৃতকলা), বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এবং ম্যাক্রো মিউজিয়াম অব কন্টেম্পোরারী আর্ট রোম- এ একক প্রদর্শনী। মায়ের বাড়ির গ্রামের কৃষাণীদের নিয়ে করা দশকব্যাপী সহযোগিতা ও প্রতিরক্ষামূলক প্রকল্প ‘শাড়ির মাঝে জীবনগাথা’, আটটি দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১২টি প্রদেশে প্রদর্শিত হয়েছে, এই প্রকল্পের সাথে সংযুক্ত করেছে হাজার হাজার মানুষকেও। তিনি অসংখ্য গ্র্যান্ট এবং পুরস্কার পেয়েছেন। তার পেইন্টিং, শাড়ি এবং আর্কাইভ স্মিথসোনিয়ানের সংগ্রহে রয়েছে। মনিকা দুবাইতে COP28 জলবায়ু সম্মেলনে একজন শিল্পী প্রতিনিধি ছিলেন, যেখানে তিনি চারটি ভেন্যুতে শাড়ির স্থাপনা শিল্প, কর্মশালা এবং চলচিত্র উপস্থাপনা করেন। তিনি ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে আর্ট প্র্যাকটিস (পেইন্টিং) বিষয়ে বিএ, শান্তিনিকেতন থেকে শিল্পে ডিপ্লোমা এবং কলম্বিয়া ল স্কুল থেকে জুরিস ডক্টর করেছেন।
Leave a Reply