নজরুল
এমন সময় কবির কয়েকজন বন্ধু কবির সঙ্গে দেখা করিতে আসিলেন। কবি তাঁহাদিগকে আমার কয়টি কবিতা পড়িয়া শুনাইলেন। বন্ধুরা আমার কবিতা শোনার চাইতে কবিকে কোথাও লইয়া যাইবার জন্য মনোযোগী ছিলেন। কবি হাবিলদারের পোশাক পরিতে পরিতে গান গাহিয়া উচ্চ হাস্যধ্বনি করিয়া লাফাইয়া ঝাঁপাইয়া নিজের প্রাণ-চাঞ্চল্যের প্রকাশ করিতে লাগিলেন। আমি কবির নিকট হইতে বিদায় লইয়া চলিয়া আসিলাম।
কার্তিকদার আড্ডায় আসিয়া দেখি, তিনি মাথায় হাত দিয়া বসিয়া আছেন। আমারই মতন জনৈক পথে-কুড়ানো ভাই তাহার বাক্স হইতে টাকা পয়সা যাহা-কিছু ছিল, সমস্ত লইয়া পালাইয়া গিয়াছে। আমার কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। এই লোকটি আমাদের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করিতেন; নিজে অভুক্ত থাকিয়া, কতদিন দেখিয়াছি, এমনই পথে-পাওয়া তাঁর কোনো অনাহারী ভাইকে খাওয়াইতেছেন। এই কি তার প্রতিদান।
আমি দেশে চলিয়া যাইব বলিতে কার্তিকদা খুশি হইলেন। আমাকে বলিলেন, “তুমি দেশে গিয়ে পড়াশুনা কর। মানুষ হয়ে আবার কলকাতা এসো। দেখবে সবাই তোমায় আদর করবে। আমিও তোমার মতো দেশে গিয়ে পড়াশুনা করতাম, লজ্জায় যেতে পারছি না। যে সব ছাত্র আমার মতো বিদ্যালয়ের গোলামখানা ছেড়ে আসেনি, তাদের কত গাল দিয়েছি; টিটকারি করে বক্তৃতা দিয়েছি। আবার তাদের মধ্যে কোন মুখে ফিরে যাব?”
বিদায় লইবার সময় আমার মাদুরখানা কার্তিকদাকে দিয়া আসিলাম। কার্তিকদা তাহা বিনা দামে কিছুতেই লইলেন না। তিনি জোর করিয়া আমার পকেটে মাদুরের দামটা দিয়া দিলেন। স্টেশনে আসিয়া আমার টিকিট খরিদ করিয়া দিলেন। বিদায় লইয়া আসিবার সময় তিনি আমাকে বলিলেন, “জসীম, যখন যেখানেই থাকবি, মনে রাখিস তোর এই কার্তিকদার মনে তোর আসনটি চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে। আমার জীবন হয়তো এই ভাবেই নষ্ট হয়ে যাবে। পড়াশুনা করে মানুষ হবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তা জীবনে ঘটবে না। নেতাদের কথায় কলেজ ছেড়ে যে ভুল করেছি, সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আমাকে হয়তো সারা জীবন করতে হবে। কিন্তু তোর জীবনে এই ভুল সংশোধন করার সুযোগ হল; তুই যেন বড় হয়ে তোর কার্তিকদাকে ভুলে যাসনে। নিশ্চয় তুই একজন বড় কবি হতে পারবি। তখন আমাদের কথা মনে রাখিস।”
আমি অশ্রুসজল নয়নে বলিলাম, “কার্তিকদা, তোমাকে কোনোদিন ভুলব না। ভালো কাজ করলে সেই কাজ বোনা বীজের মতো মানুষের মনে অঙ্কর জন্মাতে থাকে। হয়তো সকলের অন্তরে সেই বীজ হতে অঙ্কুর হয় না। কিন্তু একথা মনে রাখবে, ভালো কাজ বৃথা যায় না। তোমার কথা এই দরদেশী ছোট ভাইটির মনে চিরকাল জাগ্রত থাকবে।”
তখনকার কিশোর বয়সে এইসব কথা তেমন করিয়া গুছাইয়া বলিতে পারিয়াছিলাম কিনা মনে নাই। কিন্তু আজও আমার মনের গহন কোণে কার্তিকদার সৌম্য মর্তিখানি চির-উজ্জ্বল হইয়া আছে। এতটুকুও ম্লান হয় নাই। দেশে ফিরিয়া আসিয়া কার্তিকদার কাছে পত্র লিখিয়াছিলাম। কোনো উত্তর পাই নাই। হয়তো তিনি তখন অন্যত্র বাসা বদল করিয়াছিলেন। তারপর কতজনের কাছে কার্তিকদার অনুসন্ধান করিয়াছি। কেহ তাঁহার খবর বলিতে পারে নাই। আজ আমার কিঞ্চিৎ কবিখ্যাতি হইয়াছে। আমার বইগুলি পড়িলে কার্তিকদা কত সুখী হইতেন। বঙ্গ-বিভাগের পর তিনি কোথায় গিয়াছেন, কে জানে? হয়তো অনেকগুলি ছেলেমেয়ে লইয়া তিনি কোনো সুদুর পশ্চিম অঞ্চলে দুঃখ-দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া কোনো রকমে বাঁচিয়া আছেন।
দেশে ফিরিয়া আসিয়া দেখি, আমার মা আমার জন্য চিন্তা করিয়া শুকাইয়া গিয়াছেন। পিতা নানাস্থানে আমার সন্ধান না পাইয়া খোঁজখবর লইয়া অস্থির। আজীবন মাস্টারি করিয়া ছেলেদের মনোবিজ্ঞান তাঁর ভালোভাবেই জানা ছিল। তিনি জানিতেন চোদ্দ-পনর বৎসরের ছেলেরা এমনি করিয়া বাড়ি হইতে পলাইয়া যায়। আবার ফিরিয়া আসে। সেইজন্য তিনি আমার ইস্কুলের বেতন ঠিকমতো দিয়া আসিতেছিলেন।
মা আমাকে সামনে বসাইয়া খাওয়াইতে লাগিলেন। বাড়ির আম সেই কবে পাকিয়াছিল, তাহা অতি যত্নে আমার জন্য রাখিয়া দিয়াছেন। অর্ধেক পচিয়া গিয়াছে তবু ছোট ভাই-বোনদের খাইতে দেন নাই, আমি আসিলে খাইব বলিয়া।
আবার ইস্কুলে যাইতে লাগিলাম। নজরুল ইসলাম সাহেবের নিকট কবিতার নকল পাঠাইয়া সুদীর্ঘ পত্র লিখিলাম। কবির নিকট হইতে কবিতার মতোই সুন্দর উত্তর আসিল। কবি আমাকে লিখিলেন-
“ভাই শিশুকবি, তোমার কবিতা পেয়ে সুখী হলুম। আমি দখিন হাওয়া। ফুল ফুটিয়া যাওয়া আমার কাজ। তোমাদের মতো শিশু কুসুমগুলিকে যদি আমি উৎসাহ দিয়ে, আদর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারি, সেই হবে আমার বড় কাজ। তারপর আমি বিদায় নিয়ে চলে যাব আমার হিমগিরির গহন বিবরে।”
কবির নিকট হইতে এরূপ চার-পাঁচখানা পত্র পাইয়াছিলাম। তাহা সেকালের অতি উৎসাহের দিনে বন্ধুবান্ধবদের দেখাইতে দেখাইতে হারাইয়া ফেলিয়াছি। কিছুদিন পরে মোসলেম ভারতে যে সংখ্যায় কবির বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হইয়াছিল, সেই সংখ্যায় ‘মিলন গান’ নামে আমারও একটি কবিতা ছাপা হইল। চট্টগ্রাম হইতে প্রকাশিত সাধনা পত্রিকাতেও আমার দুই-তিনটি কবিতা ছাপা হয়। ইহা সবই কবির চেষ্টায়। আজও ভাবিয়া বিস্ময় লাগে, তখন কী-ই বা এমন লিখিতাম। কিন্তু সেই অখ্যাত অস্ফুট কিশোর কবিকে তিনি কতই না উৎসাহ দিয়াছিলেন।
চলবে…..