নজরুল
অল্পক্ষণ পরেই কবি ঘড়ি দেখিয়া বলিলেন, “আমাকে এখন হুগলি যেতে হবে।” আগাইয়া গিয়া বলিলাম, “আমি বহুদূর থেকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।” কবি আমাকে বলিলেন, “একদিন হুগলিতে আমার ওখানে এসো। আজ আমি যাই।”
এই বলিয়া কবি একটি ট্যাক্সি ডাকিয়া তাহাতে আরোহন করিলেন। আমিও কবির সঙ্গে সেই ট্যাক্সিতে গিয়া উঠিলাম। কবির প্রকাশক মৈনুদ্দীন হুসায়েন সাহেবও কবির সঙ্গে ছিলেন। আমি ভাবিয়াছিলাম, ট্যাক্সিতে বসিয়া কবির সঙ্গে দু-চারটি কথা বলিতে পারিব। কিন্তু মৈনুদ্দীন সাহেবই সব সময় কবির সঙ্গে কথা বলিতে লাগিলেন। আমি মৈনুদ্দীন সাহেবকে বলিলাম, “আপনি তো কলকাতায় থাকেন। সব সময় কবির সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আমাকে একটু কথা বলতে দিন।”
কবি কহিলেন, “বলো বলো, তোমার কি কথা?” আমি আর কি উত্তর করিব। কবি আবার মৈনুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে কথা বলিতে লাগিলেন। ট্যাক্সি আসিয়া হাওড়ায় থামিল। কবি তাড়াতাড়ি ট্যাক্সি হইতে নামিয়া রেলগাড়িতে গিয়া উপবেশন করিলেন। রাশি রাশি ধূম উদ্গিরণ করিয়া শোঁ শোঁ শব্দ করিয়া গাড়ি চলিয়া গেল। আমি স্তব্ধ হইয়া প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইয়া রহিলাম। গাড়ির চাকা যেন আমার বুকের উপর কঠিন আঘাত করিতে করিতে চলিয়া গেল।
এখন আমি কোথায় যাই-কাহার নিকটে গিয়া আশ্রয় লই? ফরিদপুরের এক ভদ্রলোক হ্যারিসন রোডে ডজ-ফার্মেসিতে কাজ করিতেন। তাঁহার সন্ধানে বাহির হইলাম। কিন্তু হ্যারিসন রোডের ডজ-ফার্মেসি কোথায় আমি জানি না। একে তো ট্রেন-ভ্রমণে ক্লান্ত, তার উপর সারাদিন কিছু আহার হয় নাই। হাওড়া হইতে শিয়ালদহ পর্যন্ত রাস্তার এপারে-ওপারে তিন-চারবার ঘুরিয়া ডজ-ফার্মেসির সন্ধান পাইলাম। ফার্মেসিতে কংগ্রেসের জন্য সংগৃহীত টাকার বাক্সটি রাখিয়া ফুটপাতের উপর শুইয়া পড়িলাম। তখন আমি এত ক্লান্ত যে সারাদিনের অনাহারের পরে খাওয়ার কথা একেবারেই ভুলিয়া গেলাম।
ইহার বহুদিন পরে আমাদের ফরিদপুরে বঙ্গীয় রাষ্ট্রীয় সমিতির অধিবেশন বসিল। এই অধিবেশনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। প্রতিদিন গাড়ি ভরিয়া বহু নেতা আমাদের বাড়ির পাশের স্টেশনে আসিয়া নামিতে লাগিলেন। স্বেচ্ছাসেবকের ব্যাজ পরিয়া আমরা তাঁহাদের অভ্যর্থনা করিতাম। একদিন আশ্চর্য হইয়া দেখিলাম, কবি নজরুল কয়েকজন শিষ্যসহ আমাদের বাড়িতে উঠিবার ইচ্ছা করিলেন। কবির সঙ্গে কমিউনিস্ট কর্মী আবদুল হালিম, গায়ক মণীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও আর একজন যুবক ছিলেন। আমি কবিকে আনন্দে আমাদের বাড়ি লইয়া আসিলাম। রান্নার দেরি ছিল। কবিকে আমাদের নদীতীরে বাঁশবনের ছায়াতলে মাদুর পাতিয়া বসিতে দিলাম। তখন বড়পদ্মা আমাদের বাড়ির পাশ দিয়া প্রবাহিত হইত। এখন চর পড়িয়া পদ্মা অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু একটি ছোট্ট নদীরেখা এখনও আমাদের বাড়ির পাশ দিয়া প্রবাহিত হয়।
কবির হাতে একখণ্ড কাগজ দিয়া বলিলাম, “কবিভাই, আপনি একটা কিছু লিখে দিন।”
আধঘণ্টার মধ্যে কবি একটি অপূর্ব কবিতা লিখিয়া ফেলিলেন। কবিতাটি হারাইয়া ফেলিয়াছি। সেজন্য মনে বড়ই অনুতাপ হয়। তার দুটি লাইন মনে আছে-
“আকাশেতে একলা দোলে একাদশীর চাঁদ নদীর তীরে ডিঙিতরী পথিক-ধরা ফাঁদ।’
সন্ধ্যাবেলা নৌকা করিয়া কবিকে নদীর ওপারের চরে লইয়া গেলাম। সেখানে আমি একটি ইস্কুল খুলিয়াছিলাম। গ্রামের লোকেরা রাত্রিকালে আসিয়া সেই ইস্কুলে লেখাপড়া করিত। তারপর সকলে মিলিয়া গান গাহিত। মনে হইয়াছিল, এই গান যদি কবির ভালো লাগে তবে কবিকে এখানে বহু দিন ধরিয়া রাখিতে পারিব।
চলবে…..