০৮:৫৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
৫৪০ কোটি টাকার ‘মাদক অর্থ’ পাচারে অভিযুক্ত বিক্রম সিং মজিঠিয়া উনসানে সমুদ্র সৈকতের রিসোর্ট উদ্বোধন: পর্যটনে বাজি ধরছে উত্তর কোরিয়া ওএমএস ও টিসিবি ডিলার নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান এসএসসি টেস্টের দুই দিনে শ্রীলঙ্কার রাজত্ব রাসেল ভাইপারের হুমকি: শহরেও ঢুকছে বিপজ্জনক সাপ! মঙ্গল অভিযানের প্রস্তুতি: মহাকাশে পাঠানো হলো গাঁজা গাছের বীজ ২০২৫ সালের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ আইসল্যান্ড, শীর্ষ দশে সিঙ্গাপুর নৌকার বাংলাদেশ: জেলা-জেলা ঘিরে এক ইতিহাস ও সংস্কৃতি ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট বা পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কী? কীভাবে এটি করা হয়? নেতানিয়াহুর বিচার বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের

শতবর্ষের আলোকবর্তিকা: সুফিয়া কামাল—কবিতা, নারী-অধিকার, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল আন্দোলন

বাংলা সাহিত্য ও বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ইতিহাসের যে স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়গুলো আজও আলো জ্বেলে রাখে, কবি সুফিয়া কামালের জীবন ও কর্ম সেগুলোর কেন্দ্রে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে জন্ম নেওয়া এই কৃতী নারী ছিলেন একাধারে কবি, গল্পকার, সংগঠক, মানবাধিকারকর্মী, নারী-স্বাধীনতার অগ্রদূত এবং মুক্তিযুদ্ধের পরীক্ষিত সহযোদ্ধা। তাঁর দীর্ঘ জীবন (মৃত্যু – ২০ নভেম্বর ১৯৯৯) জুড়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিটি মুক্তিকামী সংগ্রাম—ভাষা-আন্দোলন, ঔপনিবেশিক শোষণবিরোধী আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম, নারী-সমঅধিকার, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধ ও স্বৈরতন্ত্র-প্রতিরোধ—সকল ক্ষেত্রেই তাঁর পদচিহ্ন অমোচনীয়ভাবে আঁকা রয়েছে।

সুফিয়া কামালের সাহিত্যিক বিশ্ব, বিশেষ করে কবিতা, ছিল মানবমুক্তি আর মানবরূপী সৌন্দর্যের বন্দনা; সমান্তরালভাবে তাঁর রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যাকরণ বুনে দিয়েছে অবদমিত কণ্ঠগুলোর জন্য উন্মুক্ত মঞ্চ। স্বতন্ত্র কাব্যভাষা, লোকঐতিহ্যনির্ভর চিত্রকল্প আর নিটোল মানবতাবাদ তাঁকে দাঁড় করিয়েছে আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান সারিতে; আর অগ্রণী নারী-অধিকারকর্মী হিসেবে তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের দুর্নিবার অনুঘটক হিসেবে।

শৈশব, শিক্ষাজীবন ও আত্মপ্রকাশের প্রারম্ভ

সমাজ-সাংস্কৃতিকভাবে রক্ষণশীল অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মেও সুফিয়া কামালের মানস গঠনে আবহমান বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি ও নিজস্ব কৌম কাহিনি ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ‌মা সাবেরা বেগম ছিলেন অশিক্ষিত, কিন্তু লোকগানের এক বিরাট ভাণ্ডার তাঁর কণ্ঠে ছিল; সেই লৌকিক শিল্পধারাই শৈশব-কৈশোরে সুফিয়ার কাব্যিক কল্পনাকে শাণিত করে। অন্যদিকে, মাতুলালয় থেকে আরবি ও ফার্সি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটনাক্রমে তাঁর শব্দভাণ্ডার ও আঙ্গিককে সমৃদ্ধ করে তোলে।

১৯২৪ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সে ‘সওগাত’ পত্রিকায় তাঁর ‘বাসন্তী’ নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়; একই সময়ে ‘মানসী’ ও অন্যান্য সাময়িকীতেও তাঁর কবিতা ছাপা হতে থাকে। স্কুল-কলেজের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল সীমিত, কিন্তু স্বশিক্ষিত পাঠাভ্যাস ও সাহিত্যপিপাসা তাঁকে দ্রুত এক স্বতন্ত্র কণ্ঠে রূপান্তরিত করে। ১৯৩২ সালে ‘কেয়ার কাঁটা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ তাঁকে সাহিত্যক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং এই তরুণীর কবিতা পড়ে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে “আগামী দিনের শ্রেষ্ঠ কবি” বলে আশীর্বাদ করেন।

সাহিত্যভুবন: কবিতার প্রকৃতি, রচনা-কৌশল ও বিষয়ভিত্তিক বৈশিষ্ট্য

প্রেম ও প্রকৃতি

সুফিয়া কামালের প্রারম্ভিক কবিতায় প্রকৃতি ও নারীর রূপসৌন্দর্য মিলেমিশে এক আভিজাত্যবিহীন, সহজলভ্য সৌন্দর্যেই উপস্থিত হয়। ‘মায়া’ বা ‘সাঁঝের গান’-এ দেখা যায় তারুণ্যের কোমল অনুভূতির সঙ্গে বিশুদ্ধ গ্রামীণ প্রকৃতির মেলবন্ধন। সূর্যাস্ত, নদীবাঁক, সাঁওতাল গ্রাম কিংবা বায়ুর দোল—সবই হয়ে ওঠে এক জীবনবাদী প্রেমের ইঙ্গিত।

মানবিক দ্রোহ ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধ

১৯৪৭-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পাকিস্তানি সামরিক দুঃশাসন, অসাম্য ও নারীবিদ্বেষী সমাজ তিনি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। ‘সালাম’ বা ‘আল্লাহু আকবর’ কবিতায় সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী প্রতিবাদ উঠেছে উদ্বেল ভাষায়। দ্রোহ আর মানবিক ঐক্যবোধ—এই দ্বৈত পাথেয় তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোকে আরও উজ্জ্বল করেছে, যেমন ‘দৌলত’ (১৯৪৮) কিংবা ‘সাঁঝের মায়া’ (১৯৬৯)।

সংগ্রামী চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধ

একাত্তরের ডায়েরি’ (প্রকাশ – ১৯৮১) এ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য দলিল, যেখানে কবি দিন-দিনের যুদ্ধাভিজ্ঞতা ও গণহত্যার বিভীষিকা লিপিবদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর লেখা কবিতা ও গদ্য আজও গবেষক ও ইতিহাসবিদদের প্রথমসারি প্রামাণ্য উপাদান।

ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ: প্রতিবাদী কণ্ঠের রাজনৈতিক অভিযাত্রা

ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব

১৯৪৮ থেকে ১৯৫২—উর্দুর একচ্ছত্র চাপিয়ে দেওয়া নীতির বিরুদ্ধে তিনি সরব হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের মিছিলে, সাহিত্যসভায়, ‘পাকিস্তান মহিলা সমিতি’র আলোচনায় তিনি প্রশ্ন তোলেন মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে। ১৯৫২-র ফেব্রুয়ারিতে শোকাহত শহীদ মিনারে তাঁর উপস্থিতি, শহীদ পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো এবং নারীদের মিছিলে আহ্বান—সেই সময়ের সামাজিক মানদণ্ড ভেঙে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

স্বাধিকার ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম

১৯৬২-র শিক্ষা-আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনে তাঁর কাব্যিক ভাষণ, সভা-সমাবেশে নেতৃত্ব এবং কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নামা—সবই তাঁকে “বাংলার জননী” অভিধায় ভূষিত করে। এ সময়ে তিনি ‘ধর্মঘট’-‘হরতাল’-এ নারীদের স্বতন্ত্র মিছিলে নেতৃত্ব দেন; নিরাপত্তা-ঝুঁকি উপেক্ষা করে ধর্ষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকেন।

মুক্তিযুদ্ধ ও ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ গণহত্যার রাতেই সেনাবাহিনী তাঁর বাড়ি ঘিরে ধরে; কিন্তু তিনি সপরিবারে শহর ছেড়ে যাননি, বরং ঢাকাতেই গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। তাঁর কবিতা, চিঠি ও গোপন বার্তা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এ পাঠ হতো, যা প্রেরণা জোগাতো যোদ্ধা ও উদ্বাস্তু নারী-শিশুদের। কলকাতায় ‘বাংলাদেশ নারী মুক্তি সংসদ’-এর সভায় তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তুলতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

নারী-অধিকার: সংগঠন, আন্দোলন ও নীতিনির্ধারণে ভূমিকা

পাকিস্তান মহিলা সমিতি

১৯৪৮-এ ‘পাকিস্তান মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সুফিয়া কামাল নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভোটাধিকার ও আইনি সুরক্ষার মৌলিক প্রশ্নগুলো রাষ্ট্র-সমাজের আলোচনায় আনেন। এই সংগঠনই পরবর্তীতে বাংলাদেশের নারী-জাগরণের ভিত্তি গড়ে তোলে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩-এ তাঁর নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ গঠিত হয়। নারীজীবনকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষণ, নারী-সহিংসতার বিরুদ্ধে আইন, পারিবারিক আইন সংস্কার—এসবই ছিল পরিষদের মূল এজেন্ডা। তিনি প্রায় দুই দশক পরিষদের সভাপতিত্ব করেন, ১৯৯০-র গণ-আন্দোলন পর্যন্ত।

ধর্ষণ ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দাবি

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি হানাদার ও দোসরদের যুদ্ধাপরাধ, বিশেষ করে ধর্ষণ ও যৌন-সন্ত্রাসের বিচারের দাবিতে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন সুফিয়া কামাল। ১৯৭২-এর ২৪ মে মহিলা পরিষদের জনসভায় ‘নারী নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল’ গঠনের প্রস্তাব তিনিই প্রথম উত্থাপন করেন।

সম্পাদনা, সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব

সীমানা’ ও ‘কণিকা’ পত্রিকা

১৯৫৬-তে তিনি ‘সীমানা’ পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন; সাময়িকীটি আধুনিকতাবাদ ও নারীবাদের সংযোগস্থল হয়ে ওঠে। ১৯৭৮-এ ‘কণিকা’ মাসিক প্রকাশনার মাধ্যমে তরুণ, বিশেষত নারী লেখকদের জন্য উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি করেন।

ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত-চর্চা

পাকিস্তানি সামরিক শাসন রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করলে, সুফিয়া কামাল ‘ছায়ানট’-কে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৬৭-তে ঢাকার রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখে রবীন্দ্র-গণসঙ্গীতের সুচনা করেন, যা আজও নববর্ষ-উদ্‌যাপনের অনুপম ঐতিহ্য।

কবিতা ও সমাজ-চিন্তার আন্তঃসম্পর্ক

সুফিয়া কামালের কাব্যে শব্দের কোমলতা আর বিদ্রোহের কঠোরতা পাশাপাশি হাঁটে; সমাজভাবনায়ও সাহিত্যিক সৌন্দর্য ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সমবাহিত হয়। ‘পরবাসী’ কবিতায় তিনি নারীর ‘পরবাস’ অবস্থান তুলে ধরেন—পিতৃঘর, স্বামীর ঘর, সমাজ থেকে রাষ্ট্র; তবু একই কবিতায় আত্ম-বিশ্বাসী মনন তাকে প্রতিবাদী নায়িকায় পরিণত করে।

কবি নিজেই বলেছেন, “আমি কবিতা লিখি বিপ্লবের শ্লোক হিসেবে, আবার বিপ্লবকে ভালবাসি কবিতার ছন্দে।” তাই তাঁর রচনায় নারীর ছেঁড়া শাড়ি, শহীদের রক্ত, দুরন্ত শৈশব—সবই অস্তিত্বমিশ্রিত। কবিতাকে তিনি কখনো নিছক রাজনৈতিক প্রচারপত্রে নামাননি; বরং মানবিক সৌন্দর্যের শিল্পরূপ দিয়েছেন, যা প্রান্তিক মঞ্চে গিয়েও দোলা দিয়েছে।

দার্শনিক ও নৈতিক অবস্থান: অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা ও সমতা

সুফিয়া কামালের সমগ্র জীবন ছিল অসাম্প্রদায়িক মানবিকতার পরীক্ষাগার। ১৯৪৬-এর দাঙ্গায় তিনি হিন্দু প্রতিবেশীদের নিজ হাতে নিরাপদে পৌঁছে দেন; ১৯৬৪-র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দমনে মশাল-মিছিল করেছেন। ধর্মীয় বিশ্বাসকে তিনি মানবিক মূল্যবোধের পরিপূরক হিসেবে নিয়েছিলেন, ধর্মের নামে নিপীড়নকে নষ্ট করেছিলেন।

যুদ্ধের পর ভিন্নমত দমন, সংবাদপত্রে সেন্সর আর নারী-নিগ্রহের ঘটনায় তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে স্মারকলিপি দেন। “স্বাধীন দেশে নাগরিকের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না”—এ কথা তিনি প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

পুরস্কার, স্বীকৃতি ও সমসাময়িক প্রতিকৃতি

  • বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২)— কবিতায় অবদান
    • একুশে পদক (১৯৭৬) — ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদান
    • স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৭) — জাতীয় জীবনে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান
    • জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতিপদক, মৈত্রী সম্মাননা, আনন্দ পুরস্কারসহ অসংখ্য দেশ-বিদেশি স্বীকৃতি

সমসাময়িকরা তাঁকে “মাতৃবন্দনা” নামে ডাকতেন। শামসুর রাহমান লিখেছেন, “তিনি শুধু কবি নন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মরমী স্বর।” অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, “সুফিয়া কামাল সাহিত্য ও সমাজ-রাজনীতির মেলবন্ধনের অনন্য প্রতিবিম্ব, যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মুক্তিকামী সবার প্রেরণা।”

প্রগতিশীল আন্দোলনে উত্তরাধিকার

ছাত্ররাজনীতি, শ্রমিক-আন্দোলন, গণতন্ত্র-আন্দোলন, জেন্ডার-সমতা—সবখানেই তাঁর তত্ত্ব ও আদর্শের ছায়া পড়ে। তাঁর ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’ গানটি ১৯৯০-এর স্বৈরতন্ত্র-বিরোধী আন্দোলনে নারীদের প্রধান স্লোগান ছিল। পরিবেশ-আন্দোলন, ছিন্নমূল শিশুদের অধিকার, প্রতিবন্ধী-সমতা—এসব ক্ষেত্রেও তাঁর মানবতাবাদী দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক।

উত্তরাধিকার ও প্রেরণা

সুফিয়া কামাল বাংলা ভাষার মানবিক জিজ্ঞাসা, নারীমুক্তির স্বপ্ন ও জাতির স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষার সজীব দলিল। তাঁর কবিতা মনে করিয়ে দেয়—শিল্প সৌন্দর্যের পাশাপাশি দায়ও বহন করে। তাঁর সমাজ-অংশগ্রহণ শেখায়—সুন্দর সমাজ নির্মাণে কলম ও পদযুগলের যুগলবন্দি জরুরি।

যখন বাংলাদেশ নারীর প্রতি সহিংসতা, মতপ্রকাশের সংকট, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও জলবায়ু ন্যায়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, তখন সুফিয়া কামালের জীবন ও সাহিত্য আমাদের সাহস, যুক্তি ও মানবিক অঙ্গীকারের দিশা দেয়। তাঁর পথরেখা আমাদের আশাহত হতে দেয় না; বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মকে জাগিয়ে তোলে—“জাগো নারী, জাগো মানব, জাগো স্বাধীন প্রগতি!”

প্রায় নয় দশকের পথ অতিক্রম করে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন এমন এক মানবিক প্রতীকে, যার কাছে কবিতা নিছক শখ নয়; ছিল নিপীড়িতের মুক্তির ধারাল অস্ত্র, আবার শিশুর চোখ মুছিয়ে দেওয়ার কোমল পাখনা। নারী-অধিকার থেকে উদার ধর্ম-সঙ্গীত, শোষণমুক্ত রাষ্ট্রগঠন থেকে প্রকৃতির সৌন্দর্য—সব চেতনাই তাঁর সৃজনী সাম্রাজ্যে ভাষার দীপ্যতা ও আন্দোলনের তপ্ত শিখা এনেছে।

তিনি দীপ্ত অঙ্গীকারের গীতিনায়ক, স্বাধীনতার বংশীবাদক, নবজাগরণের কাব্যিক বাগ্মী। তাঁর লেখা ও সংগ্রাম দেখায়—মানবসমাজের সত্যিকারের মুক্তি কেবল রাজনৈতিক বাঁধ ভাঙায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং নারী-সমঅধিকার, অসাম্প্রদায়িক মানবিকতা এবং সৃজনী-স্বাধীনতার ভিত্তিতেও তা নিহিত।

ইতিহাসের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে, যখনই বাংলাদেশকে নতুন অন্ধকার গ্রাস করে, সে অন্ধকার ছিন্ন করতে শোনা যায় সুফিয়া কামালের কণ্ঠ—“মানুষের জন্যই আমার কবিতা, মানুষের মুক্তির জন্যই আমার সংগ্রাম।” সেই অমোঘ বার্তা আমাদের শিখিয়ে যায় আশাবাদী হতে, লড়তে ও ভালোবাসতে।

৫৪০ কোটি টাকার ‘মাদক অর্থ’ পাচারে অভিযুক্ত বিক্রম সিং মজিঠিয়া

শতবর্ষের আলোকবর্তিকা: সুফিয়া কামাল—কবিতা, নারী-অধিকার, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল আন্দোলন

০৮:০০:২০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫

বাংলা সাহিত্য ও বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ইতিহাসের যে স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়গুলো আজও আলো জ্বেলে রাখে, কবি সুফিয়া কামালের জীবন ও কর্ম সেগুলোর কেন্দ্রে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে জন্ম নেওয়া এই কৃতী নারী ছিলেন একাধারে কবি, গল্পকার, সংগঠক, মানবাধিকারকর্মী, নারী-স্বাধীনতার অগ্রদূত এবং মুক্তিযুদ্ধের পরীক্ষিত সহযোদ্ধা। তাঁর দীর্ঘ জীবন (মৃত্যু – ২০ নভেম্বর ১৯৯৯) জুড়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিটি মুক্তিকামী সংগ্রাম—ভাষা-আন্দোলন, ঔপনিবেশিক শোষণবিরোধী আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম, নারী-সমঅধিকার, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধ ও স্বৈরতন্ত্র-প্রতিরোধ—সকল ক্ষেত্রেই তাঁর পদচিহ্ন অমোচনীয়ভাবে আঁকা রয়েছে।

সুফিয়া কামালের সাহিত্যিক বিশ্ব, বিশেষ করে কবিতা, ছিল মানবমুক্তি আর মানবরূপী সৌন্দর্যের বন্দনা; সমান্তরালভাবে তাঁর রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যাকরণ বুনে দিয়েছে অবদমিত কণ্ঠগুলোর জন্য উন্মুক্ত মঞ্চ। স্বতন্ত্র কাব্যভাষা, লোকঐতিহ্যনির্ভর চিত্রকল্প আর নিটোল মানবতাবাদ তাঁকে দাঁড় করিয়েছে আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান সারিতে; আর অগ্রণী নারী-অধিকারকর্মী হিসেবে তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের দুর্নিবার অনুঘটক হিসেবে।

শৈশব, শিক্ষাজীবন ও আত্মপ্রকাশের প্রারম্ভ

সমাজ-সাংস্কৃতিকভাবে রক্ষণশীল অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মেও সুফিয়া কামালের মানস গঠনে আবহমান বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি ও নিজস্ব কৌম কাহিনি ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ‌মা সাবেরা বেগম ছিলেন অশিক্ষিত, কিন্তু লোকগানের এক বিরাট ভাণ্ডার তাঁর কণ্ঠে ছিল; সেই লৌকিক শিল্পধারাই শৈশব-কৈশোরে সুফিয়ার কাব্যিক কল্পনাকে শাণিত করে। অন্যদিকে, মাতুলালয় থেকে আরবি ও ফার্সি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটনাক্রমে তাঁর শব্দভাণ্ডার ও আঙ্গিককে সমৃদ্ধ করে তোলে।

১৯২৪ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সে ‘সওগাত’ পত্রিকায় তাঁর ‘বাসন্তী’ নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়; একই সময়ে ‘মানসী’ ও অন্যান্য সাময়িকীতেও তাঁর কবিতা ছাপা হতে থাকে। স্কুল-কলেজের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল সীমিত, কিন্তু স্বশিক্ষিত পাঠাভ্যাস ও সাহিত্যপিপাসা তাঁকে দ্রুত এক স্বতন্ত্র কণ্ঠে রূপান্তরিত করে। ১৯৩২ সালে ‘কেয়ার কাঁটা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ তাঁকে সাহিত্যক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং এই তরুণীর কবিতা পড়ে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে “আগামী দিনের শ্রেষ্ঠ কবি” বলে আশীর্বাদ করেন।

সাহিত্যভুবন: কবিতার প্রকৃতি, রচনা-কৌশল ও বিষয়ভিত্তিক বৈশিষ্ট্য

প্রেম ও প্রকৃতি

সুফিয়া কামালের প্রারম্ভিক কবিতায় প্রকৃতি ও নারীর রূপসৌন্দর্য মিলেমিশে এক আভিজাত্যবিহীন, সহজলভ্য সৌন্দর্যেই উপস্থিত হয়। ‘মায়া’ বা ‘সাঁঝের গান’-এ দেখা যায় তারুণ্যের কোমল অনুভূতির সঙ্গে বিশুদ্ধ গ্রামীণ প্রকৃতির মেলবন্ধন। সূর্যাস্ত, নদীবাঁক, সাঁওতাল গ্রাম কিংবা বায়ুর দোল—সবই হয়ে ওঠে এক জীবনবাদী প্রেমের ইঙ্গিত।

মানবিক দ্রোহ ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধ

১৯৪৭-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পাকিস্তানি সামরিক দুঃশাসন, অসাম্য ও নারীবিদ্বেষী সমাজ তিনি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। ‘সালাম’ বা ‘আল্লাহু আকবর’ কবিতায় সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী প্রতিবাদ উঠেছে উদ্বেল ভাষায়। দ্রোহ আর মানবিক ঐক্যবোধ—এই দ্বৈত পাথেয় তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোকে আরও উজ্জ্বল করেছে, যেমন ‘দৌলত’ (১৯৪৮) কিংবা ‘সাঁঝের মায়া’ (১৯৬৯)।

সংগ্রামী চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধ

একাত্তরের ডায়েরি’ (প্রকাশ – ১৯৮১) এ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য দলিল, যেখানে কবি দিন-দিনের যুদ্ধাভিজ্ঞতা ও গণহত্যার বিভীষিকা লিপিবদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর লেখা কবিতা ও গদ্য আজও গবেষক ও ইতিহাসবিদদের প্রথমসারি প্রামাণ্য উপাদান।

ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ: প্রতিবাদী কণ্ঠের রাজনৈতিক অভিযাত্রা

ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব

১৯৪৮ থেকে ১৯৫২—উর্দুর একচ্ছত্র চাপিয়ে দেওয়া নীতির বিরুদ্ধে তিনি সরব হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের মিছিলে, সাহিত্যসভায়, ‘পাকিস্তান মহিলা সমিতি’র আলোচনায় তিনি প্রশ্ন তোলেন মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে। ১৯৫২-র ফেব্রুয়ারিতে শোকাহত শহীদ মিনারে তাঁর উপস্থিতি, শহীদ পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো এবং নারীদের মিছিলে আহ্বান—সেই সময়ের সামাজিক মানদণ্ড ভেঙে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

স্বাধিকার ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম

১৯৬২-র শিক্ষা-আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনে তাঁর কাব্যিক ভাষণ, সভা-সমাবেশে নেতৃত্ব এবং কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নামা—সবই তাঁকে “বাংলার জননী” অভিধায় ভূষিত করে। এ সময়ে তিনি ‘ধর্মঘট’-‘হরতাল’-এ নারীদের স্বতন্ত্র মিছিলে নেতৃত্ব দেন; নিরাপত্তা-ঝুঁকি উপেক্ষা করে ধর্ষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকেন।

মুক্তিযুদ্ধ ও ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ গণহত্যার রাতেই সেনাবাহিনী তাঁর বাড়ি ঘিরে ধরে; কিন্তু তিনি সপরিবারে শহর ছেড়ে যাননি, বরং ঢাকাতেই গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। তাঁর কবিতা, চিঠি ও গোপন বার্তা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এ পাঠ হতো, যা প্রেরণা জোগাতো যোদ্ধা ও উদ্বাস্তু নারী-শিশুদের। কলকাতায় ‘বাংলাদেশ নারী মুক্তি সংসদ’-এর সভায় তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তুলতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

নারী-অধিকার: সংগঠন, আন্দোলন ও নীতিনির্ধারণে ভূমিকা

পাকিস্তান মহিলা সমিতি

১৯৪৮-এ ‘পাকিস্তান মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সুফিয়া কামাল নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভোটাধিকার ও আইনি সুরক্ষার মৌলিক প্রশ্নগুলো রাষ্ট্র-সমাজের আলোচনায় আনেন। এই সংগঠনই পরবর্তীতে বাংলাদেশের নারী-জাগরণের ভিত্তি গড়ে তোলে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩-এ তাঁর নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ গঠিত হয়। নারীজীবনকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষণ, নারী-সহিংসতার বিরুদ্ধে আইন, পারিবারিক আইন সংস্কার—এসবই ছিল পরিষদের মূল এজেন্ডা। তিনি প্রায় দুই দশক পরিষদের সভাপতিত্ব করেন, ১৯৯০-র গণ-আন্দোলন পর্যন্ত।

ধর্ষণ ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দাবি

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি হানাদার ও দোসরদের যুদ্ধাপরাধ, বিশেষ করে ধর্ষণ ও যৌন-সন্ত্রাসের বিচারের দাবিতে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন সুফিয়া কামাল। ১৯৭২-এর ২৪ মে মহিলা পরিষদের জনসভায় ‘নারী নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল’ গঠনের প্রস্তাব তিনিই প্রথম উত্থাপন করেন।

সম্পাদনা, সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব

সীমানা’ ও ‘কণিকা’ পত্রিকা

১৯৫৬-তে তিনি ‘সীমানা’ পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন; সাময়িকীটি আধুনিকতাবাদ ও নারীবাদের সংযোগস্থল হয়ে ওঠে। ১৯৭৮-এ ‘কণিকা’ মাসিক প্রকাশনার মাধ্যমে তরুণ, বিশেষত নারী লেখকদের জন্য উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি করেন।

ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত-চর্চা

পাকিস্তানি সামরিক শাসন রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করলে, সুফিয়া কামাল ‘ছায়ানট’-কে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৬৭-তে ঢাকার রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখে রবীন্দ্র-গণসঙ্গীতের সুচনা করেন, যা আজও নববর্ষ-উদ্‌যাপনের অনুপম ঐতিহ্য।

কবিতা ও সমাজ-চিন্তার আন্তঃসম্পর্ক

সুফিয়া কামালের কাব্যে শব্দের কোমলতা আর বিদ্রোহের কঠোরতা পাশাপাশি হাঁটে; সমাজভাবনায়ও সাহিত্যিক সৌন্দর্য ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সমবাহিত হয়। ‘পরবাসী’ কবিতায় তিনি নারীর ‘পরবাস’ অবস্থান তুলে ধরেন—পিতৃঘর, স্বামীর ঘর, সমাজ থেকে রাষ্ট্র; তবু একই কবিতায় আত্ম-বিশ্বাসী মনন তাকে প্রতিবাদী নায়িকায় পরিণত করে।

কবি নিজেই বলেছেন, “আমি কবিতা লিখি বিপ্লবের শ্লোক হিসেবে, আবার বিপ্লবকে ভালবাসি কবিতার ছন্দে।” তাই তাঁর রচনায় নারীর ছেঁড়া শাড়ি, শহীদের রক্ত, দুরন্ত শৈশব—সবই অস্তিত্বমিশ্রিত। কবিতাকে তিনি কখনো নিছক রাজনৈতিক প্রচারপত্রে নামাননি; বরং মানবিক সৌন্দর্যের শিল্পরূপ দিয়েছেন, যা প্রান্তিক মঞ্চে গিয়েও দোলা দিয়েছে।

দার্শনিক ও নৈতিক অবস্থান: অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা ও সমতা

সুফিয়া কামালের সমগ্র জীবন ছিল অসাম্প্রদায়িক মানবিকতার পরীক্ষাগার। ১৯৪৬-এর দাঙ্গায় তিনি হিন্দু প্রতিবেশীদের নিজ হাতে নিরাপদে পৌঁছে দেন; ১৯৬৪-র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দমনে মশাল-মিছিল করেছেন। ধর্মীয় বিশ্বাসকে তিনি মানবিক মূল্যবোধের পরিপূরক হিসেবে নিয়েছিলেন, ধর্মের নামে নিপীড়নকে নষ্ট করেছিলেন।

যুদ্ধের পর ভিন্নমত দমন, সংবাদপত্রে সেন্সর আর নারী-নিগ্রহের ঘটনায় তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে স্মারকলিপি দেন। “স্বাধীন দেশে নাগরিকের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না”—এ কথা তিনি প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

পুরস্কার, স্বীকৃতি ও সমসাময়িক প্রতিকৃতি

  • বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২)— কবিতায় অবদান
    • একুশে পদক (১৯৭৬) — ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদান
    • স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৭) — জাতীয় জীবনে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান
    • জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতিপদক, মৈত্রী সম্মাননা, আনন্দ পুরস্কারসহ অসংখ্য দেশ-বিদেশি স্বীকৃতি

সমসাময়িকরা তাঁকে “মাতৃবন্দনা” নামে ডাকতেন। শামসুর রাহমান লিখেছেন, “তিনি শুধু কবি নন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মরমী স্বর।” অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, “সুফিয়া কামাল সাহিত্য ও সমাজ-রাজনীতির মেলবন্ধনের অনন্য প্রতিবিম্ব, যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মুক্তিকামী সবার প্রেরণা।”

প্রগতিশীল আন্দোলনে উত্তরাধিকার

ছাত্ররাজনীতি, শ্রমিক-আন্দোলন, গণতন্ত্র-আন্দোলন, জেন্ডার-সমতা—সবখানেই তাঁর তত্ত্ব ও আদর্শের ছায়া পড়ে। তাঁর ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’ গানটি ১৯৯০-এর স্বৈরতন্ত্র-বিরোধী আন্দোলনে নারীদের প্রধান স্লোগান ছিল। পরিবেশ-আন্দোলন, ছিন্নমূল শিশুদের অধিকার, প্রতিবন্ধী-সমতা—এসব ক্ষেত্রেও তাঁর মানবতাবাদী দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক।

উত্তরাধিকার ও প্রেরণা

সুফিয়া কামাল বাংলা ভাষার মানবিক জিজ্ঞাসা, নারীমুক্তির স্বপ্ন ও জাতির স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষার সজীব দলিল। তাঁর কবিতা মনে করিয়ে দেয়—শিল্প সৌন্দর্যের পাশাপাশি দায়ও বহন করে। তাঁর সমাজ-অংশগ্রহণ শেখায়—সুন্দর সমাজ নির্মাণে কলম ও পদযুগলের যুগলবন্দি জরুরি।

যখন বাংলাদেশ নারীর প্রতি সহিংসতা, মতপ্রকাশের সংকট, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও জলবায়ু ন্যায়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, তখন সুফিয়া কামালের জীবন ও সাহিত্য আমাদের সাহস, যুক্তি ও মানবিক অঙ্গীকারের দিশা দেয়। তাঁর পথরেখা আমাদের আশাহত হতে দেয় না; বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মকে জাগিয়ে তোলে—“জাগো নারী, জাগো মানব, জাগো স্বাধীন প্রগতি!”

প্রায় নয় দশকের পথ অতিক্রম করে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন এমন এক মানবিক প্রতীকে, যার কাছে কবিতা নিছক শখ নয়; ছিল নিপীড়িতের মুক্তির ধারাল অস্ত্র, আবার শিশুর চোখ মুছিয়ে দেওয়ার কোমল পাখনা। নারী-অধিকার থেকে উদার ধর্ম-সঙ্গীত, শোষণমুক্ত রাষ্ট্রগঠন থেকে প্রকৃতির সৌন্দর্য—সব চেতনাই তাঁর সৃজনী সাম্রাজ্যে ভাষার দীপ্যতা ও আন্দোলনের তপ্ত শিখা এনেছে।

তিনি দীপ্ত অঙ্গীকারের গীতিনায়ক, স্বাধীনতার বংশীবাদক, নবজাগরণের কাব্যিক বাগ্মী। তাঁর লেখা ও সংগ্রাম দেখায়—মানবসমাজের সত্যিকারের মুক্তি কেবল রাজনৈতিক বাঁধ ভাঙায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং নারী-সমঅধিকার, অসাম্প্রদায়িক মানবিকতা এবং সৃজনী-স্বাধীনতার ভিত্তিতেও তা নিহিত।

ইতিহাসের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে, যখনই বাংলাদেশকে নতুন অন্ধকার গ্রাস করে, সে অন্ধকার ছিন্ন করতে শোনা যায় সুফিয়া কামালের কণ্ঠ—“মানুষের জন্যই আমার কবিতা, মানুষের মুক্তির জন্যই আমার সংগ্রাম।” সেই অমোঘ বার্তা আমাদের শিখিয়ে যায় আশাবাদী হতে, লড়তে ও ভালোবাসতে।