রণজিৎ সরকার
খবরটা শোনার পর থেকে রাশেদের মন ভীষণ বিষণ্ন। এমন খারাপ খবর শোনার জন্য ও প্রস্তুত ছিল না। কান্নায় রাশেদের দুচোখ দিয়ে অঝোরধারায় পানি ঝরছে। চোখের পানি ঝরে পড়ার কোনো পূর্বপ্রস্তুতি থাকে না। অথচ বৃষ্টির পানি পড়ার পূর্বপ্রস্তুতি থাকে। আকাশের কালো মেঘের পরিবেশ বলে দেয় একটু পর বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টির পানিতে ভেজার হাত থেকে বাঁচার জন্য কেউ কেউ আশ্রয় নেয়। আবার কেউ কেউ বৃষ্টিতে ভেজার জন্য দুুজন একসাথে ভিজবে বলে পুলকিত মন নিয়ে উদ্যানে অপেক্ষায় থাকে, যেমন অপেক্ষায় উড়ে বেড়ায় চাতকপাখি। কিন্তু রাশেদের এমন ঘটনা মেনে নেওয়ার জন্য কোনোরকমের প্রস্তুতি ছিল না। কোনো আশা পূরণের অপেক্ষায় ছিল না। রাশেদ বৃষ্টির মধ্যেই বাসা থেকে বের হতে বাধ্য হলো। ঘটনাস্থলে তাকে যেতেই হবে। কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি জ্যামে আটকে গেল। রাস্তার সাথে ডানপাশে একটা আমগাছ। আমগাছের দিকে তাকাল। আমগাছে অনেক মুকুল এসেছে। এক গাছে পাতা আর মুকুল একসাথে থাকলেও ওদের সম্পর্ক দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। এক মায়ের সন্তানের ভাইবোনের সম্পর্ক দীর্ঘ হয় কিন্তু গাছের পাতা-ফুলফলের সম্পর্ক হয় ক্ষণস্থায়ী। আজকের ঝড়বৃষ্টিতে আমগাছের মুকুল অনেক পড়ে গেছে। গাছের নিচে কিছু মুকুল মাটিতে পড়ে আছে। মুকুলগুলো ফল হয়ে ওদের জীবনের পূর্ণতা অর্জন করতে পারল না। অপূর্ণতার বেদনা নিয়ে মাটিতেই পড়ে আছে। রাশেদ মাটিতে পড়ে থাকা মুকুলগুলো দেখে ভাবছে, সব মুকুল আমে রূপান্তির হতে পারল না। নির্দিষ্ট সময়ে যার ঝরে যাওয়া সে ঝরে যাবেই, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমার জীবনের ফুল, মুকুল, ফল এত তাড়াতাড়ি ঝরে যাবে- মানতে পারছি না। আমার মুকুলসহ গাছটাই ঝরে গেল। আমি কী নিয়ে বাঁচব। সারা জীবন চোখের পানি ফেলেও গাছকে আর জীবিত করা যাবে না। গাছের পাতাগুলোর মতো অসংখ্য ব্যক্তিগত স্মৃতির পাতা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। হৃদয়ের ভেতরে ভালোবাসার ছায়া দেওয়ার আশ্রয়ের বটবৃক্ষ চলে যাওয়ায় আমার হৃদয়টা আজ থেকে মরুভূমি হয়ে গেল। এই মরুভূমিতে আর কেউ আসবে না। যদিও অন্য কেউ শান্তির জন্য বৃষ্টির পানি হয়ে এলেও তাকে আর সঙ্গী হিসাবে স্থান দিতে পারব না।
রাশেদের পাশের সিটে বসা একজন বললেন, ‘ভাই, আপনি কি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর আত্মীয়স্বজনের কেউ? বসু বাবু তো প্রমাণ করেছেন গাছেরও প্রাণ আছে। গাড়ি জ্যামে পড়ার পর থেকেই আপনাকে দেখছি গভীর মনোযোগ দিয়ে গাছ দেখছেন। আর মাঝে মাঝে চোখের পানি ফেলছেন। আসল কাহিনি কী বলুন তো?’
লোকটার কথা শোনার পর রাশেদ ভাবছে, আসল কাহিনি বলব, নাকি মিথ্যা আশ্রয় নিয়ে বানিয়ে গল্প বলব। তার সাথে কি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সম্পর্কে আলোচনা করব। আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে, চোখের সামনে থেকে সবুজের সুন্দর পরিবেশ যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ রক্ষা করার জন্য সচেতনমূলক কথা বলব। এই যে বায়ুদূষণে ঢাকা শহর পৃথিবীর সেরা দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে স্থান অর্জন করেছে, পরপর কয়েক বার। এসব নিয়ে জনসচেতনতা নিয়েও তো আলোচনা করা যায়।
রাশেদের ভাবনার জগতের সিদ্ধান্ত শেষ হয়নি তখনই লোকটা বললেন, ‘ভাই, আপনি মনে হয় খুবই টেনশনে আছেন। আপনার সাথে কথা বলছি, আপনি উত্তর দিচ্ছেন না। আপনি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছেন। তবে সত্যি যদি টেনশনে থাকেন, তাহলে চুপচাপ না থেকে আমার সাথে কথা বলুন। দেখবেন আকাশের ঝড়ের কালো মেঘ কেটে গেলে যেমন পরিষ্কার আকাশ দেখা যায় ঠিক তেমনি আপনি কষ্ট ও বেদনার কথা শেয়ার করলে আপনার মনের কালো মেঘ কেটে যাবে। আপনি স্বস্তি পাবেন।’
রাশেদ জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আপনি ভালো কথা বলেছেন। তবে মনে হচ্ছে আপনি মনোবিজ্ঞানের বই কম পড়েছেন। মানুষের চেহারার অবস্থা দেখলেই তো মানুষের মনের অবস্থা বোঝা যায়। বিশেষ করে আয়নাতে নিজের চেহারা দিনে এক-দুইবার দেখেন নিশ্চয়। তখন তো নিজের চেহারা আর মনের অবস্থা বুঝতে পারেন।’
‘দুটোর কোনোটাই করি না। মনোবিজ্ঞানের বই কেন, কোনো বই-ই পড়া হয় না। মোবাইল ফোনে কত রকমের কত কিছু দেখে মজা পাই, তাই আর বই পড়ার সময় পাই না। আয়নাতে নিজের চেহারা দেখি না। নিজের চেহারা ভালো না! তাই দেখি না। তবে শোনেন। আমার বউ সুন্দরী। সে দিনে-রাতে কতবার যে আয়নাতে নিজের মুখ দেখে ঘরের আয়নায়, বাথরুমের আয়নায়। তবে বউ কিন্তু বই পড়ে। তাকে বই পড়ার অভ্যাস অবশ্য আমি করিনি। করেছেন তার এক লেখক বন্ধু। তিনি আমার বউয়ের প্রিয় লেখক।’
লোকটার বউয়ের কথা শোনার পর রাশেদের বউয়ের কথা খুবই মনে পড়ছে।
লোকটি বললেন, ‘কি, কথা বলছেন না কেন? কোনো কথা শুনে মন আপনার বেশি খারাপ হয়ে গেল।’
কিছু সময় পর রাশেদ বলল, ‘আচ্ছা, আপনি তো শুধু বউয়ের প্রশংসা করলেন। বিয়ের কত বছর হলো। সন্তান আছে নিশ্চয়?’
লোকটি বলল, ‘বিয়ের এক বছর পূর্ণ হয়নি। দশ দিন বাকি আছে। সন্তানের কথা বললেন না। সন্তান এখনো তার মায়ের গর্ভে আছে। পাঁচ মাস চলছে। দোয়া করবেন তারা যেন ভালো থাকে।’
রাশেদ বলল, ‘তাই! আমার সন্তানও তো তার মায়ের গর্ভে। ছয় মাস চলছে।’
‘ও তাই!’
‘হ্যাঁ।’
এর মধ্যে একজন যাত্রী বলে উঠল- ‘এই যে ড্রাইভার সাহেব। একটু দেখেশুনে সতর্কতার সাথে জোরে চালান।’
ড্রাইভার বুদ্ধিমান। যাত্রীর সাথে কোনোরকমের কথা বললেন না। তখন হেলপার বলে উঠলেন, ‘ওই মিয়া, দেহেন না। গাড়ি জ্যামের ভেত্তর।’
‘ভীষণ তাড়া রে ভাই। আমার শাশুড়ি হাসপাতালে ভর্তি।’
‘প্রাইভেটকার নিয়েও তো তাড়াতাড়ি যেতে পারেন না। এখন চুপচাপ বসে থাকেন। শাশুড়ির জন্য দোয়া পড়েন।’
লোকটা সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দেখলেন, সামনে আর দুই পাশে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, লোকটা আর কিছু বললেন না। সিটের ওপর হাত রাখলেন, হাতের উপর মাথাটা রেখে চুপ মেরে গেলেন। এই গাড়ির ভেতর সবচেয়ে বেশি তাড়া রাশেদের কিন্তু কী আর করা, জ্যামের কাছে বড় অসহায়। মনের কাছে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করছে, মানবজনম এমন কেন। সবারই ফেরার তাড়া। রাশেদ ভারি অস্থির হয়ে যাচ্ছে। ওর মনটা কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছে না। তার ডান পাশের সামনের সিটে একজন বৃদ্ধ আরাম করে ঘুমাচ্ছেন। চশমাটা চুলের ভেতর। গাড়ির ঝাঁকুনিতে মাঝে মাঝে মাথাটা এদিক-ওদিক নড়েচড়ে। কিন্তু চোখে মেলে না। লোকটাকে দেখে নিজেকে একটু হলেও স্থির করার চেষ্টা করল। আবার চিন্তা করল। তিনি কি ঘুমের কারণে গন্তব্য ছেড়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছেন না তো! ডাক দেবে কি দেবে না। ভাবছে। একটু পর রাশেদ নগরের সচেতন নাগরিক হিসাবে একজন যাত্রী হয়ে অন্য একজন যাত্রীর ভালোর জন্য দায়িত্ব নিয়ে বলল, ‘চাচা, ও চাচা। ঘুমিয়ে গেছেন।’
বৃদ্ধ লোকটা চোখ বন্ধ অবস্থায় বললেন, ‘আমি জানি আপনি এখন বলবেন, কোথায় নামবেন। বাসস্ট্যান্ড কি ছেড়ে চলে গেলেন। গাড়ির গন্তব্য যেখানে শেষ। আমিও সেখানেই নামব। কনডাকটার আমাকে চেনে। আমি এই গাড়ির নিয়মিত যাত্রী। ঘুমিয়ে গেলেও কনডাকটার আমাকে নামিয়ে দেবেন।’
রাশেদ ভদ্রতার সাথে বলল, ‘সরি চাচা, আপনার ঘুমের ডিস্টার্ব করার জন্য।’
‘সরি বলবেন না। আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। এই দায়িত্বটা কয়জন পালন করেন বলেন?’
‘সবাই আসলে সব দায়িত্ব পালন করতে পারে না।’
‘তা ঠিক।’
‘চাচা, আপনি এখন ঘুমান। আপনার শরীর মনে হয় খারাপ। ঘুমালে ভালো লাগবে।’
‘ঠিক আছে।’ এই বলে চাচা সামনের সিটে হাত দুটো রেখে হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন।
রাশেদ তার মোবাইল ফোনটা বের করে দেখে অসংখ্যা কল এসেছে। কিন্তু মোবাইল ফোনটার সাইলেস মুডে কখন চাপ লেগেছে বুঝতে পারেনি, তাই কলের শব্দ হয়নি। রাশেদ একে একে কল ব্যাক করে বলল, ‘এখনো ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারিনি। রাস্তায় জ্যাম। আরও সময় লাগবে।’
একজন মহিলা যাত্রী কিছু সময় ধরে বাসে উঠে দাঁড়িয়ে আছেন। রাশেদের নড়াচড়া দেখে তিনি মনে করেছেন, এই বুঝি রাশেদ গাড়ি থেকে নামবে। তার সিটে তিনি গিয়ে বসবেন। কিন্তু রাশেদ যখন মোবাইল ফোনে কথা বললেন, কথাগুলো শোনার পর মহিলা যাত্রীটি কথা বলার সুযোগ পেয়ে বললেন, ‘আপনি মনে হয় খুবই টেনশনে আছেন। আপনার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে।’
রাশেদ মহিলাটির দিকে তাকাল। এত সময় তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। টের পাইনি। এমনকি তাকে সম্মান করে কেউ যে সিটে বসতে দেবে, তাও কেউ করেনি। রাশেদ মহিলাটির পেটের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল গর্ভবতী। তাই সাথে সাথে সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বলল, ‘আপা, আপনি বসেন। আপনার বসার দরকার। আমি সামনের বাসস্ট্যান্ডে নেমে যাব।’
মহিলাটি বললেন, ‘না না আপনার বসা দরকার। আপনি মনে হয় সত্যি টেনশনে আছেন। চোখ-মুখ দেখে কেউ না বুঝতে পারলেও আমি বুঝতে পারছি।’
রাশেদ কোনো উত্তর না দিয়ে হঠাৎ ভাবছে, নারী জাতি তো মায়ের জাতি। তাই হয়তো সন্তানের সব দুঃখ-কষ্টের অনুভূতি যেমন মা সবার আগে বুঝতে পারে। আজ আমার বেদনার কথাটা মা আগে বুঝতে পারতে এবং আমি তাকে সবার আগে দুসংবাদটা দিয়ে হালকা হতাম। মা পৃথিবীতে নেই। কিন্তু পথে মা জাতির একজন আমার মনের অনুভূতি বুঝতে পেরেছেন।
মহিলাটি আবার বললেন, ‘আপনি মনে হয় কিছু ভাবছেন। আপনার সিটে বসেন।’
‘আপনি বসেন। আমি তো একটু পর নেমে যাব।’
‘প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। আপনার অস্থিরতার কারণ হিসাবে সত্যি কথাটা জানতে পারলাম না।’
‘সব পরিবেশে সব সময় ব্যক্তিজীবনের কিছু কথা বলতে হয় না।’
‘আপনি পুরুষ মানুষ হিসাবে গোপন কথা গোপন রাখতে পারবেন জানি। আমি একজন নারী হিসাবে কিছু কথা গোপন রাখতে পারি না। কারণ আমি অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি। নারীরা গোপন কথা সহজে গোপন রাখতে পারে না। আপনার যদি কষ্টের গোপন কথা হয়, তাহলে দোয়া করি। আপনার মানসিক শক্তি বেড়ে যাক। বিপদে সব সময় ধৈর্য ধারণ করে চলবেন আর বেশি কথা বলবেন না। তাহলেই পরবর্তীধাপে সফল হতে পারবেন।’
রাশেদ মহিলাটির কথা শুনে ভাবছে, তিনি তো মায়ের মতো কথা বলছেন। মা যেমন সন্তানের মনের সব খবর অনুভূতিতে বুঝতে পারেন। এই মহিলা কি বুঝতে পেরেছেন আমার ঘটনা? তিনি কি আমার মৃত মা! আমার বিপদে জীবিত হয়ে সন্তানকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য গাড়িতে উঠেছেন? রাশেদ আর কিছু বলল না। গাড়ি চলছে। এমন সময় হেলপার বললেন, ‘ব্যাংক কলোনি, ব্যাংক কলোনি, ব্যাংক কলোনিতে নামেন।’
হেলপারের কথা শুনে রাশেদ ওই মহিলাকে বললেন, ‘আপনি আমার মায়ের মতো কথাগুলো বলেছেন। আমার মা জীবিত থাকলে এমন করেই হয়তো কথাগুলো বলতেন। আমাকে পরামর্শ ও সাহস জুগিয়েছেন। সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। বসেন। আমি নেমে যাব।’
‘ভালো থাকবেন। আপনার প্রতি আমার দোয়া থাকবে সব সময়।’
‘ধন্যবাদ।’
রাশেদ গাড়ি থেকে ব্যাংক কলোনিতে নেমে দেখে রাস্তার ডানপাশে মানুষের ভিড়। দুটি গাড়ি দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে। এগিয়ে যেতে যেতে সে কল দিল। সামনে থেকে একজন পুলিশ কল রিসিভ করে বললেন, ‘আপনি কি রাশেদ।’
রাশেদ বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘সড়ক দুর্ঘটনায় আপনার স্ত্রী আহত হয়েছেন। ওই যে হাসপাতাল দেখা যাচ্ছে, সেখানে যান। তিনি মৃত না জীবিত, ওখানে গেলেই বুঝতে পারবেন।’রাশেদ হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পেল অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর লাশ।
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
Leave a Reply