কাগজের বই থাকবে কি থাকবে না এ কোন বড় বিষয় নয়। মূল হলো বই। যেখানে দুই মলাটের ভেতর সংরক্ষিত থাকে মানুষের চিন্তা বা অভিজ্ঞতা- যার অপর নাম জ্ঞাননামক সম্পদ।
মানুষ ও অন্য জীবের জন্ম একই প্রক্রিয়ায়। বেড়ে ওঠা একই অবস্থানে। ক্রমে মানুষ আজ এ মানুষে পরিণত হয়েছে, পৃথিবীর সকল জীবের ওপর শুধু নয় প্রকৃতির ওপর রাজত্ব করছে একটি কারণেই, মানুষ তার অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানকে পরবর্তী জেনারেশানকে দিয়ে যেতে পারে। আর এ মানুষ তখন থেকেই শুরু করেছে যখন সে মনের ভাব প্রকাশ করার কোন না কোন এক ধরনের ভাষা তৈরি করেছে।
মুখে মুখে এ জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়েছে হাজার হাজার বছর। সেখানে অনেক কিছুই হারিয়ে যেতো। অনেক কিছুই বিকৃত, ক্ষয় বা বর্ধিত হতো। এই ঘাটতিটুকুও মানুষ উত্তরণ ঘটালো যখন সে পাথরে হোক, চামড়ায় হোক আর গাছের বাকলে বা পাতায় হোক লেখা শুরু করলো। সেই লেখা থেকে আজ বই।
এর পরে মনে হয় এই বই মানব সভ্যতার কী এবং কতটুকু তা আর বলার কোন প্রয়োজন থাকে না। শুধু এইটুকু বলা যায়, মানুষের জীবনে সবার ওপরে বই। তারপরে অন্যকিছু। কারণ, মানুষ, সভ্যতা এবং জ্ঞান এই তিনই শেষ সত্য। বাদবাকী সবই এক সময়ে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যায়। রুমির সময়ে পারস্যের রাজা বা সেনাপতি কে ছিলো আজ কেউ জানে না। তেমনি মোগল সম্রাটদের সকলের নাম আজ অধিকাংশ মানুষই জানে না। গালিবকে তার থেকে অনেক বেশি মানুষ জানে।
আর পৃথিবীর যে প্রকৃত পরিবর্তন, বাস্তবে যারা পৃথিবীর গেইম চেঞ্জার তারা মুনি বা জ্ঞানী কখনো বা বিশেষভাবে জ্ঞানী অর্থাৎ বিজ্ঞানী বা দার্শনিক। অন্যরা পৃথিবীতে কয়েক হাজার বছরও দাপটে তাদের অনুসারীদের রাখতে সমর্থ হবেন কিন্তু কোন মতেই তারা পৃথিবীর গেইম চেঞ্জার নন।
তাই পৃথিবীর পরিবর্তন বা উন্নয়ন হোক বা খন্ডিতভাবে কোন ভূখন্ডের বা কোন এক নৃগোষ্ঠীর উন্নয়ন হোক এর শেষ সত্য-উপাদান বই।
এখন যদি মনে করা হয়, দুই মলাটের মধ্যে অক্ষরের পর অক্ষর সাজানো থাকলেই তা বই হবে তা নয়। বই তাই যা মানুষের চিন্তার সকল দিককে এগিয়ে নেয়। এক এক ধরনের বই একেক দিক এগিয়ে নেবে এই চিরসত্য।
বাংলাদেশে এবার যখন আবার বই দিবস এসেছে সে সময়ে আমাদের জন্যে সব থেকে বড় সংবাদ হলো, এর মাত্র কয়েক মাস আগে রাজধানীর এককালের সমৃদ্ধ বই এর মার্কেট, নিউ মার্কেটের এ মুহূর্তের সব থেকে পুরাতন বুকশপ ‘জিনাত বুক হাউজ এন্ড সাপ্লাই’ বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলোও টিম টিম করে জ্বলছে।
দেশের জেলা শহরগুলোতে এখন থেকে তিন দশক আগেও যে সব রোডগুলো বুক শপে ভরা ছিলো সেখানে এখন অটোমোবাইল না হয় ফাস্ট ফুডের দোকান।
অন্যদিকে সরকার থেকে শুরু করে, দেশের বড় এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবি বইয়ের মার্কেট দেশীয় লেখকদের বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষপাতি। এটা ব্যবসায়িক চিন্তা, জাতীয়তাবাদী চিন্তা না জ্ঞানের চিন্তা তার কোন সঠিক ব্যাখা তাদের কাছে নেই। তবে যে জাতি জ্ঞান প্রবেশের ক্ষেত্রে দেয়াল তোলে বা যারা জ্ঞান প্রবেশের ক্ষেত্রে দেয়াল তোলার পক্ষে -তারা যে শুধু দেশের জিনাত বুক শপ বন্ধের কারণ তা নয়, তারা দেশের আগামী প্রজন্মের মনের অনেক বাতি নিভিয়ে দেবার কাজটিও সফলভাবে করছেন। কেন এ উন্মাদনা তা নিয়েও কোন ব্যাখা নেই। এমনকি এই বই দিবসে এ কথা লিখেও কোন লাভ নেই- বই কে উন্মুক্ত করা হোক। উল্লেখ করেও কি খুব বেশি লাভ হবে এই সত্য যে, নলেজ ক্যাপিটাল ছাড়া কোন মানব গোষ্ঠীই কখনই তার প্রকৃত উন্নয়নের পৌঁছাতে পারেনি।
অথচ এই নলেজ ক্যাপিটালকে বাধা দেয়া হয়, শুল্ক ক্যাপিটাল সংগ্রহের জন্যে। বাংলাদেশে বিদেশী বই প্রবেশে একের পর এক নানান ধরনের শুল্ক বসিয়েও বাংলাদেশ পায়, বছরে মাত্র ৩০ কোটি টাকা। অথচ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের আমলে ২০১৬ সালে এই শুল্ক একবারের জন্যে উঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। সে সময় হিসাব করা হয়েছিলো, এই ৩০ কোটি টাকা সরকার আয় না করলে বিদেশী বইয়ের দাম যা কমবে, এবং সাধারণ ছেলেমেয়েরা তার ফলে যে সংখ্যক বেশি বই পড়বে, ওই বই পড়ার ফলে পরবর্তী ১৫ বছরে দেড় লাখ কোটি টাকার নলেজ ক্যাপিটাল যোগ হবে দেশে। দুর্ভাগ্য হলো, সে চিন্তা হেরে যায় বৈশ্য চিন্তার ৩০ কোটি টাকার শুল্কের কাছে এক বছর পরেই।
তাই এ বই দিবসে কী আশা করা যেতে পারে! তারপরেও জীবনের ধর্মই হলো আশা করা। আর সে আশা হোক, আগামী বছর না হোক, অন্তত যত দ্রুত হোক শুভ বুদ্ধির জয় হোক। বইয়ের প্রাচীর তুলে দেয়া হোক। এমনকি সরকার দুই একটি রাস্তা ঘাট নির্মান বন্ধ রেখে বিদেশী ভালো বই, বর্তমান সময়ের নতুন নতুন চিন্তার রাজ্যের বই এর বাংলাদেশী এডিশানের কপিরাইট কিনে সুলভ মূল্যে শুধু মাত্র বাংলাদেশে বিক্রি’র সুযোগ সৃষ্টি করুক। আর কাগজের বইয়ের বাইরে, ই-বুক কেনার সকল বাধা উঠে যাক। কাগজের এবং ই- বুক উভয়েই মুক্ত হোক সব ধরনের শৃঙ্খল। যার যখন ইচ্ছে সে যেন সহজে পায় সেটা।
মুক্ত হোক জ্ঞান, খুলে যাক আপন প্রাঙ্গণের দরজা, জ্ঞানের বসুধাকে খন্ড ক্ষুদ্র না করে সে উদ্ভাসিত আলোয় বিশ্বায়নের যুগে একক বিশ্ব হিসেবেই সামনে এসে যেন দাঁড়ায়। যেন সেখানে ধ্বনিত হয়, আমি এসেছি আলো হাতে। প্রতিটি দিন শেষে অন্ধকার নামা যেমন নিয়ম, তেমনি মানুষের চিন্তায় প্রতি মুহূর্তে আলোর পাশাপাশি অন্ধকারও নামে। তাই দিন শেষে যেমন বাতি জ্বালাতে হয়, তেমনি মনের জন্যেও ওই উদাত্ত স্বর প্রয়োজন, আলো এসেছে। অর্থাৎ জ্ঞান বা বই এসেছে মানুষের সামনে।
Leave a Reply