ডঃ মহীউদ্দীন খান আলমগীর
৪ মার্চ ২০২১ এ বাংলাদেশ সরকারের ১ম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম জীবনের পরপারে চলে গেছেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনে ও জনগনের সেবায় নিবেদিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর ভূমিকায় তিনি তার নাম প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
হোসেন তৌফিক ইমাম ১৯৩৯ সালের ১৫ জানুয়ারী টাঙ্গাইল শহরে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা ও ১৯৫৪ এ পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ন হয়ে রাজশাহী কলেজ থেকে অর্থনীতিতে সম্মান সহ স্নাতক হন। এরপর ১৯৫৮ এ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে এম. এ ডিগ্রী অর্জন করেন। পরে তিনি রাজশাহী সরকারী কলেজে অর্থনীতির শিক্ষক হিসাবে কাজ করে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি) প্রতিযোগীতার ভিত্তিতে যোগ দেন। চাকুরীতে সময়কালীন তিনি ১৯৬৮ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের দূর্গ, লাহোরস্থ সিভিল সার্ভিস একাডেমীতে ২১ ফেব্রুয়ারীর সকালে ভাষা শহীদদের স্মরনে কালো ব্যাজ পরে ও খালি পায়ে তৌফিক ইমামের নেতৃত্বে সকল প্রশিক্ষনরত বাঙ্গালী অফিসাররা তাদের ক্লাসে উপস্থিত হয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য তুলে ধরেছিলেন।
১৯৬২ সালে তৌফিক ইমাম তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসাবে রাজশাহী জেলা প্রশাসনে সহকারী কমিশনারের পদে তারুন্যের প্রভা ও তৎপরতা নিয়ে সুনাম অর্জন করেন। এরপর তিনি নওগাঁ মহকুমার প্রশাসক হিসাবে যোগ দেন। আমি ১৯৬৬-৬৭ সালে তৎকালীন সিএসপির সদস্য হিসাবে নওগাঁর প্রশাসক বা এসডিও পদে কাজ করেছি। নওগাঁর যেখানে গিয়েছি সেখানে তার দক্ষতা ও সততার কথা শুনেছি, জনগনের হিতার্থে তার বিভিন্ন কর্মকান্ডের পরিচিতি পেয়ে একই সার্ভিসের সদস্য হিসাবে গর্ববোধ করেছি। ১৯৭১ এর উত্তাল মার্চ মাসে তিনি রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক পদে যোগ দেন। তার সাথে সেই সময় যোগ দিয়েছিলেন সিভিল সার্ভিসে আমাদের অন্য এক স্বনামধন্য সহকর্মী সৈয়দ আব্দুস সামাদ।
১৯৭১ এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়া স্বাধীনতার বার্তা তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩টি মহকুমা এখনকার বান্দরবন, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলাতে ছড়িয়ে দিতে থাকেন। সেই বছরের ৭ মার্চে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষিত বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষনা- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- হৃদয়ে ধারন করে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সিএসপি সমিতির পুরোধা মুজিবুল হকের সভাপতিত্বে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাধীনতার স্বপক্ষে সকল তৎপরতা শুরু করার আহব্বান ও নির্দেশ নিয়ে আমরা কজন সুশীল সেবক বিভিন্ন জেলায় কর্মরত জেলা প্রশাসকদের কাছে মুক্তি যুদ্ধের বানী পৌছে দেয়ার জন্য দায়িত্ব নেই। আমি তৎকালীন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক শামসুল হক (সিএসপি) ও নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল করিম (সিএসপি) এর সাথে দেখা ও আলোচনা করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আহব্বান পৌছে দিয়ে ১৭ মার্চ চট্টগ্রামে উপস্থিত হই। সেখানে আরেক সিএসপি সহকর্মী জেলা প্রশাসক মুস্তাফিজুর রহমানের বাসস্থানে এবং পরদিন আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকির বাংলোতে প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা ক্যাপটেন মনসুর আলীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতা আন্দোলনে জেলা প্রশাসকদের তরফ হতে যথাসম্ভব সকল সহযোগীতা ও সমর্থন দেয়ার আহব্বান তৌফিক ইমাম ও অন্যান্যদের কাছে পৌছে দেই। তৌফিক ইমাম ফিরে যেয়ে সেদিন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সংগ্রামস্থল হিসাবে পরিচালিত করতে থাকেন। মুষ্টিমেয় কতিপয় দেশদ্রোহী ব্যাতিত সেই জেলায় কর্মরত সকল সুশীল সেবক ও অফিসারবৃন্দ বিভিন্ন গোষ্টির জনতার সাথে মিশে স্বাধীনতার সংগ্রামে ব্রতী হন। অন্যান্যদের মধ্যে জেলার পুলিশ তত্ত্বাবধায়ক বজলুর রহমান ও কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্বাহী শামসুদ্দিন জেলা প্রশাসক তৌফিক ইমামের নেতৃত্বে একাত্ম হয়ে যথা প্রয়োজন সংগঠন শক্তি প্রয়োগ করেন।
মে মাসে তিনি পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী ও তাদের দালালদের বিরুদ্বাচারনে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সব্রুম হয়ে আগরতলায় তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের নিয়ে চলে আসতে বাধ্য হন। এখানে ভারতীয় সুশীল প্রশাসন ও সৈন্য বাহিনীর সাথে ফলপ্রসূ সংযোগ স্থাপন করে তিনি ঐ এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ব্যুহ গড়ে তুলেন। তার সাথে দেশের পূর্বাঞ্চলে কর্মরত সহযোগীর ভূমিকায় থাকেন (পাকিস্তান) সিভিল সার্ভিসের কতিপয় উজ্জল নক্ষত্র, সৈয়দ আব্দুস সামাদ, আকবর আলী খান, ওয়ালিউর রহমান, খসরুজ্জামান চৌধুরী, প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের শামসুদ্দিন আহমেদ ও ফয়েজ আহমেদ এবং পুলিশ সার্ভিসের বজলুর রহমান ও শাহ এম এ মজিদ। এই সময়ে আগরতলা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আগত অন্যান্যদের মধ্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান ও আনিসুজ্জামানকে নিরাপদে স্বাধীন বাংলার স্বপক্ষে বাক ও বুদ্ধির যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরতে সুযোগ ও সহায়তা প্রসারিত করেন তৌফিক ইমাম। তার সহায়তায় নিরাপদে সে এলাকায় আশ্রয় নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অনুকূলে প্রচার ও সমর্থনমূলক তৎপরতায় ব্রতী হন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি মিজানুর রহমান চৌধুরী (চাঁদপুর), এম আর সিদ্দিকী (চট্টগ্রাম), খাজা আহমেদ (নোয়াখালী) এবং বিদ্রোহী সৈনিক মেজর রফিকুল ইসলাম (কুমিল্লা)। কবি আল মাহমুদ ও নির্মলেন্দু গুন, শিল্পী কামরুল হাসান ও শাহাবুদ্দিন, কন্ঠ শিল্পী আব্দুল জাব্বার, আপেল মাহমুদ ও সানজিদা খান তাদের লেখা ও কন্ঠ নিয়ে তৌফিক ইমামের সহযোগীতা ও সমর্থনে মুক্তিযুদ্ধকে সুদীপ্ত করার সুযোগ পান। তৌফিক ইমামের ব্যবস্থাপনা ও সহযোগীতায় স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারকে এই প্রেক্ষিতে ও লক্ষ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আগরতলায় আগমন উৎসারিত প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় সজ্জিত ও প্রয়োগ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চে প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী ১০ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুজিব নগরে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সরকার প্রতিষ্ঠা ঘোষনা করা হয়। জুন মাসের দিকে তওফিক ইমামকে কোলকাতায় নিয়ে এসে প্রবাসী এই সরকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসাবে পদায়িত করেন। তিনি অদম্য প্রশাসনিক নিপুনতা ও আনুগত্যবোধ নিয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত সরকারের কাঠামো স্থাপন, ভারত সরকারের সাথে সহযোগীতা প্রসারন এবং মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে সবল লোকবল ও যথাপ্রয়োজন অস্ত্র আহরনে নিরবিচ্ছিন্ন সাহসিক ভূমিকা পালন করেন। ভারতীয় পক্ষে বাংলাদেশ বিষয়ক অন্যতম নীতি নির্ধারক ডি পি ধর ও পি এন হাকসারের সাথে নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ও সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন তৌফিক ইমাম। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্যঃ এইচ.টি.ইমাম, বাংলাদেশ সরকার, ১৯৭১)।
১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকাতে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বাদি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে সুবিন্যস্থ করে ১৮ তারিখ তৌফিক ইমাম অন্যান্য কোলকাতায় কর্মরত সাবেক সিএসপি অফিসার নামত মূখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুস, সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের ও অর্থ সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান এবং পুলিশের মহাপরিচালক এম এ খালেক সহ ঢাকায় চলে আসেন। সেই দিনেই মন্ত্রিসভার বিশেষ জরুরী বৈঠকে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের আশু অনুসরনীয় ও করনীয় বিষয়ে কতিপয় গুরুত্বপূর্ন ও সুদুর প্রসারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২৩ শে ডিসেম্বর ঢাকায় আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার ১ম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে প্রধান প্রধান সিদ্ধান্ত ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দান, প্রাক্তন স্টেট ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক নামে নামকরন, সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মান এবং বিদ্যমান সকল পাটকল রাষ্ট্রয়াত্ব করন, সনাতন গভর্নমেন্ট হাউসকে ‘বঙ্গভবন’ নামে শিলায়িতকরন এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনকে জনসাধারনের গণতান্ত্রিক অধিকারের দ্যোতক ‘গণভবন’ নামে নতুন পরিচিতি প্রদান। ৭১ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর ঢাকায় নতুন মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহন অনুষ্ঠিত হয়। এই শপথ এবং এর সাথে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের শপথ বাক্য বাংলায় প্রনয়নে তৌফিক ইমামকে সহায়তা করেছিলাম আমি ও সহকর্মী আকবর আলী খান। জনাব ইমাম সহ এইসব শপথ বাক্যের যে মোসাবিদা আমরা করেছিলাম তা এখনও বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি (দ্রষ্টব্যঃ পূর্বোক্ত বাংলাদেশ সরকার, ১৯৭১, পৃঃ২৭৭)। তখন থেকে ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের অযুত কর্ম সমূহের আনুষ্ঠানিক গ্রহন ও সম্পাদনে প্রস্তাবক, কেন্দ্রীয় রেকর্ডরক্ষক ও বাস্তবায়নে সারথীর অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন তৌফিক ইমাম। এই সময়ে নব প্রতিষ্ঠিত সরকার সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়নীয় ও অনুসরনীয় যত সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন তত সিদ্ধান্ত ভিন্নতর দেশে কোন সরকার এত অল্প সময়ে গ্রহন করেছে বলে দেশের প্রশাসনিক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়না।
ইতিহাসের নির্মম পরিহাস স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব তৌফিক ইমাম বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পর ১৯৭৫ সালের সেই প্রতিক্রিয়াশীল সেনা চক্রের নির্দেশে সেই বছরের ২৬ আগষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশেই চাকুরীচ্যুত ও কারারুদ্ধ হন। তাকে সেই অশুভ চক্র নানা রকম বাহানা দিয়ে ১৯৭৬ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত কারারুদ্ধ রাখে। উল্লেখ্য ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে যে প্রকোষ্টে তাকে অন্তরীন রাখা হয়েছিল সেখানে পরে ২০০৭ সালে সামরিক শক্তিতে আসীন তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাকেও মিথ্যা মামলায় অবরুদ্ধ রেখেছিল। ৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাজউদ্দীন আহমেদ সহ ৪ জাতীয় নেতাকে নির্মম ভাবে হত্যার রাতে তৌফিক ইমাম কারাগারের সেই প্রকোষ্টে থেকেই দুঃসহ হত্যার নারকীয়তা অনুভব করেছিলেন। ঐ বছরের শেষ দিকে তার বিরুদ্ধে নির্লজ্জ ভাবে সামরিক আদালতে ২টি দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়। দুটি মামলাতেই তৌফিক ইমাম নির্দোষ প্রমানিত হন। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদ অসদাচারনের অভিযোগ এনে প্রশাসনিক বিভাগীয় মামলা চালু করেন। ১৯৭৬ সালে সেই বিভাগীয় মামলায়ও তাকে স্বসম্মানে মুক্তি দেন তদন্ত কর্মকর্তা সৎ ও নিষ্ঠাবান বোরহানউদ্দীন আহমেদ (১৯৫০ সালের সিএসপি)। তথাপিও তৎকালে নিযুক্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব পাকিস্তান পন্থী সফিউল আজম (১৯৪৯ সালের সিএসপি) তাকে কোন পদে নিযুক্তি না দিয়ে অপমানিত ভাবে বিশেষ কাজে নিযুক্ত কর্মকর্তা হিসাবে চাকুরীতে অন্তর্ভূক্ত রাখেন। পরে তাকে প্রশাসনিক ষ্টাফ কলেজ এর প্রকল্প পরিচালক হিসাবে সচিব থেকে নিন্মতর পদে পদায়িত করা হয়। তিনি পদত্যাগ না করে দেশের সরকারে থাকা তার অধিকার হিসাবে বিবেচনা করে অর্পিত দায়িত্ব প্রতিবাদহীন ভাবে পালন করেন এবং পুনঃবিন্যাস ও উন্নয়নের ভিত্তিতে জনপ্রশাসন ও প্রশিক্ষন কেন্দ্র নির্মান করেন। তার নির্মিত জনপ্রশাসন প্রশিক্ষন কেন্দ্রের পরিচালক সদস্য হিসাবে ১৯৯১ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরাগভাজন হয়ে আমিও পদায়িত হয়েছিলাম। বিদ্যমান সরকারের অসহযোগীতার পরিধিতে এই কেন্দ্রের গঠন ও বিন্যাশ আমাকে তৌফিক ইমামের কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচিতি তুলে ধরে মুগ্ধ করেছে। ১৯৮৪ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে এককালের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব তৌফিক ইমামকে সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে পদায়িত করা হয়। এই পদে থেকে তিনি নিপুনতার সাথে যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মান প্রকল্প প্রনয়ন ও তার অর্থায়নের জন্য সুব্যবস্থা করেন। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ না হওয়ার আগেই তাকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে বদলী করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের ১ম মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বিরুদ্ধে যে মিথ্যা ও অন্যায় পদক্ষেপ দেশের সামরিক ও তার উত্তরসূরী সরকার নিয়েছিল তা জাতির জন্য লজ্জাজনক। দেশের সুশীল প্রশাসনের তরফ হতে ও তৌফিক ইমামের প্রতি এই অবিচারের কোন প্রতিবাদ করা হয়নি। এর পরে ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহন করেন। অবসরে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন ২০০৮ সালে অবাধ মুক্ত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনি তাকে মন্ত্রির পদ মর্যাদা সহ জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। ২০১৪ তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মন্ত্রির মর্যাদা সহ রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করেন। উপরন্ত এই সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও দলীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো চেয়ারম্যান হিসাবে দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তেমনি নিপুনতা ও সংবেদনশীলতা নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। মনে আসে এই সময়ে একবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রি হিসাবে আমি যখন তার সাথে দেখা করতে চেয়েছি তিনি নিজেই আমার অফিসে আসতে চেয়েছিলেন। আমি অবশ্য তার কথা অমান্য করে তার অফিসে যেয়েই তার সাথে দেখা করেছি, প্রথাগত ভাবে প্রবীনতর সহকর্মীর প্রতি যথাপ্রাপ্য সম্মান প্রদর্শন করেছি। ২০২১ এর ৪ মার্চ তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি সুচারু ও সফল ভাবে রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে নিষ্ঠা, সততা ও দেশ প্রেমের নজির রেখে যান। তিনি কাজের প্রখর চাপের মধ্যেও ৩টি বই লিখে গিয়েছেন ঃ (১) বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, আগামী প্রকাশনী, (২) বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫, হাক্কানী পাবলিশার্স, (৩) স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিক ভাবনা, জার্নিম্যান বুকস। তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামী, নিষ্ঠাবান ও নিপুন সহকর্মী হিসাবে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। তাকে মরনোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা জাতির জন্য লক্ষ্যানুগ হবে বলে আমি মনে করি।
লেখকঃ সাবেক সচিব ও প্রাক্তন সংসদ সদস্য।
Leave a Reply