সূচ্যগ্র আনন্দের ভার
নির্মলেন্দু গুণ
আমার অন্তর্লোক এখন অনাস্বাদিত
এবং অনির্বচনীয় আনন্দে পূর্ণ হয়েছে।
ভরাবর্ষায় বঙ্গের নদী যেরকম,
সকল পাপড়ি মেলে ফোটা গোলাপ
বা সরোবরে ফোটা নিশিপদ্ম যেরকম,
দশমমাসে আসন্নপ্রসবা মাতৃগর্ভ যেরকম;
আমার অবস্থা এখন তদ্রূপ।
আমি এখন পূর্ণব্রহ্ম।
পদ্মগর্ভে, প্রিয়সঙ্গমে সমাশক্ত।
জীবনের সকল অপূর্ণতা থেকে মুক্ত আমার অন্তর
এখন সূচ্যগ্র আনন্দের
একটি কণাও বহনে অক্ষম।
শব্দ
ফারুক মাহমুদ
নৈঃশব্দ্যের মুখরতা (মাঝে মাঝে) মন্দ কিছু নয়
জলের ঠোঁটের হাসি, মাঠে মাঠে সবুজ হাওয়া
ভালো নয়- কোন মুখে বলি
যার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা আমার
কোনোকিছু না দেখার মতো
পিছনে তাকিয়ে একবার সেই মেয়ে যদি
দ্রুত চলে যায়
তার সে নিঃশব্দ চরণের ধ্বনি বুকে তুলে রাখি
তবে ‘শব্দ’ যে আমার অতিশয় প্রিয়
এ-কথা বলায় আমি মুখচোরা নই
শব্দ হচ্ছে অস্তিত্বের চাক্ষুষ প্রমাণ
শব্দ হচ্ছে ছন্দসুরে কবিতা ও গান
শব্দ হচ্ছে প্রকৃতির ঝলোমলো হাসি
শব্দ হচ্ছে উচ্ছ্বসিত আলো রাশি-রাশি
শব্দ হচ্ছে চলে যাওয়া, ফিরে চলে আসা
শব্দ হচ্ছে স্নেহপুণ্য প্রীতিভালোবাসা
দোষণের ঝুঁকি আছে, তবু আমি উঁচু-নিচু বহুবিধ শব্দ শুনতে চাই
একটি কঙ্কালের খোয়াবনামা
আবু জাফর খান
আজ সন্ধ্যায়—
আকাশে একটিও তারা নেই,
চাঁদের শরীরে খুব বেশি ক্ষত
ক্ষত আমার হৃৎপিণ্ডের লোহিত নিলয়েও!
যে নৌকা দিগভ্রান্ত
আমি তার মাঝি, বৈঠা নেই
বিপুল এই জলরাশির কোনখানে আমি—
ঠিক জানি না-পাড় খুঁজি!
‘আমায় ভাসাইলি রে আমায় ডুবাইলি রে…’
কে ভাসায় কেইবা ডোবায়, আমি তাও জানি না
আমি আসলে কিছুই জানি না
না কুল না শ্যাম, শুধু জানি শ্যামের বাঁশি—
গোপিনী গৃহত্যাগ করেছিল!
নৌকার ক্লান্ত পাটাতনে—
আমি চোখ বুঁজে থাকি, আমার খুব জলের পিপাসা
‘ওয়াটার ওয়াটার এভরিহয়ার, নর আ ড্রপ টু ড্রিংক…’!
এই কোলাজ পিপাসার জল—
অপার জলরাশির কোথাও নেই,
এই জল—
আসমুদ্র হিমাচলও দিতে পারে না,
আমি তাই কূল খুঁজি
খুঁজতে খুঁজতে একদিন কঙ্কাল হয়ে যাই
হৃথিবী রথের যাত্রী ২১
আনিফ রুবেদ
পৃথিবীর পকেট হাতড়ে হাতড়ে কয়েকটা ধাতব মুদ্রা বের করে নিয়ে আসলে বাজাতে বাজাতে দু’হাতের ভেতর। বললে- ‘চল এবার ঘর বাঁধি পৃথিবীর সমস্ত মানুষের সাথে। সাদা গোলাপ সাদা গোলাপ, লাল গোলাপ লাল গোলাপ, কালো গোলাপ কালো গোলাপই থাকবে। আমাদের পৃথিবীর ঘরে শান্তির ঘুম আর জেগে থাকা।’ গিরিবালা, তুমি ধাতব মুদ্রাকে ভেবেছ শান্তির চমৎকার দীপ জ্বালানোর তেল। পৃথিবীর অজস্র পকেট হাতড়ে হাতড়ে যদি শান্তিমুদ্রা বের করতে পারতে কিছু হতো হয়তো।
তুমি সূর্যের দিকে তাকাও আর মাটির দিকে তাকাও। এইসব গ্রীষ্মকালে বুঝতে পারবে রোদপুরুষ কেমন শুকিয়ে দেয় মাটির ঠোঁট চুষে চুষে আর ঘাসগুলো জ্বলছে আমাদেরই চুলার ভেতর। আগুনকে কখনো কাঁদতে দেখেছ? আগুন কখনো কাঁদে না কারণ আগুন কাঁদলে সে নিজেই নিভে যাবে যে নিজের অশ্রুতে।
জন্মান্ধ কলম
গিরীশ গৈরিক
একটি অন্ধকারের কবিতা লিখবো বলে
জন্মের পূর্বে ও মৃত্যুর পর থেকে বসে আছি।
যখনই সাদা খাতায় কালো কালিতে অন্ধকারের কবিতা লিখতে যাই-
তখনই সাদা খাতাজুড়ে আঁধার নেমে আসে
পৃথিবী অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
আমি কেমন করে-অন্ধকার খাতায়
কালো কালিতে রোপণ করব কবিতা!
আলো জন্মের বহু আগে থেকেই আমি অন্ধ
তবুও তোমরা কেউ কি আমায় একটি জন্মান্ধ আয়না দিবে?
আমি একটি অন্ধকারের কবিতা লিখবো।
শিকারবিদ্যা
হানযালা হান
রোদের দিকে তাকিয়ে চোখে বিভ্রম অথবা অনেক পথ ওড়ার পর না খেয়ে থাকার ক্লান্তি অথবা পূর্বপুরুষের শিকারবিদ্যা ভুলে সাদা বকের দুই ঠোঁট থেকে একটা মাছ পড়ে গেল;
ঘুঘুর চেয়েও চতুর কোনো ফাঁদ অথবা মিসরীয় রূপসীর কোনো পিরামিড অথবা মিথের দেবীর রতিবিদ্যা ভেবে আমরা রক্তে বাণ মেরে শিখে নিই নতুন কোনো জাদু;
একটা ভোমর ভনভন উড়ে চলে অথবা একটা ইঁদুর রাস্তা পার হয় অথবা চন্দ্রগ্রস্ত পৃথিবীর তাবৎ নারী মৃত নদীর মতো পড়ে থাকে।
কত জল
তন্ময় মণ্ডল
বয়ে যায়…
পাড় ভাঙে
বাঁধ ভাঙে…
বেঁচে থাকে, থাকার চেষ্টা করে
কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ছায়া
কত জল শুষে নেয় কালের প্রলেপ।
রঙ লাগে, ফিকে হয়
নিয়তিই শেষ কথা বলে
সময় সবটা জানে। ভেসে থাকা ডুবে থাকা সবই
আগুনের গান আসে, ছায়া পোড়ে
পুড়ে যায় নদীটির দুপাশের তীর
তবুও ক্ষণিক সুখে
নদীকে জীবন ভেবে
আগলে রাখে
কিছু ছায়ার শরীর…
অপ্রাপ্তি
কোলাপসেবল গেটের মতো আমার দ্বিখণ্ডিত মনকে
দু’দিক থেকে টানছে এক অদৃশ্য শক্তি
কষ্ট কীভাবে দুঃখ হয়ে ওঠে তা আমার জানা নেই…
তবে যখন মডার্ন বাসস্টপে কোনো ওড়না পরা যুবতীর মুখের আদল
বড্ড চেনা লাগে,
কেন যেন মনে হয়,
হেরে যাওয়া আর হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে যেমন বিস্তর ফারাক,
ঠিক তেমনি ছোঁয়া আর ছুঁয়ে থাকার মধ্যেও।
বছর দিয়ে আমি কখনও স্মৃতির বয়স মাপিনি অবন্তিকা,
যতবার স্মৃতিরা পলি হয়ে মিশে যেতে চায়
চোখের অতল গহ্বরে- মহানন্দায়;
ততবার আমি
ছোঁয়াকে ছুঁয়ে থাকা ভাবি
আর আমার নির্বাসিত দৃষ্টি এক অমোঘ প্রাপ্তি নিয়ে চেয়ে থাকে
অপ্রাপ্তির দিকে…
ঈশ্বরের মুখ
নাদিম মাহমুদ
তুমি আর খাবে কী? তুমিতো ঈশ্বরের মুখ!
দোটানায় পড়ে থাকা মনের অসুখ।
মায়ার উঠানে ছাদহীন খোলা আকাশ, যেখানে বৃষ্টি নেই সেখানে জলের উদ্ভট আত্মপ্রকাশ, মৃত মানুষ! চোখের জল শিশির বিন্দু হয়ে টলমল করে ঘাসের ডগায়, সেও এক জীবন, প্রথম ভোর, প্রথম ঘোর, প্রথম কুয়াশা।
যাকে চোখের পাতায় আগলে রেখে ভেবেছি ঘুমহীন বিশ্ব সংসার, আমার যতো দুঃখ, বেদনা, হতাশা, বিষাদ, যন্ত্রণা যে পৃথিবী আশ্রয় দিয়েছে তার চাইতে বড় নয়, এইরকম ব্যক্তিগত দুঃখ বড় হলে পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হয়।
এর জন্যেই তোমার কোন প্রতিশ্রুতি আমাকে টানেনি, আমাদের সবকিছু মৃত্যুর মতো জৈবশক্তিতে রুপান্তর করেছে সবুজ ঘাসে।
বাসস্টপ
মীর রবি
টিকাটুলি টু আর্মিটোলা, বাস নাম্বার আট, লোকাল প্যাসেঞ্জার, লং জ্যাম—সামার সিজনে লবণ রোদ লেপ্টে আছে আটোসাটো সিটে। একটু এগোলেই বাসস্টপ, না—স্টপওয়ে বলে কিছু নেই। চুপচাপ সিটি মেয়রের যাত্রী ছাউনি—ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে বসে আছে।
বাস থেকে নামতেই ছিঁড়ে যাওয়া স্যান্ডেল, মানিব্যাগের নো মানি—স্টপ স্টপ করছে প্যারা লাইফ প্র্যাকটিসে। বাসস্টপ হাসছে—পেটের ভেতর ঢুকছে আস্ত শুয়োর, সেদিকেই ছুটছে সমস্ত শহর।
Leave a Reply