সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৬:৪২ পূর্বাহ্ন

জাল (গোয়েন্দা উপন্যাস)

  • Update Time : রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৬.৩০ পিএম

আবু ইসহাক

 

আমার কথা

আমার প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য-দীর্ঘল বাড়ী’ লেখা শেষ হয় ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে। তারপর চার-চারটে বছর প্রকাশকের সন্ধানে কলকাতা ও ঢাকায় ঘোরাঘুরি করেও বইটির প্রকাশক পাইনি। হতাশ হয়ে ভাবলাম, ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখলে হয়তো প্রকাশক পাওয়া যাবে। কলম হাতে নিলাম। কিন্তু কী লিখবো? আমি পেশায় ডিটেকটিভ। এ ব্যাপারে আমার পেশাগত প্রশিক্ষণ ও পড়াশুনো আছে, আছে অপরাধ তদন্তের বাস্তব মালমসলা। তাই বিদেশী গোয়েন্দাকাহিনী নকল করে বা তার ছায়া অবলম্বন করে কিছু লেখার প্রশ্নই ওঠে না। তা’ ছাড়া অপরাধ তদন্তের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা নেই এমন কিছু লেখকের মতো আজগুবি ও অবাস্তব তদন্তকাহিনী পরিবেশন করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মালমসলা তো আছে প্রচুর, কিন্তু কোনটা লিখবো? ঠিক তখনই মনে পড়লো, ১৯৫০ সালে ‘জাল নোটে’র কয়েকটা মামলার তদন্তের ভার পড়েছিলো আমার ওপর। সেই অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করেই ‘জাল’ উপন্যাসটি রচিত।

১৯৫৪ সালে উপন্যাসটি লেখা শেষ করে পাণ্ডুলিপি তৈরি করছি, এমন সময় হঠাৎ ‘সূর্য-দীর্ঘল বাড়ী’ উপন্যাসের প্রকাশক পাওয়া গেলো। ১৯৫৫ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে উপন্যাসটি সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ যে সুখ্যাতি অর্জন করেছে তা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কায় তখন ডিটেকটিভ উপন্যাস প্রকাশ করা আমি মোটেই সমীচীন মনে করিনি। তাই আমার লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস ‘জাল’-এর পাণ্ডুলিপি বের করে আগাগোড়া পড়লাম এবং নতুন করে বুঝতে পারলাম, ‘জাল’ আমার সুনাম মোটেই ক্ষুণ্ণ করবে না, কারণ এটি একটি ভিন্ন স্বাদের উপন্যাস, গতানুগতিক ডিটেকটিভ উপন্যাস নয়। তা’ ছাড়া এর ভেতরে আছে অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে আমার উদ্ভাবিত কিছু মৌলিক পদ্ধতি।

উপন্যাসটি ১৯৮৮ সালে ‘আনন্দপত্র’ ঈদ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনার পর এটি গ্রন্থকারে প্রকাশিত হলো নসাস থেকে।

                                                                                                                            -আবু ইসহাক

 

ক্রিং ক্রিং ক্রিং

মিস্টার আলী রেজা রিসিভারটা তুলে নেন, হ্যালো…জ্বী। আস্সালামু আলায়কুম স্যার।… কেস সম্বন্ধে ?… কনফারেন্স? কি আলোচনা হলো স্যার? ….ও…হুঁ… হ্যাঁ, তাতো বটেই। দেশের জন্যে এ যে কত বড় দুর্বিপাক কিন্তু চেষ্টাতো আর কম করছি না স্যার।… গত সপ্তাহে? সব জেলার রিপোর্ট এখনো পাইনি স্যার। এ পর্যন্ত যে ক’টা পেয়েছি তার মধ্যে বরিশালে দশটা, রংপুরে চোদ্দটা, বগুড়ায় চারটে আর…আর ও হ্যাঁ, দিনাজপুরেও তিনটে কেস হয়েছে।… হ্যাঁ স্যার, বেড়েই চলেছে। যেন এপিডেমিক আর কি। ইন্সপেক্টরকে বগুড়া পাঠিয়েছি স্যার। ওখানকার পোস্টাপিসে মানিঅর্ডারের জন্যে আটখানা দশ টাকার জাল নোট দিতে গিয়ে ধরা পড়েছে একটা লোক। ওটারই তদন্তের জন্যে পাঠিয়েছি স্যার।…ও, হ্যাঁ… কাল? কখন আপনার সময় হবে স্যার? …আচ্ছা স্যার।

-আল্লাহ তুমিই মালিক’, বলতে বলতে রিসিভারটা নামিয়ে রাখেন মিস্টার আলী রেজা।

কলিং বেল টিপতেই আদালী এসে দাঁড়ায়।

-দ্যাখোতো ইলিয়াস সাহেব এসেছেন কি না? আর্দালী বেরিয়ে গেলে

বিরক্তির সাথে বলেন, গতকাল ফিরে আসার কথা ছিল। এদ্দিন কী সে করছে…।

-আসতে পারি স্যার?

-এই যে ইলিয়াস, এসো এসো। এই মাত্র তোমার নাম করছিলাম। অনেকদিন বাঁচবে। আল্লাহ মালিক। বসো। কখন এলে?

-এইতো তিনটের ট্রেনে। সুমুখের চেয়ারে বসে বলেন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর।

-এদিকে ব্যাপার কিন্তু বড় সাংঘাতিক। বড় সাহেব এই মাত্র ফোন করেছিলেন। হাফ-ইয়ারলি কনফারেন্সে নাকি আমাদের কেসের ব্যাপার নিয়ে তুমুল আলোচনা। কেউ কেউ নাকি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে এক্সপার্ট আনার কথা তুলেছিলেন। ভাবো দেখি, কি বদনামটা হবে তাহলে? হাত-পা ধুয়েমুছে বাড়ি গিয়ে বসেছিলাম দিলের ময়লা সাফ করার জন্যে। তা দু’-দু’টো বছর পরে ডেকে এনে আবার কাঁধে জোয়াল জুড়ে দিয়েছে। এখন বুড়ো বয়সে কপালে কালির ছাপ নিয়ে ফিরে যাই আর কি। আল্লাহ তুমিই মালিক।

-অতো ভাববেন না স্যার? আপনি বসে বসে আল্লার নাম নিন। দেখুন…. ইন্সপেক্টর বলেন।

-তুমি তো বলছো, ভাববেন না। কিন্তু…. মি. আলী রেজা মাথা চুলকান। মি. আলী রেজা এককালের ঝানু গোয়েন্দা। কার্যদক্ষতার জন্যে তিনি বহু রিওয়ার্ড পেয়েছিলেন। সেগুলো লিপিবদ্ধ করতে মূল সার্ভিসবুকের সাথে আরো দু’খানা সার্ভিসবুক জুড়তে হয়েছিল। তিনি কিংস মেডালও পেয়েছিলেন একদল দুর্ধর্ষ গ্যাং ডাকাত ধরে। এ অশেষ খ্যাতিই তাঁকে অবসর জীবন থেকে টেনে এনেছে স্পেশাল অফিসার করে, নোট জাল মামলার তদন্ত পরিচালনার জন্যে। কিন্তু তার এ জীবনসায়াহ্নে মধ্যাহ্নের ঔজ্জ্বল্য আছে বলে ইলিয়াসের মনে হয় না। পারলৌকিক চিন্তা তার পার্থিব বুদ্ধি-চাতুর্যকে ভোঁতা করে দিয়েছে যেন। এতোদিন তিনি অপরাধীর পেছনে লেগেছিলেন। এখন এ বুড়ো বয়সে যেন আজরাইল তাঁর পেছনে লেগেছে। মাথা চুলকে মিঃ আলী রেজা বলেন, কাল কাগজপত্র নিয়ে বড় সায়েব যেতে বলেছেন লাঞ্চের পর। তিনি দেখতে চান কতদূর কি হলো অর্থাৎ দীর্ঘ তিন মাস ধরে আমরা কি শুধু শুধুই মাইনে খেয়েছি, না কিছু করেছি।

-তিন মাস ছ’মাস নোট জালিয়াতি ডিটেকশনের পক্ষে কিছু নয় স্যার।

-যাক, এবার তোমার খবর বলো। কিছু সূত্র পেলে?

-কিছু না। যাকে ধরা হয়েছে সে এক বুড়ো স্বর্ণকার। কে যে কবে সোনা কিনে জাল নোট গছিয়ে গেছে তা সে বলতে পারে না। তার ক্যাশবাক্স তালাশ করে আরো চারখানা দশ টাকার জাল নোট পেয়েছি। আপনার কি মনে হয়, স্যার?

-আমারতো মনে হয় লোকটা নির্দোষ।

-আমারও তাই মনে হয়। লোকটা যদি সত্যি সত্যি জালিয়াত বা ‘আটারার’ হতো তবে সে পোস্টাপিসে জাল নোট মানিঅর্ডার করতে যাবে কেন? আর কোনো জালিয়াত বা আটারারই ক্যাশবাক্সে এভাবে জাল নোট রাখে না।

হুঁ।

-আর এটাও লক্ষ্য করার বিষয়-এ পর্যন্ত যে শ’চারেক লোক নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করলাম তার মধ্যে বাহাত্তরজন স্বর্ণকার আর এদের কাছেই পাঁচ- সাত-দশখানা করে চালিয়ে গেছে। শয়তানগুলো সোনা কেনার তালে আছে।

-হ্যাঁ, তাই। অন্য কিছু কিনে কি বোঝা বইবে নাকি?

-দশ টাকারটা কাপড়ের দোকানেও কিছু চালিয়েছে। হোটেলে আর সিগারেট ও মিষ্টির দোকানে পাঁচ টাকার নোট চালিয়েছে বেশি।

-আচ্ছা, লোকগুলো কি এতই বোকা যে আসল নকল চিনতে পারে না?

-স্যার, পাকিস্তানী নতুন নোট বেরিয়েছে ছ’মাস হলো। এখনো হাটে- বন্দরে ভালোভাবে চালু হয়নি। নোটে চাঁদ-তারা এ উর্দু হরফ দেখে তাদের মনে কোন সন্দেহই জাগে না। এ পর্যন্ত যত কেস হয়েছে তার শতকরা নব্বইটা হয়েছে রাজধানী থেকে দূরের জেলাগুলোতে। নিরক্ষর আর অল্প শিক্ষিত লোকেরাই ঠকেছে বেশি। আর ওদেরই বা দোষ দেব কি! ইন্ট্যাগলিও প্রসেসে করা জাল নোট চেনা খুব সোজা নয়তো স্যার। আসল নকল দেখে দেখে চোখ পেকে গেছে বলেই না আমাদের কাছে এতো সহজে ধরা পড়ে।

-লিথো, ফটোজিনকোগ্রাফি বা হাতে খোদাই ব্লকে করা জাল নোট চেনা

সহজ। বলেন স্যার।

ইলিয়াস ফাইল খুলে কয়েকখানা দশ টাকার জাল নোট বের করেন। স্পেশাল অফিসারের হাতে দিয়ে বলেন, বগুড়ার স্বর্ণকারের কাছে এগুলো পাওয়া গেছে। দেখুন স্যার, ইন্ট্যাগলিও প্রসেসে করা জাল নোট আসলের প্রায় কাছাকাছি যায়।

-আল্লাহ্ তুমিই মালিক, বলে হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেন স্পেশাল অফিসার। তারপর বলেন, এই দ্যাখো, এই নম্বরের নোট ডবল ডবল। আহম্মকগুলো কি নেওয়ার সময় দেখে নেয় না! এটুকুও বোঝে না ওরা যে, একই নম্বরের আসল নোট দু’টো থাকতে পারে না।

-সাধারণ লোক যারা ঠকে তারা বড় বেশি লেখাপড়া জানে না। আর যারা জানে তারাও নম্বর নিয়ে অত মাথা ঘামায় না। এবারে আরো একটা নতুন নম্বরের পাওয়া গেছে।

-তাই নাকি?

-হ্যাঁ, এটা নিয়ে মোট পাঁচটা হলো। এই পাঁচটা নম্বরই সারা ইস্টবেঙ্গলে চালানো হচ্ছে। পাঁচ টাকার নোটের মাত্র একটা নম্বর আমাদের হাতে এসেছে।

-আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না? আসল ও জাল নোটে যে পার্থক্য আছে, সেগুলো কাগজে ছাপিয়ে দিলে কেমন হয়?

-তা ভালোই হয় স্যার। তবে খুব বেশি লাভ হবে না। কারণ কাগজের খবর সাধারণ লোকের কাছে বড় পৌঁছায় না। তাঁর চেয়ে হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে প্রত্যেক থানায় পাঠিয়ে দিলে কিছু কাজ হতে পারে।

-তা দু’টোই করা যাক। আর গড়িমসি নয়। কাল বড় সায়েবের অনুমোদন নিয়ে খবরের কাগজে পাঠিয়ে দেয়া যাক। হ্যান্ডবিল পরে হবে। তুমি কাগজ- কলম নাও।

স্পেশাল অফিসার পকেট থেকে দশ টাকার একটা খাঁটি নোট বের করে জাল নোটের সাথে মিলাতে থাকেন। কিছুক্ষণ পরে বলেন, লেখো….এক. আসল নোটের কাগজ বেশ কড়কড়ে এবং শক্ত। জাল নোটের কাগজ অতোটা কড়কড়ে ও শক্ত নয়।

দুই. আসল নোটের অক্ষর ও সংখ্যাগুলো সমুন্নত অর্থাৎ উঁচু উঁচু ভাসা ভাসা মতন, হাত দিয়ে বেশ অনুভব করা যায়। কিন্তু জাল নোটের অক্ষর ও অঙ্কগুলো হাত দিয়ে অনুভব করা যায় না।

 

“দ….দ…. দয়ালরে তুই চি-চি…. চিনলিনারে হবে কি….কি উপায়….”দু’জনেই দরজার দিকে তাকান। মি. আলী রেজা দাঁড়িয়ে বলেন, আসুন হুজুর, আসুন। তিন-চার দিন ছিলেন কোথায়? তোতলা দরবেশ প্রবেশ করেন। তার মাথায় মি. আলী রেজার দেয়া কিশতি টুপি। চার-পাঁচ দিন আগে একটা পাজামা আর একটা কলিদার পাঞ্জাবীও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেগুলো তার পরিধানে নেই এখন। দরাজদিল মানুষ। কোনো ভিখিরিকে দিয়ে দিয়েছেন হয়তো। তার পরিধানে এখন আগেকার সেই সত্তর তালির জামা-পাজামা। আর সে তালিও লাগানো হয়েছে কাপড়ের রঙের সাথে মিলিয়ে নয়। লাল, নীল, সবুজ-সব রঙের কাপড়ই তালি হয়েছে।

তোতলা দরবেশ ইলিয়াসের পাশের চেয়ারে বসে পড়েন। তার হাতে একটা টগর ফুল। মি. আলী রেজার দিকে তাকিয়ে বলেন, এ….এ….এই দো…. দো…. দোজখের লাকড়ি।

“দ–দ–দয়ালরে তুই চি–চি–চিনলিনারে

হবে কি–কি–কি উপায়,

এ….এ….এই দ্যাখ না ফু….ফু…. ফুলের মাঝে

তা…. তা….তারে দেখা যায়।”

তোতলা দরবেশ মি. আলী রেজার দিকে ফুলটা ছুঁড়ে মারেন। মি. রেজা অপরিসীম ভক্তির সাথে ফুলটা কুড়িয়ে নিয়ে চুম্বন করেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন,-ও আল্লাহ্, সাড়ে চারটা বেজে গেছে। ইলিয়াস, তুমি ওটা লিখে খাড়া করো। আমি নামাজ পড়ে আসি। তোতলা দরবেশ চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছেন। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন।

ইলিয়াস আসল ও জাল নোট মিলিয়ে মিলিয়ে পার্থক্যগুলো লিখে চলেছেন। নামাজ পড়ে মিস্টার আলী রেজা যখন ফিরে আসেন তখন ইলিয়াসের লেখা শেষ হয়েছে।

তিনি বলেন, দেখুন স্যার এই লিখলাম-

-পড়ো। দরবেশের দিকে তাকিয়ে আবার বলেন, হুজুর ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?

ইলিয়াস পড়তে শুরু করেন-

তিন. সূক্ষ্ম রেখার বুনুনি আসল নোটে স্পষ্ট ও অবিচ্ছিন্ন। কিন্তু জাল নোটে সেগুলো অস্পষ্ট, কোথাও ভাঙা ভাঙা। আসল নোটের রেখাগুলো সূক্ষ্মতায় একই রকম। কিন্তু জাল নোটে রেখাগুলো কোথাও মোটা, কোথাও, চেকন আবার কোথাও কালি লেপটানো।

চার. আসল নোটে চাঁদ-তারায় শেড বা ছায়া বিদ্যমান। জাল নোটে সে রকম নেই। আসল নোটে চাঁদ ও তারার মধ্যবর্তী জায়গায় ছোট ছোট চক্র আছে। জাল নোটে সেরকম চক্র নেই।

পাঁচ. আসল নোটে উর্দুতে লেখা দশ রুপেয়া ও হুকুমতে পাকিস্তান-এ যে দাঁত দাঁত মতো শেড আছে, জাল নোটে সে রকম নেই।

ছয়. খাঁটি নোট কখনো একই নম্বরের দু’টো হতে পারে না। অপরদিকে ক্রমিক নম্বর দিয়ে নোট ছাপান জালিয়াতের পক্ষে সম্ভব নয়। একই নম্বরের একাধিক নোট পেলেই বুঝতে হবে সেগুলো জাল নোট।

-হ্যাঁ ঠিক আছে। আলী রেজা বলেন। -পাঁচ টাকা ও দশ টাকার জাল নোটের যে নম্বরগুলো আমরা পেয়েছি, সেগুলোও একই সাথে দিয়ে দাও। ওই নম্বরের নোট পেলেই যেন নোটদাতাকে পাকড়াও করে থানায় খবর দেয়।

তা দিয়ে দেব, স্যার। –

-হ্যাঁ, আর এক কথা। এই ক’মাসে আমরা কি করেছি তার একটা প্রগ্রেস রিপোর্ট আজ রাতের মধ্যে তৈরি করে ফেলবে। কাল বড় সায়েব হয়তো দেখতে চাইবেন। রিপোর্টের প্রথমে থাকবে-গত পাঁচ বছরে প্রদেশের বিভিন্ন জেল থেকে যে পাঁচ জন নোটজালকারী ও মুদ্রাজালকারী খালাস পেয়েছে তাদের নামধাম সংগ্রহ এবং তাদের বর্তমান কার্যকলাপ সম্বন্ধে আমাদের গোপন তদন্ত, তদন্তের সংক্ষিপ্ত ফলাফল প্রত্যেকটা নামের শেষে লিখতে হবে।

-যে দু’জন-আলীজান ও নির্মল জেল থেকে বেরিয়েই ফেরার হয়েছে, সেটা কি মন্তব্যের ঘরে লিখে দেব, স্যার?

হ্যাঁ, তা দিও। সি. আই. জি.১ তে ফেরারীর তালিকায় ওদের নামধাপ, চেহারার বর্ণনা ও ফটো ছাপা হয়েছে, সেটাও বাদ দিও না।

ইলিয়াস একটা কাগজে টুকে নেন।

মিস্টার আলী রেজা আবার বলেন, সি. আই. বি.২ থেকে একই মোডাস অপারেণ্ডির আরো যে দু’জন পুরনো পাপীর নামধাম সংগ্রহ করা হয়েছে তাদের কাজ-কারবার ও চলাফেরার ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ ও তার ফলাফল শেষের দিকে থাকবে। জাল নোটসহ যাদের ধরা হয়েছে তাদের ঘরবাড়ি তল্লাস ও জিজ্ঞাসাবাদের ফলাফল। এদের মধ্যে কেউ পুরনো দাগী কিনা তা খোঁজ করবার জন্যে ফিংগারপ্রিন্ট ব্যুরোতে টিপসই প্রেরণ।

-এসব কাগজ-কলমের তদন্তের রিপোর্ট দেখিয়ে কি বড় সায়েবকে খুশি করতে পারবেন, স্যার?

-তা পারব না জানি। তবে এর বেশি আর কী-ইবা দেখাতে পারি এখন!

-আমি একটা উপায়ের কথা চিন্তা করেছি, স্যার। এখনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌছতে পারিনি। পরে আপনাকে বলবো।

-তা বেশ। তোমরাই তো করবে। আমি বুড়ো মানুষ। এখন কি আর খোদার নাম ছাড়া মাথায় কিছু খেলে। তবে আমার কাছ থেকে যে কোনো সাহায্য, অবশ্য যদি আমার সাধ্যে থাকে, পাবে।

-এইতো চাই, স্যার। অনেক ধন্যবাদ।

-তোমাকে আর আটকাবো না। জার্নি করে এসেছো, বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। রাত্রে বসে প্রগ্রেস রিপোর্টটা লিখে ফেলো। দেখো, বেশি প্যাঁচালো যেন না নয়। অল্প কথায় শেষ করবে অথচ কোনো পয়েন্ট যেন বাদ না পড়ে।

-আচ্ছা স্যার চলি, আস্সালামু আলায়কুম।

-ওয়ালাইকুম আস্সালাম্।

প্রকাণ্ড অফিসবাড়িটার একটি মাত্র কক্ষে শুধু আলো জ্বলছে। দোতলার দক্ষিণ- পশ্চিম কোণের এই কক্ষে বসে কাজ করছেন ইলিয়াস। একজন আদালী

বারান্দার এক কোণে টুলের ওপর বসে ঝিমুচ্ছে।

১. ক্রিমিন্যাল ইনটেলিজেন্স গেজেট।

২. ক্রিমিন্যাল ইনভেসটিগেশান ব্যুরো।

-আল্লাবক্স।

ডাক শুনে আদালী ধড়ফড়িয়ে ওঠে। অফিস কক্ষে ঢুকে সে টেবিল থেকে ফাইল ও কাগজপত্র আলমারিতে তুলবার উদ্যোগ করে।

কিন্তু ইলিয়াস বাধা দেন, উহু, ওগুলো থাক।

রাত অনেক হলো স্যার। –

-তা হোক। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার বলেন, মাত্র আটটা, তুমি চলে যাও। যাবার সময় আবিদ সায়েবকে একটা খবর দিয়ে যেও। রাত দশটার স্টীমারে তার বরিশাল যাওয়ার কথা। আমার কথা বলো, আজ বরিশাল যাওয়ার দরকার নেই। তিনি যেন এক্ষুণি অফিসে চলে আসেন।

আর্দালী বেরিয়ে যায়। ইলিয়াস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। গুনগুন করর একটা সুর ভাজতে ভাজতে পশ্চিমদিকের দেয়ালের যেখানটায় সারি সারি মানচিত্র টাঙানো রয়েছে সেখানে এগিয়ে যান। রাজশাহী বিভাগের মানচিত্রটা খুব মনোযোগের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে দেখেন ইলিয়াস। তারপর ফিরে গিয়ে আবার কাগজপত্রের মধ্যে ডুবে যান। সাব-ইন্সপেক্টর আবিদ আসে নয়টার পরে। ইলিয়াস তাকে দেখেই বলেন, এই যে আবিদ, বরিশাল যাওয়ার দরকার নেই আজ। তোমাকে আগেই বলেছিলাম আটারারদের বের না করে জালিয়াতের সন্ধান পাওয়া একরকম অসম্ভব। তাই আটারারদের খোঁজে লেগে যেতে হবে সকলের আগে।

-কিন্তু আটারারগুলোকে বের করবো কেমন করে, তাইতো ভেবে পাচ্ছিনে। নতুন কিছু পেলে?

ইলিয়াস ও আবিদ দু’জনেই একসাথে সারদাহ্ ট্রেনিংয়ে ছিলেন। তাই উর্ধ্ব- অধঃ ভেদাভেদ করে কথা বলেন না কেউ। কোনো রকম মুরব্বিয়ানা তাদের মধ্যে অচল।

ইলিয়াস বলেন, পাইনি এখনো, তবে পাবো বলে আশা করি। তোমাকে আগেই একদিন দেখিয়েছিলাম, আটারার অন্ততঃ তিনজনের কম নয়। এই দ্যাখো, আজ আবার একটাকে আবিষ্কার করেছি। সমস্ত জেলার গত সপ্তাহের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখতে পাই, এই নভেম্বর মাসের আট তারিখে দিনাজপুরে দু’টো, নোয়াখালীতে একটা, সিলেটে একটা আর নয় তারিখে বরিশালে দু’টো কেস হয়েছে। দিনাজপুর, নোয়াখালী ও সিলেটে যারা জাল নোট চালিয়েছে তারা ভিন্ন ভিন্ন লোক এ-তো স্পষ্টই বোঝা যায়। এমনকি বরিশালের আটারারও এদের থেকে আলাদা। কারণ আট তারিখে দিনাজপুর, নোয়াখালী বা সিলেটে জাল নোট চালিয়ে ঐ তিনজনের কেউ একদিনের মধ্যে বরিশাল পৌঁছে জাল নোট চালাতে পারেই না।

-আটারার যে আট বা নয় তারিখেই জাল নোট চালিয়েছে তার কি কোনো প্রমাণ আছে। আটারার হয়তো এক মাস আগে চালিয়েছে। তারপর দশ হাত ঘুরে আট বা নয় তারিখে ধরা পড়েছে।

-উঁহু, দশ হাত ঘুরে তারপর ধরা পড়েছে এরকম কেসগুলো হিসেবের মধ্যে নিইনি। আটারার যাদের প্রত্যক্ষভাবে ঠকিয়েছে তাদের কেসগুলোই শুধু নিয়েছি। জাল নেট গছিয়ে যাবার পরে পরেই থানায় এসব কেসের এজাহার রেকর্ড করা হয়েছে। নোটগুলো আর দু’হাত হতে পারেনি। -দু’হাত হতে পারেনি, কেমন করে বুঝলে?

ইলিয়াস সাপ্তাহিক রিপোর্টের একটা ফাইল সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, যে কেসগুলো লাল দাগ দিয়ে রেখেছি তার দু’একটা পড়ে দ্যাখো, তাহলেই বুঝবে।

আবিদ একটা কেস বেছে নিয়ে স্থানীয় পুলিশের তদন্ত-বিবরণী পড়ে বিবরণীটা নিম্নরূপ-

ঘটনাস্থল: চরকাই, দিনাজপুর।

ঘটনার তারিখ: ৮.১১.১৯৪৯, বেলা ৯টা।

প্রতারিত মদনমোহন স্বর্ণবণিকের বয়স ষাটের উপরে। সে চোখে ভালো দেখিতে পায় না। ঘটনার দিন বেলা অনুমান নয়টার সময় একজন লোক তাহার সোনা-রূপার দোকান হইতে দশখানা গিনি কিনে এবং নতুন পাকিস্তানী নোটে উহার দাম চুকাইয়া চলিয়া যায়। এই সময়ে তাহার ক্যাশবাক্সে কোন নোট ছিল না। আধঘণ্টা পরে উক্ত স্বর্ণবণিকের ছেলে দোকানে আসে এবং নোটগুলি জাল বলিয়া চিনিতে পারিয়া থানায় খবর দেয়। বৃদ্ধ স্বর্ণবণিককে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া দুষ্কৃতকারীর চেহারার কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় নাই। তবে এইটুকু শুধু পাওয়া যায় যে তাহার পরিধানে প্যান্ট এবং হাতে চামড়ার হাতব্যাগ ছিল।

আবিদ ফাইল থেকে মাথা তুলে প্রশ্ন করে, -আচ্ছা, না হয় বুঝলাম, আটারারগুলো ভিন্ন ভিন্ন লোক। কিন্তু এটুকু জেনে আমাদের লাভটা কি শুনি?

-লাভ অনেক। শোনো বলছি। আমরা এ পর্যন্ত জাল দশটাকা নোটের পাঁচটা আর পাঁচটাকা নোটের একটা নম্বর পেয়েছি। সবগুলো আটারারই এ কয়টা নম্বরের নোট চালাচ্ছে। এখন আটারারগুলো যদি ভিন্ন ভিন্ন লোক হয় এবং তারা সবাই যদি একই নম্বরের নোট চালায় তবে কি বুঝতে হবে।

-বুঝতে হবে একই জালিয়াত কোম্পানীর সাথে সম্পর্ক আছে সকলের।

-এই তো ঠিক বুঝেছ।

-কিন্তু এটুকু বুঝে আমাদের কি সুবিধে হবে?

-হবে বন্ধু, হবে। বিভিন্ন জেলার আটারারগুলো যদি একই জালিয়াত কোম্পানীর জাল নোট চালায় তবে তাদের সাথে ঐ কোম্পানীর যোগাযোপ রাখার দরকার আছে নিশ্চয়ই। আর এতো দূরদূর থেকে রেল-স্টীমারে আসা যাওয়া করে যোগাযোগ রাখা সব সময়ে সম্ভব নয় নিশ্চয়ই।

-তা অবিশ্যি সম্ভব নয়।

-অতএব তাদের মধ্যে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান অবিশ্যি সম্ভব। আর তা যদি হয় তবে ওদের একটা চিঠি হাত করতে পারলেই….

-তুমি কি পাগল? সমুদ্র মন্থন করবে নাকি? সমস্ত দেশটার চিঠি ইনটারসেপশান? একি কখনো সম্ভব? নাম জানা নেই, ঠিকানা জানা নেই। অন্ততঃ একটা এলাকা জানা থাকলেও সম্ভব ছিল।

-হ্যাঁ, এই এলাকাই খুঁজে বার করতে হবে। অন্ততঃ একটা আটারারের আস্তানা কোন এলাকায় বের করতে পারলে অনুসন্ধান চালানো খুব কঠিন হবে না।

-কিন্তু এই এলাকাই খুঁজে বার করবে কেমন করে? একি সম্ভব?

-তোমার কাছে কিছুই সম্ভব নয়। ইউ আর অলওয়েজ এ পেসিমিন্ট। সম্ভব কিনা চেষ্টা করে দেখতে হবে তো। তোমাকে এ জন্যেই ডেকেছি। ঐ সে ম্যাপগুলো রয়েছে, ওর থেকে বরিশাল-খুলনা-ফরিদপুরের এক সঙ্গে একটা, দিনাজপুর-রংপুর-বগুড়ার একটা আর কুমিল্লা-নোয়াখালীর একটা-এই তিনটা খসড়া ম্যাপ তৈরি করতে হবে।

ইলিয়াস দেরাজ থেকে ট্রেসিং পেপার, পেন্সিল ও কাগজ বের করে আবিদের দিকে এগিয়ে দেন।

-ম্যাপ দিয়ে কি হবে? আবিদ জিজ্ঞেস করে।

-দেখি কিছু করা যায় কিনা। ম্যাপে আজে-বাজে কিছু থাকবে না। জেলার সীমারেখা, নদী, রেলপথ এবং আপাতত জেলা ও মহকুমা শহরগুলোর নাম, ব্যস। আমি এদিকে কতগুলো কেস তারিখ অনুযায়ী সাজিয়ে নিচ্ছি।

আবিদ দেয়াল থেকে মানচিত্র নামিয়ে টেবিলের ওপর রেখে নকল করতে শুরু করে। ইলিয়াস সাপ্তাহিক রিপোর্টের ফাইল নিয়ে বসেন। লাল পেন্সিলের চিহ্ন দেয়া কেসগুলো অর্থাৎ যেসব ক্ষেত্রে জাল নোট দ্বিতীয় হাতে যাওয়ার আগেই ধরা পড়েছে সেগুলোর একটা কালানুক্রমিক তালিকা প্রস্তুত করার কাজে মনোনিবেশ করেন।

বরিশাল-খুলনা-ফরিদপুরের মানচিত্র নিয়েও অনেকক্ষণ মাথা ঘামায় ইলিয়াস। কিন্তু এই দিককার জাল নোট চালানকারীর আস্তানার সঠিক এলাকা সম্বন্ধে কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেন না।

ইলিয়াস তারপর উত্তরাঞ্চলের সন্ধানে দিনাজপুর-রংপুর-বগুড়ার মানচিত্র নিয়ে বসেন। প্রথমে কালানুক্রমিক তালিকায় চালানকারীর এক একটা অপরাধযাত্রা ভাগ করে নেন। অপরাধযাত্রাগুলো ভাগ করতে মোটেই বেগ পেতে হয় না। দিনের পর দিন একাদিক্রমে অনেকগুলো ঘটনা ঘটার পর বেশ কিছুদিন আর কোন ঘটনা ঘটে না। তারপর আবার শুরু হয় ও কিছুদিন ধরে রোজ অন্ততঃ দু’-তিনটে করে ঘটনা ঘটে। এই দুই অপরাধযাত্রার মধ্যবর্তী সময়ের ঘটনাশূন্য দিনগুলো চালানকারীর বিশ্রামকাল, স্পষ্টই বোঝা যায়। চালানকারী যেখানে এ বিশ্রামকাল যাপন করে সেখানেই তার আস্তানা, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এ আস্তানা কোথায়, অন্ততঃ কোন এলাকায় এটা বের করাই সমস্যা।

ইলিয়াস অনাবশ্যকবোধে অপরাধীর কতগুলো অপরাধ অভিযান বাদ দিয়ে সুবিধে মতো পাঁচটা বেছে নেন। অভিযানগুলো এই-

ইলিয়াস তালিকানুযায়ী ঘটনস্থলগুলো খসড়া মানচিত্রের যথাস্থানে চিহ্নিত করে নাম লিখে নেন। সমস্ত ঘটনাস্থলগুলো জিলার মানচিত্রে নেই। মহকুমার মানচিত্র থেকে খুঁজে সেগুলোর অবস্থান নির্ণয় করা হয়। এবার ঘটনার তারিখগুলো ঘটনাস্থলের পাশে লিখে কালক্রমানুসারে ঘটনাস্থলগুলো লাইন টেনে যোগ করেন। লাইন টানার সময় তার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

কুমিল্লা-নোয়াখালীর ম্যাপ অঙ্কনরত আবিদ দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,- আশার আলো দেখতে পাচ্ছি যেন।

-দাঁড়াও, এক্ষুণি পেয়ে যাচ্ছি।

আবিদ উঠে এসে ম্যাপের দিকে ঝুঁকে পড়ে দেখে। লাইন টানা হয়ে গেলে ইলিয়াস বলেন, এই দ্যাখো, পাঁচটার মধ্যে কেবলমাত্র সেপ্টেম্বরেরটা পূর্ণচক্র অভিযান অর্থাৎ চালানকারী যেখান থেকে জাল নোট চালাতে শুরু করেছে, অনেক জায়গা ঘুরে প্রায় তার কাছাকাছি গিয়ে ক্ষান্ত হয়েছে। এতে কি মনে হয়, বল দেখি?

-মনে হয় চালানকারী আস্তানা থেকে বেরিয়ে আবার আস্তানায় ফিরে গেছে।

-এই তো মাথা খুলেছে। আস্তানা থেকে বেরিয়ে আস্তানায় ফেরার আরো প্রমাণ রয়েছে। অক্টোবর ও নভেম্বরেরটা যদিও পূর্ণচক্র অভিযান নয় তথাপি দ্যাখো, অক্টোবর মাসে কোথায় চিলমারি, ফুলছড়ি ঘুরে বাড়িমুখো অনেকদূর গিয়ে বামনডাঙ্গায় শেষ করেছে। ওদিকে আবার নভেম্বর অভিযানে শান্তাহার বগুড়া কাঁহা কাঁহা মুল্লুক ঘুরে বোনারপাড়া গিয়ে শেষ করেছে। দীর্ঘ দিন ধরে এ দু’টো অভিযানে অনেক জায়গায় ঘুরেছে বলে আমি আন্দাজ করছি, হয়তো জাল নোট ফুরিয়ে গিয়েছিলো। আর এই দু’টো অভিযানই রেলস্টেশনে শেষ হয়েছে বলে এটা অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে ট্রেনে করে চালানকারী নিজের আস্তানায় ফিরে গেছে। এর আরো প্রমাণ রয়েছে। বামনডাঙ্গায় যে কেসটা হয়েছে তার তদন্ত বিবরণী থেকে জানা যায়, চালানকারী উত্তরগামী ট্রেনের শেষের দিকের এক কামরায় বসেছিল। গাড়ি ছাড়ে ছাড়ে এমন সময় সে প্ল্যাটফর্মের পান- সিগারেটওয়ালার কাছ থেকে পাঁচ প্যাকেট ক্যাপস্টান সিগারেট কিনে একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বলে, কতো ফেরত পাবো দে, জলদি দে। গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়ি এর মধ্যে চলতে শুরু করেছে। সিগারেটওয়ালা নোটটা বুক পকেটে রেখে তাড়াতাড়ি পয়সা গুনে গাড়ির সাথে সাথে কিছুটা দৌড়ে খদ্দেরের পাওনা ফেরত দেয়। তারপর বুক পকেট থেকে নোটটা চোরাপকেটে রাখবার সময় দ্যাখে সেটা জাল। গাড়ি ততক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে।

আবিদ নির্বাক বিস্ময়ে শোনে এবং ম্যাপে চালানকারীর পরিক্রমণ পথের দিকে চোখ বুলাতে থাকে।

ইলিয়াস আবার বলেন,- আগষ্টের দু’টোই সংক্ষিপ্ত অভিযান। এই দু’টোতে অন্য কিছু পাওয়া যাক আর না যাক, চালানকারীর আস্তানা সম্বন্ধে আরো স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়।

-সে কি রকম?

-এই দ্যাখো। মিস্টার ইলিয়াস পেন্সিল হাতে নেন। সেপ্টেম্বরের পূর্ণচক্র অভিযানের শেষ ঘটনাস্থল নিসবতগঞ্জ এবং যে যে জায়গা থেকে অভিযান শুরু হয়েছে সে প্রথম ঘটনাস্থলগুলো অর্থাৎ নয়াহাট, মির্জাপুর, পুরা, ধলা ও নলতা রেখা টেনে যুক্ত করে বলেন, একটা ষড়ভুজ হয়েছে দ্যাখো। এই ষড়ভুজের মধ্যে কোনো না কোনো জায়গায় চালানকারীর আস্তানা।

-ষড়ভুজের মধ্যে রংপুর টাউন পড়েছে দেখছি। তাহলে রংপুরেই-

-হ্যাঁ, রংপুর টাউনেই চালানকারীকে পাওয়া সর্বসম্ভাবনা। আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, রংপুর টাউনে একটা জাল নোটের কেসও হয়নি। অপরাধীরা তাদের বাড়ির আশেপাশে কখনো অপরাধ করে না।

-ওহ্, সত্যি ইলিয়াস, তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়। সত্যি বলতে কি, বিরক্তির সাথে ম্যাপ আঁকছিলাম আর মনে মনে তোমার মুণ্ডুপাত করছিলাম। ভেবেছিলাম, সমস্ত পরিশ্রমটাই বুঝি মাঠে মারা যাবে। যাক, এবার চিঠি খুঁজে পেতে কষ্ট হবে না।

-হ্যাঁ, রংপুর হেডপোস্টাপিসে ইন্টারসেপশান চালালেই একরকম হয়ে যাবে। আমি কালই আলী রেজা সাহেবকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবো। ইন্টারসেপশানের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেলে আর একদিনও দেরি নয়। তোমাদের কয়েকজনকে চিঠি সেনশারের কাজে পাঠিয়ে দেবো। দেয়ালঘড়ি রাত তিনটে ঘোষণা করে। ইলিয়াস ও আবিদ বাসায় ফেরার জন্যে উঠে দাঁড়ান।

মসজিদ থেকে মাগরেবের নামাজ পড়ে মিঃ আলী রেজা বাসায় এসে দেখেন তোতলা দরবেশ বৈঠকখানায় বসে আছেন। সোফায় মাথা হেলান দিয়ে চোখ বুজে কিসের ধ্যান করছেন তিনি। তাঁর ধ্যান ভাঙতে সাহস হয় না মিঃ আলী রেজার। তিনি নিঃশব্দে একটা চেয়ারে বসে পড়েন। দরবেশ চোখ বুজেই গেয়ে ওঠেন-

“তো-তো-তোর চোখ নাই, কা-কাকান নাই,

না-না-নাইরে কিছু হায়-

দ-দ-দয়ালরে তুই চি-চি-চিনলি নারে

হ-হ হবে কি উপায়?

ও-ও-ওরে চো-চো-চো থাকিলে

র-রঙ বে-বেরঙে তারে দ্যাখা যায়।

জি-জি-জিত থা-থা থাকিলে

ফ-ফ-ফলের স্বাদের তারে বুঝা যায়।

ও-ও-ওরে কা-কা কান থাকিলে

পা-পা-পাখির গা-গা-গানে তারে জানা যায়,

না-না-নাক থা-থা-থাকিলে

ফুফু ফুলের গন্ধে তা তাতারে চিনা যায়।”

গান শুনে মিঃ আলী রেজার চোখ ছলছল করে ওঠে। তাঁর ধর্মভীরু বৃদ্ধ মনটি পারলৌকিক চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তিনি ভাবেন, খোদা পরম করুণাময়। তার মেহেরবানি না হলে তার মতো পাপীর ভাগ্যে কি এরকম একজন দরবেশের দেখা পাওয়া সম্ভব?

মাত্র কিছু দিন আগে দরবেশের দেখা পেয়েছেন মিঃ আলী রেজা। স্পেশাল অফিসার হয়ে পুনর্নিয়োগের মাসখানেক পরের ঘটনা। একদিন সকালবেলা বৈঠকখানায় বসে খবরের কাগজ দেখছিলেন তিনি। হঠাৎ পায়ের শব্দে মাথা তুলে দেখেন, একটা পাগল টেবিলের ওপর একটা টাকা রেখে চলে যাচ্ছে।

তিনি পাগলটাকে ডাকলেন, এই-এই-এই-শোনো-

কিন্তু পাগল ফিরেও তাকায় না।

তিনি আবার ডাকলেন, এই-এই শোনো-

কিন্তু কে শোনে কার ডাক?

তিনি চেয়ার ছেড়ে ওঠেন। দরজা পেরিয়ে গলি। গলিতে পাগলটাকে দেখতে না পেয়ে তিনি বড় রাস্তার দিকে ছুটে যান। রাস্তার এদিক-ওদিক তাকান স্তিমিত চোখের দৃষ্টি যতদূর যায়। কিন্তু বিচিত্র রঙের তালিযুক্ত জামা পরিহিত পাগলকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কি আশ্চর্য! মুহূর্তের মধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো যেন!

এর কয়েকদিন পরের একদিন। মিস্টার আলী রেজা রমনার রাস্তায় প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। এ-রাস্তা সে-রাস্তা ঘুরে বাসায় ফেরবার পথে রোজই একটা গাছের ছায়ায় সিমেন্টের বেঞ্চির ওপর বসে তিনি খানিকক্ষণ বিশ্রাম করেন। অন্যদিনের মতো সেদিনও সেখানে বসে তিনি একটা সিগারেট ধরান। অদূরের একটা আমগাছে যেন কাকের মেলা বসে গেছে। ভালো করে তাকাতেই তার চোখ বিস্ফারিত হয় বিস্ময়ে। সেদিনের সেই পাগলটা গাছের অনেকটা ওপরের একটা ডালে ঘোড়সওয়ারের মতো বসে কাকগুলোকে রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়াচ্ছে। হ্যাঁ, সে ছাড়া আর কেউ নয়। তার পরিধানে সেই বিচিত্র রঙের তালি-দেয়া জামা।

মিঃ আলী রেজা পকেটে হাত দিয়ে দেখেন, টাকাটা পকেটেই আছে। ক’দিন ধরে টাকাটা তার মনকে সর্বক্ষণ পীড়া দিচ্ছে। তিনি গাছের তলায় গিয়ে ডাকলেন, এই-এই-এই যে শোন-পাগল তার ডাক শুনেছে বলে মনে হলো না। তিনি আবার ডাকেন। বারবার ডেকে হয়রান হন, হাতজোড় করেন। কিন্তু পাগল ফিরেও তাকায় না। তার হাতে লম্বা সরু একটা গাছের ডাল। সে আপন মনে রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে ডালের আগায় বসিয়ে এগিয়ে ধরছে আর কাকগুলো সেখান থেকে তা কাড়াকাড়ি ঝাপটাঝাপটি করে নিয়ে উড়ে পালাচ্ছে।

মিঃ আলী রেজা গাছতলায় দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ পরে নিজের খুশিমতো নেমে এলো পাগল। টাকাটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, -এই যে তোমার টাকাটা।

মিঃ আলী রেজা পেছন থেকে পাগলের একটা হাত ধরে টাকাটা গুঁজে দেন তার হাতে। পাগল ছুঁড়ে ফেলে দেয় টাকাটা। তিনি আবার হাত ধরেন পাগলের, জিজ্ঞেস করেন, কেন দিয়েছিলে এ টাকা?

-ম-ম-মনে নাই? আ-আ-আমারে, দি-দি-দিছিলি? ছা-ছা- ছাড়, আ-আ-আমারে। তু-তু-তুই, দো-দো-দোজখের লা-লা- লাকড়ি।

মিঃ আলী রেজার মনে পড়ে না কবে এ পাগলকে তিনি টাকা দিয়েছিলেন। তার হাত ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কবে তোমাকে টাকা দিলাম আমি?

-ম-ম-মনে নাই? তি-তি-তিন, ব-ব-বচ্ছর আগে। তিন বছর আগে! কতো জনকেই তো দান-খয়রাত ফেতরা-যাকাত দিয়ে

থাকেন তিনি। কিন্তু কে আর মনে রাখে কাকে কবে কত দান করা হয়েছে। আর ফেরত পাওয়ার জন্যে তো কেউ দান করে না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,

-তিন বছর আগে কোথায় তোমাকে টাকা দিয়েছি?

-খু-খু-খুলনায়, মーম-মনে নাই?

তাইতো! তিন বছর আগে তিনি খুলনায়ই ছিলেন।

মিঃ আলী রেজা বিস্ময়ে হতবাক। টাকাটা মাটি থেকে তুলে তিনি দেখেন, পাগল অনেক দূর চলে গেছে। স্কুল ও বাতগ্রস্ত শরীর নিয়ে তিনি ছুটলেন তার পিছুপিছু। পাগল ততক্ষণে রাস্তার মোড় পর্যন্ত ঘুরে দক্ষিণমুখো রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। মিঃ আলী রেজা মোড় পর্যন্ত গিয়ে আর দেখতে পান না তাকে। অবাক কাণ্ড! এতো তাড়াতাড়ি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলো সে!

মিঃ আলী রেজা বুঝতে পারলেন, এ পাগল নয়, নিশ্চয়ই কোন কামেল দরবেশ। দুই-দুইবার দেখা পেয়েও তাঁকে ধরতে পারলেন না বলে তাঁর আফসোসের সীমা নেই। তিনি জীবনে অনেক পীরসাহেব, শাহসাহেব ধরে মুরীদ হয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও সত্যিকার কামেল লোকের সাক্ষাৎ পাননি। তাঁর মনে হয়েছে, পীর ও শাহসাহেবরা বিনে পুঁজিতে মোটা লাভের ব্যবসা ফেঁদে বসে আছেন। তিনি ঐ সব পীরসাহেব-শাহসাহেবদের বলে থাকেন, ‘মহাসম্মানিত পরভোজী প্রতারক।’

মিঃ আলী রেজা হয়তো আরো কিছু দিন হায়-আফসোস করতেন। কিন্তু তিনদিন পরে অপ্রত্যাশিতভাবে দরবেশ তাঁর বৈঠকখানায় এসে হাজির। সোজা তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে দরবেশ দুই হাত দিয়ে তাঁর দুই গালে মৃদু চপেটাঘাত করতে করতে বলেন,-কি-কি-কিরে দো-দো-দোজখের লাই চপেটাঘাত অ্যা-অ্যাতো আ-আ-আফসোস ক-ক-করছিলি কে-কে-কেনরে?

তো-তো-র দি-দি-দিলের আরজু অ-অ-অবহেলা করতে পা-পা- পারলাম না। তো-তো-তোর অ-অন্তরের ডাক আমি শুশু-শুনছি। মিঃ আলী রেজা খুশিতে টইটম্বুর। সত্যি সত্যি তাঁর অন্তরের ডাক শুনেছেন দরবেশ।

এরপর থেকে মাঝে মাঝেই মিঃ আলী রেজার বাসা ও অফিসে তোতলা দরবেশ তাঁর কৃপাদর্শন দিয়ে থাকেন।

দরবেশ গান গেয়েই চলেছেন-

দ-দ-দয়ালরে তুই চি-চি-চিনলি নারে হ-হবে কি উপায়?

ফফফ-ফলের মাঝে, ফু-ফু-ফুলের মাঝে তা-তারে দ্যাখা যায়।

ল-ল-লতার মাঝে, পা-পা-পাতার মাঝে তা-তা-তারে দ্যাখ্যা যায়। দরজা খোলার শব্দে আবেশ ভাঙে আলী রেজার। এই যে ইলিয়াস, এসো এসো। কখন এলে?

-এই তো বিকেলে এসেছি। পাশের একটা চেয়ারে বসেন ইন্সপেক্টর ইলিয়াস।

-খবর ভালো। চারদিক দেখে নিয়ে আবার বলেন, একটা অদ্ভুত চিঠি পাওয়া গেছে।

-অদ্ভুত চিঠি! দেখি দেখি?

ইলিয়াস পোর্টফলিও ব্যাগ থেকে চিঠি বের করে মিঃ আলী রেজার সামনে রাখেন। নিজেও ঝুঁকে পড়েন চিঠিটার ওপর।

-অরিজিন্যাল? মিঃ আলী রেজা জিজ্ঞেস করেন।

-না, হুবহু কপি।

-আরে! এ কেমন চিঠি!

-চিঠি কিনা বলতে পারবো না, ইনভেলাপের ভেতর একটা চিঠির সাথে পাওয়া গেছে। চিঠিটায় লেখা আছে ‘কামরূপ হইতে সংগ্রহ করিয়া সর্বরক্ষা তাবিজ পাঠাইলাম। রূপার মাদুলিতে পুরিয়া মাজায় বান্ধিও।’

-তবে আর কেন? এটা তাবিজই।

-কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে।

-আচ্ছা, চিঠি যদি হয় তবে কোন ভাষার অক্ষর এগুলো?

-এ রকম অক্ষর কোনো ভাষায় আছে বলে তো জানা নেই।

-তবে কি সাইফার।

-সাইফার বলেই মনে হয়।

-কী ফ্যাসাদ। পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেছো?

-না, মাত্র কালই রংপুর পোস্টাফিসে পেয়েছি। পেয়ে আর দেরি করিনি। পরের গাড়ি ধরেই চলে এসেছি।

মিস্টার আলী রেজা চিঠিটার ওপর চোখ বুলাতে বুলাতে বলেন,-এ কেমনতরো অক্ষর। তাসের চিড়িতন, ত্রিভুজ, আরে এই দ্যাখো আবার বক, হাঁস, ঘোড়ার মাথা। ভারী অদ্ভুত তো!

-হ্যাঁ, অদ্ভুতই বটে। হাতীর মাথা, বন্দুক অনেক কিছুই আছে।

-বর্ণমালা আবিষ্কারের আগে সেই প্রাচীনকালে লেখার কাজ চলতো ছবি এঁকে। সেরকম কিছু নয়তো?

-না, সেরকম বলে তো কিছু মনে হয়না।

স্পেশাল অফিসার আবার চিঠিটার ওপর চোখ বুলাতে থাকেন। এক সময় বলেন, এটা আমাদের দরকারে আসবে তো? না ধরতে মাগুর মাছ, চড়বো খাজুর গাছ! কি বলো? হয়তো বা এটা একটা তাবিজই। তাঁর কথার সুরে ঘোর সন্দেহ।

-দেখি, পাঠোদ্ধার যদি করা যায়। ইলিয়াস বলেন।

তোতলা দরবেশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। আলী রেজা সাহেবের কাছে গিয়ে তাঁর দুই গালে চড় মারতে মারতে বলেন,-দু-দু-দুনিয়াদারী লল- লইয়া থাকবি? এ-এ-এযার না-না-নামাজ প-প-পড়বি না?ও ওওঠ।

-এই যাচ্ছি হুজুর। এখনি যাচ্ছি।

ইলিয়াসের রাগ ধরে। তিনি পীর-ফকির-দরবেশ দু’চক্ষে দেখতে পারেন না। মিঃ আলী রেজার এরকম দরবেশপ্রীতি দেখে তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত হয়।

এবার দরবেশ ইলিয়াসের দিকে ফিরে বলেন,-কি-কি-কিরে দো-দো-দোজখের লাকড়ি-

তো-তো তোর চোখ নাই, কা-কান নাই, না-নাইরে কিছু হায়, দদদয়ালরে তুই চিনলি নারে হ-হ-হবে কি উপায়?

গান গাইতে গাইতে মিঃ আলী রেজার পেছন দিয়ে ইলিয়াসের কাছে যান দরবেশ। তার গালে চড় মারবার জন্যে হাত তুলতেই ইলিয়াস ক্ষিপ্রহন্তে দরবেশের হাত ধরে ফেলেন।

-কি করছো। একি করছো ইলিয়াস।

মিঃ আলী রেজা চেয়ার থেকে উঠে তাড়াতাড়ি দরবেশের হাত ছাড়িয়ে নেন। ইলিয়াসকে বলেন, তুমি বোকা। এরকম করতে আছে কখনো? দু’-চারটে ফুলের টোকা না হয় মারতোই গালে। কি হতো তাতে। রাগে আর বিরক্তিতে ইলিয়াসের মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোয় না। মিঃ আলী রেজা আবার বলেন, তোমাদের রক্ত এখনো গরম। বয়স হলে বুঝবে।

-ও বুঝে দরকার নেই, স্যার।

স্পেশাল অফিসার আর এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করেন না। ইলিয়াসকে বলেন, চিঠিটা আমার কাছে থাক। তুমি কাল ভোরে এসো। চেষ্টা করে দেখবো চিঠিটার পাঠোদ্ধার করা যায় কিনা।

পরের দিন ভোর বেলা। ইন্সপেক্টর ইলিয়াস স্পেশাল অফিসারের বৈঠকখানায় এসে দেখেন, তিনি টেবিলের ড্রয়ারগুলোর মধ্যে কি যেন খুঁজছেন। ইলিয়াসকে দেখে তিনি বলে ওঠেন, এই যে ইলিয়াস, কাল রাত্রে তুমি কি সে চিঠিটা নিয়ে গিয়েছিলে?

-না তো, স্যার!

-এই দ্যাখো, আমার তো যতদূর মনে পড়ে, টেবিল থেকে তুলে ড্রয়ারের মধ্যেই রেখেছিলাম চিঠিটা।

ইলিয়াসও ড্রয়ারগুলোর মধ্যে তন্ন তন্ন করে খোঁজেন। কিন্তু বৃথা। তারপর সম্ভব-অসম্ভব অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি হলো। কিন্তু চিঠিটা আর পাওয়া গেল নাতো পাওয়াই গেল না।

ইলিয়াস একদম হতাশায় ভেঙে পড়েন! চারজন লোক ঝাড়া পঁচিশটা দিন খোঁজাখুঁজি করে তবে এ চিঠিটা আবিষ্কার করেছেন। আর একজনের অসাবধানতার-যাক বালাই গেছে। মিঃ আলী রেজা হাত ঝেড়ে বলেন। -ওটা আসলে কোনো চিঠিই নয়। ওটা ঠিকই একটা তাবিজ। কিসের সব হাতী-ঘোড়ার মাথামুণ্ডু। আর কিছু হলেও ওটার পাঠোদ্ধার করা আমাদের-শুধু আমাদের কেন, কারোই কম্মো নয়।

ইলিয়াসের মাথায় তখন অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে কোথায় গেল চিঠিটা? টেবিল থেকে বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায়নি তো। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা নিয়েই বা কি করবে?

গতস্য শোচনা নাস্তি। ইলিয়াস সমস্ত হতাশা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আবার চিঠি অনুসন্ধানের কাজে লেগে যান। এবার আর সুই খুঁজতে পুকুর সেচন নয়। এতোদিনের পরিশ্রম একেবারেই বিফলে যায়নি। একটা সন্দেহজনক সাঙ্কেতিক চিঠির প্রাপকের নাম-ঠিকানাতো পাওয়া গেছে অন্তত। আরও পাওয়া গেছে খামের ওপরের সীল থেকে প্রেরকের ডাকঘরের নাম-ভরতপুর, জিলাঃ চট্টগ্রাম। প্রাপকের নাম এ. চৌধুরী। হিন্দু কি মুসলিম, বুঝবার যো নেই। অক্ষয় চৌধুরী বা আনোয়ার চৌধুরী। বা-‘এ’ আদ্যক্ষরযুক্ত অসংখ্য নামের যে কোনো একটা হতে পারে। ঠিকানা: সদানন্দ ক্লাব, রংপুর।

ইলিয়াস তাঁর সাহায্যকারী রফিক এবং মহিউদ্দীনকে সদানন্দ ক্লাবের মেম্বারদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের ভার দিয়ে আজমলকে নিয়ে চিঠি সন্ধানের কাজে লেগে যান। এবার আর সমস্ত চিঠি খুলে দেখবার কোনো দরকার নেই। শুধুমাত্র সদানন্দ ক্লাবের ঠিকানায় যে সব চিঠি আসবে, সেগুলোই পরীক্ষা করা হবে। সাঙ্কেতিক চিঠির রহস্য উদঘাটিত না হওয়া পর্যন্ত অন্যদিকের চিঠি হাতড়ে সময় নষ্ট করা ঠিক নয়।

ইলিয়াসের নির্দেশমতো রফিক ও মহিউদ্দীন পর্যবেক্ষণ ও গোপন তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন।

সদানন্দ ক্লাব শহরের ব্যাঙ্কপাড়ায় বড় রাস্তার ধারে একটা দোতলা বাড়িতে অবস্থিত। নিচের ছ’টা কামরায় একটায় ক্লাবের অফিস ও আরেকটায় হল- কাম-ডাইনিং রুম। বাকি চারটায় বসে তাস-দাবা-ক্যারম ইত্যাদি খেলার আসর। সামনের লনে ব্যাডমিন্টন ও পেছনের লনে টেনিস খেলার ব্যবস্থা আছে। ব্যাঙ্ক ও সরকারী কর্মচারী, ব্যবসায়ী, উকিল, কলেজের শিক্ষক ইত্যাদি নানা পেশার লোক ক্লাবের মেম্বার। বিকেল পাঁচটার পরে শুরু হয় লোকজনের আনাগোনা। রাত ন’টা পর্যন্ত ভীড়টা থাকে বেশ জমজমাট। একটা ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বলে, সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ে। সেটা নাকি তিনতাসের জুয়ার আড্ডা। দোতলায় বারোটি আবাসিক কক্ষ। অনেকটা হোটেলকক্ষের মতো। ক্লাবের মেম্বার ছাড়া বাইরের লোকও সেখানে থাকতে পারে, তবে তাদের ভাড়া দিতে হয় দ্বিগুণ। ক্লাবের ব্যয়ের একটা মোটা অংশ আসে এ কক্ষগুলোর ভাড়া থেকে। ডবল ভাড়া দিয়ে এ মুহূর্তে যারা আছে তাদের সংখ্যা পাঁচ। এদের দু’জন আছে অনেকদিন ধরে।

সরাই আইন অনুযায়ী আবাসিক কক্ষের বাসিন্দাদের বিবরণ রোজ পাঠাতে হয় থানায়। রফিক ও মহিউদ্দীন থানায় গিয়ে পুরো এক মাসের বিবরণ ভালো করে উল্টেপাল্টে দেখেন। কিন্তু-‘এ’ চৌধুরীর নামের চিঠির জন্যে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকলে চলবে না। কারণ ও নামে কোনো লোকই সদানন্দ ক্লাবের সদস্য তালিকায় বা ভাড়াটের রেজিস্টারে নেই। যে কোনো একটা নতুন নামে হয়তো চিঠি চলে আসবে।

তেরো দিন পরে চিঠি আসে এ. চৌধুরীর নামেই। সাধারণ চিঠি, ইংরেজিতে লেখা। পাঁচ-ছ’টা লাইনে আজে-বাজে কুশলপ্রশ্নাদি। কিন্তু চিঠির কাগজের তিন- চতুর্থাংশ ফাঁকা। এতো ছোট্ট চিঠি এর আধখানা কাগজেও লেখা যেতো। অথবা এই মামুলি চিঠি পোস্টকার্ডে লিখলেও চলতো। ইলিয়াসের মনে সন্দেহ জাগে। তিনি চিঠিটা তির্যক সূর্যরশ্মিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভালো করে চোখ বুলাতে থাকেন। দু’টো জায়গায় অস্পষ্ট দু’টো সাদাটে দাগ দেখা যায় কি যায় না। এ ছাড়া আর কিছুই মালুম করা যাচ্ছে না। তবে কি অদৃশ্য কালির লেখা?

অদৃশ্ লেখা যদি হয়ই তবে আলট্রাভায়োলেট রশ্মির মধ্যে ফেললে অতি সহজেই পাঠোদ্ধার করা যায়। কিন্তু এখানে তার ব্যবস্থা কোথায়? ঢাকা হেডকোয়র্টারে অবশ্য ভালো ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ঢাকা থেকে ফিরে এসে চিঠিটা সদানন্দ ক্লাবে বিলি করতে কমপক্ষে তিনটে দিন দেরি হয়ে যাবে। আর দেরি হলে প্রাপকের মনে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। দুধ, লেবুর রস, চিনির পানি অথবা সলিউশান অব ক্লোরাইড অব কোবাল্ট দিয়ে লেখা হয়ে থাকলে উত্তাপ দিয়ে সে লেখা দৃশ্যমান করা যায়। কিন্তু সে চিঠি আর প্রাপকের কাছে বিলি করা যায় না। তাছাড়া এমন অনেক অদৃশ্য কালি আছে যা তাপে ধরলে একেবারেই উবে যায়। তখন আর কোনো কারিকুরিই খাটে না তার পাঠোদ্ধারের। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জার্মান যুদ্ধবন্দীরা পানিতে অ্যাসপিরিন গুলিয়ে এ রকম গোপন চিঠি লিখতো।

অ্যাসপিরিনগোলা দিয়ে চিঠিটা লেখা হয়ে থাকলে আলট্রাভায়োলেট রশ্মিই হচ্ছে পাঠোদ্ধারের সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ মাধ্যম। কী করা যায়? ইলিয়াস মাথা চুলকান। আর একটা নিরাপদ পন্থা অবশ্য আছে। সেটা ব্যর্থ হলে অগত্যা ঢাকা দৌড়াতে হবে।

ইলিয়াস বাজার থেকে কয়েক গ্রেণ সলিড আয়োডিন ও একটা ছোট অ্যালুমিনিয়াম পাত্র কিনে ডাকবাংলোয় তাঁর কামরায় ফিরে আসেন। পাত্রে আয়োডিন গুলে স্টোভ ধরান। পাত্রটি স্টোভের ওপর কিছুক্ষণ রাখার পর বাষ্প উঠতে থাকে। ইলিয়াস চিঠির কাগজটির একটা দিক আয়োডিন বাষ্পের ওপর ধরেন। কতকগুলো রেখা আস্তে আস্তে ভেসে উঠছে কাগজের ওপর। ইলিয়াসের নিশ্বাস পড়ে না, পলক পড়ে না বিস্ফারিত চোখে। অস্পষ্ট রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তিনি উল্লসিত হয়ে উঠেন আনন্দে। হ্যাঁ, সেই হাতী-ঘোড়ার মাথামুণ্ড, হরতন, চিরিতন। ইলিয়াস তাড়াতাড়ি কাগজ পেন্সিল বের করে অদৃশ্য চিঠির অদ্ভুত চিহ্নগুলো যত্নের সাথে এঁকে ফেলেন:-

চিঠি নকল শেষ করে ইলিয়াস মূল চিঠিটা আলো-বাতাসে রেখে দেন কিছুক্ষণ। দৃশ্যমান চিহ্নগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ইলিয়াস চিঠিটা খামে পুরে তক্ষুণি ডাকঘরে রেখে আসেন বিলি করার জন্যে।

তদন্ত ও পর্যবেক্ষণের কাজে রফিক ও মহিউদ্দীনকে রেখে ইলিয়াস তাঁর সহকারী আজমলকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। আপাততঃ কিছুদিন আর চিঠি ‘ইন্টারসেপশানের’ দরকার নেই। যে চিঠি পাওয়া গেছে তার পাঠোদ্ধার তো আগে হোক।

স্পেশাল অফিসার ইলিয়াসের ওপর বিরক্ত হয়েছিলেন। বিরক্তির প্রথম কারণঃ কিছুদিন আগে এখানকার এক দৈনিক কাগজের সম্পাদকীয়তে ‘পুলিশের অক্ষমতা’ হের্ডিং দিয়ে পুরো দুই কলাম ঠুকেছে। তাতে এও বলা হয়েছে, ‘নোট জালিয়াতি উত্তরোত্তর যেরূপ বৃদ্ধি পাইতেছে তাহাতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অদূর ভবিষ্যতে শোচনীয় আকার ধারণ করিবে, কোনো সন্দেহ নাই। এমতাবস্থায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দক্ষ ডিটেকটিভ আনিয়া অবিলম্বে দুষ্কৃতকারীদের ধরিবার ব্যবস্থা করা যায় কি না সে সম্বন্ধে কর্তৃপক্ষকে ভাবিয়া দেখিতে অনুরোধ করি।’

বিরক্তির দ্বিতীয় কারণ-সম্প্রতি ভারতের কয়েক স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে গেছে, হক সাহেবকেও নাকি হত্যা করা হয়েছে বলে গুজব রটিয়েছে ভারত থেকে আগত শরণার্থীরা। প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এদেশেও ১০ই ফেব্রুয়ারী ১৯৫০ থেকে কয়েকদিন দাঙ্গা হয়ে গেল। এই দাঙ্গা রোধের জন্য সি.আই.ডি১ সহ বিভিন্ন বিভাগের পুলিশ অফিসারদের বিভিন্ন দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় পাঠানো হয়েছে। এই মহাদুর্যোগের সময় ইলিয়াস ও তাঁর সহকর্মী তিনজন কিনা রংপুরে বসে দিব্যি এক তামাসার খেলা নিয়ে মেতে আছেন। বড় সায়েবের কাছে এ জন্যে কৈফিয়তও কম দিতে হয়নি স্পেশাল অফিসারকে।

বিরক্তি গোপন করে স্পেশাল অফিসার জিজ্ঞেস করেন, কী খবর ইলিয়াস? -কোনো খবর নেই স্যার, শুধু শুধুই-

-অ্যাঁ, কোনো খবর নেই! স্পেশাল অফিসারের বিরক্তি আর গোপন থাকে না। তবে এদ্দিন কি করলে শুধু শুধু? আর আমি এদিকে মিথ্যে কৈফিয়ত দিয়ে মরি!

১. ক্রিমিন্যাল ইনভেসটিগেশান ডিপার্টমেন্ট.

-মিথ্যে কৈফিয়ত! কেন?

-কেন, জিজ্ঞেস করছো? সবাইকে রায়ট ঠেকাবার জন্যে পাঠানো হয়েছে। আমি বুড়ো বলেই রেহাই পেয়েছি। বড়সায়েব এ ক’দিন দুইবেলা তোমার খোঁজ করেছেন। আমি নিরুপায় হয়ে মিথ্যে করে বলেছি, রংপুরে কিছু সূত্র পাওয়া গেছে, তাই…।

-এ আর মিথ্যে কি! সূত্রতো একটা পাওয়াই গেছিলো যা হোক।

-ও তুমি সেই চিঠির কথা বলছো? ও কিছু না। ও ঠিকই সর্বরক্ষা তাবিজ।

-চিঠিটা বুঝি আর পাওয়া গেল না, স্যার?

-নাহ্, ও আর পাওয়া যায়নি। ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই আর, বুঝলে?

-এখন উঠি স্যার। ট্রেনে আসতে ঠাণ্ডা লেগে গেছে। শরীরটাও ব্যথা করছে খুব।

-শরীর ব্যথা করছে! এটাতো ইনফ্লুয়েঞ্জোর লক্ষণ!

-হ্যাঁ, ইনফ্লুয়েঞ্জায়ই ধরেছে বলে মনে হয়।

-তুমি যাও, বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। শরীর কেমন থাকে না থাকে, কাল খবর দিও।

স্পেশাল অফিসারের কাছে সাঙ্কেতিক চিঠির কথা বলা হয়নি। এবারকার চিঠির কথা ঘুর্ণাক্ষরেও তাঁকে জানতে দেয়া হবে না। আগের বারেই বেশ শিক্ষা হয়েছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা হওয়ার কথাটাও নিছক ফাঁকি। এরকম ভান না করলে আজ-কালের মধ্যেই হয়তো তাঁকে কোনো দাঙ্গা মামলার তদন্ত করতে পাঠিয়ে দেয়া হতো। চিঠিটা নিয়ে এখন বেশ কয়েকদিন মাথা গুঁজে পড়ে থাকা দরকার। ইলিয়াস চারদিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে তাঁর দোতলার শয়নকক্ষের দরজা বন্ধ করেন। সন্ধ্যা উতরে গেছে অনেকক্ষণ।

টেবিলল্যাম্প জ্বেলে ইলিয়াস অদ্ভুত চিঠিটা নিয়ে বসেন। চিঠিটার মধ্যে কি আছে বলা যায় না। যদি কিছু থাকে তবে তাড়াতাড়ি পাঠোদ্ধার করতে পারলে অপরাধীর পিছু নেয়া সম্ভব হবে।

চিঠির বিচিত্র চিহ্ন ও ছবিগুলো কোনো ভাষারই অক্ষর নয়। চীন, বর্মী, সিংহলী ইত্যাদি ভাষার অক্ষর পেটেন্ট ওষুধের মুদ্রিত ব্যবস্থাপত্রে অনেক দেখেছেন ইলিয়াস। কিন্তু এমন অদ্ভুত বিচিত্র অক্ষর কোনো ভাষাতে নেই এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। হাতী-ঘোড়ার মাথামুণ্ডু, হাঁস, বন্দুকধারী-এসব ছবিগুলোও কোন ভাব বা অর্থ প্রকাশ করে না। তবে কি চিহ্নগুলো কোনো ভাষার সাঙ্কেতিক অক্ষর যাকে ইংরেজিতে বলা হয়-ক্রিপটোগ্রাম (Cryptogram) ?

ইলিয়াস বেছে বেছে বিভিন্ন রকমের চিহ্নগুলো বের করেন। চিঠিটায় মোট আটত্রিশ রকম চিহ্ন রয়েছে। এক একটা চিহ্নকে সম্ভবতঃ এক একটা অক্ষরের পরিবর্তে বসানো হয়েছে। তাই যদি হয় তবে কোন ভাষার গুপ্ত অক্ষর এগুলো? ইংরেজিতে সর্বমোট ছাব্বিশটা অক্ষর। সুতরাং ইংরেজি ভাষার গুপ্ত অক্ষর আটত্রিশটা হতেই পারে না। উর্দুতে মোট সাইত্রিশটা অক্ষর। সুতরাং উর্দুও নয়। পরিচিত ভাষার মধ্যে একমাত্র বাংলাভাষায়ই অধিকসংখ্যক অক্ষর আছে। কিন্তু ছদ্মঅক্ষরে বাংলাভাষা লিখিত হলে তার পাঠোদ্ধারের কোনো উপায়ই নেই। ইংরেজি ভাষার এরকম সাঙ্কেতিক চিঠির পাঠোদ্ধারের পদ্ধতি ইলিয়াসের জানা আছে। কিন্তু বাংলা ভাষার সাঙ্কেতিক চিঠির পাঠোদ্ধারের কোন পন্থাই এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত হয়নি। কোনো কালে এরকম অদ্ভুত ও আটত্রিশ চিহ্নের গুপ্ত চিঠি কোনো ডিটেকটিভের হাতে পড়েছে বলেও তো শোনা যায়নি।

ইলিয়াস মাথা চুলকাতে থাকেন। চিঠিটার পঠনযোগ্য অংশটুকু ইংরেজিতে থাকায় তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সাঙ্কেতিক চিহ্নগুলো ইংরেজি ভাষারই অক্ষর। কিন্তু এমন যে হবে কল্পনাও করা যায়নি।

সাঙ্কেতিক চিঠিটা ১৭.০২.১৯৫০ তারিখে পাওয়া গেছে। আজ ২৪.০২.১৯৫০। আটদিন হয়ে গেছে। কিন্তু ইলিয়াস চিঠিটায় দাঁত ফুটাতে পারেননি একটুও। দাঁত ফুটাবেন কি? ছদ্মঅক্ষরে লেখা বাংলা চিঠির পাঠোদ্ধারের কোনো সমাধানসূত্র থাকলে তো! এই সমাধানসূত্র উদ্ভাবনের জন্যেই কয়েকদিন ধরে উঠে-পড়ে লেগেছেন ইলিয়াস। এই কাজে গোনাগুনতি করতে হচ্ছে অনেক। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় আঠারো ঘণ্টা তিনি এই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন।

সকাল দশটা। গত কয়েকদিনের গোনাগুনতির ফলগুলো একটার পর একটা সাজিয়ে লিখছিলেন ইলিয়াস। হঠাৎ নিচে একটা গাড়ি থামবার আওয়াজ হয়। তার পরেই নিচের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ইলিয়াস উঠে গিয়ে জানালায় মুখ বাড়িয়ে দেখেন, অফিসের জীপ। কড়া নাড়ছে স্পেশাল অফিসারের আদালী। ইলিয়াসের আর্দালী আল্লাবক্স নিচেই ছিল। সে দরজা খুলে একটা চিঠি নিয়ে এসে ইলিয়াসের হাতে দেয়। স্পেশাল অফিসার লিখেছেন,-জীপ পাঠালাম। এক্ষুণি কোতোয়ালী থানায় চলে এসো একটা ভালো কেস এসেছে।

ইলিয়াস তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে নেন। শোবার ঘর তালাবন্ধ করে আল্লাবক্সকে সর্বক্ষণের জন্য বাসায় থাকবার নির্দেশ দিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন।

থানায় পৌঁছতেই স্পেশাল অফিসার জেনারাল ডাইরীটা ইলিয়াসের দিকে এগিয়ে দেন। ডাইরী ইংরেজিতে লেখা। ওটার বাংলা অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায়,-

-আজ বেলা অনুমান আট ঘটিকার সময় ৪০/৪৫ বৎসর বয়স্ক একটি লোক তারা মিয়ার মুদিদোকানে আসিয়া দুই সের সরিষার তৈল কিনে এবং তৈলের দাম বাবদ একখানা ভাঁজ করা পাঁচটাকার নোট আগাইয়া দেয়। তৈল মাপিবার সময় মুদির হাতে তৈল লাগিয়া গিয়াছিল। এই জন্য সে উক্ত নোট হাত পাতিয়া না নিয়া লোকটিকে তাহার বসিবার চটের উপর রাখিতে বলে। লোকটি নোট রাখিয়া তৈল লইয়া চলিয়া যায়। মুদি হাত মুছিয়া নোটটি হাতে নেয় এবং ভাঁজ খুলিয়া দেখে যে উহা জাল নোট। মুদি তাড়াতাড়ি লোকটির পথ ধরিয়া যায় এবং কিছুদূর গিয়া তাহাকে দেখিতে পায়। মুদি পিছন হইতে লোকটিকে ডাকে। কিন্তু লোকটি ভ্রুক্ষেপমাত্র না করিয়া একটা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে এবং দরজা বন্ধ করিয়া দেয়। মুদি অনেকক্ষণ কড়া নাড়িলে লোকটি দরজা খোলে। মুদি বলে, আপনি এই নোটটা বদলে দিন। এটা জাল নোট।

লোকটি বলে, আমি সাচ্চা নোট দিয়েছি। জাল নোট দিইনি।

এই নিয়ে দু’জনের মধ্য কথা কাটাকাটি হয়। গণ্ডগোল শুনিয়া আশপাশের অনেক লোক জমা হয় এবং কেহ কেহ উক্ত লোকটির পক্ষ নেয় এবং মুদিকে ধমকাইয়া বলে, বাটপাড়ির আর জায়গা পাওনা মিয়া! কে কখন জাল নোট দিয়ে গেছে। এখন ভদ্রলোকের ঘাড়ে চাপাতে চাও।

মুদি উপায়ন্তর না দেখিয়া থানায় আসিয়া এই খবর দেয়। মুদি খোঁজ লইয়া জানিতে পারিয়াছে লোকটি রিফিউজী। ৭ নম্বর অখিল দত্ত রোডে নতুন আসিয়াছে। তাহার নাম জাফর আহমদ।

ডাইরী থেকে মাথা তুলতেই স্পেশাল অফিসার জিজ্ঞেস করেন, কি করতে চাও এখন?

-আমারতো মনে হয় বাড়িটা এই মুহূর্তে সার্চ করলে কিছু পাওয়া যেতে পারে।

-আমিও তাই ঠিক করেছি। তাহলে আর দেরি নয়। সার্চওয়ার‍্যান্ট বের করে চলে যাও তাড়াতাড়ি। থানা থেকে একজন সাব-ইন্সপেক্টর ও চারজন কনস্টেবল নিলেই চলবে।

ইলিয়াস তার দলবল নিয়ে যখন অখিল দত্ত রোডের সাত নম্বর বাড়ি ঘেরাও করেন তখন বারোটা বাজেনি। কড়া নাড়তেই দশ বছরের একটি ছেলে দরজা খুলে দেয়। দু’জন সাক্ষী, থানার সাব-ইন্সপেক্টর ও একজন কনস্টেবল নিয়ে ইলিয়াস দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়েন। ইলিয়াসের ডান হাত প্যান্টের পকেটে রিভলভার ধরে আছে।

ছেলেটি পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে ঘরের দিকে ছুটে চলে যায়। শব্দ পেয়ে বেরিয়ে আসে বেশ-বাসে মার্জিতা আধুনিকা এক তরুণী। পুলিশ দেখে সে থ’ বনে গেছে মনে হয়।

-জাফর আহমদ কোথায়? ইলিয়াস জিজ্ঞেস করেন।

-বাবা বাইরে গেছেন। তরুণী ঢোক গিলে উত্তর দেয়।

-বাইরে কোথায় গেছেন?

-তা তো বলে যাননি।

-কখন ফিরবেন।

-তাও জানি না।

-তাতো জানবেই না। থানার সাব-ইন্সপেক্টরের কথায় রাগ ও বিরক্তি। তিনি নিচু গলায় ইলিয়াসকে বলেন, ব্যাটা ঘরের কোথাও লুকিয়ে আছে বোধ হয়, স্যার।

-আচ্ছা তা দেখা যাবে-খন। তরুণীটিকে আবার প্রশ্ন করেন ইলিয়াস- আপনার বাবা কি করেন?

-কলকাতা পোর্ট কমিশনার অফিসে চাকরি করতেন। কিন্তু ব্যাপার কি বলুন তো? এতক্ষণে সাহস সঞ্চয় করে প্রশ্ন করে তরুণী।

-এটা আপনাদের বাড়ি?

-হ্যাঁ, আমাদেরই বলা যায়। আমাদের কলকাতার বাড়ির সাথে এক্সচেঞ্জ হবে। হিন্দু বাড়িওয়ালা জানের ভয়ে কলকাতা চলে গেছে। সে এলেই-

-এ বাড়ি আমরা সার্চ করবো। ইলিয়াস বলেন।

-কেন?

-আপনার বাবা জাল নোট চালিয়েছেন। এই দেখুন সার্চওয়ার‍্যান্ট।

বাক্স-পেটরা, বোঁচকা-বুচকি সমস্ত উঠানে এনে তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায় না। লেপ-তোষক-বালিশ টিপে টিপে দেখা হয়। সম্ভব- অসম্ভব সব জায়গায় তল্লাসী চালানো হয়। কিন্তু জাল নোটের সন্ধান কোথাও পাওয়া যায় না।

একটা ট্রাঙ্কের ভেতর কয়েকখানা বই বেরিয়েছে। ইলিয়াস একটা একটা করে বই নিয়ে বুড়ো আঙুলের চাপে ধরে পাতা ছাড়তে থাকেন। একটা মোটা ডাইরেক্টরী পঞ্জিকার অনেকগুলো পাতা একসঙ্গে ধপ করে পড়ে গেল। ইলিয়াস দেখেন বেশ পুরু পঞ্জিকাটার প্রথম ও শেষের দিকের কতকগুলো পাতা বাদ দিয়ে মাঝের সবগুলো পাতা একত্রে আঠা দিয়ে আটকানো। ওপর দিকের দু’তিনটে পাতা জ্যামক্লিপ দিয়ে ঐ আটকানো অংশের সাথে এঁটে দেয়া হয়েছে।

সাব-ইন্সপেক্টর ও সাক্ষীরা এবার বইটির দিকে ঝুঁকে পড়েন।

ইলিয়াস জ্যামক্লিপটা খুলে ওপর দিককার আলগা পাতা তিনটে টে তুলতেই এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। পঞ্জিকাটার পাতার চারধারের এক ইঞ্চি পরিমাণ রেখে মধ্যেকার অংশ কেটে ফেলে কোটর তৈরি করা হয়েছে। ঐ কোটরের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো নোট।

নোটগুলো ঝেড়ে মাটিতে ফেলেন ইলিয়াস। একটা নোট হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলেন, অ্যাঁ! এ যে একশ’ টাকার জাল নোট!!!

-হ্যাঁ স্যার, সবগুলোই জাল নোট বলে মনে হচ্ছে। কয়েকটা নোট নেড়ে চেড়ে সাব-ইন্সপেক্টর বলেন।

-একশ’ টাকার জাল নোট আমাদের হাতে আর আসেনি এর আগে। কি আশ্চর্য!

যথারীতি তল্লাশী-তালিকা তৈরি হয়। চল্লিশখানা একশ’ টাকার জাল নোটের সঙ্গে ডাইরেক্টরী পঞ্জিকাটিও পুলিশের হেফাজতে নেয়া হয়।

-ছোট জাল নোট তো একটাও পাওয়া গেলনা, স্যার। সাব-ইন্সপেক্টর বলেন।

-কি জানি, কোথায় রেখেছে। হয়তো লোকটার পকেটেই আছে।

-লোকটা ঠিক পুলিশের গন্ধ পেয়ে ভেগেছে। নিচু গলায় বলেন সাব- ইন্সপেক্টর।

-হুঁ, ভেগে আর যাবে কোথায়? ওর মেয়েকে আপাততঃ থানায় নিয়ে যাওয়া যাক।

-ঠিক বলেছেন, স্যার। এই মেয়েটাকে থানায় নিয়ে গেলে ও ব্যাটা কানে হেঁটে থানায় গিয়ে ধরা দেবে। তখন না হয় ছেড়ে দেয়া যাবে মেয়েটাকে। –

হুঁ, তাই করা যাক।

তরুণীকে কাছে ডেকে ইলিয়াস জিজ্ঞেস করেন, আপনার নাম কি?

-রোকসানা আহমদ।

-আপনাকে থানায় যেতে হবে।

রোকসানাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার দু’ঘণ্টার মধ্যে জাফর আহমদ সত্যি সত্যিই

থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। আসামীকে দেখে সাব-ইন্সপেক্টরের মেজাজ চড়ে যায়। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, কিরে ব্যাটা, পালিয়ে থেকে সুবিধে হলো না বুঝি?

-আমি পালাইনি। ব্যাপারটা কি বলুনতো?

-বাহ্ এখন কিচ্ছু জানেন না। বলি, এ ব্যবসায়ে কবে নেমেছিস?

-ভদ্রভাবে কথা বলুন।

-অ্যাঁহ, আমার ভদ্ররে। কোথায় এ জাল নোট তৈরি হয়?

-জানি না।

-কোথায় পেয়েছিস এগুলো?

-অভদ্রের কথার উত্তর আমি দিই না।

-আচ্ছা হুজুর বাহাদুর দয়া করে বলুন, এগুলো কোথায় তৈরি হয়?

-এখানে বলবো না। যা বলবার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলবো।

-আচ্ছা-

খবর পেয়ে ইলিয়াস আসেন। সাব-ইন্সপেক্টর বলেন, ওর মেয়েকে থানায় নিয়ে আসায় কাজ হয়েছে। নয়তো ব্যাটা কক্ষণো ধরা দিতো না।

-হ্যাঁ, তাইতো মনে হয়।

ইলিয়াস বারবার প্রশ্ন করেন জাফর আহমদকে। কিন্তু সে বেঁকে বসেছে। পুলিশের কোনো প্রশ্নের উত্তরই সে দেবে না। যা বলবার কোর্টে গিয়ে বলবে।

অগত্যা রোকসানাকে জামিনে খালাস দিয়ে জাফর আহমদকে আদালতে চালান দেয়া হয়। চালানে এ কথাও যোগ করে দেয়া হয়-আসামী তাহার অপরাধ স্বীকার করিবে। তাহার স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করিতে আজ্ঞা হয়।

পরের দিন। আসামীকে কোর্টে হাজির করলে ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞেস করেন,

-অপরাধ করেছো?

-না। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে উত্তর দেন জাফর আহমদ। তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে ভদ্র ব্যবহার আশা করেছিলেন।

অর্ডার শীটের ওপর ম্যাজিস্ট্রেটের কলম চলে, আসামী অপরাধ অস্বীকার করিয়াছে। অর্ডার শীটের কপি পেয়ে মিঃ আলী রেজা বলেন, পুলিশের কাছে যারা অপরাধ অস্বীকার করে তারা কখনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অপরাধ স্বীকার করে না। আমার পঁয়ত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে এমন নজীর একটিও দেখি নাই। -এখন কি করবো, স্যার? ইলিয়াস জিজ্ঞেস করেন।

-কী আর করবে! তদন্ত করে চার্জশীট দিয়ে দাও। যা সাক্ষী-প্রমাণ আছে

তাতে পাঁচটি বছরতো চোখ বুজে হয়ে যাবে।

-কিন্তু জালিয়াতের কোনো খোঁজই যে পাওয়া গেলো না, স্যার।

-তা পাওয়া এতো সহজ নয়। ও ব্যাটার কাছ থেকে পেতে চেয়েছিলে জালিয়াতের খবর! ওকি যেমন তেমন ঘুঘু! নিজে ধরা পড়েছে পড়েছে। তাই বলে দলের কারো নাম বলবে না। এক কাজ অবশ্য করতে পারো। মামলার তারিখে ওর পক্ষে তদবিরের জন্য নিশ্চয় কেউ না কেউ আসবে তাদেরকে ‘শেডো’ করে দেখতে পারো।

রাত দু’টো পার হয়েছে। ইলিয়াসের ফুফু নফল রোজার সেহরী খেতে উঠে দেখেন, ইলিয়াসের ঘরে আলো। তিনি কয়েক পা গিয়ে জানালা দিয়ে তাকান, চেয়ারে হেলান দিয়ে ইলিয়াস মাথায় হাত দিয়ে কি যেন চিন্তা করছেন।

-ইলু, এখনো ঘুমুসনি বাবা?

-ফুফুমা, তুমি উঠেছো? একটু চা খাবো। আবদারের সুরে ইলিয়াস বলেন।

-আচ্ছা দিচ্ছি। কিন্তু এতো রাত জাগলে যে অসুখ করবে রে। ফুফু চলে যান। এই নিঃসন্তান বিধবা ফুফু ছাড়া আপন বলতে আর কেউ নেই ইলিয়াসের। বাবা-মা একই দিনে কলেরায় মারা যান। ইলিয়াসের বয়স তখন আট। তারপর থেকেই এই ফুফু মানুষ করেছেন তাঁকে।

কিছুক্ষণ পরে চা নিয়ে ফুফু আসেন। বলেন, এভাবে আর কত কাল জ্বালাবি? এবার বিয়ে থা’ করে আমায় মুক্তি দে বাবা।

ফুফুর কথায় কান না দিয়ে ইলিয়াস চায়ে চুমুক দেন। রোজ রোজ একই কথার আর কি জবাব দেয়া যায়?

ফুফু চলে যান। চা খেয়ে চাঙা হয়ে ইলিয়াস আবার কাজের মধ্যে ডুবে যান।

বাংলাভাষার গুপ্তসঙ্কেত (cryptogram) পাঠোদ্ধারের উপায় উদ্ভাবনের নেশায় তাঁকে পেয়ে বসেছে। তাঁর চিন্তা-ভাবনা ও গোনাগুনতির ফলাফল এখনো গুছিয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়নি।

রাত তিনটে নাগাদ তাঁর গোনাগুনতির সমস্ত ফলাফল লেখা সমাপ্ত করে ইলিয়াস এবার প্রথম থেকে পড়তে শুরু করেন:-

॥ বাংলা গুপ্তসঙ্কেত পাঠোদ্ধারের পদ্ধতি ॥

বাংলা ভাষায় ব্যঞ্জনবর্ণ, স্বরবর্ণ ও স্বরচিহ্ন মিলিয়ে মোট ৬০টি। এই ৬০টি বর্ণ ও স্বরচিহ্নের প্রত্যেকটার পরিবর্তে এক একটা ছদ্মঅক্ষর বা চিহ্ন বসিয়ে যদি কোন দুই ব্যক্তি তাদের পূর্ব-ব্যবস্থামতো নিজেদের মধ্যে গোপন চিঠিপত্র আদান প্রদান করে তবে তৃতীয় ব্যক্তির পক্ষে সেই সাঙ্কেতিক চিঠির পাঠোদ্ধার কি উপায়ে সম্ভব হতে পারে?

সঙ্কেতিক চিঠির পাঠোদ্ধার করতে হলে সর্বপ্রথমে ঐ চিঠির বিভিন্ন ছদ্মঅক্ষর বা চিহ্নগুলোর সংখ্যা নির্ণয় করা দরকার। তারপর ঐ চিহ্নগুলোকে তাদের সংখ্যাদিধ্যানুসারে সাজিয়ে নিতে হবে। এবার কোন্ চিহ্নটা বাংলার কোন অক্ষরের ছদ্মঅক্ষর সেটা চিনতে হলে প্রথমতঃ জানা দরকার বাংলা ভাষায় কোন অক্ষর বা স্বরচিহ্নগুলো ঘন ঘন ব্যবহার করা হয় এবং সাধারণতঃ কোনটার চেয়ে কোনটা অধিকতর বেশিবার ব্যবহৃত হয়। বাংলা ভাষার স্বরচিহ্ন ও বর্ণমালাকে তাদের ব্যবহারের পৌনঃপুনিকতার ক্রমানুসারে সাজানো গেল।

া    ে   র    ি     ক     ন     ব     ত     ল     ম    স    য়   প     অ     দ      ু

ট   ই    শ   হ   জ   গ   ী   ছ   খ   য   এ     চ     ভ     ড়       ও

উ   ফ     শ     খ    ঠ    দ    *    ড   ঙ    ঝ    ং     ঘ    ক্ষ     ূ     ৈ     ৎ

ষ      ঢ      ণ      ঐ     ঈ      ঊ       ঢ়       ঔ    ঃ   ।

উপরে সাজানো বর্ণ ও স্বরচিহ্নগুলোর প্রথম কয়েকটা খুব বেশি সংখ্যায়, মাঝের অনেকগুলো অল্প সংখ্যায় এবং শেষের কতকগুলো কদাচিৎ ব্যবহৃত হয়।

দ্বিতীয়ত: জানা দরকার-বাংলা স্বরচিহ্ন ও বর্ণমালার যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য আছে সেগুলো। ওপরে সাজানো বর্ণমালার তালিকা দেখে শুধু অনুমান করা যাবে কোন চিহ্নটা কোন অক্ষর বা স্বরচিহ্ন এবং এই অনুমান ঠিক হচ্ছে কিনা তার যাচাইয়ের জন্যে স্বরচিহ্ন ও বর্ণবিশেষের বৈশিষ্ট্যের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এবার সংখ্যাধিক্যানুসারে সাজানো প্রথমদিকের কয়েকটা সাঙ্কেতিক চিহ্ন ধরে আলোচনা করে সমাধানসূত্রগুলো বের করা যাক।

১ম সূত্র: যে চিহ্নটা সবচেয়ে বেশি সেটাকে উপরোক্ত বর্ণমালার তালিকা অনুযায়ী । (আ-কার) বলে অনুমান করা যায়। । (আ-কার)-এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইহা কখনো শব্দের আদিতে বসে না।

২য় সূত্র: দ্বিতীয় সর্বাধিক চিহ্নটি (এ-কার) হতে পারে। ইহা শব্দের আদিতে ও মধ্যে বসে। কিন্তু শব্দের শেষে বসতে পারে না।

৩য় সূত্র: তৃতীয় সর্বাধিক চিহ্নটির- হতে পারে। এর বিশেষত্ব হচ্ছে-এটা বেশির ভাগ সময় শব্দের শেষে বসে। সাঙ্কেতিক চিঠির প্রত্যেকটি শব্দের সর্বশেষ চিহ্নগুলোর সংখ্যা ভিন্ন ভিন্নভাবে নির্ণয় করলে যে চিহ্নটি সর্বাধিক হয় সেটাই-র। শব্দের শেষে কিছু সংখ্যক। (আ-কার) যুক্ত-র- পাওয়া যেতে পারে।

৪র্থ সূত্র: চতুর্থ সর্বাধিক চিহ্নটিকে (ই-কার) বলে অনুমান করা যায়। ইহা শব্দের আদিতে ও মধ্যে বসতে পারে। কিন্তু অন্তে বসতে পারে না। (ই- কার) যদি কখনও সাধারণ নিয়ম লংঘন করে (এ-কার)-এর চেয়ে সংখ্যায় বেশি হয়ে যায় তবে তাদের চেনবার উপায় হচ্ছে, । (আ-কার) এর বাম দিকের দুইটি চিহ্নের কোনোটা (ই-কার) হতে পারে না এবং। (আ-কার)-এর অব্যবহিত বাম দিকের চিহ্নটি (এ-কার) হতে পারে না।

৫ম সূত্রঃ া, ,ে র, ,ি বের করার পর অ-এর সন্ধান করতে হবে। অ- কখনো শব্দের শেষে রসতে পারে না। শব্দের মাঝেও-অ- কদাচিত বসে। যেমন বেআইনী, বেআবরু। যদি দেখা যায় একটা সাঙ্কেতিক চিঠিতে একটা বিশেষ চিহ্ন অনেকবার আছে অথচ সেটির সাথে। (আ-কার) ছাড়া অন্য কোন স্বরচিহ্ন নেই এবং সেই চিহ্নটি প্রায় সর্বক্ষেত্রে শব্দের আদিতে বসেছে তবে সেটিকে প্রায় নিশ্চিত রূপে-অ- বলে ধরে নেয়া যায়।

৬ষ্ঠ সূত্র: এবার -এ-এর সন্ধান করা যেতে পারে। এ- বেশি সংখ্যায় থাকে না। যে ক’টা থাকে সে ক’টা অধিকাংশ সময় শব্দের আদিতে বসে এবং-এ-এর সাথে কোনো স্বরচিহ্ন অর্থাৎ-1 f- ইত্যাদি থাকে না।

৭ম সূত্র: তারপর দেখা দরকার কোনো চিহ্ন একক অবস্থায় আছে কিনা। যদি পাওয়া যায় তবে সেটা-ও- হওয়ার সম্ভাবনা।

সাঙ্কেতিক চিঠিটা যাতে নষ্ট না হয় সেজন্যে পেন্সিল দিয়ে তার একটা কপি আগেভাগেই করে রাখা দরকার। এবার ঐ কপিটা নিয়ে তার মধ্যস্থিত -1, ,ে র, ,ি অ, এ, ও-এর স্থলাভিষিক্ত চিহ্নগুলোকে রাবার দিয়ে মুছে- 1, ,ে র, কি, অ, এ, ও-কে সেখানে বসিয়ে দিলে দু’চারটে শব্দের অস্পষ্ট চেহারা বেরিয়ে পড়বে।

৮ম সূত্র: এখন এমন দু’একটা অজ্ঞাত চিহ্ন বের করতে হবে যেটা দুই বা ততোধিক শব্দের মধ্যে সাধারণ। যেমন ধরা যাক-আ+ি এবং আ+ার। শব্দ দু’টোর+সম্ভবতঃ ম অথবা স। এখন অন্য যে শব্দগুলোতে আছে সেগুলোতে -ম- এবং-স- বসিয়ে দেখা যাক। আ+রা শব্দে+এর বদলে স বসালে কোন অর্থ প্রকাশ করে না। কিন্তু-ম- বসালে ‘আমরা’ হয়। সুতরাং + = ম। এবার+এর বদলে -ম- বসালে অনেক শব্দের চেহারা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং অনেক ছদ্মঅক্ষরের মুখোস খসে যাবে।

বাংলা বর্ণ ও স্বরচিহ্নের আরো যে যে বৈশিষ্ট্য সাঙ্কেতিক-লিপি পাঠোদ্ধারে সহায়তা করবে সেগুলো সমন্ধে কিছু বলা যাক,-

৯ম সূত্রঃ ক ও ন-এদের সংখ্যা প্রায় সমান। শব্দের মধ্যে ক-এর প্রাচুর্য বেশি, অপরপক্ষে-ন-শব্দের অন্তে বেশি থাকে।

১০ম সূত্র: ই, ঈ, উ, উ, এ, ঐ, ও এবং ঔ-এদের সঙ্গে-া, -িপ্রভৃতি স্বরচিহ্ন যোগ হতে পারে না।

একাদশ সূত্র: ব-অক্ষরটি শব্দের বেশি থাকে।

দ্বাদশ সূত্রঃ ড়, ঢ়, গু-কখনো শব্দের আদিতে বসে না। য়-কখনো শব্দের আদিতে বসে না। শুধুমাত্র য়ুরোপ লেখার সময় এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। য়- শব্দের শেষে বেশি থাকে।

ত্রয়োদশ সূত্র: দুটি। (আ-কার) দুটি (ই-কার) দুটি (এ-কার) বা অন্য কোনো স্বরচিহ্ন দুটি এক সঙ্গে পাশাপাশি বসতে পারে না।

সাঙ্কেতিক চিঠির শব্দ যুক্তাক্ষরবর্জিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ যুক্তাক্ষরবিশিষ্ট শব্দ দিয়ে সাঙ্কেতিক চিঠি তৈরি করা দুরূহ এবং তার পাঠোদ্ধার আরো বেশি দুরূহ।

যদি কোনো সাঙ্কেতিক চিঠির শব্দগুলোকে ভেঙে তিনটা, চারটা, পাঁচটা বা ছয়টা চিহ্নকে একত্র গুচ্ছবদ্ধ করে সাজিয়ে দেয়া হয় তা’হলেও উপরোক্ত পন্থায় তার পাঠোদ্ধার করা যাবে। বর্ণমালার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থেকেই ধরা যাবে, কোথায় শব্দের আরম্ভ এবং কোথায় শেষ হওয়া উচিত।

কোনো সাঙ্কেতিক চিঠিতেই বিরামচিহ্ন ব্যবহার করা হয় না। পাঠোদ্ধারের পর সহজেই বোঝা যাবে কোথায় দাড়ি, কমা ইত্যাদি বসানো দরকার। পাঠোদ্ধারের পর বিরামচিহ্নগুলোকে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে দেখাতে হবে।

পড়া শেষ করে ইলিয়াস দাঁড়ান। আড়ামোড়া ভেঙে হাত-পাগুলোকে সজীব করে নেন। ক্লান্ত দেহ-মন নিয়ে এখন আর সাঙ্কেতিক চিঠির পাঠোদ্ধারে বসা কোনো মতেই উচিত হবে না।

পরের দিন বেলা আটটা। তাজা মন নিয়ে নতুন উদ্যমে সাঙ্কেতিক চিঠির পাঠোদ্ধারের সঙ্কল্প নিয়ে কাজে বসেন ইলিয়াস। প্রথমেই তিনি চিঠিটার একটা কপি করে নেন পেন্সিল দিয়ে। তারপর শুরু করেন গোনাগুনতি। বিভিন্ন ছদ্মঅক্ষরগুলোর সংখ্যা নির্ণয় করে তিনি সংখ্যাধিক্যানুসারে সাজিয়ে নেন:-

ত্রিভুজ                  ………                   ৪৮ টি

বক                         ………                   ৩৬ টি

চতুর্ভুজ                 ………                   ১৬ টি

ত্রিশূল                   ………                   ১৪ টি

হরতন                  ………                   ১৩ টি

হাঁস                      ……….                  ১১ টি

ছদ্মঅক্ষরগুলো মধ্যে ত্রিভুজ সবচেয়ে বেশি। মোট আটচল্লিশটি ত্রিভুজের একটিও কোনো শব্দের আদিতে স্থান পায়নি। সুতরাং ত্রিভুজকে। (আ-কার) বলে সনাক্ত করা যায়।… (প্রথম সূত্র)।

দ্বিতীয় সর্বাধিক চিহ্ন বক। এটা শব্দের আদিতে ও মধ্যে আছে কিন্তু অন্তে নেই।…(দ্বিতীয় সূত্র)। তৃতীয় সূত্র অনুসারে এটা-র-হতে পারে না, কারণ-র- বেশির ভাগ সময় শব্দের শেষে বসে। অধিকন্তু-র-কোথাও না কোথাও। (আ- কার) যুক্ত হয়। কিন্তু বকের অব্যবহিত পরে কোথাও ত্রিভুজ অর্থাৎ। (আ-কার) নেই। এটা (ই-কার)-ও হতে পারে না, কারণ সাঙ্কেতিক চিঠির পঞ্চম লাইনের তৃতীয় শব্দে ত্রিভুজ অর্থাৎা (আ-কার)-এর বাম দিকের দুটি চিহ্নের কোনোটাি (ই-কার) হতে পারে না।… (চতুর্থ সূত্র)। সুতরাং বক= (এ-কার)।

চতুর্ভুজের সংখ্যা ষোল। শব্দের শেষেই চতুর্ভুজের প্রাচুর্য বেশি এবং অনেক স্থলে চতুর্ভুজের ডানে ত্রিভুজ অর্থাৎ। (আ-কার) যোগ হয়েছে। সাঙ্কেতিক চিঠির প্রত্যেকটি শব্দের সর্বশেষ চিহ্নগুলো সংখ্যার ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নির্ণয় করে ইলিয়াস দেখেন চতুর্ভুজই সর্বাধিক অর্থাৎ আটটি শব্দের সর্বশেষ চিহ্ন চতুর্ভুজ। সুতরাং তৃতীয় সূত্র অনুসারে চতুর্ভুজ = র।

চতুর্থ সর্বাধিক চিহ্ন ত্রিশূত্র। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী অর্থাৎ বর্ণের সংখ্যাধিক্যানুসারে এটি (ই-কার) হওয়া উচিত। কিন্তু পাঁচটি শব্দের অন্তে ত্রিশূল আছে। সুতরাং চতুর্থ সূত্র অনুসারে এটি (ই-কার) হতে পারে না। তাছাড়া ত্রিশূলের অব্যবহিত পরে ত্রিভুজ অর্থাৎ। (আকার) আছে। আবার এটি- ক-হওয়ার সম্ভাবনাও কম। নবম সূত্র অনুযায়ী শব্দের মধ্যে-ক-এর এবং অন্তে- ন-এর প্রাচুর্য বেশি। চোদ্দটি ত্রিশূলের মধ্যে ছ’টি শব্দের অন্তে আছে। সুতরাং ত্রিশূলকে আপাতত-ন-বলে ধরে নেয়া যায়।

পঞ্চম সর্বাধিক চিহ্ন হরতন। যেহেতু হরতনের ডানে ত্রিভুজ অর্থাৎ (আ- কার) আছে সেহেতু এটিও (ই-কার) নয়। তেরোটি হরতনের মধ্যে শব্দের মধ্যে বসেছে আটটি। সুতরাং নবম সূত্র অনুসারে হরতনকে আপাতত-ক-বলে ধরে নেয়া যায়।

হাঁসের সংখ্যা এগারো। সবগুলো হাঁসই শব্দের আদিতে ও মধ্যে আছে। কিন্তু অন্তে নেই। হাঁসের অব্যবহিত পরে কোথাও ত্রিভুজ অর্থাৎ। (আ-কার) বা বক অর্থাৎ (েএ-কার) নেই। ইলিয়াস আরো ভালো করে দেখতে শুরু করেন। ত্রিভুজ অর্থাৎ। (আ-কার) গুলোর বাম দিকের দু’টো চিহ্নের কোনোটা হাঁস কি না। উহু, কোথাও এরকম দেখা যায় না। সুতরাং চতুর্থ সূত্র অনুসারে হাঁস (ই-কার)।

ত্রয়োদশ সূত্র অনুসারে ত্রিভুজ, বক ও হাঁস-এই তিনটি চিহ্নকে ইলিয়াস আর একবার যাচাই করে দেখেন। না, দুটি ত্রিভুজ, দুটি বক বা দুটি হাঁস কোথাও পাশাপাশি নেই। সুতরাং ত্রিভুজ, বক এবং হাঁস সন্দেহাতীতভাবে যথাক্রমে া,  েএবং ি ।

পঞ্চম সূত্র ধরে এবার-অ-এর সন্ধান করেন ইলিয়াস। হাতীর মাথা, হরতন, চিরিতন, ঘোড়ার মাথা-সেগুলো কোনোটা শব্দের মাঝে বসেছে বা কোনোটার আগে–ে এবং — আছে। সুতরাং এগুলো-অ-হতে পারে না। সাতটি বন্দুকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে সবগুলোই শব্দের আদিতে বসেছে এবং কোথাও কোথাও । (আ-কার) যুক্ত হয়েছে। সুতরাং বন্দুক = অ।

ষষ্ঠ সূত্র অনুসারে ইশকাপনকে-এ-এবং সপ্তম সূত্র অনুসারে শিকারীকেও চিনে নিতে কষ্ট হয় না ইলিয়াসের।

ইলিয়াস সাঙ্কেতিক চিঠির পেন্সিল-কপিটা নিয়ে বসেন এবার ত্রিভুজ, বক, চতুর্ভুজ, হাঁস, বন্দুক, ইশকাপন এবং শিকারী-এই চিহ্নগুলোকে রাবার দিয়ে মুছে সেখানে-া, ,ে র, ,ি অ, এ-এবং-ও-বসিয়ে দেন। কি আশ্চর্য! অনেকগুলো শব্দের আবছা চেহারা বেরিয়ে পড়েছে।

সাঙ্কেতিক চিঠির প্রথম লাইনের প্রথম শব্দ, দ্বিতীয় লাইনের তৃতীয় শব্দ, দশম লাইনের শেষ শব্দ এবং দ্বাদশ লাইনের প্রথম শব্দ-এগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট বোঝা যায়, শব্দগুলো যথাক্রমে ‘আমাদের’, ‘অমন’, ‘ওদের’, এবং -আমি।… (অষ্টম সূত্র)। সুতরাং এবার আরো তিনটে অক্ষর ম, দ, ন-পাওয়া গেলো। এগুলোকে বসিয়ে নেয়ার পর আরো স্পষ্টতর হয়ে ওঠে শব্দের চেহারা। অষ্টম সূত্র অনুসারে পর্যালোচনা করলে সহজেই বেরিয়ে পড়বে-নবম লাইনের শেষ শব্দ এবং দ্বাদশ লাইনের তৃতীয় শব্দ যথাক্রমে ‘নেমে’ এবং ‘নামব’, অষ্টম লাইনের প্রথম ও দ্বিতীয় শব্দ, নবম লাইনের তৃতীয় শব্দ এবং দ্বাদশ লাইনের শেষ শব্দ যথাক্রমে ‘একাই’, ‘একশো’, ‘ওকে’ এবং ‘ওদিক’, সপ্তম লাইনের দ্বিতীয় শব্দ এবং নবম লাইনের প্রথম শব্দ যথাক্রমে ‘দেখনি’, এবং ‘দেখে’। এভাবে-ব, ক, ই, শ-এবং-খ-পাওয়া গেলো।

ইলিয়াস আনন্দে আত্মহারা। উত্তেজনায় তিনি চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ান। আবিষ্কারের আনন্দ আর্কিমিডিসের চেয়ে তাঁর কিছু কম হয়নি। তিনি চটপট বাকি অক্ষরগুলো যথাস্থানে বসিয়ে পড়তে আরম্ভ করেন:-

আমাদের যাতরার দল হিনদুসথান ছেড়ে আসছে (।)

অমন কাছাছাড়া দল সেখানে ঠাঁই পায় (?) পাঁচু

শতু দশরথ পাকিসতানে আসতে পারবে না (।) এ

সুযোগে নীলু লালু ও শ্যামকে ঢোকাতে হবে (।)

শ্যামকে দেখনি (।) আসর মাত করতে ও একাই

একশো (।) ওর চাঁদমুখ ও ফিগার দেখে অধিকারী

ওকে লুফে নেবে (।) বানপুর গেলে দল ধরা যাবে (।)

ওদের নিয়ে উনিশ তারিখ বারোটার আমি পোড়াদহ

নামব (।) তুমি এ দিককার গাড়ীতে একটায় সেখানে যাবে (।)

কিন্তু একি! চিঠিটার একটা যাত্রার দলের হিন্দুস্থান ছেড়ে পাকিস্তানে আসবার খবর শুধু।

ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন ইলিয়াস। তাঁর আনন্দ কোথায় উবে গেছে। হতাশায় চুল টানতে শুরু করেন তিনি। তাঁর এতো রাত জাগরণ, এতো পরিশ্রম বৃথাই গেলো। স্পেশাল অফিসার ঠিকই বলেছিলেন, ধরতে মাগুর মাছ, চড়বো খাজুর গাছ।

দুপুরে খাওয়ার পর ইলিয়াস সিগারেট ধরিয়ে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দেন। কুণ্ডলায়িত ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয় তাঁর অন্তরের সব আশা পুড়ে ধোঁয়া হয়ে উড়ছে।

চকিতে ইলিয়াসের মনে বিদ্যুৎ খেলে যায়। যাত্রাদলের খবর এ রকম সঙ্কেতে পাঠাবার প্রয়োজন? টেবিল থেকে চিঠিটা নিয়ে তিনি পড়েন একবার- দু’বার-অনেকবার। পাঁচু, শতু, দশরথ সংখ্যাসূচক নাম, নীলু, লালু এবং শ্যাম-বর্ণসূচক নাম। এগুলো অর্থ কি?

ইলিয়াসের মুখের জমাট মেঘ আস্তে আস্তে কেটে যায়। তাঁর চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মুখ।

পাঁচু, দশরথ ও শতু সম্ভবত: পাঁচ, দশ ও এক শ’ টাকার ভারতীয় নোট। ওগুলো পাকিস্তানে অচল, তাই আসতে পারবে না। ‘এ সুযোগে নীলু, লালু ও শ্যামকে ঢোকাতে হবে’ অর্থাৎ ভারতীয় নোটের বদলে নীল, লাল ও সবুজ রঙের পাঁচ, দশ ও এক শ’টাকার জাল পাকিস্তানী নোট গছাতে হবে।- ‘একাই একশো’ মানে একখন্ড কাগজের নোটের মূল্য একশ’ টাকা। ‘চাঁদমুখ ও ফিগার’ বলতে মনে হয়, বুঝিয়েছে নোটের মূল্য একশ’ টাকা। ‘চাঁদমুখ ও ফিগার’ বলতে, মনে হয়, বুঝিয়েছে নোটের ওপরের চাঁদের ছবি ও সংখ্যায় লিখিত নোটের বিনিময়মূল্য। ‘কাছাছাড়া দল’, খুব খুব সম্ভব মুসলিম শরণার্থী দল। লুঙ্গি এ দেশীয় মুসলিমদের পোশাক আর লুঙ্গি পরে ধুতির মতো কাছা দেয়া যায় না বলে বোধ হয় ‘কাছাছাড়া’ বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে।

তিনি অবাক বিস্ময়ে ভাবেন, দুর্বৃত্তরা কী সাংঘাতিক ধুর্ত আর হুঁশিয়ার! দুর্জেয় ধাঁধার কুহেলিকা সৃষ্টি করে রেখেছিল তারা। অদৃশ্য কালি, দুর্বোধ্য লিপি আর হেঁয়ালি বুলি-এই তিন ধাঁধার তিন পাহাড় ডিঙিয়ে ইলিয়াসের মন উল্লাসে নেচে ওঠে।

সাঙ্কেতিক চিঠির রহস্য মোটামুটি উদঘাটিত হয়েছে। তা-ও আন্দাজ অনুমানের ওপর। অনুমানের সাথে ঘটনার সমর্থন থাকা দরকার। সমর্থন থাকলে তবেই

জোর দিয়ে কিছু বলা যায়। কিন্তু সেরকম কিছু নেই। কতকগুলো শব্দ এখনো ধাঁধাই রয়ে গেছে।

ইলিয়াস ভাবনায় পড়েন।

হঠাৎ কি একটা খেয়াল হতেই ইলিয়াস উঠে দাঁড়ান। বিকেল তখন। ঘরটা তালাবদ্ধ করে আল্লাবক্সকে ঘরের পাহারায় রেখে তিনি জাফর আহমদের বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন।

বার দুই কড়া নাড়তেই দরজা খুলে যায়। দরজা খুলেই পুলিশের লোক দেখবে ভাবতে পারেনি-রোকসানা। রীতিমতো ভড়কে যায় সে। ইলিয়াস বুঝতে পেরে মুখে হাসি টেনে বলেন, ভয় নেই গ্রেফতারী পরোয়ানা নিয়ে আসিনি এবার। আপনাদের মামলার তদন্ত করছি আমি, বোধ হয় জানেন। আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবো শুধু। হয়তো এতে আপনাদের উপকারই হবে।

উপকারের আশ্বাস পুলিশের মুখ থেকে। বিশ্বাস হয় না রোকসানার। টোপ ফেলে বড়শিতে গাঁথবার কৌশল বলে মনে হয় তার। তবুও সে বলে, আসুন, ভেতরে এসে বসুন।

ইলিয়াস বৈঠকখানায় প্রবেশ করেন। একটা চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করেন,

-আপনারা কোলকাতা থেকে এসেছেন নিশ্চয়?

-হ্যাঁ, বাবা ওখানে পোর্ট কমিশনার অফিসে চাকরি করতেন। প্রশ্নের উত্তর টুকবার জন্যে ইলিয়াস নোটবই বের করেন।

-আপনাদের এখানে আসার উদ্দেশ্যটা জানাতে পারি কি?

-উদ্দেশ্য কিছু নয়। প্রাণ বাঁচাবার তাগিদ। রোকসানার মুখে ম্লান হাসি।

-কোলকাতায় রায়ট। বেনিয়াটোলায় আমাদের বাড়িতে হামলা করেছিল গুণ্ডারা। প্রতিবেশী এক হিন্দু পরিবার আশ্রয় দিয়েছিলো। তাঁরা লুকিয়ে না রাখলে বাঁচবার ভরসা ছিলো না। সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়ে তাঁরাই নিজেদের গাড়ি করে শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে যান।

-আপনারা কোন বর্ডার দিয়ে এসেছেন?

-বানপুর দিয়ে।

-আচ্ছা কোন তারিখে ক’টার সময় বানপুর নেমেছিলেন নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে?

-আমরা বানপুর নামি বিকেল চারটা-সাড়ে চারটায়। তারিখ-হ্যাঁ মনে পড়ছে, ২০শে ফেব্রুয়ারী। ইলিয়াস পকেট থেকে সাঙ্কেতিক চিঠির সমাধান বের করে চোখ বুলান-

‘বানপুর গেলে দল ধরা যাবে। আমি উনিশ তারিখ বারোটায় পোড়াদহ নামব।’ ইলিয়াস ঠোঁট কামড়ান। আপন মনেই মাথা নাড়েন কয়েকবার। তারপর রোকসানাকে জিজ্ঞেস করেন, -আচ্ছা বানপুর নেমে আপনার বাবা টাকা-কড়ি বদল করেছিলেন?

-বদল করতে দেখিনি। তবে বদল যে করেছিলেন তা পরে বাবার কাছে শুনেছি। ওদেশের টাকা এ দেশে এনে তো চালানো যেতো না।

-তা ঠিক। তবে বদলানো টাকাও তো আর চালাতে পারলেন না। আচ্ছা একটা ব্যাপার কিন্তু আমার কাছে কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

-কোন ব্যাপারটা?

-আপনার বাবা ডাইরেক্টরী পঞ্জিকার ভেতর ফোঁকর বানিয়ে যে ভাবে জাল নোট লুকিয়ে রেখেছিলেন, তাতে সন্দেহ হয়-

-সন্দেহ হয় তিনি জেনেশুনে জাল নোট লুকিয়ে রেখেছিলেন, তাই না?

-হ্যাঁ, তাই।

-শুনুন তবে-কোলকাতায় দাঙ্গা শুরু হবার পর একদিন দেখি, বাবা পুরনো একটা ডাইরেক্টরী পঞ্জিকার পাতা চারদিকের কিছুটা রেখে ভেতরের অংশ কেটে ফেলে দিয়ে পাতাগুলোকে আঠা দিয়ে জুড়ে দিচ্ছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন,-ম্যাজিশিয়ানরা এক প্যাকেট তাস দেখিয়ে তার ভেতর থেকে চার-পাঁচটা রুমাল বের করে দর্শকদের অবাক করে দেয়, দেখিসনি? তাসগুলোর মাঝের অংশ আয়তাকারে কেটে ফেলে খোপ বানিয়ে তার ভেতর লুকিয়ে রাখে রুমাল। আমিও সেরকম খোপ বানাচ্ছি। নোট লুকিয়ে রাখার চমৎকার ব্যবস্থা। গুণ্ডারা তালা ভেঙে বাক্স-আলমারি তচনচ করবে। কিন্তু পঞ্জিকাটা কেউ ছুঁয়েও দেখবে না। দাঙ্গার সময় থেকে লুটপাটের ভয়ে বাবা একশ’ টাকার নোটগুলো পঞ্জিকার ওই খোপের ভেতরেই লুকিয়ে রাখতেন। বদল-করা নোটগুলোও বাবা ওই খোপের ভেতরেই রেখেছিলেন।

-হ্যাঁ, এবার পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা। আচ্ছা, বানুপুরে কোনো লোক আপনার বাবার সাথে দেখা করেছিলো?

-হ্যাঁ, ট্রেন থেকে নামবার পরে পরেই একটা লোক এসেছিলো। বাবার সাথে

কথা বলছিলো সে।

-তাদের কথাবার্তা কিছু শুনেছেন?

-না, তারা ভীড় থেকে দূরে সরে গিয়ে কথা বলছিলো। তারপর লোকটা

বাবাকে একটা চায়ের দোকানে নিয়ে যায়।

-চায়ের দোকান থেকে ফিরে এসেছিলো লোকটা?

-না।

-আচ্ছা, লোকটাকে এখন দেখলে আপনি চিনতে পারবেন?

-আশা করি, পারবো।

-কি করে পারবেন? একদিন অল্পক্ষণের জন্যে তো মাত্র দেখেছেন!

-আমাদের কলেজের ডিমস্ট্রেটর বিমল বাবুর মতো দেখতে ছিলো লোকটা। প্রথমে দেখে আমি তো ভুল করে তাকে ডাকতেই যাচ্ছিলাম।

-তা হলে তো চিনতে কোনো অসুবিধে হবে না। ঠিক আছে। আপনাকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।

-কোথায়?

-কোথায়, তা এখন বলা যাবে না।

-কাছাকাছি কোথাও?

-না, দূরেই। আর যেতে হবে গোপনে।

বলছে কি লোকটা। রোকসানার পায়ের তলা শিরশির করে। পুলিশের লোকের সাথে কোথায় যাবে সে? এমনিতেই পুলিশের ওপর তার অশেষ ঘৃণা। অনাত্মীয় অপরিচিত যুবকের সাথে কোথাও যাওয়ার কথা সে কল্পনাই করতে পারে না। সে বলে, মাপ করবেন, আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। -কিন্তু আপনার যাওয়াটা নিতান্তই দরকার। আপনার যাওয়ার ওপর আপনার বাবার মামলা নির্ভর করছে।

রোকসানা নিরুত্তর। তার চিন্তাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ইলিয়াসের খেয়াল হয়, তিনি একজন তরুণীর সাথে কথা বলছেন। এক সম্ভাবনার ইঙ্গিত তার মনকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। নিজের অন্যমনষ্কতা ও অসঙ্গত প্রস্তাবের জন্য লজ্জিত হন ইলিয়াস। তিনি বলেন, থাক, আপনার যাওয়ার দরকার নেই। এক কাজ করুন, আপনার বাবার জামিনের জন্য বেল পিটিশান মুভ করান। আমি তার জামিনের জন্যে রেকমেন্ড করবো।

পরের দিনই জাফর আহমদের জামিনের ব্যাপার কোর্টে উত্থাপিত হয়। কিন্তু কোর্ট ইন্সপেক্টরের ঘোর আপত্তিতে ইলিয়াসের সুপারিশ ভেস্তে যায়। ইলিয়াসের সুপারিশের অযৌক্তিকতা সম্বন্ধে মন্তব্য করতেও ছাড়েন না ম্যাজিস্ট্রেট। স্পেশাল অফিসার মিঃ আলী রেজা তো ব্যাপারটা শুনে রেগেই আগুন। এ রকম গুরুতর সুপারিশ করতে পারলো!

মিঃ আলী রেজার মনে সন্দেহের মেঘ জমে। কিন্তু ইলিয়াস সম্বন্ধে কোনো বদনাম তো শোনা যায় না। কে জানে কখন কার মতি কোন দিকে গতি নেয়।

উকিলের প্রতীক্ষায় বসেছিলো রোকসানা, কিন্তু এলেন একজন অপরিচিত ভদ্রলোক।

রোকসানা কেমন হকচকিয়ে গেছে। তাই লক্ষ্য করে আগন্তুক বলেন,- আমার নাম সোলেমান। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ ইলিয়াসের অ্যাসিস্ট্যান্ট।

-কই, আপনাকে এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না তো? -আমাদের যতো কম দেখবেন ততোই ভালো। সোলেমান হাসেন।

কপালের ঘাম মুছবার জন্য পকেট থেকে রুমাল বের করবার সময় ইচ্ছে করেই তিনি এক খণ্ড শক্ত কাগজ মাটিতে ফেলে দেন। পুলিশের আইডেন্টিটি কার্ড-চিনতে পারে রোকসানা। কিন্তু সে ভালো করে দেখবার আগেই সোলেমান সেটাকে তুলে পকেটে পুরে ফেলেন।

কার্ড ফেলার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। লোকটিকে পুলিশের গুপ্ত বিভাগের লোক বলে চিনতে পেরে রোকসানা এতক্ষণে বলে,-চলুন, ভেতরে গিয়ে বসবেন। বৈঠকখানায় গিয়ে একটা বেতের চেয়ারে বসেই সোলেমান জিজ্ঞেস করেন,-বাড়িতে আর কেউ নেই?

-ছোট ভাই আছে, দশ বছর বয়েস।

-আপনার মা?

-নেই! মা-কে হারিয়েছি অনেকদিন।

-ও, তাহলে তো মস্ত মুসিবত। অন্ততঃ এদিক বিবেচনা করে আপনার পিতার জামিন হওয়া উচিত ছিল। আমরা তো সবাই আশা করেছিলাম জামিন হবে। কিন্তু জামিনের কর্তারা এ রকম বেঁকে বসবেন, তা ভাবতে পারিনি। কিছু খরচ-বরচ করেননি বোধ হয়?

না।

-তা হলে আর কি আশা করতে পারেন। কিছু খরচ-বরচ করলে জামিন হয়ে যেতো। কেসটা অবিশ্যি খুবই গুরুতর। ৪৮৯-বি ধারা। যাবজ্জীবন যার সাজা।

রোকসানা শিউরে ওঠে।

সোলেমান বুঝতে পারেন, ঠিক জায়গায় আঘাত করা হয়েছে। আঘাতটাকে

আরো বেদনাদায়ক করার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, জালনোটও পাওয়া গেছে

একটা দু’টো নয়। আর যে অবস্থায় পাওয়া গেছে- রোকসানার চোখ টলটল করে। সে কিছু বলবার চেষ্টা করে। কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না।

সোলেমান জিভের আগা দাঁতে ঠেকিয়ে শ্চーশ্চ-শ্চ শব্দ করে আফসোস প্রকাশ করেন। তারপর বলেন,-বুড়ো বয়সে কেন এমন কাজ করতে গেলেন।

এখন কি উপায় হবে আপনাদের? আমি তো আপনাদের ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার দেখছি। কোনো আত্মীয়স্বজন আছে এখানে?

-না। ধরা গলায় বলে রোকসানা। কোলকাতার রায়ট থেকে জান নিয়ে পালিয়ে এসেছি আমরা।

-ও-হো, রিফিউজী আপনারা। শ্চ-শ্চ-শ্চ। আবার আফসোস করেন সোলেমান।

রোকসানা এবার অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে,-আচ্ছা, এ মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার কি কোনো পথ নেই? আমার বাবা কিন্তু নির্দোষ। তিনি এ কাজ করতেই পারেন না।

সোলেমান অবিশ্বাসের হাসি হেসে বলেন, মুক্তি? কেন, ইন্সপেক্টর কিছু বলেননি?

-উহুঁ, নাতো! ও হ্যাঁ, তিনি বলেছিলেন তাঁর সাথে এক জায়গায় যেতে।

-এক জায়গায় যেতে। আপনি যেতে রাজী হয়েছেন?

-না।

-না করেছেন, ভালো করেছেন। কোথায় গিয়ে কোন্ বিপদে পড়বেন, বলা তো যায় না। এ ছাড়া আর কিছু বলেননি।

-না তো!

-এই দেখুন, উনি আবার একটু বেশি লাজুক। শুনুন, তাঁর সাথে এ কেস নিয়ে আমাদের আলাপ হয়েছে। তবে-সোলেমান কথা শেষ না করলেও রোকসানা আঁচ করতে পারে, কি তার বক্তব্য। তবুও সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।

-তবে কি না টাকা ঢালতে হবে অনেক। বুঝতেই তো পারছেন, কঠিন মামলা। শক্ত গেরো চারদিকে। প্রত্যেকটা গেরো খুলতে টাকা ঢালতে হবে। এই ধরুন না সার্চ লিসটের সাক্ষী। বিনে টাকায় তাদের এক চুল নড়ানো যাবে না। রোকসানার চিন্তাক্লিষ্ট মুখে হতাশা ফুটে ওঠে। সে বলে, টাকার অঙ্কটা জানতে পারি কি?

-টাকার অঙ্ক বলে তো কিছু লাভ নেই। আপনার সামর্থ্য কি সেটা আগে জানা দরকার।

-সামর্থ্য আর কী-ই বা আছে! যা ছিল, সবইতো আপনারা জাল বলে- ‘

সীজ’ করেছেন। এখনতো আর হাতে কিছুই নেই।

-একটু চেষ্টা করলেই হাতে এসে যাবে।

-টাকার পরিমাণটা জানতে পারলে একবার চেষ্টা করে দেখতাম।

-কম সে কম তিন হাজার। এর কমে মিঃ ইলিয়াসকে রাজী করানো যাবে না।

রোকসানার চিন্তাক্লিষ্ট মুখে হতাশা।

সোলেমান তাকান রোকসানার মুখের দিকে। তার মন বুঝি বা নরম হয় একটু। তিনি বলেন,- আচ্ছা আপনি যোগাড় করুন যতটা পারেন। কাল ঠিক এ সময়ে আমি আসবো। আমার এখানে আসার কথাটা যেন কাকপক্ষীও জানতে না পারে। ব্যাপারটা কোনো রকমে ফাঁস হয়ে গেলে বিপদ আছে। কারণ এন্টিকরাপশান কোথায় ঘাপটি মেরে আছে, বলা তো যায় না। আর হ্যাঁ শুনুন, মিঃ ইলিয়াসকেও আমার কথা কিছু বলবেন না। তিনি আবার রাঘববোয়াল কি- না! সবটা একাই গিলতে চান। এদিকে মনে হচ্ছে তিন হাজার টাকা যোগাড় করাও আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় যদি তিনি জানতে পারেন, এ কম টাকার কারবারে আমিও ভাগীদার রয়েছি, তবে হয়তো তিনি খুদ খেয়ে পেট নষ্ট করতে চাইবেন না। ফলে আমিও কিছু পাবো না, আর আপনাদেরও মুশকিল আসান হবে না। তার চেয়ে বরং মিঃ ইলিয়াসকেই খুশি করুন। ইচ্ছে হয়, আমাকে যৎসামান্য দেবেন। আর না দিলেও আমি কিছু মনে করবো না। আমি কাল এসে সব বুঝিয়ে দিয়ে যাবো। আচ্ছা আসি।

রোকসানা তার সোনার অলঙ্কার বিক্রি করে। একমাত্র মেয়ের বিয়ের অলঙ্কার কোলকাতার বি. সরকারের দোকান থেকে করিয়ে রেখেছিলেন জাফর আহমদ। অলঙ্কারগুলোর জন্যে রোকসানার এতোটুকু দুঃখ নেই। তার পিতার মুক্তির চেয়ে কিছুই আজ বড় নয়। কিন্তু ওগুলো বিক্রি করে টাকা এসেছে মাত্র দেড় হাজার। এ টাকায় কতদূর কি হবে বুঝে উঠতে পারে না রোকসানা।

সোলেমান পরের দিন যথাসময়ে আসেন। রোকসানা পনেরোখানা একশ’ টাকার নোট তার সামনে এনে রাখে। সোলেমান নোটগুলো দেখে বলে ওঠেন, -বাঃ বেশ কড়কড়ে নোট তো! জাল-টাল নয়তো? সোলেমান হাসেন।

-হ্যাঁ, জাল নোটই। এই মাত্র ছাপা হয়ে এলো আমাদের কারখানা থেকে। হাসে রোকসানাও।

সোলেমান একখানা একশ’ টাকার নোট তুলে ভালো করে এপিঠ-ওপিঠ দেখেন। তারপর নিজের পকেট থেকে একটা ময়লা একশ’ টাকার নোট বের করে বদলে নিতে নিতে বলেন, ব্যাড মানি ড্রাইভস গুড মানি আউট অব সার্কুলেশন। তারপর কতকগুলো দশ টাকার নোট বের করে বলেন, – পকেটের বোঝাটাও একটু কমিয়ে নিচ্ছি। বড্ড ভারী হয়ে আছে পকেট।

সোলেমান নোটগুলো গুনে রোকসানার হাতে দিয়ে বলেন,-দুশ’ টাকা। গুনে নিন। তারপর নিজেই দু’টো একশ’ টাকার নোট টেবিল থেকে তুলে নিজের পকেটে রেখে দেন। সোলেমান বলেন,-টাকাতো মাত্র দেড় হাজার। এতো অল্প-সল্প টাকা আমি নিয়ে গেলে মিঃ ইলিয়াস রাজীই হবে না। কেন রাজী হবে না, কালই আপনাকে বলেছি। কাল ভোরের দিকে মিঃ ইলিয়াসকে আপনার এখানে আসবার অনুরোধ করে পাঠান। এক টুকরো কাগজে লিখে পাঠালেই চলবে। ১৫ নম্বর সাদত হাসান লেনে তাঁর বাসা। তিনি হলে বলে-কয়ে টাকাটা গছিয়ে দেবেন। একবার টাকা নিলে তিনি আপনাদের কাজ করবেন। আমার জন্যে অবশ্য ভাববেন না। পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু ধরে দিলে দেবেন, আর না দিলেও-

-না না, আপনার সম্মানী আপনি পাবেন।

রোকসানা তিনটা একশ’ টাকার নোট সোলেমানের হাতে তুলে দেয়।

সোলেমান টাকা পকেটে রেখে বিনয়ের সুরে বলেন, আমার এ না হলেও চলতো। এবার মিঃ ইলিয়াসকে খুশি করার চেষ্টা করুন। ও হ্যাঁ, আমার কথা কিন্তু মিঃ ইলিয়াসকে বলবেন না। তা হলে কিন্তু ঐ যে বলেছি, সব গোলমাল হয়ে যাবে। আচ্ছা আসি এবার।

-আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। ভবিষ্যতেও আপনার সাহায্য পাবো, আশা করি।

-নিশ্চয়ই।

পরের দিন ভোর বেলা। পশ্চিমদিক থেকে একটা জীপ আসে। রোকসানাদের বাড়ি ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে সেটা বিগড়ে যায়। জীপের চারজন আরোহী নেমে চলে যায়। ড্রাইভার জীপের বনেট খুলে এটা-ওটা নাড়াচাড়া করে। কিন্তু তার

একজোড়া চোখ রোকসানাদের বাড়ির দরজায় সতর্ক দৃষ্টি ফেলছে। ইন্সপেক্টর ইলিয়াস মোটর সাইকেলে এসে নামেন। দরজা খটখট করতেই রোকসানা এসে দরজা খুলে তাঁকে ভেতরে নিয়ে যায়।

জীপের ড্রাইভার হাত বাড়িয়ে গাড়ির হেডলাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে নিবিয়ে দিয়ে আবার জ্বালায়। এরকম তিনবার সঙ্কেত দেয়ার কিছুক্ষণ পর আরোহী চারজন ফিরে আসে। তারা পাঁচজন এবার রোকসানাদের বাড়ির

দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। ইলিয়াস মিনিট পনেরো পরে বেরিয়ে আসেন। দরজার বাইরে পা দিতেই পাঁচজন লোক তাঁকে ঘিরে ফেলে।

ইলিয়াস দু’জনকে চিনতে পারেন। একজন মিস্টার আহমদ বাকের, ম্যাজিস্ট্রেট। জাফর আহমদের জামিনের দরখাস্তে ইলিয়াসের সুপারিশের জন্য ইনিই সেদিন বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। অন্যজন মিঃ আফতাব, দুর্নীতি দমন বিভাগের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট।

মিঃ আফতাব বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ও সাক্ষীদের সামনে আপনার পকেটের সব কিছু খুলে দেখান।

ইলিয়াসের বুঝতে বাকি নেই কিছু। তিনি তাঁর পকেটের কাগজপত্র, দু’টো পকেটের সব কিছু খুলে দেখান।

-আর কি আছে খুলে দিন। মিঃ আফতাব বলেন।

-অবিশ্বাস করছেন যখন তখন সার্চ করে নিঃসন্দেহ হওয়াই উচিত।

মিঃ আফতাবের নির্দেশে একজন সাক্ষী ইলিয়াসের শরীর তল্লাশের কাজে লেগে যায়।

দরজা বন্ধ করবার জন্য ইলিয়াসের পিছু পিছু এসেছিল রোকসানা। দরজা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় দেখে এ কাণ্ড। কিছুই বুঝতে পারে না সে। গতকালের সোলেমান নামধারী লোকটি অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। রোকসানার চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ নামিয়ে নেয়। আস্তে আস্তে সরে গিয়ে রাস্তার ভিড়ের মাঝে গা ঢাকা দিতে চেষ্টাও করে। রাস্তায় বেশ ভিড় জমে গেছে ইতিমধ্যে।

ইলিয়াসের শরীর তল্লাশ করে কিছুই পাওয়া যায় না। ম্যাজিস্ট্রেট কাগজপত্র ও খুচরো পয়সা ইলিয়াসকে ফেরত দেন। চোখে চশমা পরে তিনি নোট দু’খানা উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখেন। তাঁর মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে। তিনি মাথা নাড়েন।

-কি স্যার, দস্তখত নেই? মিঃ আফতাব জিজ্ঞেস করেন।

-উঁহু। এই বিশ টাকা ঘুষের জন্যে ইনি এসেছেন বলে মনে হচ্ছে নাকি আপনার? কী যে করেন আপনারা।

-তবুও স্যার, নম্বর মিলিয়ে দেখি একটু। মিঃ আফতাবের সন্দেহ তখনো ঘোচেনি।

ম্যাজিস্ট্রেট পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে মিঃ আফতাবের হাতে দেন। তিনি কাগজে লিখিত নম্বরের সাথে নোট দু’টোর নম্বর মিলিয়ে দেখেন। কিন্তু নম্বরও মিলে না।

এতোক্ষণ পরে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় রোকসানার কাছে। সে দৌড়ে যায় বৈঠকখানা ঘরে। টেবিলের ওপর বই চাপা দেয়া রয়েছে বারোশ’ টাকা। অনেক অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও ইলিয়াস স্পর্শ করেননি এ টাকা। সোলেমান নামধারী লোকটি যে নোটগুলো বদলে দিয়ে গিয়েছিল সেগুলো বেছে বের করে রোকসানা। কি আশ্চর্য! সবগুলোতে একই দস্তখত।

রোকসানা আবারও গিয়ে দরজায় দাঁড়ান। ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট বিগড়ে যাওয়া সেই জীপটায় উঠে রওনা হন। সোলেমান নামধারী লোকটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সে নিশ্চয় সরে পড়েছে। তার সরে পড়ার কারণ বুঝতে কষ্ট হয় না রোকসানার।

ইলিয়াস মোটর সাইকেলে উঠে রওনা হন। ভিড়ের সমস্ত লোকের দৃষ্টি তাঁর ওপর। পাশের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যায় রোকসানার সঙ্গে। তাঁর চোখ থেকে শ্লেষ ও ঘৃণা ঠিকরে বেরুচ্ছে। আর সে দৃষ্টির প্রচণ্ডতায় রোকসানার চোখ দু’টো যেন ঝলসে যায়, দুমড়ে মুচড়ে যায় বুকের ভেতরটা।

পিতার মুক্তিচিন্তায় মুসড়ে পড়লেও ইলিয়াসের কথার মধ্যে একটা আশার আভাস পেয়েছিল রোকসানা। কিন্তু আজকের ঘটনাটা সে আশার দীপ ফুৎকারে নিবিয়ে দিয়ে গেছে। ইলিয়াসের সাহায্যে বা সহানুভূতি কোনোটাই আর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, বুঝতে পারে রোকসানা।

ইলিয়াসকে নিয়ে মোটর সাইকেলটা রাস্তার মোড়ে অদৃশ্য হয়ে যাবার পরও রোকসানা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। তারপর হতাশ-বিহ্বল শরীরটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে সে একটা সোফায় ঢেলে দেয়। তার একটা কথাই বারবার মনে হয়, ইলিয়াস নিশ্চয়ই মনে করে থাকবে, তাঁকে ফাঁদে ফেলবার জন্যে রোকসানাই দুর্নীতি দমন বিভাগে খবর দিয়ে এই কাণ্ড করেছে। ঘৃণায় কুঞ্চিত তাঁর ভ্রূ ও সশ্লেষ দৃষ্টি থেকেই এটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে সে।

ইলিয়াসকে ফাঁদে ফেলবার যোগসাজসের মধ্যে সে ছিল না-এইটুকু ভেবে রোকসানা নিজের মনকে হাল্কা করবার চেষ্টা করে। কিন্তু মনের ভার তাতে একটুও লাঘব হয় না।

টেবিলের ওপর নোটগুলো এলোমেলো ছড়িয়ে পড়ে আছে। বাতাসের ঝাপটায় দু’-চারখানা পড়েও গেছে মেঝের ওপর। নোটগুলো যেন ছিঃ ছিঃ করছে রোকসানার দিকে চেয়ে। বলছেও যেন ইলিয়াসের গম্ভীর গলার সে ক’টা কথা,-কিসের টাকা এ? জাহান্নামের টিকেট কেনবার জন্যে? কিন্তু আমি জাহান্নামে যেতে রাজী নই, বুঝেছেন? মারি কড়ি পারি যথা যে বা কৌশলে- এই মতের মতলববাজ যারা টাকার পাহাড় তৈরি করছে আমি সে দলের নই।

ইলিয়াসের সততায় মুগ্ধ না হয়ে পারে না রোকসানা। সে উঠে গিয়ে চিঠি লিখতে বসে ইলিয়াসকে। আজকের ব্যাপারে তার যে কোনো হাত ছিল না, সেটাই সে বিস্তারিত লেখে চিঠিতে। ব্যাপারটার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে সে ক্ষমাও চায় ইলিয়াসের কাছে। কিন্তু চিঠিটা ভাঁজ করে খামে পুরবার সময় কি ভেবে সে ওটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেয়।

তাড়াতাড়ি সে কাপড়-চোপড় বদলে একাই বাড়ি থেকে বেরোয়। একটা রিকশায় উঠে রিকশাচালককে নির্দেশ দেয়, সাদত হাসান লেন। ইলিয়াসের বাসা দোতলায়। রোকসানা সিঁড়ির গোড়ায় গিয়েই দেখে, ইলিয়াস নেমে আসছেন ওপর থেকে। তাঁর হাতে একটা অ্যাটাশে কেস, অন্য হাতে ছোট হোল্ডলে বাঁধা বিছানা। ইলিয়াস নেমে এসে জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার?

-ব্যাপার কিছু নয়। তবে আজকের ব্যাপারটার জন্যে অত্যন্ত দুঃখিত।

-হ্যাঁ, দুঃখিত হবারই কথা। ফাঁদে ফেলতে পারলে নিশ্চয় খুশি হতেন। -তা বলুন আপনার যা ইচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানতাম না।

-জানলেও কিছু সুবিধে হতো না। যাক, আমার একটু তাড়া আছে।

-কোথাও যাচ্ছেন?

-তাতো দেখতেই পাচ্ছেন।

-কোথায়, জানতে পারি কি?

-মাপ করবেন। ইলিয়াস ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চলতে শুরু করেন।

-শুনুন। রোকসানাও সাথে সাথে এগোয়। ঐদিন আপনার সাথে কোথায় যেতে বলেছিলেন?

-কেন?

-আমি যাবো আপনার সাথে।

-একজন অনাত্মীয় অপরিচিত যুবকের সাথে কোথায় যাবেন আপনি?

-যেখানে নিয়ে যাবেন। আপনার যে পরিচয় পেয়েছি তাই যথেষ্ট।

-কিন্তু আপনার পরিচয় তো আমি পাইনি। আচ্ছা আসি।

ইলিয়াস একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়েন। চলন্ত রিকশার দিকে বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে রোকসানা। মোড় ঘুরে রিকশাটা অদৃশ্য হতেই নিজের অজান্তে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

কে যেন ডাকছে। পেছন ফিরে রোকসানা দেখে, একজন প্রৌঢ়া মহিলা সিঁড়ির ওপর থেকে ডাকছেন।

প্রৌঢ়ার ডাক উপেক্ষা করতে পারে না রোকসানা। সে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে যায়। তার একটা হাত আকর্ষণ করে প্রৌঢ়া জিজ্ঞেস করেন, কে মা তুমি? -আমাকে আপনি চিনবেন না। আমার বাবার মামলার তদন্ত করছেন ইলিয়াস সাহেব।

-ও আচ্ছা। একটু থেমে আবার বলেন প্রৌঢ়া, আমি ইলিয়াসের ফুফু। চলো মা, ভেতরে গিয়ে বসি। মামলার ব্যাপারে ওরা কাছে কাজ ছিল বুঝি?

-হ্যাঁ, কিছু কাজ ছিল। কিন্তু উনিতো ভারি ব্যস্ত। কোথায় যেন চলে গেলেন।

-হ্যাঁ, মা, ভারি ব্যস্ত।

রোকসানা বসে। তার পাশেই তেপায়ার ওপর একটা বেহালা।

-বেহালা কে বাজায়? কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে রোকসানা।

-আবার কে! ও-ই বাজায় মাঝে মাঝে। বেহালাটা কেস-এর ভেতর রাখতে রাখতে আবার বলেন ফুফু, আজ অনেকদিন পরে ওটা নিয়ে বসেছিল একটু। ভোরে কোথায় গিয়েছিল। সেখান থেকে যখন ফিরে আসে, দেখি মুখ ভার ভার। জিজ্ঞেস করলাম, কিছুই বললো না। বেহালাটা নিয়ে বসলো। কি বলবো মা, ও বেহালা বাজাচ্ছিল, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো ও বেহালার সুর নয়। যেন আমার ইলুই কাঁদছে। তারপর এই তো কিছুক্ষণ আগে কোথেকে এক টেলিগ্রাম এলো। ব্যাস, বেহালা-ছড় ফেলে ছুটলো। কোথায় গেলো কে জানে? এতো করে বললাম, খেয়ে যা। না হয় পরের কোনো ট্রেনে যাস। তাসে কিছুতেই শুনলো না। কাজ পড়লে আর কোনো কিছুর দিকে খেয়াল থাকে না। এ আচ্ছা এক কাজ পাগলা ছেলে।

-উনি কবে ফিরবেন?

-তা কি আর বলে যায় মা। ও নিজেও বোধ হয় জানে না, কবে ফিরতে পারবে। ঘরের ভাত বড় একটা মুখে যায় না ওর।

রোকসানার বুকের ভেতর বেদনার মেঘ জমতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পর্শ পেলেই বর্ষণ শুরু হয়ে যেতে পারে। তাই সে উঠে পড়ে। রুদ্ধ কণ্ঠে কোনো রকমে উচ্চারণ করে, আজ আসি। আর একদিন আসবো।

সদানন্দ ক্লাবের ঠিকানায় আর একটা সাঙ্কেতিক চিঠি আসে। কিন্তু এবার আর এ. চৌধুরীর নামে নয়। কোনো এক লুৎফর রহমানের নামে। সাবইন্সপেক্টর আবিদ চিঠিটার প্রতিলিপি রেখে ইলিয়াসকে জরুরী টেলিগ্রাম করেছিলো।

টেলিগ্রাম পেয়ে ইলিয়াস রংপুর আসেন। গুপ্ত চিঠিটার পাঠোদ্ধার করতে এবার আর কোনো অসুবিধাই হয় না, কারণ চিঠিটার ছদ্মঅক্ষরগুলো ঠিক আগেরটার মতোই। আজেবাজে এটা-সেটা লেখার পর লিখেছে ‘আগামী ৭ই মার্চ বিকেল পাঁচটার দিকে আমি পোড়াদহ পৌঁছব। লালু ও শ্যাম আমার সাথে যাবে, তুমি এসো।’

৭ই মার্চের এখনো তিনদিন বাকি। এই তিনদিনের মধ্যে সদানন্দ ক্লাবের প্রত্যেকটা লোকের চেহারা চিনে ফেলা দরকার। ইলিয়াস ডাকবাংলো ছেড়ে হোটেল তিস্তার দোতলার একটা কামরায় গিয়ে ওঠেন। হোটেলটা সদানন্দ ক্লাব থেকে অল্প দূরে রাস্তার উলটো দিকে। এখান থেকে ক্লাবের ওপর চোখ রাখতে অসুবিধে হবে না। ইলিয়াস তার বাইনোকুলার বের করে নেন। খাটটাকে জানালার কাছে নিয়ে গিয়ে ইচ্ছেমতো শুয়ে বসে লক্ষ্য করতে থাকেন। ক্লাবঘরে কারা আসছে, ভেতরে কে কি করছে-সব দেখা যায় বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে।

তিনদিনের পরিশ্রমে ক্লাবের সব লোকের চেহারাই এক রকম চেনা হয়ে যায় ইলিয়াসের। তারপর ৭ই মার্চ খুব ভোরে উঠে হোল্ডল ও এট্যাশে কেস আবিদের কাছে রেখে শুধু একটা কাপড়ের ঝোলা কাঁধে চড়িয়ে রংপুর রেলস্টেশনে গিয়ে বসেন ইলিয়াস। পোড়াদহ বিকেল নাগাদ পৌছতে হলে এগারোটার ট্রেন ধরতেই হবে। ভোর সাতটায়ও পোড়াদহ যাওয়ার একটা গাড়ি আছে। এতো আগে হয়তো যাবে না লোকটা। কিন্তু যেতেও তো পারে। ইলিয়াস বার বার জায়গা বদল করে দৃষ্টি রাখেন প্রবেশপথের সিঁড়ির দিকে।

সাতটার ট্রেন চলে যায়। কিন্তু সদানন্দ ক্লাবের কাউকে ট্রেনে উঠতে দেখা যায় না। ইলিয়াস স্টেশনে পায়চারি করেন। কিন্তু তাঁর সর্তক দৃষ্টি সর্বত্র, বিশেষ করে টিকেট ঘরের প্রবেশপথের দিকে।

অবশেষে সাড়ে দশটার সময় রিকশা থেকে নামেন একজন লোক। বয়স পঁয়ত্রিশের ওপর। তার হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ। লোকটিকে অনেক রাত পর্যন্ত ক্লাবে তাস নিয়ে ফ্লাশ খেলতে দেখেছেন ইলিয়াস।

লোকটি টিকেট করবার জন্যে ইন্টার ক্লাস কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ায়। ইলিয়াস তার কাছাকাছি থার্ড ক্লাস টিকেটের কিউতে দাঁড়িয়ে যান। পোড়াদহের টিকেট চাইছে লোকটা। ইলিয়াসের সর্বশরীর আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়। এই সেই লোক, কোনো সন্দেহ নেই। বহুদিনের বহু পরিশ্রমের পর আজ একজনের সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে। লোকটা যে ইন্টার ক্লাস কামরায় ওঠে, তার পাশের থার্ড ক্লাস কামরায় উঠে বসেন ইলিয়াস।

সাড়ে পাঁচটার সময় গাড়ি পোড়াদহ পৌঁছে। লোকটি নেমে সোজা ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে গিয়ে ওঠে। ইলিয়াস চলতে চলতে জানালা দিয়ে ওয়েটিং রুমের ভেতরটা দেখে নেন। সেখানে আর একজন মাত্র লোক। আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে আছে। লোকটি ফর্সা, কিছুটা বেঁটে, কিন্তু হৃষ্টপুষ্ট। তার চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। বয়স চল্লিশ, বড়জোর পয়তাল্লিশ। রংপুরের লোকটি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তার সামনে বসেছে। দু’জনে কথা বলছে অনুচ্চ স্বরে। বাইরে থেকে কিছু শোনা যায় না।

ওয়েটিং রুমের দুটি দরজা দুই প্ল্যাটফর্মের দিকে। দূর থেকে দুই দরজার দিকে নজর রাখা সম্ভব নয়। আবার ওয়েটিং রুমের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ্য করাও নিরাপদ মনে হয় না ইলিয়াসের কাছে। তিনি দূরেই সরে যান। ব্রাকেটে একটা ফোল্টহ্যাট ঝুলছে। ওয়েটিং রুমে তৃতীয় ব্যক্তি নেই এবং রংপুরীর মাথায়ও কোনো হ্যাট ছিল না। সুতরাং হ্যাটটা যে ঐ অভিজাত চেহারার লোকটারই তাতে কোনো সন্দেহ নেই ইলিয়াসের মনে। ইলিয়াস দূর থেকে জানালার ভেতর দিয়ে ফোল্ট হ্যাটটা লক্ষ্য করতে থাকেন আর মাঝে মাঝে পায়চারি করতে করতে গিয়ে দেখে আসেন।

ঘণ্টাখানেক পরে একবার চক্কর দিতে গিয়ে ইলিয়াস জানালা দিয়ে দেখেন, রংপুরী তার হাতব্যাগটা বন্ধ করছে। বোধ হয় এই মাত্র কিছু রেখেছে ওতে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রংপুরী বলে, আপনাকে তো আরো দু’ঘণ্টা বসে থাকতে হবে।

-হ্যাঁ, ন’টার ট্রেনেই আমি ফিরছি। গোয়ালন্দ গিয়ে ঢাকা মেল ধরবো।

কাল আমাকে ঢাকা পৌঁছতে হবে। বিশেষ দরকার।

রংপুরী বিদায়-সম্ভাষণ জানিয়ে বেরিয়ে আসে। ইলিয়াস অনুমান করতে পারেন, কোথায় কি উদ্দেশ্যে যাচ্ছে সে। ইলিয়াস ঘড়ি দেখেন-সন্ধ্যা সাতটা বাজে। সোয়া সাতটায় দর্শনার গাড়ী। দর্শনার ওপারেই বানপুর। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীদের কাছে জাল নোট চালাবার জন্যেই যাচ্ছে সে। এ লোকটারও পিছু নেয়ার প্রয়োজন। কিন্তু তাঁর অধীনস্ত সব ক’জনকে বিভিন্ন কাজে পাঠিয়ে দিয়ে একা এসেছেন তিনি। অগত্যা রংপুরীকে ছেড়ে তিনি নতুন লোকটার দিকে নজর দেন।

দু’ঘণ্টা পরে উঠবে লোকটা-তার কথা থেকেই জানা গেলো। লোকটা তাহলে ন’টার মিক্সড এ গোয়ালন্দ যাবে। ইলিয়াস নিশ্চিন্ত মনে রিফ্রেশমেন্ট রুমে গিয়ে ঢোকেন। তার খিদেও পেয়েছে খুব।

আধ ঘণ্টা পরে ফিরে আসেন ইলিয়াস ফোল্ট হ্যাটটা ঝুলছে ব্রাকেটে।

রাত সাড়ে আটটা। মিক্সড ট্রেন আসার আর মাত্র আধ ঘণ্টা দেরি। ইলিয়াস এবার চক্কর দিতে গিয়ে জানালা দিয়ে দেখেন-আরাম কেদারা খালি। তাঁর বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠে। কিন্তু ঐ যে ঝুলছে হ্যাটটা-নির্ভাবনার প্রতীক।

তিনি ওয়েটিং রুমের ভেতর ঢুকেই পড়েন। কিন্তু এ কি! তৃতীয় ব্যক্তিও ছিল এখানে! ডানদিকের কোণ ঘেষে একটা আরাম কেদারা। জানালা দিয়ে দেখাই যায়নি সেটা। ওখানে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। একখানা বইয়ের মধ্যে তিনি ডুবে আছেন।

ইলিয়াসের পায়ের শব্দে মনোযোগ টুটে যায় লোকটার। বই থেকে মাথা তুলে তিনি সময় জিজ্ঞেস করেন। সাড়ে আটটা। লোকটি এবার ধড়ফড় করে উঠে পড়েন। এট্যাশে কেসটা হাতে নিয়ে ফোল্টহ্যাটটা পাড়বার জন্যে হাত বাড়ান।

হায় হায়। কী ভুলটাই না হয়ে গেছে! আর এ ভুলের জন্যে পালিয়ে গেছে ধূর্ত শেয়ালটা। ইলিয়াস বুকিং কাউন্টার, প্ল্যাটফর্মের এদিক-ওদিক খোঁজ করেন। কিন্তু কোথাও আর লোকটার সন্ধান পাওয়া যায় না।

সোয়া সাতটায় দর্শনার গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর একটা মাত্র ট্রেন খুলনা এক্সপ্রেস ছেড়ে গেছে পৌনে আটটার সময়। তা হলে যশোর-খুলনার দিকেই গেছে লোকটা। কিন্তু রংপুরীর কাছে মিথ্যে করে ঢাকা যাওয়ার কথা বললে কেন সে? অপরাধীদের এটাই রীতি। দলের লোকের কাছেও তারা সত্য কথা বলে না। এটুকু ইলিয়াসের আগেই বোঝা উচিত ছিল।

পরবর্তী পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে যশোর খুলনা যাওয়ার কোনো গাড়ি নেই। এ পথে গিয়ে তাই লাভ হবে না কিছু। ইলিয়াস ঝটপট তার কর্তব্য স্থির করে ফেলেন। গুপ্ত চিঠির খামের ওপরে ডাকঘরের যে সীল ছিল তার থেকে অনুমান করা হয়েছে জালিয়াতের আস্তানা চাটগাঁয়ের কোথাও। সুতরাং চাঁদপুর গিয়ে অপেক্ষা করলে লোকটার দেখা পাওয়া যেতেও পারে।

ইলিয়াস মিক্সড ট্রেনে গোয়ালন্দ গিয়ে চিটাগং মেল ধরেন। স্টীমার চাঁদপুর পৌছায় পরের দিন সন্ধ্যার সময়। চাঁদপুর স্টেশনে যে সমস্ত জাহাজ ভিড়ে তার কোনোটাই বাদ দেন না ইলিয়াস। জেটিতে দাঁড়িয়ে অগণিত যাত্রীর মাঝে অভিজাত চেহারার বেঁটে লোকটার সন্ধান করেন তিনি। তাঁর চোখে ব্যথা ধরে যায়। শেষে তৃতীয় দিন বিকেল দু’টোয় বরিশাল-ঢাকা স্টীমার থেকে নামে সেই লোক। স্যুটের বদলে পাজামা-শেরোয়ানী পরেছে সে। মাথায় জিন্নাহ টুপি। চোখদু’টো একটু অসাবধান হলেই ফস্কে গিয়েছিল আর কি!

ইলিয়াস নিজের চোখদু’টোর জন্য গর্ব অনুভব করেন মনে মনে। অসংখ্য যাত্রীর মাঝ থেকে বেশবাস পরিবর্তিত মাত্র কিছুক্ষণের দেখা লোকটি চিনে বের করা কম কৃতিত্বের কথা নয়। পোড়াদহ স্টেশনে অল্পক্ষণের দেখা লোকটাকে ক্যামেরার লেন্সের মতোই চোখদু’টো তাঁর মনের পর্দায় ছাপ মেরে রেখেছে।

ট্রেন একটা দাঁড়িয়েই ছিল। আর লোকটার বোধ হয় গন্তব্য অবধি টিকেট করা ছিল। সে চাটগাঁগামী ট্রেনের একটা প্রথম শ্রেণীর কামরায় উঠে বসে। ইলিয়াস ভিড়ের মাঝে মিশে থাকাটা পছন্দ করেন। আর তার ময়লা বেশবাস ট্রেনের উচ্চ শ্রেণীর উপযোগী নয়। তিনি তৃতীয় শ্রেণীর টিকেট কেটে পাশের কামরায় উঠে পড়েন। লোকটির গন্তব্যস্থান জানা না থাকায় তাকে এ লাইনের শেষ স্টেশন চাটগাঁয়ের টিকেট কাটতে হয়।

ট্রেন ছাড়ে বিকেল সাড়ে তিনটায়।

ধুমঘাট পৌছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। ইলিয়াস চিন্তিত হয়ে পড়েন। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। লোকটা যে কোন্ স্টেশনে নামবে, কিছু জানা নেই। সম্ভবতঃ চাটগাঁয়েই নামবে। তবু কোনো স্টেশনে গাড়ি থামবার সাথে সাথে তিনি জানালায় মুখ বাড়ান।

কুমিরা স্টেশনে নামে লোকটা। ইলিয়াসও নামেন। লোকটি গটগট করে গেট পার হয়ে চলে যায়। কিন্তু তাড়াতাড়ি গেট পার হতে গিয়ে বাধা পান ইলিয়াস। তাঁর অপরিচ্ছন্ন পোশাক দেখে ঠাট্টা করতেও বাধে না টিকেট কালেকটরের, ‘অত সঅরে কডে যাইতা লাইগ্যন এক্সপ্রেস সাব? টিঅট সাই।’ টিকেট দেখে আবার সে বলে, চাডিগ দূরঅস্ত। ইবাতো কুমিরা।’

-অ আঁই অ্যাডেই লামি ফইল্যাম।

-টিঅট চাডিগর, অ্যাডে আমি ফইল্যাম মানি?

-ইবার মানি কিছু নাই। মেহেরবানী করি পথ ছাড়ন।

ইলিয়াসের ভাষা শুনে স্থানীয় লোক মনে করে টিকেট কালেকটার। সে পথ ছেড়ে দেয়। ইলিয়াস তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে লোকটাকে দেখবার চেষ্টা করে। কিন্তু তাকে আর দেখা যায় না। কিছু দূরেই রাস্তাটা বাঁ দিকে মোড় নিয়েছে। মোড় ঘুরে সে চোখের আড়ালে চলে গেছে বোধ হয়।

যেতে যেতে ইলিয়াস শুনতে পান, টিকেট কালেক্টর টিটকারি মারছে,-হুঁহ, থাড কেলাস লোক ইবার কতা কওনের ডং দেইক্কোনা। টিঅট চাডিগর আর তেই কুমিরা লাইম্যে। এই রইম্যা পঅল গাছত ধরেরন্যা।’

একটা গাড়ির স্টার্ট দেয়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। মোড় পর্যন্ত যেতে যেতে গাড়ি অনেক দূরে চলে গেছে। গাড়ির নম্বরটাও পড়া গেল না।

ইলিয়াস হতাশায় ভেঙে পড়েন। টিকেট কালেক্টরের ওপর বিরক্তিতে তাঁর মেজাজ বিগড়ে যায়। লোকটা অন্ততঃ একটা মিনিটতো নষ্ট করেছে তাঁর। আর এই এক মিনিটের দাম যে কতো, তা শুধু তিনিই বোঝেন। এই একটু বিলম্বের জন্যেই তাঁর সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হয়ে যাবে বুঝি।

ইলিয়াস অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকেন গাড়িটা দেখার আশায়। দুটি লাল আলো ছুটে চলেছে। যেতে যেতে আলো দু’টো হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। ইলিয়াস অনুমান করেন, কোনো টিলার আড়ালে পড়ে গেছে বোধ হয় গাড়িটা। কিছুক্ষণ পরেই আবার দেখা যায় গাড়ির পেছনের দু’টো লাল আলো। এবার যে পথ ধরেছে সে পথে আরো দু’-একটা গাড়ি চলাচল করছে। বোধ হয় পাকা রাস্তা ধরেছে গাড়িটা। কিছুক্ষণ পরে আবার দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় সেটা। ইলিয়াস তবুও তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু গাড়িটা আর দেখা যায় না।

ইলিয়াস তাঁর ঝোলা থেকে একটা টর্চ লাইট বের করেন। রাস্তার ওপর আলো ফেলে তিনি এগিয়ে যান। ইটবিছানো রাস্তার বেশ কিছুদূর পর্যন্ত ভাঙা। কয়েকদিন আগে বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছিল এ এলাকায়। নরম মাটির ওপর টায়ারের সুস্পষ্ট দাগ রেখে গেছে গাড়িটা। টায়ারের দাগ দেখে বোঝা যায় গাড়িটা একটা জীপ।

এ এলাকায় জনবসতি বিরল। রাস্তায় লোকজন নেই। ইলিয়াস টায়ারের দাগ অনুসরণ করে চলেন। দূরে একটা টিলা দেখতে পান তিনি। তার অনুমান ঠিকই হয়েছে। এখানে এসেই গাড়িটা দৃষ্টির আড়ালে চলে গিয়েছিল একবার। আরো বেশ কিছু দূর হেঁটে তিনি পাকা রাস্তায় গিয়ে পড়েন। এবার আর চাকার দাগ দেখে অনুসরণ করবার উপায় নেই।

 

রাত বারোটা। আশে পাশে কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া শব্দ নেই। ইলিয়াস টিলার পাশের কাঁচা রাস্তায় ফিরে আসেন। একটা জায়গায় টায়ারের দাগ খুবই স্পষ্ট। কিছুটা জায়গার টায়ারের দাগ রক্ষা করা খুবই দরকার। হাত তিরিশেক জায়গায় টায়ারের দাগের চারপাশে বড় বড় কতকগুলো চাঙড় ফেলে রাখেন ইলিয়াস। এ পথে কোনো গাড়ি এলেও সেটা পাশ কাটিয়ে যাবে, চাঙড়ার স্তূপ ডিঙিয়ে টায়ারের দাগ নষ্ট করতে পারবে না।

ইলিয়াস এবার কিছুটা স্বস্তি বোধ করেন। রাত্রির অন্ধকারে টায়ারের দাগ নিয়ে কিছু করবার যো নেই। ভোর হোক, দিনের আলোয় ভালো করে পরীক্ষা করা যাবে তখন।

ইলিয়াস জনহীন টিলার ওপর উঠে একটা পরিষ্কার সমতল জায়গা বেছে নেন। বসন্তের মধ্যরাত্রি। উঁচু টিলার ওপর বাতাস বইছে হুহু করে। কেমন শীত শীত লাগছে তাঁর। ঝোলা থেকে চাদর বের করে বিছিয়ে নেন পাথালি করে যাতে চাদরের অর্ধেকটা দিয়ে বুক ঢাকা যায়। এবার ব্যাগটি মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়েন। ক্লান্তি ও অবসাদে ঘুম আসতে দেরি হয় না।

ভোরে যখন তাঁর ঘুম ভাঙে তখন ফিকে আঁধারে ছেয়ে আছে টিলাটা। লোক চলাচল শুরু হওয়ার আগেই তিনি টায়ারের দাগ পরীক্ষা শুরু করেন।

সামনের টায়ারের দাগ মুছে যায় পেছনের টায়ারের ঘযায়। নরম মাটিতে যে দাগ রয়েছে তা পেছনের টায়ার দু’টোরই। প্রত্যেকটি টায়ার ফেলে গেছে পাঁচ সারি করে সমাকৃতির স্পষ্ট আঁকাবাঁকা রেখা। অসংখ্য ইংরেজী অক্ষর ‘V’ যেন সারি বেঁধে শুয়ে আছে।

ইলিয়াস মনোযোগ দিয়ে দেখেন রেখাগুলো। পেছনের ডানদিকের টায়ারের মাঝের রেখাটির এক জায়গার একটি ‘V’ অনুপস্থিত। তিনি আরো একটু এগিয়ে গিয়ে দেখেন ‘V’-টা আবারও অনুপস্থিত। একটি গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে ওটা দিয়ে মেপে দেখেন। ‘V’-টার অনুপস্থিতি সমান দূরত্বে, পাঁচ হাত দূরে দূরে। তিনি বুঝতে পারেন টায়ারের জিগজাগ নালীর এক জায়গায় ”-টা কোনো কারণে ভেঙে গেছে বা তৈরি হওয়ার সময় কেটে গেছে। তাই প্রতিটি চক্করে একবার ‘V’-এর অনুপস্থিতি ঘটে।

ইলিয়াস এ বৈশিষ্ট্যটুকু সম্বল করে এগিয়ে যান পাকা রাস্তা ধরে। মাইল দুই দূরে একটা কাঁচা রাস্তা এসে মিশেছে পাকা রাস্তার সাথে। তিনি আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করেন, কাঁচা রাস্তায় সেই টায়ারের দাগ-সমান দূরত্বে ‘V’-এর অনুপস্থিতি। তিনি দেখে দেখে এগিয়ে যান। মাঝে মাঝে হারিয়ে যায় টায়ারের দাগ। এগিয়ে আবার খুঁজে বের করেন। মাইল দুয়েক গিয়ে কাঁচা রাস্তাটা আবার পাকা রাস্তায় মিশেছে। এবার আর টায়ারের চিহ্ন নেই। ইলিয়াস এগিয়ে যান। কিন্তু আর হদিশ করতে পারেন না, কোন্ দিকে গেছে জীপটা। একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন-রাস্তাটা হাটহাজারী থেকে এসে চলে গেছে সোজা চাটগাঁ শহরের দিকে। এখান থেকে হাটহাজারী চার মাইল আর চাটগাঁ শহর দশ মাইল। জায়গাটার নাম পায়রাছড়ি। ইলিয়াসের মনে সন্দেহ জাগে, জীপটা চাটগাঁ শহরের দিকে যায়নি তো?

তিনি এবার শহরের দিকে হাঁটা শুরু করেন। মাইলখানেক যাওয়ার পর দেখতে পান, রাস্তার খানিকটা ভাঙা আর বৃষ্টির দরুণ নরম হয়ে আছে সেখানকার মাটি। সেখামে গিয়ে টায়ারের দাগ খোঁজেন তিনি। কিন্তু সে দাগ আর পাওয়া যায় না।

জীপটা এদিক দিয়ে যায়নি তাহলে-ইলিয়াস ভাবেন। তবে লোকটা যেই হোক, চাটগাঁ শহরে না গিয়ে সে পারবে না। কাল না হোক পরশু, নয়তো কয়েকদিন পরে তাকে শহরে যেতেই হবে। এটাই যখন চাটগাঁ শহরে যাওয়ার সোজা রাস্তা, তখন এ ভাঙা জায়গাটার নরম মাটিতে টায়ারের দাগ ফেলেই যেতে হবে জীপটাকে।

ইলিয়াস হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়েছেন আজ আটদিন। ওদিকে নিশ্চয় তাঁর জন্যে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। হেডকোয়ার্টারে তাঁর ফিরে যাওয়া একান্ত দরকার। কিন্তু কাজটা এভাবে অসমাপ্ত রেখে যেতে তাঁর মন চাইছে না। শেষে মনস্থ করেন, আরো দিন কয়েক এখানে থেকে তিনি গাড়িটা খুঁজে বার করবেন।

রাস্তার আশেপাশে লোকালয় নেই। এদিকটায় লোক চলাচলও খুব কম। অনেকক্ষণ পর দক্ষিণদিক থেকে একটা খালি রিকশা আসতে দেখা যায়। ইলিয়াস রিকশায় উঠে হাটহাজারীর দিকে রওনা হন।

হাটহাজারী পৌছে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা হোটেল পাওয়া যায়। নাম-হোটেল ভাইভাই। টিনের ঘরটার দোতলায় ডবল সীটের একটা কামরা নিয়ে ইলিয়াস সেখানে ওঠেন।

তাঁর বেশবাস অপরিচ্ছন্ন। দাড়ি চাঁচা হয়নি পাঁচদিন। এক দিন গোসলও হয়নি। তিনি ঝোলা থেকে দাড়ি চাঁচার সরঞ্জাম বের করেন। কিন্তু হঠাৎ কি ভেবে সেগুলো ঝোলায় তুলে রাখেন। তাড়াতাড়ি গোসল সেরে তিনি লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে কামরায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়েন।

গত রাতে কিছুই খাওয়া হয়নি। নিচের রেস্তোরাঁয় বসে তিনি ভালো করে নাশতা করেন। তারপর পোস্টাপিসে গিয়ে জরুরী একটা টেলিগ্রাম পাঠান মিঃ আলী রেজার নামে-রফিককে বাহনসহ অবিলম্বে হাটহাজারীর-হোটেল ভাইভাই-এ পাঠিয়ে দিন।

ইলিয়াস।

হোটেলে ফিরে গিয়ে ইলিয়াস ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলেন। ঝোলা থেকে বের করেন একটা ময়লা ফতুয়া ও পুরনো গামছা। ফতুয়াটা গায়ে দিয়ে গামছাটা কাঁধে ফেলে, দরজায় তালা লাগিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন।

রাস্তার এক দোকান থেকে চারটে বনরুটি ও কিছু গুড় কিনে ঠোঙাটা গামছার খুঁটে বাঁধেন। তারপর আরো কিছু দূর হেঁটে বড় রাস্তার মোড় থেকে একটা রিকশা থেকে নামেন। রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে তিনি ধীরে ধীরে দক্ষিণদিকে হাঁটতে থাকেন।

রাস্তার ভাঙা জায়গাটার দশ-বারো হাত দক্ষিণে পুব পাশে একটা বড় ইউর‍্যাম গাছ। ইলিয়াস একটা আটকিরা গাছের ডাল ভেঙে গাছের তলাটা ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করেন। তারপর কাঁধের গামছাটা সেখানে বিছিয়ে তিনি বসে পড়েন।

টেলিগ্রামতো পাঠানো হলো। রফিককে কি আসতে দেবেন স্পেশাল অফিসার? -ভাবেন-ইলিয়াস। রফিককে নাকি কোন দাঙ্গা মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছে।

যারা তাঁর অধীনে কাজ করছে তাদের সবাইকে তিনি বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। আবিদ রংপুরে চিঠি সেনসারের কাজে নিয়োজিত। মহিউদ্দীন খুলনার কয়েকটা জাল নোটের মামলা তদন্ত করছে। মনোয়ারকেও ফরিদপুরের কয়েকটা জাল নোটের মামলা তদন্ত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ওয়াচার তিনজনের সবাইকে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে তোতলা দরবেশের পেছনে। তারা পালা করে সর্বক্ষণ দরবেশের গতিবিধির ওপর নজর রাখবে।

শুয়ে বসে সময় কাটে ইলিয়াসের। মাঝে মাঝে গাড়ির আওয়াজ শুনে তিনি সচকিত হন। এক ঝাঁক হরিয়াল এসেছিল উইর‍্যামের গোটা খাওয়ার জন্যে। পাখিগুলো অনেকক্ষণ ছিল। তিনি শুয়ে শুয়ে ওদের ডাকাডাকি শুনছিলেন, ঝাপটাঝাপটি দেখছিলেন। সময়টা ভালোই কেটেছিল। একঘেয়ে বাকি সময়টা আর কাটতে চাইছে না।

সন্ধ্যা পর্যন্ত এ রাস্তা দিয়ে দক্ষিণদিকে গেছে ছ’খানা গাড়ি আর উত্তরদিকে চারখানা। এগুলোর মধ্যে বাস চারখানা, প্রাইভেট কার তিনখানা, আর জীপ তিনখানা। তিনখানা জীপই সরকারী বলে মনে হলো। তবুও জীপগুলোর নম্বর টুকে তিনি টায়ারের দাগ পরীক্ষা করে দেখেন। কিন্তু সমান দূরত্বে ‘V’-এর অনুপস্থিতি দেখতে পান না। দু’টো জীপের টায়ার আবার অন্য কোনো কোম্পানীর তৈরি বলে মনে হলো। ওগুলোর দাগ আলাদা রকমের।

ইলিয়াস ফিরে আসেন হোটেলে। কোনো বাস বা রিকশা না পাওয়ায় তাঁকে চার মাইল পথ হেঁটেই আসতে হয়।

পরদিন খুব ভোরে সাব-ইন্সপেক্টর রফিক হোটেল ভাইভাই-এ পৌছে।

টেলিগ্রাম পেয়েই স্পেশাল অফিসার তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। রফিককে দেখে ইলিয়াস খুশি হন খুব। জিজ্ঞেস করেন,-জীপটা নিয়ে এসেছো তো?

-না, মোটর সাইকেল নিয়ে এসেছি। তেল বেশি পুড়বে বলে স্পেশাল অফিসার জীপটা দিলেন না। উনিতো ট্রেনেই আসতে বলেছিলেন। ট্রেনে এলে আজ দুপুরের আগে পৌছানো যেতো না।

-মোটর সাইকেলটা কোথায়?

-থানায় রেখে এসেছি।

-খুবই বুদ্ধিমানের কাজ করেছো। জীপটা হলে ভালো হতো। ওটা যখন আনতে পারোনি তখন মোটর সাইকেলটা দিয়েই কাজ চালাতে হবে। একটু থেমে তিনি আবার বলেন, তুমি খুবই ক্লান্ত। গোসল করে নাশতা খাও। তারপর একটানা ঘুম দাও দুপুর পর্যন্ত। আমি একটু পরেই বেরিয়ে যাবো। তুমি দুপুরের খাওয়া সেরে একটা রিকশা নিয়ে মাইল সাড়ে তিনেক যাবে চাটগাঁয়ের রাস্তা ধরে। তারপর হাঁটতে শুরু করবে দক্ষিণদিকে। আধা মাইল হাঁটলেই আমাকে পাবে। জায়গাটার নাম পায়রাছড়ি। প্যান্ট-শার্ট পরে গেলে কিন্তু চলবে না। এই আমার মতো লুঙ্গি-ফতুয়া বা লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে গামছা কাঁধে ফেলে গাঁয়ের সাধারণ মানুষের বেশে যাবে।

-কাজটা কি করতে হবে, স্যার?

-হ্যাঁ, জানাবো। একটা জীপের সন্ধান করতে হবে। টায়ারের দাগ দেখে চিনতে হবে জীপটাকে।

-টায়ারের দাগ দেখে। কিন্তু…

-ঘাবড়ে যেও না। দুপুরে যখন আমার কাছে যাবে তখন বুঝিয়ে দেবো।

ওদিককার খবর কি? তোতলা দরবেশের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে তো?

-হ্যাঁ স্যার, রাখা হচ্ছে।

-স্পেশাল অফিসার এ ব্যাপারে কিছু জানতে পারেননি তো?

-না, উনি কিছুই টের পাননি। উনি তো তোতলা দরবেশকে নিয়ে মেতে আছেন। তাঁর ইস্কাটনের দেয়ালঘেরা প্লটটায় টিনের ঘর তুলে দিয়েছেন দরবেশকে। তিনি এখন সেখানেই থাকেন। বেশ কিছু ভক্ত রোজই সেখানে ভিড় জমায়।

-আচ্ছা, বেশ জমিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যে!

-হ্যাঁ, ঐ জায়গাটা নাকি খুবই পবিত্র। দরবেশ স্বপ্নে দেখেছেন, আমাদের পয়গম্বরের পায়ের চিহ্ন নাকি আছে জায়গাটার কোথাও, মাটির নিচে।

-অ্যাঁ, তাই নাকি!

-হ্যাঁ স্যার, দরবেশ ওখানে দরগা বানাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তাই আলী রেজা সাহেব প্লটটা তোতলা দরবেশকে দান করে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ইলিয়াসের মুখে গাম্ভীর্য ছায়াপাত করে। গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয় তাঁর মন।

-স্যার তোতলা দরবেশের….

আচ্ছন্নতার ঘোর কাটিয়ে ইলিয়াস জেগে ওঠেন। বলেন, কি বলছিলেন? -স্যার, তোতলা দরবেশের চার-পাঁচজন চেলাও জুটেছে। কেউ বাজার করে, কেউ রান্না করে, একজন বাতাস করে, একজন হাত-পা টিপে।

-খুব ভালো। বেশ মৌজে আছে দরবেশ। যাকগে, তুমি দু’টোর মধ্যে পায়রাছড়ি পৌঁছে যাবে। যাওয়ার সময় একটা মাটির ছোট্ট কলসী কিনে নিয়ে যেও।

সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত পালা করে গাড়ির সন্ধান করছেন ইলিয়াস ও রফিক। রাস্তার ভাঙা জায়গাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই এর মধ্যে একবার রাস্তার পাশের নালা থেকে কলসী ভরে পানি তুলে জায়গাটা ভিজিয়ে দেয়া হয়েছে।

অবশেষে তৃতীয় দিন সাড়ে ন’টার সময় আসে একটা জীপ। নম্বর CH 1638। টায়ারের দাগ পরীক্ষা করে উল্লসিত হয়ে ওঠেন ইলিয়াস। সেই দাগ আর সমান দূরত্বে ‘V’-এর অনুপস্থিতি।

ইলিয়াস আর দেরি না করে চলে যান হাটহাজারী।

রফিককে পেছনে বসিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে ইলিয়াস শহরে যান। মোটর ভেহিকল্স রেজিস্ট্রেশান অফিসে গিয়ে রেজিস্টার খুলে CH 1638 নম্বরের গাড়িটার মালিকের সন্ধান করেন।

কিন্তু এ কি! নম্বরটাতো একটা অস্টিন কার-এর। গাড়িটার মালিকও বদল হয়েছে এক বছর আগে। বর্তমান মালিক থাকেন খুলনায়। গাড়িটা জীপ নয় বলে খুলনায় মোটর ভেহিকল্স রেজিস্ট্রেশান অফিসে খোঁজ করার কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না ইলিয়াস। তাহলে কি নম্বর বদল করে চালানো হয় জীপটা? নিজেকেই প্রশ্ন করেন ইলিয়াস।

তাঁর মনে সন্দেহ জাগে।

কি একটা মনে হতেই রেজিস্ট্রারের পাতা উল্টিয়ে CH 1938 নম্বরের গাড়ির পাতা বের করেন।

তাইতো। ঐ নম্বরের গাড়িটা জীপই বটে। মালিকের নাম তাহসীন পেগুওয়ালা। ঠিকানা: ২৩/১, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম।

রফিককে নিয়ে ইলিয়াস আন্দরকিল্লা চলে যান সেদিনই। মোটর সাইকেলটা রাস্তার পাশে রেখে তাঁরা হেঁটে হেঁটে খোঁজ করেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঠিকানাটা খুঁজে পাওয়া যায়। জুয়েল প্রিন্টিং প্রেসের ঠিকানা ওটা। কিন্তু জীপটাকে প্রেসের কাছাকাছি কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।

তাঁরা আর এক দণ্ডও বিলম্ব না করে পায়রাছড়ি চলে যান। মোটর সাইকেলটাকে রাস্তার বাঁ দিকের একটা ঝোপের উত্তর পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। দক্ষিণদিক থেকে আসার সময় ওটাকে দেখতে পাবে না কেউ।

প্রায় দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর CH 1638 নম্বরের জীপটাকে দেখা যায়। রাস্তার ভাঙা জায়গাটা পার হয়ে চলে যাওয়ার সাথে সাথে ইলিয়াস রফিককে টায়ারের দাগ দেখান। সেই একই রকম দাগ। সমান দূরত্বে ‘V’-এর অনুপস্থিতি।

রফিককে পেছনের সীটে তুলে মোটর সাইকেলটা নিয়ে ছুটে যান ইলিয়াস। জীপটা অনেক দূর চলে গেছে। ওটার দিকে দৃষ্টি রেখে তিনি মোটর সাইকেলের গতি আরো বাড়িয়ে দেন।

জীপটা বাঁ দিকের একটা কাঁচা রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে। ইলিয়াস সেদিকে না গিয়ে পাকা রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে যান। জীপটা এখনো দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে জীপটা বাঁ দিকে মোড় নেয়। ইলিয়াস তাঁর বাহন থামিয়ে রাস্তার বা দিকে ঝোপের আড়ালে ওটাকে রেখে দেন। দু’জনেই এবার মাঠের ভেতর দিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকেন।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দূরের একটা টিলার ওপর আলো দেখা যায়। কিন্তু জীপটা আর দেখা যায় না এখন। অল্প কিছুক্ষণ পরে টিলাটার পাদদেশের কিছু ওপরে গাড়ির হেডলাইট দেখা যায়। ওটা চক্রাকার রাস্তা ঘুরে টিলার ওপর উঠছে। কিছুক্ষণ পরে হেডলাইট আর দেখা যায় না। পেছনের লাল আলো দু’টো দেখা যায় এখন। অল্পক্ষণ পরেই গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে যায়। চার-পাঁচ মিনিট পর আবার হেডলাইটটা দেখা যায়। তারপর পেছনের দু’টো লাল আলো এভাবে চার-পাঁচ চক্কর দিয়ে গাড়িটা টিলার ওপর ওঠে।

ইলিয়াস ও রফিক ফিরে যান মোটর সাইকেলের কাছে। আজ আর কিছু করার নেই। জায়গাটার অবস্থান ভালো করে দেখে নিয়ে তাঁরা হাটহাজারী চলে যান।

হোটেলের কামরায় বসে ইলিয়াস রফিককে জিজ্ঞেস করেন, গাড়ির নাম্বার প্লেটটা ভালো করে লক্ষ্য করেছো তো?

-হ্যাঁ, করেছি।

-কি বুঝলে?

-নম্বরগুলো মেটালের। পেতলের বলেই মনে হলো।

-আর কিছু দেখলে?

-আর তো কিছু নজরে এলো না।

-শোনো, ওপরে ও নিচে নাট-বল্টু দিয়ে নম্বরগুলো আলাদা করে প্লেটের সাথে আটকানো। এবার বুঝতে পেরেছো তো CH 1938 কিভাবে CH 1638 হয়ে গেছে?

-হ্যাঁ, বুঝতে পারছি স্যার, নাইনকে উল্টো করে নাট-বল্টু দিয়ে আটকে দিয়েছে।

-হ্যাঁ, তাই। আবার প্রয়োজন মতো সিক্সকে উল্টো করে বসিয়ে CH 1938 করা যাবে।

পরদিন ইলিয়াস ও রফিক মধুয়ালের ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়েন। রফিকের হাতে ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়াবার বোন্দা। লম্বা লাঠির মাথায় খড় ও ঢেঁকিলতা পেঁচিয়ে বানানো হয়েছে ওটা। ইলিয়াসের একহাতে একটি লম্বা ছুরি ন্যাকড়া জড়ানো এবং অন্য হাতে কাপড়ে মুখবাঁধা একটা হাঁড়ি।

মৌচাকের খোঁজ করতে করতে তাঁরা ভালো করে দেখে নেন টিলার চারদিকটা। টিলার উত্তর পাশে একেবারে নিচে পানি গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ আসছে। তারা নেমে যান। কাছে গিয়ে দেখেন, চার ইঞ্চি ব্যাসবিশিষ্ট গ্যালভানাইজড লোহার পাইপের মুখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে নিচের নালায়। ইলিয়াস বুঝতে পারেন, টিলার ওপরের বাড়িটা থেকে মাটির নিচে দিয়ে নামানো হয়েছে এ পাইপ। বাড়ির ব্যবহার্য পানি নিষ্কাশনের সুন্দর ব্যবস্থা।

টিলার পশ্চিম পাদদেশের কিছু ওপরে ঘোরানো রাস্তার পাশে একটা ইটের কুঠরী। ওটার কাঠের দরজায় বিদেশী ম্যারটিজ লক। এ সামান্য কুঠরীটার জন্যে এতো দামী বিদেশী তালা লাগাবার কোনো প্রয়োজন আছে কি? সস্তায় এর চেয়ে মজবুত তালা লাগানো যেতো। কুঠরীর ভেতরে জেনারেটার চলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুতের কোনো খাম্বা দেখা যায় না। নিশ্চয়ই মাটির নিচে দিয়ে টানা হয়েছে বিদ্যুতের তার। বিদঘুটে আওয়াজ এড়াবার জন্যেই দূরে বসানো হয়েছে জেনারেটার।-বুঝতে পারেন ইলিয়াস। টিলার চারপাশে বৃত্তাকারে ঘোরানো রাস্তাটা ছাড়া মানুষের তৈরি আর কোনো কিছু দেখা যায় না। পানির জন্যে নিশ্চয়ই গভীর নলকূপ বসাতে হয়েছে। সেটা এবং পানির পাম্পও নিশ্চয়ই কুঠরীটার ভেতরেই। পাম্পের চাপে মাটির নিচে দিয়ে নেয়া লুক্কায়িত পাইপ বেয়ে পানি উঠছে ওপরে।

ইলিয়াস ও রফিক বৃত্তাকার রাস্তা ধরে অনেকদূর উঠেছিলেন। কিন্তু আর কিছুই চোখে পড়ছে না। আর ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না ভেবে নেমে যান নিচের দিকে। একটু দূরে দু’জন কৃষক জমিতে কাজ করছে। মৌপোকের বাসার খোঁজ নেয়ার ফাঁকে তাঁরা টিলা ও টিলার মালিকের খোঁজ খবর নেন।

টিলার নাম বাদুরটিলা। বছর দুই আগে ওটার ওপর বাড়ি করেছেন এক ধনী সওদাগর। বর্মা মৃলুকে নাকি তাঁর বিরাট ব্যবসা ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানীরা যখন সিঙ্গাপুর দখল করে বার্মার দিকে এগিয়ে আসছিল তখন তিনি ওখান থেকে এসে চাটগাঁয়ে ব্যবসা শুরু করেন।

ফিরে আসার সময় ইলিয়াস ও রফিক তাঁদের হাতের ছুরি, মেটে হাঁড়ি ও বোন্দা জঙ্গলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাটহাজারী চলে আসেন। বেলা তখন পৌনে দু’টো। গোসল সেরে দুপুরের খাওয়া খেয়ে তাঁরা হোটেলকক্ষেই জিরিয়ে নেন কিছুক্ষণ। তারপর তাঁরা হাটহাজারী থানায় রাখা মোটর সাইকেলটা নিয়ে রওনা হন ঢাকার দিকে।

রাত দু’টোয় রফিককে নিয়ে ঢাকা পৌছেন ইলিয়াস। পরদিন অনেক বেলায় ঘুম ভেঙ্গে তিনি গোসলখানায় ঢোকেন। দশ দিনে বেশ বড় হয়েছে দাড়ি-গোঁফ।

এগুলো রেখে দিলে কেমন হয়?- ভাবেন ইলিয়াস। সিংহীর চেয়ে সিংহ অনেক বেশি সুন্দর, কারণ সিংহের কেশর আছে। দাড়িওয়ালা পুরুষ কি মেয়েদের চোখে সুন্দর লাগে? মনে হয় না। রাশেদ ভাই বিয়ের পর বিলেত গিয়েছিলেন পড়তে। ফিরে আসেন ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি নিয়ে। বউয়ের তাড়নায় তাঁকে তাঁর দাড়ি চেঁচে ফেলতে হয়েছিল।

ইলিয়াস দাড়ি-গোঁফ চেঁচে সাবান মেখে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করেন। তারপর বেরিয়ে শার্ট-প্যান্ট পরে নাশতার টেবিলে গিয়ে বসেন।

রান্নাঘরে ফুফু কারো সাথে কথা বলছেন। ইলিয়াসের চেয়ার টেনে বসার শব্দ পেয়ে ফুফু ট্রেতে করে নাশতা এনে টেবিলে রাখেন।

ইলিয়াস খাওয়া শুরু করলে কাছে দাঁড়িয়ে ফুফু বলেন, রোকসানা এসেছে তোর সাথে দেখা করতে। ওর বাবার নাকি এখনো জামিন হয়নি?

-জামিন হয়নি, তার আমি কি করবো?

-তুই একটু চেষ্টা করলেই জামিন হয়ে যাবে। তুই ট্যুরে যাওয়ার পর থেকে প্রায় রোজই একবার আসতো তোর খোঁজ নিতে। মেয়েটা খুবই ভালো। যেমন দেখতে শুনতে, তেমনি চালচলন আর কথাবার্তা।

ইলিয়াস ডিম-রুটি চিবোতে চিবোতে ফুফুর দিকে তাকান।

ফুফু আবার বলেন, লোকটা নির্দোষ বলেই আমার মনে হয়।

-তুমি লোকটাকে দেখেছো? না দেখে কি করে বলছো, সে নির্দোষ?

-এমননিতেই বোঝা যায়। ওরা এসেছে কোলকাতা থেকে জান বাঁচিয়ে। এক বিপদ কাটিয়ে এসে পড়েছে আর এক বিপদে। তুই বাবা একটু চেষ্টা করে দ্যাখ। -এতো তাড়াতাড়ি কিছু হবে না। ভদ্রলোককে আরো কিছুদিন হাজতে থাকতে হবে। -আরো হাজতে থাকতে হবে! উদ্বেগভরা কণ্ঠে বলে ওঠে রোকসানা। সে

খাবার ঘরে ঢুকে পড়েছে। তার চোখ ছলছল করছে।

-হ্যাঁ, আরো কিছুদিন থাকতে হবে। ইলিয়াস বলেন।

-বাবার জেল-টেল হবে না তো?

-আমি তো বিচারক নই। কেমন করে বলবো?

-আপনি তো তদন্ত করছেন! আমার বাবা এ অপরাধের সাথে জড়িত আছেন-এরকম কোনো প্রমাণ পেয়েছেন কি?

-এখনো কিছু বলতে পারছি না। কয়েকদিনের মধ্যেই বলতে পারবো। -তুমি কথা বলো, মা। ফুফু বলেন,- আমি নিচে থেকে আসছি।

ফুফু চলে গেলে রোকসানা বলে, আপনি আমাকে নিয়ে কোথাও যাওয়ায় কথা বলেছিলেন।

-আপনি যাবেন?

-হ্যাঁ, যাবো।

-বেশ সাহস আছে তো আপনার।

-নিশ্চয়ই আছে।

-কিন্তু যদি ভেগে যাই আপনাকে নিয়ে?

-এতো সাহস আছে আপনার?

-সাহস নিশ্চয়ই আছে, তবে-

-তবে চলুন না, আমি যাবো আপনার সাথে।

-দেখা যাক। প্রয়োজন হলে পরে বলবো।

-হ্যাঁ বলবেন। আপনার তদন্তের কাজে সামান্য সাহায্য করতে পারলেও আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।

ইলিয়াস কিছু চিন্তা করেন। তারপর বলেন, ইস্কাটনে একজন দরবেশ আস্তানা গেড়েছেন। শুনেছি, তিনি একজন কামেল দরবেশ। তাঁর কাছ থেকে পানিপড়া এনে দিতে হবে আমাকে। পারবেন?

-পানিপড়া। আপনি বিশ্বাস করেন পানিপড়ায়? হেসে ওঠে রোকসানা। ইলিয়াসও হেসে বলেন, আমাদের দেশের অনেক উচ্চশিক্ষিত লোক, এমনকি উজির-নাজির পর্যন্ত পানিপড়া খান, মাজায়-গলায় তাবিজ-কবচ পরেন। আমিই বা বিশ্বাস করবো না কেন?

-ঠিক আছে। আপনি যদি বিশ্বাস করেন তবে পানিপড়া অবশ্যই এনে দেবো।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে ইলিয়াস বলেন,-আচ্ছা, দেখুন তো কেমন অভদ্র আমি। একাই খেয়ে যাচ্ছি আমি। আপনি বসুন, ফুফুকে চা-নাশতা দিতে বলছি।

-না না, আমার নাশতা খাওয়া হয়ে গেছে। এখন আর কিছু খাবো না।

ইলিয়াসের চা খাওয়া শেষ হয়েছে। তিনি সাইডবোর্ড থেকে একটা ফ্লাস্ক বের করে তাতে পানি ভরেন। তারপর একটা কাঁচের গ্লাস ও পিরিচ রোকসানার হাতে দিয়ে বলেন, চলুন তা হলে।

ইলিয়াসের পেছনে পেছনে রোকসানাও বেরিয়ে যায়। রাস্তায় গিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি ডেকে তারা সেটায় উঠে বসেন।

তোতলা দরবেশের আস্তানা থেকে কিছুটা দূরে গাড়িটা থামে। গ্লাসটা ভেজা রুমাল দিয়ে মুছে ইলিয়াস ওটা রোকসানার হাতে ধরা পিরিচের ওপর বসিয়ে দেন। তারপর ফ্লাস্ক থেকে গ্লাসটায় পানি ঢেলে বলেন, সাবধান, গ্লাসটায় যেন তোমার, সরি আপনার হাত না লাগে।

ইলিয়াসের নির্দেশমতো রোকসানা পাঁচ টাকার একটা কড়কড়ে নোট তোতলা দরবেশের পায়ের কাছে রেখে তার হাতে-ধরা পিরিচের ওপর বসানো গ্লাসটা এগিয়ে ধরে তাঁর দিকে। মুখে বলেন, হুজুর, আমি গ্যাস্ট্রিক আলসারের রোগী। আমি স্বপ্নে দেখেছি, আপনার মুখের ঝুটা পানি খেলে আমার ব্যারাম ভালো হয়ে যাবে। আপনি গ্লাসের পানিতে একটা চুমুক দিয়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিন। তোতলা দরবেশ গ্লাসটা তুলে এক চুমুক পানি খান। তারপর কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে তিনটে ফুঁ দিয়ে গ্লাসটা পিরিচের ওপর বসিয়ে দেন। রোকসানা পানিপড়া নিয়ে ফিরে আসে। ইলিয়াস দেখেন, তোতলা দরবেশের ডান হাতের পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়েছে গ্লাসটায়।

রোকসানাকে তাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ইলিয়াস সোজা চলে যান সি.আই. ডি.-এর ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরোতে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টের কাছে আঙুলের ছাপগুলোর শ্রেণী নির্ণয় করে অনুসন্ধানের অনুরোধ জানিয়ে গ্লাসটা সেখান রেখে আসেন।

ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো থেকে বেরিয়ে অফিসে পৌঁছতে ইলিয়াসের সাড়ে বারোটা

বেজে যায়। তিনি প্রথমেই স্পেশাল অফিসারের সাথে দেখা করেন। তিনি তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইলিয়াসকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক কিছু বলতে হয়। সাঙ্কেতিক চিঠি ও তার পাঠোদ্ধারের কথা অবশ্য তিনি চেপে যান।

-স্যার, একটা কথা বলবো, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনার ঘনিষ্ঠ যারা তাদের মধ্যে কেউ হয়তো আমাদের তদন্ত সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।

-কাউকে কি তোমার সন্দেহ হয়?

-হ্যাঁ, স্যার। আমার সন্দেহ হয় তোতলা দরবেশের ওপর।

-অ্যাঁ কি বল্লে! মিঃ আলী রেজা ধমকে ওঠেন। অমন কামেল দরবেশ সম্পর্কে তোমার ধারণা?

-হ্যাঁ, স্যার।

-দ্যাখো, দরবেশ সম্পর্কে কোনো কথা আমি বিশ্বাস করতে রাজী নই। রাগত স্বরে বলেন মিঃ আলী রেজা। কোনো মামলা সম্পর্কে আমি বাইরের কারো সাথে কোনো আলোচনা করি না। এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

স্পেশাল অফিসারের কামরা থেকে বেরিয়ে নিজের কামরায় যান ইলিয়াস। প্রথমেই ডাকেন সিনিয়ার ওয়াচার জহুরকে। সে বারোদিনের ওয়াচ রিপোর্ট এনে তাঁর সামনে রাখে।

ইলিয়াস একটা একটা করে ওয়াচ রিপোর্ট পড়েন।

তোতলা দরবেশ ইস্কাটনে আস্তানা গেড়েছেন আজ-আট দিন। এ আটদিনের মধ্যে তিনি বাইরে কোথাও যাননি। এর আগে চারদিনের দু’দিন তিনি মিঃ আলী রেজার বাড়িতে ছিলেন। দু’দিন অর্থাৎ ৬ই এবং ৭ই মার্চ তিনি বেরিয়েছিলেন। ৬ই মার্চ আলী রেজার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি গেণ্ডারিয়ায় এক মেসে গিয়েছিলেন। বিকেলবেলা ঐ মেসের একজন তাঁর সাথে এসেছিল মিঃ আলী রেজার বাসা পর্যন্ত। (১০ই মার্চের মন্তব্য: এই লোকটাও এখন ইস্কাটনের আস্তানার একজন পাণ্ডা। দরবেশ তাকে মকবুল বলে ডাকে)। পরের দিন ৭ই মার্চ তিনি আলী রেজার বাসা থেকে গিয়েছিলেন টঙ্গীর এক বাসায়। গোপন তদন্তে জানা গেছে, সে বাসায় ভেদরগঞ্জ থানার এক লোক তার দুই বউ নিয়ে থাকে। তোতলা দরবেশ সেখান থেকে সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসেন। (১০ই মার্চের মন্তব্য: টঙ্গীর এ লোকটাও এখন ইস্কাটন আস্তানার একজন পাণ্ডা। দরবেশ তাকে কোব্বাদ বলে ডাকেন)।

বিগত চারদিনের রিপোর্ট পড়ে জানা যায়, দরবেশের ভক্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাঁর ভক্তের মধ্যে মিঃ আলী রেজা ছাড়া আছেন একজন গণপরিষদের সদস্য, কয়েকজন উকিল, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, দশ- বারো জন ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার। ১৪ই মার্চ অর্থাৎ গতকালের ওয়াচ রিপোর্ট থেকে আরো জানা যায়, ঐ দিন সন্ধ্যার অনেক পরে মকবুল ও কোব্বাদ বাইরে থেকে আস্তানায় আসে। মকবুলের হাতে একটা খালি মাটির জালা আর কোব্বাদের কাঁধে একটা চটের থলে ছিল। চাল অথবা ডাল অথবা অন্য কোনো দানা জাতীয় কিছু ভরা ছিল থলেটায়। পোঁটলা-পুঁটলি থাকলে নিশ্চয় উঁচু-নিচু দেখাতো থলের গা, এতো মসৃণ দেখাতো না।

মাটির জালা দিয়ে কী করবে? ও রকম মাটির পাত্রে গুড় ভরা হয়।-

ভাবেন ইলিয়াস।

টেলিফোন বেজে ওঠে হঠাৎ। ইলিয়াস রিসিভারটা তোলেন। ট্রাঙ্ককল? রংপুর থেকে ?… দিন। হ্যালো, আবিদ, কী খবর ?.. চিঠি পেয়েছো ?… ঠিক আছে। আমি রাত আটটার ট্রেনে রওনা দিচ্ছি।

রিসিভারটা নামিয়ে রাখেন ইলিয়াস।

পরদিন বেলা দশটায় রংপুর পৌঁছেই ইলিয়াস সাঙ্কেতিক চিঠিটার পাঠোদ্ধার করেন। চিঠির প্রয়োজনীয় অংশটুকু তিনি একটা কাগজে টুকে নেনঃ

…বড় সায়েবের একজন ড্রাইভার আবশ্যক। তুমি যে ড্রাইভারটির চাকরির জন্য বলেছিলে তাকে বাইশে মার্চ গোয়ালন্দঘাটে পাঠিয়ে দাও। রেললাইনের শেষ মাথায় যে টিবিটা আছে তার পেছনে আমি বিকেল ছ’টায় থাকবো। আমার হাতে কালো মলাটের একটা বই থাকবে। ড্রাইভারের হাতে যেন একটা বেতের ছড়ি থাকে। আমার প্রশ্ন:- এখান দিয়ে একটা বিলাতী কুত্তা যেতে দেখেছো? উত্তর:-না তো, একটা খেঁকি কুত্তা দেখেছি।

ইলিয়াস দু’বার পড়ে আবিদের দিকে বাড়িয়ে দেন কাগজটা। তারপর চোখ বুজে কিছুক্ষণ চিন্তা করেন। চোখ মেলে দেখেন, আবিদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাঁর দিকে। তিনি বলেন, মস্ত একটা সুযোগ। এ সুযোগটা কাজে লাগাতেই হবে।

-কি করে লাগাবে?

-ড্রাইভার আমরাই পাঠাবো। পরিচয়জ্ঞাপক প্রতীক ও পাসওয়ার্ড যখন পেয়ে গেছি তখন আমাদের ড্রাইভার ঢোকাতে কোনো অসুবিধেই হবে না। রফিক ড্রাইভিং জানে খুবই ভালো সব রকম গাড়ি সে চালাতে পারে।

-হ্যাঁ, রফিককে পাঠানো যেতে পারে। তার সাহসও আছে খুব।

-হ্যাঁ, রফিককে এখানে আসবার জন্যে আমি আজই ট্রাঙ্ককল করে দিচ্ছি।

আবিদ ও রফিককে নিয়ে ইলিয়াস রংপুর স্টেশনের ওপর নজর রাখতে শুরু করেন একদিন আগে অর্থাৎ একুশে মার্চের ভোর থেকেই। কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত লোকটিকে সেদিন স্টেশনে আসতে দেখা যায়না। পরের দিন খুব ভোরে দেখা যায়, রংপুরী স্টেশনে ঢুকছে। তার পেছনে ছড়ি হাতে একজন লোক। তারা সোজা চলে যার টিকেট ঘরের দিকে। ছড়িধারী তৃতীয় শ্রেণীর টিকেটের জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে যায়।

রংপুরীও কি যাবে ড্রাইভারটির সঙ্গে? তাহলে তো প্ল্যানটা নেহায়েত মাঠে মারা যাবে। ভাবেন ইলিয়াস।

রফিক টিকেট কাটার জন্যে একই লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। ইলিয়াস লাইনের কাছেই ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকেন। আবিদ দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। তার পরিধানে দামী কাপড়ের প্যান্ট ও হাওয়াই শার্ট।

ছড়িধারী গোয়ালন্দঘাটের একটাই টিকেট নিচ্ছে। দেখতে পান ইলিয়াস।

তাঁর দুশ্চিন্তা কেটে যায়।

রফিক পোড়াদহের তিনটা টিকেট কিনে।

রংপুরীর সাথে হাত মিলিয়ে ছড়িধারী তৃতীয় শ্রেণীর একটা কামরায় উঠে পড়ে। তার হাতের ছড়িটা ছাড়া তার সাথে রয়েছে একটা টিনের স্যুটকেস। রফিকও ওঠে সেই একই কামরায়। ইলিয়াস ও আবিদ ওঠেন ওটার সাথে লাগানো আর একটা তৃতীয় শ্রেণীর কামরায়।

ট্রেনটা রংপুর স্টেশন থেকে ঠিক সাতটায় ছাড়ে। দুপুর একটায় ট্রেন পৌঁছে পোড়াদহ। এক হাতে ছড়ি ও অন্য হাতে স্যুটকেস নিয়ে লোকটা দক্ষিণদিকের প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কালো মলাটের বই হাতে আবিদ তাকে ডাকে, -এই যে শোনো, এখান দিয়ে একটা বিলাতী কুত্তা যেতে দেখেছো?

লোকটা থতমত খেয়ে যায়। এই পোড়াদহে তো তাকে এরকম প্রশ্ন করার কথা নয়! আবিদ আবার একই প্রশ্ন করে। তার হাতে কালো মলাটের বই দেখতে পায় লোকটা। নিজেকে সামলে নিয়ে এবার সে বলে, নাতো। একটা খেঁকি কুত্তা দেখেছি।

আবিদ তার পিঠ চাপড়ে বলে,-পথে তোমার কোনো অসুবিধে হয়নিতো? আমি পোড়াদহ এসেছিলাম কাজে। হঠাৎ ছড়ি হাতে তোমাকে দেখে ভাবলাম, গোয়ালন্দ যাওয়ার আর দরকার কি। জগন্নাথগঞ্জঘাটে আমার কিছু কাজ আছে। তাই এখান থেকে ট্রেনে জগন্নাথগঞ্জঘাট যাবো। সেখান থেকে যাবো ঢাকা। ঢাকায়ও আমার কিছু কাজ আছে। এবার চলো, ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নিই। আর শোনো, তোমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটা দেখাও।

লোকটা তার স্যুটকেস থেকে লাইসেন্সটা বের করে আবিদের হাতে দিয়ে দেয়। আবিদ ওটার পাতা উলটিয়ে দেখে পকেটে রাখতে রাখতে বলে, এখন থাক, পরে দেখবো।

আবিদ লোকটিকে নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকে বলে,-তুমি হাত মুখ ধুয়ে এসে বসো এ টেবিলটায়। আমি বাইরে থেকে সিগারেট কিনে নিয়ে আসছি।

ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে লাইসেন্সটা ইলিয়াসের হাতে চালান করে দেয় আবিদ।

ইলিয়াস বলেন, লোকটার থাকা-খাওয়ার সম্বন্ধে যা যা বলে দিয়েছি, তা. যেন ঠিক মতো হয়। লোকটাকে বলবে, বড় সায়েব সিঙ্গাপুর গেছেন। তিনি ফিরে এলেই তোমাকে চাটগাঁ পাঠিয়ে দেবো। লোকটাকে একেলা কোথাও বেরুতে দিও না। সে চিঠি লিখতে চাইলে নিষেধ করো না। তবে ডাকে দেওয়া নাম করে তার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিও। আর হ্যাঁ, ঢাকা গিয়েই মহিউদ্দীনকে মোটর সাইকেলসহ হাটহাজারী ভাইভাই হোটেলে পাঠিয়ে দিও। আর আজমলকে পাঠিয়ে দিও রংপুরে।

আবিদ সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে ক্যান্টিনে ঢোকে।

রফিক দু’খানা প্রথম শ্রেণীর টিকেট কিনে ইলিয়াসের দিকেই আসছিলো। তাকে নিয়ে ইলিয়াস গোয়ালন্দগামী ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরায় উঠে বসেন। ট্রেন ছাড়ে দুপুর দেড়টায়।

কামরাটায় আর কোনো যাত্রী নেই। ইলিয়াস ড্রাইভিং লাইসেন্সটা বের করে দেখেন। লোকটার নাম আব্দুল বারেক। লাইসেন্সেটা দু’বছর আগে রংপুর থেকে ইস্যু করা হয়েছিল। তারপর নবায়ন করা হয়েছে দু’বার। ওটায় আব্দুল বারেকের লাগানো ফটো আছে। ইলিয়াস ব্লেড ও কাঁচির সাহায্যে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ফটোটার গলা, মুখ ও মাথার অংশটুকু কেটে তুলে ফেলেন। এবার রফিকের ফটো থেকে ঐ অংশটার হুবহু মাপে গলা ও মাথাসমেত মুখটা কেটে নেন। তারপর আঠা দিয়ে নিখুঁত ভাবে টুকরোটা লাগিয়ে দেন ফটোর ফাঁকা জায়গাটায়।

খুব নিখুঁতভাবে তৈরি হয়েছে গলাকাটা লাইসেন্স। ফটোটা দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না যে শরীরটা একজনের আর গলা, মুখ ও মাখা আর একজনের।

ট্রেন গোয়ালন্দঘাটে পৌঁছে বিকেল সোয়া পাঁচটায়।

ট্রেন থেকে নেমে ইলিয়াস ও রফিক একটা রেস্তোরাঁয় বসে চা খান। ইলিয়াস একটা প্যাকেট রফিকের হাতে দিয়ে বলেন,-এর মধ্যে ছোট ছোট শিশি আছে দু’ডজন হোমিওপ্যাথি ওষুধভরা লেবেল লাগানো শিশি। কারো সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। আরো আছে একদলা মোম। এগুলো স্যুটকেসে রেখে দাও। ওষুধ ফেলে দিয়ে শিশির ভেতর রোলকরা চিঠি ভরা ছিপি দিয়ে শিশির মুখ ভালো করে বন্ধ করবে। ছিপির বাড়তি অংশ ব্লেড দিয়ে কেটে তার ওপর মোম লাগিয়ে দেবে যাতে শিশির ভেতর পানি ঢুকতে না পারে। যেভাবে বলে দিয়েছি সে ভাবে রোজ একটা করে শিশি গোছলের পানির সাথে ছেড়ে দিও। ছ’টা বাজতেই এক হাতে বেতের ছড়ি ও অন্য হাতে টিনের একটা স্যুটকেস নিয়ে রফিক এগিয়ে যায় রেল লাইনের শেষ মাথায়।

হ্যাঁ, ঐ তো টিবির পেছনে দেখা যায় কালো মলাটের বই হাতে একটা লোক। রফিক তার কাছাকাছি যেতেই তিনি বলেন, এই যে শোনো, এখান দিয়ে একটা বিলাতী কুত্তা যেতে দেখেছো।

লোকটা রফিকের হাতে একটা একশ’ টাকার নোট দিয়ে বলেন, কোনো রেস্তোরাঁয় গিয়ে কিছু খেয়ে নাও। তারপর একটা ইন্টার ক্লাসের গোয়ালন্দ টু কুমিরা থ্রু টিকেট কিনবে। আমরা চিটাগাং মেলে যাবো।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় চিটাগাং মেল স্টীমার ছাড়ে। ইলিয়াস ইন্টার ক্লাসের টিকেট কেটে বসেন রফিকের উল্টো দিকের বেঞ্চে। সারাটা পথে দু’জনের মধ্যে একটা কথাও হয় না। এমন কি ইশারা-ইঙ্গিতেও কেউ কাউকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করেন না। রফিকের কর্মদাতা বসেছেন প্রথম শ্রেণীতে।

পরদিন ভোর ছ’টায় স্টীমার চাঁদপুর পৌঁছে। রফিক ও তার কর্মদাতা স্টীমার থেকে নেমে চাটগাঁগামী ট্রেনে নিজ নিজ শ্রেণী অনুযায়ী উঠে বসে। ইলিয়াসও রফিকের পিছু পিছু গিয়ে ওঠেন ইন্টার ক্লাস কামরায়।

বেলা সাড়ে এগারোটার কুমিরা স্টেশনে ট্রেন থামে। রফিককে নিয়ে তার কর্মদাতা নেমে যায়। ইলিয়াস লক্ষ্য করেন স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছে CH 1638 নম্বরের জীপটা।

ট্রেন চলতে শুরু করেছে। ইলিয়াস তবু চেয়ে আছেন জীপটায় দিকে। অনেক দূর থেকে ইলিয়াস দেখতে পান, রফিক জীপের পেছনের সীটে উঠছে।

রফিকের জন্যে কেমন একটা আশংকা, কেমন একটা অস্বস্তি তাঁর মনে হামাগুড়ি দেয়। কোনো রকমে ধরা পড়ে গেলে তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। নিজের বাহন না থাকলে কুমিরা নেমে হাটহাজারী যাওয়া খুবই কষ্টকর। ওখান থেকে কোনো গাড়ি বা রিকশা ভাড়ায় পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই তিনি চাটগাঁ চলে যান। সেখান থেকে তিনি নাজিরহাট লাইনের ট্রেনে ওঠেন। হাটহাজারী পৌছতে বিকেল ছ’টা বেজে যায়।

পরদিন সূর্য ওঠার আগে ইলিয়াস লুঙ্গি-ফতুয়া পরে গামছা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর হাতে একটা কাপড়ের ঝোলা। ওতে বড় করে বাংলায় লেখা-সর্বশান্তি আয়ুর্বেদীয় ঔষধালয়, চট্টগ্রাম। কিছুদূর হেঁটে তিনি একটা রিকশা নেন। বাদুরটিলার কাছাকাছি পৌঁছুবার আগেই পাকা রাস্তার ওপর রিকশাটা ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে থাকেন। টিলাটার বরাবর গিয়ে তিনি চারদিক দেখে নিয়ে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে কবরেজী লতাগুল্ম খুঁজতে খুঁজতে দক্ষিণদিকে এগিয়ে যান। টিলাটার উত্তর পাদদেশে পানি নিষ্কাশনের যে পাইপটা তিনি কয়েকদিন আগে দেখে গিয়েছিলেন সেটার মুখে একটুকরো মশারির জাল শক্ত করে বেঁধে দেন। তারপর ওপর থেকে পাতা সমেত কয়েকটা বুনো লতা টেনে পাইপটা ঢেকে দিয়ে যে পথে এসেছিলেন সে পথেই আবার ফিরে যান।

পরদিন খুব ভোরে ইলিয়াস একই বনৌষধি সংগ্রাহকের বেশে আবার যান বাদুরটিলার পাদদেশে। পাইপের মুখ থেকে জালটা খুলে তিনি ওটার ভেতর একটা শিশি পান। গোসলখানার পানির সাথে নেমে এসেছে এটা। জালটা আবার পাইপের মুখে বেঁধে তিনি হোটেল ভাইভাইয়ে ফিরে আসেন।

ইলিয়াস শিশির ভেতর থেকে রোল করা ছোট্ট এক টুকরো কাগজ বের করেন। ওতে লেখা আছে: আমি নিরাপদ। থাকার জন্য একটা রুম পেয়েছি। বাড়িটা বেশ বড়। এক অংশে বড় সায়েব পরিবার নিয়ে থাকেন আর এক অংশে অফিস।

পরদিন আবার সকালে গিয়ে জালের ভেতর থেকে নিয়ে আসেন দু’টো শিশি একটার ভেতর চিঠি: আমাকে নতুন গাড়ি ভকসলটা চালাতে দিয়েছে। নম্বর CH 3489। বড় সায়েব ও তাঁর পরিবার এ গাড়িটা ব্যবহার করেন। যার সাথে এখানে এসেছি, তার নাম জামশেদ। তাকে সবাই মেজো সায়েব বলে। কেউ কেউ তাকে মার্কেটিং ম্যানেজারও বলে। সেজো সায়েবের নাম জুলহাস।

তিনি নাকি অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার।

অন্য শিশিটায় পাওয়া যায় বাড়িটার একটা মোটামুটি নকশা। দেয়াল ঘেরা বাড়িটাকে যোগচিহ্নের মতো দেয়াল তুলে চারটা অংশে ভাগ করা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অফিস ও গ্যারাজ, দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বড়সায়েবের বাসভবন। পুব-উত্তর দিকে অতিথিশালা ও টেনিস কোর্ট। পশ্চিম-উত্তর দিকে উত্তর দিকের দেয়ালের সমান্তরাল একটা লম্বা দালান। সেটায় অনেকগুলো ছোট ছোট কামরা। ড্রাইভার, প্রহরী ও ভৃত্যরা থাকে এ কামরাগুলোতে। তাদের জন্যে উত্তর-পশ্চিম কোণে তিনটা গোসলখানা।

সেদিনই সন্ধ্যার পর সাব-ইন্সপেক্টর মহিউদ্দীন হোটেলে এসে ইলিয়াসের সাথে দেখা করে। ইলিয়াসের পূর্বনির্দেশ অনুযায়ী মোটর সাইকেলটা সে হাটহাজারী থানায় রেখে এসেছে।

আবিদ পোড়াদহ থেকে আব্দুল বারেক নামে ড্রাইভারটিকে ঢাকা নিয়ে যেতে পেরেছে কিনা এ সংবাদটা জানার জন্যে ইলিয়াস খুবই উদগ্রীব ছিলেন।

মহিউদ্দীনকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলে, হ্যাঁ, লোকটাকে ঢাকা নিয়ে যেতে আবিদের কোনো অসুবিধে হয়নি। লোকটা বেশ আরামেই আছে। খাচ্ছে- দাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে।

-কোনো সমস্যার সৃষ্টি করছে না তো লোকটা? -না, আবিদের কাছে শুনলাম, শান্ত-শিষ্ট গোবেচারা ধরনের লোক।

তোতলা দরবেশের খবর কি? –

-হ্যাঁ, খুব মজার খবর আছে। গতকাল আলী রেজা সাহেব আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ইস্কাটনের আস্তানায়। তোতলা দরবেশ বাটি চালান দিয়ে একটা জায়গার ওপর বাটিটা রেখে ওটার চারদিকে মাটির চাড়া দিয়ে একটা কুণ্ডলী টানেন। তারপর তোতলাতে তোতলাতে বলেন, এই সেই জায়গা। এই খানে মাটির নিচে রসুলের পায়ের একজোড়া খড়মশরীফ আছে। তোরা এখানে পানি ঢাল। আজ সারা দিনে সাতাশ বালতি পানি ঢালতে হবে। তার মুখের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার ভক্তরা সে জায়গাটায় পানি ঢালতে শুরু করে।

ইলিয়াস হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যান। সামনের টেবিলের ওপর আঙুলের মৃদু টোকা দিচ্ছে আর কি যেন ভাবছেন। কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরে পেয়ে তিনি বলেন, -কাল ভোরে তোমাকে এখানকার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আমি ঢাকা যাবো।

কুণ্ডলীঘেরা জায়গাটায় পানি ঢালা হচ্ছে। প্রথমদিন ঢালা হয়েছে সাতাশ বালতি। দ্বিতীয় দিন একুশ বালতি। আজ তৃতীয়দিনেও নাকি একুশ বালতি পানি ঢালতে হবে।

গিজগিজ করছে লোক। ভক্ত ও দর্শনার্থীদের আর জায়গা দেয়া যাচ্ছে না দেয়ালঘেরা জায়গাটায়।

তোতলা দরবেশ চোখ বুজে তসবীহ্ গুনছেন। তাঁর ভক্তরা তাঁরই বাঁধা মারফতি গান গাইছে-

“দয়ালরে তুই চিনলি নারে হবে কি উপায়, ঐ দেখ না ফুলের মাঝে তারে দ্যাখা যায়।”

বেলা দশটায় পানি ঢালতে গিয়ে দরবেশের ভক্ত মকবুল বিস্মিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, হুজুর, মাডি ফাইট্যা গেছে। ফাটার ভিতর কী যেন দেখা যায়!

দরবেশ চোখ বুজেই হাতের ইশারায় আরো পানি ঢালার নির্দেশ দেন। বহু লোক ফাটল দেখবার জন্যে এগিয়ে যায়। তারা দেখে, সত্যি ফেটে গেছে কুণ্ডলী ঘেরা জায়গাটা।

দুপুরের দিকে ফাটলটা আরো বড় হয়। নতুন ফাটলও দেখা যায়।

দরবেশের ভক্তরা কুণ্ডলীঘেরা জায়গাটার চার পাশে কয়েকটা খাটো বাঁশের খুঁটি পুঁতে কয়েক প্যাঁচ রশি বেঁধে দেয় যাতে ভিড়ের দরুন মানুষের পা লেগে জায়গাটার পবিত্রতা নষ্ট না হয়।

-আ-আ-আরো পা-পা-পানি ঢা-ঢা-ঢাল। তোতলা দরবেশ নির্দেশ দেন।

আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পনেরো বালতি পানি ঢালা হয়েছে। আরো ছয় বালতি ঢালতে হবে।

ভক্তরা বালতি ভরে পানি এনে ঢালে জায়গাটায়। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে উপস্থিত ভক্ত ও দর্শনার্থীদের অবাক করে দিয়ে মাটি ভেদ করে ওপরে উঠে আসে এক জোড়া খড়ম। -ইয়া আল্লাহ, ইয়া রসুলুল্লাহ। উপস্থিত সবাই আল্লাহ-রসুলের নাম নেয়, দোয়া-দরুদ পড়ে।

মিস্টার আলী রেজা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি এগিয়ে গিয়ে দেখেন, এক জোড়া বউলাওয়ালা খড়ম। বহুদিনের ব্যবহারে পায়ের দাগ বসে গেছে খড়ম দু’টোয়। তিনি ডান হাত দিয়ে খড়মজোড়া স্পর্শ করে সে হাতে চুমু খান তিনবার। এ সময়ে ইলিয়াসের কথা মনে পড়ে তাঁর। তিনি ভাবেন, ইলিয়াস যদি এখন এখানে থাকতো তাহলে বুঝতে পারতো তোতলা দরবেশ কতো বড় কামেল দরবেশ। তাঁকে সন্দেহ করে সে-কী ভুলটাই না করছে!

তোতলা দরবেশের নির্দেশে ঐ জায়গাটা ইট বিছিয়ে সিমেন্ট করে দেন মিস্টার আলী রেজা। শিল্পপতি শফি আহমদ খড়মশরীফ স্থাপনের জন্য একখানা রূপার সিংহাসন বানিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

ইলিয়াস ঐদিনই সন্ধ্যার পর ঢাকা পৌছে খবর পান, তোতলা দরবেশের এবাদতের গুণে মাটির তলা থেকে রসুলুল্লাহর খড়মমোবারক উঠে এসেছে।

ইলিয়াস পরদিন ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরোতে যান। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট মিঃ শামশের তাঁকে দেখে খুশি হন খুব। বলেন, গতকাল থেকেই আপনাকে খুঁজছি। টেলিফোনও করেছিলাম দু’বার। কেউ বলতে পারলো না, আপনি কোথায় গেছেন।

-আমি ঢাকার বাইরে ছিলাম। কোনো খবর আছে?

-হ্যাঁ, ভালো খবর আছে। ভেদরগঞ্জ থানার একটা মামলার কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। ডাকাতি করার সময় তিনজন খুন হয়েছিল ডাকাতদের হাতে।

-হ্যাঁ, শুনেছি। মামলাটাতো সি.আই.ডি. তদন্ত করছে।

-হ্যাঁ, ইন্সপেক্টর সালাহউদ্দিন তদন্ত করছেন। সেই মামলার ঘটনাস্থলে একটা ছোরা পাওয়া গিয়েছিল। ওটায় যে আঙুলের ছাপ ছিল। দাঁড়ান সালাহউদ্দিন সাহেবকে ডাকছি।

আর্দালী পাঠাবার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইন্সপেক্টর সালাহউদ্দিন আসেন। দরজা বন্ধ করে তাঁরা বেশ কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করেন। তারপর ইলিয়াস ও সালাহউদ্দিন বেরিয়ে নিজ নিজ অফিসে চলে যান।

তোতলা দরবেশ তার আস্তানার নাম দিয়েছেন ‘খড়মরসুল দরগা।’ লোকের মুখে মুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে এ নাম। ঢাকা শহরের বাইরে থেকেও অগুনতি লোক আসে খড়মশরীফ দর্শনের জন্য।

একটা কাঠের চেয়ারের ওপর লাল মখমল বিছিয়ে তার ওপর রাখা হয়েছে খড়মমোবারক। এর জন্য রূপার সিংহাসন তৈরি হয়ে এসেছে। আজ বিকেল পাঁচটায় খড়মরসুল দরগার শুভ উদ্বোধনী। এ অনুষ্ঠানে খড়মশরীফ রূপার সিংহাসনে স্থাপন করে দরগার উদ্বোধন করা হবে। মাননীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব গোলাম রহমান খান প্রধান অতিথিরূপে এ অনুষ্ঠানে তশরীফ নিতে রাজী হয়েছেন।

একটা লম্বা বাঁশের মাথায় দরগার লাল নিশান উড়ছে পতপত করে। ভোর থেকে ডেকোরেটরের লোকজন গেট সাজাচ্ছে, মঞ্চ তৈরি করছে, সামিয়ানা খাটাচ্ছে।

মিঃ আলী রেজা একজন দলিল লেখককে নিয়ে সকাল ন’টার দিকে আসেন দরগায়। ডেকোরেটারদের কাজ দেখে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। এখান থেকে বেলা দশটায় তিনি যাবেন জিলা রেজিস্ট্রার-এর অফিসে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগেই দরগার নামে জমিটা দানপত্র রেজিস্ট্রি করে দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। তোতলা দরবেশ এজন্যে তাগিদ দিচ্ছেন বারবার।

দলিল লেখককে নিয়ে মিঃ রেজা গেটের বাইরে পা দিয়েই দেখেন, পুলিশ দরগাটা ঘেরাও করেছে।

পুলিশ দেখে তিনি হকচকিয়ে যান। রাগে তাঁর মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না।

ইউনিফর্ম পরিহিত সার্কল ইন্সপেক্টর বশীর আহমদ এগিয়ে এসে স্যালুট দেন মিঃ আলী রেজাকে। তাঁর পেছনে সাদা পোশাকে ইন্সপেক্টর সালাহউদ্দিন ও ইলিয়াস।

-স্যার, আসামী ধরতে এসেছি। বলেন বশীর আহমদ।

-কে আসামী? এতক্ষণ পরে কথা ফোটে মিঃ আলী রেজার মুখে। ভেতরে হুটোপাটির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

দরবেশের চেলারা পালাবার জন্যে পেছনের দরজার দিকে দৌড়ে যায়। তোতলা দরবেশও দেয়াল ডিঙিয়ে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ তাদের সবাইকে ধরে ফেলে। মিঃ আলী রেজার কাছে গিয়ে ইন্সপেক্টর সালাহউদ্দিন বলেন, স্যার, দু’বছর ধরে লোকটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। দরবেশ সেজে সে দিব্যি আমাদের চোখে ধুলো দিয়েছিল এতোদিন। সে ভেদরগঞ্জ থানার খুন ও ডাকাতি মামলার আসামী। ডাকতরা ঘটনাস্থলে একটা ছোরা ফেলে গিয়েছিল। ওতে যে আঙুলের ছাপ ছিল তার সাথে মিলে গেছে তোতলা দরবেশের আঙুলের ছাপ। ইলিয়াস সাহেবই ওর আঙুলের ছাপ পাঠিয়েছিলেন। ওর চেলাদেরও এ্যারেস্ট করলাম। ওদের মধ্যেও ফেরারী আসামী আছে বলে আমাদের বিশ্বাস। ওরা হাসতে হাসতে খুন করতে পারে। ডাকাতি করতে গিয়ে ওরা তিনটা লোককে খুন করেছিল।

বাইরে হৈ-হট্টগোল শোনা যাচ্ছে।

খড়মরসুল দরগায় পুলিশ হামলা করেছে শুনে তোতলা দরবেশের ভক্ত ও ধর্মভীরু জনসাধারণ ক্ষেপে গেছে। তারা পুলিশের ওপর ঢিল ছুঁড়ছে আর গালাগাল ঝাড়ছে।

মিঃ আলী রেজা একটা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্ত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা শান্ত হোন, আমার কথা শুনুন-

অনেকেই জানে, মিঃ আলী রেজা তোতলা দরবেশের সবচেয়ে বড় ভক্ত। তিনি কী বলতে চান, শুনবার জন্যে সবাই চুপ করে।

-আমরা এতোদিন যাকে দরবেশ বলে মান্য করেছি, ভক্তি-শ্রদ্ধা করেছি সে একজন দুর্ধর্ষ ডাকাত। সে খুন ও ডাকাতি মামলার আসামী। ডাকাতি করার সময় সে ও তার দল তিনটা খুন করেছে। আলী রেজা বলেন।

ভিড়ের মাঝ থেকে কে একজন চেঁচিয়ে ওঠে, রসুলুল্লাহর খড়মশরীফ উঠে এলো কেমন করে? তাহলে মাটির তলা থেকে-ওগুলো রসুলুল্লাহর খড়ম হতেই পারে না। ইলিয়াস জোর গলায় বলেন।

-মাটির নিচে তেরোশ’ বছর থাকলে নিশ্চয়ই সে খড়ম পচে-গলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো।

ইলিয়াসের নির্দেশে তাঁর আর্দালী একটা গাঁইতি নিয়ে এসেছিল। গাঁইতিটা উঁচু করে ধরে ইলিয়াস বলেন, আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন। খড়ম কি করে মাটি ভেদ করে ওপরে উঠেছে তা একটু পরেই আপনারা দেখতে পাবেন।

ইলিয়াস গাঁইতিটা নিয়ে সিমেন্ট করা জায়গাটা খুঁড়তে শুরু করেন। কিছুটা খুঁড়বার পর দেখা যায় ফুলে ওঠা ছোলার স্তূপ। আরো একটু খুঁড়তেই মাটির জালার কানা বেরিয়ে পড়ে।

উদগ্রীব জনতা এবার বুঝতে পারে, মাটির জালার ভেতর শুকনো ছোলা ভরে তা ইঞ্চি দু’য়েক মাটি দিয়ে ঢেকে তার ওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছিলো খড়মজোড়া। খড়ম জোড়া আবার ইঞ্চি তিনেক মাটির স্তরের নিচে ঢেকে রাখা হয়েছিল। পানি খেয়ে খেয়ে ছোলা ফুলে উঠেছে আর খড়ম মাটি ভেদ করে ওপরে উঠেছে।

জনতা আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তাদের আক্রোশ এবার তোতলা দরবেশের ওপর। তারা তোতলা দরবেশকে তাদের হাতে ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু ক্ষুব্ধ জনতার হাতে ছেড়ে দিলে দরবেশের হাড্ডি একটাও আস্ত থাকবে না, জানেন আইনের লোকেরা। তাই জনতাকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে হাতকড়া লাগানো তোতলা দরবেশ ও তার পাঁচজন চেলাকে গাড়িতে তুলে পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁদের বাহিনী নিয়ে প্রস্থান করেন। মিঃ আলী রেজা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। ভণ্ড দরবেশ তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে কেনা জমিটা গ্রাস করার মতলব এঁটেছিল। ইলিয়াস না থাকলে গ্রাস করেই ফেলতো। তিনি ইলিয়াসের বৃদ্ধিচাতুর্যের প্রশংসা না করে পারেন না। তিনি মনে মনে তওবা করেন, মহাসম্মানিত পরভোজী প্রতারকদের নাম উচ্চারণ করে তিনি আর তাঁর মুখ অপবিত্র করবেন না।

তোতলা দরদেশের মুখোস খোলার আনন্দে উৎফুল্ল ইলিয়াস। দরবেশের চেলাদেরও আসল নাম ঠিকানা পাওয়া গেছে জিজ্ঞাসাবাদের পর। পাঁচজনের সবাই ভেদরগঞ্জ থানার খুন ও ডাকাতি মামলার আসামী।

বিকেলে অফিস থেকে ফিরে ইলিয়াস চা-নাশতা খান। তারপর বেঠকখানায় গিয়ে একটি সোফায় গা এলিয়ে দেন পরম তৃপ্তিতে। হঠাৎ উঠে গিয়ে তিনি বাক্স থেকে বেহালা ও ছড় বের করেন। যন্ত্রটায় অনেকদিন তাঁর হাত পড়েনি। ওটার কান টিপে তার ঠিক করে তিনি বাজাতে শুরু করেন। সুরের মুর্ছনায় তাঁর দেহের তন্ত্রীগুলোও যেন বেজে ওঠে। সুরের সাথে একাত্ম হয়ে তিনি বাজিয়ে চলেছেন।

রোকসানা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠে। বেহালার সুর শুনে সে পা টিপে টিপে বৈঠকখানার দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকে।

ইলিয়াস চোখ বুজে বাজিয়েই চলেছেন।

রোকসানাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইলিয়াসের ফুফু এগিয়ে এসে

বলেন, কখন এলে, মা?

-এই তো কিছুক্ষণ আগে এলাম।

কথাবার্তার শব্দে ধ্যান ভাঙে ইলিয়াসের। বাজনা থামিয়ে তিনি বেহালা ও ছড়টি রেখে দেন সামনের তেপায়ার ওপর।

রোকসানা ইলিয়াসের কাছে আসে। হাতের খবরের কাগজটি তাঁর দিকে এগিয়ে ধরে সে বলে, এই দেখুন আজকের ‘সান্ধ্য সংবাদ’ এ কি লিখেছে। ইলিয়াস দেখেন, কাগজের প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরের হেডিং, ‘তোতলা দরবেশসহ ছয়জন খুনী ডাকাত গ্রেপ্তার। খড়মরসুল দরগার রহস্যভেদ।’

ইলিয়াস খবরটি পড়েন। বিস্তারিত কিছু নেই ওতে। ইলিয়াস, সালাহউদ্দিন ও বশীর আহমদের নাম উল্লেখিত হয়েছে সংবাদটিতে।

-আমি আঙুলের ছাপ এনে দিয়েছিলাম বলেই তো তোতলা দরবেশকে ধরতে পেরেছেন। হাসতে হাসতে বলে রোকসানা।- আমার নামটাতো ছাপা হলো না।

-খবরের কাগজের রিপোর্টার আমার কাছ থেকে খবরটা নেননি। আমার কাছে বিস্তারিত খবরের জন্যে এলে আপনার সহযোগিতার কথা অবশ্যই উল্লেখ করবো।

-থাক, তার আর দরকার নেই।

-কেন?

-গোয়েন্দা পুলিশদের সাথে ছাপা হবে আমার নাম! তওবা!

-কেন? গোয়েন্দা পুলিশদের আপনি পছন্দ করেন না?

-না।

-কাউকেই পছন্দ করেন না?

-শুধু একজনকে করি।

-কে সেই ভাগ্যবান? জানতে পারি কি?

-সে জেনে কাজ নেই। এখন বলুনতো, আপনার সহকারী হওয়ার মতো যোগ্যতা আমার আছে কি না?

-তা অবশ্য আছে, স্বীকার করছি।

-তবে আমাকে আপনার সাথে নিয়ে যেতে চাইছেন না কেন?

-পারবেন আপনি যেতে?

-নিশ্চয়ই পারবো?

-আপনার ছোট ভাই আছে বাড়িতে। তাকে দেখাশুনা করবে কে?

-তার দেখাশুনোর জন্যে চিন্তা নেই। সাজুখালা মানে আমাদের অনেক কালের পুরনো কাজের মহিলা আছে।

-বাড়িতে কি বলবেন? কার সাথে যাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন?

-বলবো এক বন্ধুর সাথে যাচ্ছি জরুরী কাজে।

-যদি জানতে পারে বন্ধুটি পুরুষ?

-জানতে পারলে “আরো বেশি নিশ্চিন্ত হওয়ার কথা। কারণ নিরাপত্তার জন্যে পুরুষবন্ধু অনেক নির্ভরশীল।

-তা হলে বন্ধু আজই যেতে হবে। আমি আজ রাত আটটার ট্রেন ধরবো।

-কোথায় যাওয়া হবে?

-তা এখন বলা যাবে না।

ঘড়ি দেখে আবার বলেন ইলিয়াস, এখন ছ’টা দশ। আপনি বাসায় যান। খেয়ে-দেয়ে তৈরি হয়ে সাড়ে সাতটার ফুলবাড়িয়া স্টেশনে চলে আসুন।

রোকসানা আর দেরি করে না। একটা রিকশা নিয়ে সে বাড়ির দিকে রওনা হয়। ইলিয়াস সাড়ে সাতটা বাজার তিন মিনিট আগে স্টেশনে পৌঁছেন। ওয়েটিং রুম বা প্লাটফর্মের কোথাও রোকসানাকে দেখা যায় না। তিনি মনে মনে ভাবেন, হঠাৎ হুজুগের মাথায় সে বলে ফেলেছে যে যাবে। পরে বাড়ি গিয়ে বোধ হয় মত বদলেছে।

ইলিয়াস তাঁর নিজের জন্যে টিকেট কিনতে যাবেন এমন সময় রোকসানা এসে হাজির। সে বলে, একটু দেরি হয়ে গেল। বাবার এক বন্ধু এসেছিলেন। তাঁকে কোন রকমে বিদায় করে এলাম।

রোকসানা একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরেছে। ইলিয়াসের চোখে অপূর্ব সুন্দর লাগছে আজ রোকসানাকে। ইলিয়াস নিচু গলায় বলেন,- ডিটেকটিভের সহকারীকে কিন্তু অনেক কিছু সাজতে হয়, ছদ্মবেশ নিতে হয়।

-কি ছদ্মবেশ নেবো?

-মাথায় কাপড় দিয়ে বউ সাজতে হবে, বউয়ের অভিনয় করতে হবে।

-ধ্যাত!

-না সাজলে লোকের মনে সন্দেহ জাগতে পারে, কেউ প্রশ্ন করে বসতেও পারে।

ইলিয়াস দু’টো স্লিপিং বার্থ রিজার্ভ করে রোকসানাকে নিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় ওঠেন। রোকসানা সত্যি মাথায় কাপড় দিয়েছে।

এতো সকালে শোবার দরকার নেই। ইলিয়াস তাই নিচের বার্থে বসেন রোকসানার পাশে। ট্রেন ছাড়ার পর ইলিয়াস একটা বই খুলে পড়তে চেষ্টা করেন। কিন্তু ট্রেনের স্বল্প আলোয় পড়া সম্ভব হয় না। তিনি বইটা বন্ধ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। রোকসানা তাঁর কোল থেকে বইটা নিয়ে পড়তে

চেষ্টা করে। কিন্তু সে-ও অপর্যাপ্ত আলোয় পড়তে পারে না।

উল্টোদিকের বার্থ থেকে এক প্রৌঢ়া রোকসানার বাঁ পাশে এসে বসেন। মহিলার গা ভর্তি গয়না। রোকসানা বই বন্ধ করতেই কৌতূহলী মহিলা নিচু গলায় জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের বুঝি নতুন বিয়ে হয়েছে, মা?

-হ্যাঁ, দু’মাস হলো।

-বাচ্চা-কাচ্চা না দেখে আমি তাই অনুমান করেছিলাম।

লজ্জায় রক্তিম হয় রোকসানার মুখ।

-বাপ-মায়ের অমতে বিয়ে করেছ বোধ হয়?

-কেন? রোকসানার ভ্রূ কুঞ্চিত হয়।

-গায়ে গয়নাগাটি কিছু দেখছি না কিনা!

-গয়না বাবার বাড়ি থেকেও পেয়েছি, শ্বশুর বাড়ি থেকেও পেয়েছি। গয়না পরে রাস্তা-ঘাটে চলাফেরা নিরাপদ নয়। প্রায়ই তো ট্রেনে ডাকাতি হয়।

-ওমা, তাই নাকি!

-হ্যাঁ, প্রায়ইতো খবরের কাগজে দেখি।

-সব্বোনাশ, আমি এখন কি করি?

মহিলা তাঁর হাতের ও গলার গয়না খুলে তাড়াতাড়ি হাত ব্যাগের ভেতর ভরে ফেলেন।

-কানেরটা আর খুললাম না। তা তুমি শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছো, না বাপের বাড়ি?

-শ্বশুর বাড়ি।

-শ্বশুর বাড়ি কোথায়?

-রংপুর।

ইলিয়াস বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও পৌঢ়ার প্রশ্ন ও রোকসানার উত্তর স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছেন। তিনি ভাবেন, রোকসানা কেমন বানিয়ে মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে। পর মুহূর্তেই আবার ভাবেন, মিথ্যা না বলে উপায় কি? অবিবাহিত তরুণ-তরুণীকে দেখলে মানুষের মনে আরো বেশি কৌতুহল জাগতো।

-রোকু, চা-টা কিছু খাবে? ইলিয়াসের কণ্ঠে ঘনিষ্ঠতার সুর।

-না, তুমি খাও। আমার ভীষণ পানির তেষ্টা পেয়েছে।

-লেমনেড খাবে? না ভিমটো?

-আনাও একটা কিছু। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

ট্রেনের এ পরিবেশে একে অন্যকে- ‘তুমি’ সম্বোধন মোটেই অস্বাভাবিক লাগছে না ইলিয়াস ও রোকসানার কানে।

ইলিয়াস ডাইনিং কারের বেয়ারাকে ডেকে দু’টো লেমনেড আনিয়ে নেন। দু’জনেই লেমনেডের বোতল হাতে নেন। বোতলে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে রোকসানা বলে, রংপুর ক’টায় পৌঁছবে?

-তা বেলা ন’টা সাড়ে ন’টা বাজবে।

-যে লোকের কথা তুমি বলেছিলে, তাকে কি দেখতে পাবো সেখানে?

-আশা তো করি।

রাত দশটা বাজে। ট্রেনের চুলানিতে ঝিমনি আসে দু’জনেরই। রোকসানা একবার ঢলে পড়ে ইলিয়াসের গায়ে। ইলিয়াস তাঁর কাঁধ থেকে রোকসানার মাথাটা আলগোছে সরিয়ে সোজা করে দেন। রোকসানা জেগে ওঠে। তার চোখে লজ্জিত বিব্রত দৃষ্টি।

ইলিয়াস ফুঁ দিয়ে দিয়ে তাঁর রাবারের বালিশটায় হাওয়া ভরে বলেন, তুমি এটায় মাথা রেখে শুয়ে পড়ো, হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাও। আমি আমার জায়গায় যাচ্ছি।

-বালিশটা তুমি নিয়ে যাও। আমার ব্যাগটায় বালিশের কাজ চলবে।

-তবে তোমার ব্যাগটাই নিয়ে যাই। ওটা নিরাপদে থাকবে আমার শিথানে। ইলিয়াস রোকসানার কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে ওপরের বার্থে উঠে পড়েন।

রাত বেড়ে চলেছে। সর্বক্ষণ ঝাঁকুনি দিয়ে ঝিকিরধিকির আওয়াজ তুলে ছুটে চলেছে ট্রেন। ইলিয়াসের ঘুম আসছে না। রোকসানার মনের ঠিকানা তাঁর জানা হয়ে গেছে। তার সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্যে প্রবল আকর্ষণ বোধ করেন তিনি। এমনি আকর্ষণের শিকার হয়েছিলেন তিনি আট বছর আগে। তখন তিনি কলেজে পড়তেন। মুনিরা পড়তো তাঁরই সাথে। দু’জনই দু’জনকে পছন্দ করতো, ভালোবাসতো। বি. এ. পাশ করে ইলিয়াস অন্য কোথাও সুবিধা করতে না পেরে পুলিশ বিভাগে চাকরি নেন। মুনিরার বাবা কো-অপারেটিভ ইন্সপেক্টর। তিনি কিছুতেই পুলিশ অফিসারের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজী হননি। মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি এক সাব-রেজিস্ট্রারের সাথে তার বিয়ে দেন।

 

মুনিরা কোথায় আছে, কেমন আছে কোনো খবরই আর রাখেন না ইলিয়াস। মুনিরাও কি তাঁর খবর রাখে? তাঁর কথা ভাবে? মনে হয়, দু’জনই এখন দু’জনের কাছে মৃত।

রোকসানা শুয়ে শুয়ে ভাবে তার বাবার কথা। আজ কতো দিন হয়ে গেল তিনি হাজত খাটছেন। সে জেলখানায় গিয়ে তাঁকে কয়েকবার দেখে এসেছে। অনেক শুকিয়ে গেছেন বাবা। হাজতে যাওয়ার পর তিনি আর দাড়ি চাঁচেননি। অর্ধেকের বেশি চুল-দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে। তিনি তেমন কথাও বলেন না। কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছেন। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেন, নয়তো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। কোলকাতার দাঙ্গার সময়েও যিনি সাহস হারাননি, নিজের ছেলেমেয়েকে নরপিশাচদের কবল থেকে রক্ষা করেছেন, তিনি জাল নোটের মামলায় পড়ে এমন ভেঙে পড়বেন, কল্পনাই করা যায় না।

এমনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের এলোমোলো ভাবনা ভাবতে ভাবতে রোকসানা এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে

…কয়েকটা গুণ্ডা তাদের বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েছে। তাদের ধারালো ছোরা চকচক করছে। কারো ছোরা রক্ত মাখানো।… রোকসানা দৌড়াচ্ছে, সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠছে। গুণ্ডাগুলোও উঠে আসছে ছাদে। সে দৌড়ে ছাদের এক প্রান্তে গিয়ে থেমে যায়। কোথায় যাবে সে এখন ?…. গুণ্ডাগুলো ধেয়ে আসছে। নিচে অনেকটা ব্যবধানে আরেকটা ছাদ। রোকসানা লাফ দিয়ে সে ছাদে নামতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেই ছাদের নাগাল সে পায় না। সে নিচে পড়ে যায় ধুডুম করে।…দ

ঘুম ভেঙে যায় রোকসানার। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, কাঁপছে থরথর করে। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে দ্রুত। তার ঘাড়ে, কোমরে ব্যথা। সত্যি যেন সে ছাদ থেকে পড়ে গেছে।

কিছুক্ষণ পরে তার সম্বিত ফিরে এলে সে মনে করতে পারে, সে ট্রেনের কামরায় শুয়ে আছে।

কামরায় আলো নেই। বাতিগুলো কি নিজের থেকেই নিভে গেছে, না কেউ

নিভিয়ে দিয়েছে? কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীয়মাণ চাঁদের ম্লান আলোয় কামরার গাঢ়

অন্ধকারে কিছুটা ফিকে হয়েছে। তবু ভালো করে কিছু দেখা যায় না। সব বার্থের

যাত্রীরাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রোকসানার শরীর এখনো কাঁপছে। তার কেমন ভয় হয়। গুণ্ডাগুলো বুঝি বা ধারেকাছেই কোথাও ওঁত পেতে আছে!

সে কোনো রকমে উঠে দাঁড়ায়। আলতোভাবে ইলিয়াসের গায়ে ধাক্কা দিয়ে নিচু গলায় সে বলে, ওগো শুনছো?

ইলিয়াস ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ধড়ফড় করে উঠে তিনি সাড়া দেন, কি, কি হয়েছে?

-তুমি নিচে নেমে এসো। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।

-ট্রেনের ভেতর আবার কিসের ভয়?

-তুমি নিচে নেমে এসো না, প্লীজ?

ইলিয়াস নিচে নেমে আসেন। রাবারের বালিশটা পেতে দিয়ে রোকসানা বলে,-তুমি ঘুমাও। আমি তোমার মাথার কাছে বসে থাকবো।

-তুমি ঘুমোবো না?

-না। একটা দুঃস্বপ্ন দেখলাম। ভীষণ ভয় লাগছে। আর ঘুম আসবে না। অগত্যা ইলিয়াস বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন। রোকসানা তার মাথার কাছে বসে থাকে।

ইলিয়াসের ঘুম আসছে না। তিনি এ-কাত ও-কাত করছেন।

-তোমার ঘুমটা নষ্ট করলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, তুমি ঘুমোও।

ইলিয়াস কিছু বলার আগেই রোকসানা ইলিয়াসের মাথায় হাত রাখে, চুলে বিলি কাটতে থাকে।

প্রীতির স্নিগ্ধ পরশে ইলিয়াসের সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তাঁর মনের নিভৃতে মমতাময়ীর জন্যে মমতা দানা বাঁধতে শুরু করে। তিনি ডান হাত বাড়িয়ে রোকসানার একটা হাত ধরেন। রোকসানা সে হাত সরিয়ে দেয় না। বরং নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে ইলিয়াসের হাত। একজনের হাত অবলম্বন খোঁজে আর একজনের হাতে।

ট্রেনটা রংপুর পৌঁছে পরদিন বেলা দশটায়। স্টেশন থেকে বেরিয়েই রোকসানাকে নিয়ে ইলিয়াস সোজা চলে যান হোটেল তিস্তায়। দোতালার রাস্তার ধারের রুমটা খালি পাওয়া যায়। হোটেল রেজিস্টারে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় লিখে তিনি রোকসানাকে নিয়ে রুমটায় গিয়ে ওঠেন।

প্রায় এক মাস আগে হোটেল তিস্তার এই কামরায় বসেই ইলিয়াস সদানন্দা ক্লাবের ওপর নজর রেখেছিলেন। তিনি খাটটাকে ঠেলে জানালার কাছে নিয়ে যান। পর্দা ফাঁক করে রোকসানাকে দেখান সদানন্দ ক্লাবটা। তারপর এট্যাশে কেস থেকে বাইনোকুলার বের করে রোকসানার হাতে দিয়ে বলেন, এই খাটে বসে বা উপুড় হয়ে শুয়ে জানালার পর্দা সামান্য ফাঁক করে তুমি বাইনোকুলার দিয়ে দেখতে থাকো। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। তুমি দরজাটা বন্ধ করে এসে তোমার কাজে লেগে যাও।

রোকসানা দরজা বন্ধ করে খাটের ওপর এসে বসে। বাইনোকুলারের সাহায্যে তার চোখ জরিপ করে সদানন্দ ক্লাবের প্রত্যেকটা রুম, আনাচে- কানাচে, খেলার মাঠ। যারা ক্লাবে আসা-যাওয়া করে তাদের সে ভালো করে দেখে। সবই অপরিচিত মুখ। দোতলার একটা রুম বাইরে থেকে তালাবন্ধ।

ঘণ্টাখানেক পরে ইলিয়াস ফিরে এসেই জিজ্ঞেস করেন,-দেখতে পেলে? -উঁহু, বহু মুখই দেখলাম, কিন্তু সেই মুখটি চোখে পড়ল না। রোকসানার কণ্ঠে হতাশা।

ইলিয়াস বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে তাকান সদানন্দ ক্লাবের দিকে। চোখ থেকে বাইনোকুলার নামিয়ে বলেন,-রুমটা দেখছি তালাবন্ধ। ওই রুমেই থাকে লোকটা। অনেক রাত পর্যন্ত তাকে তিন চার জনের সাথে তিন-তাসের জুয়া খেলতে দেখেছি।

-লোকটা বাইরে কোথাও গেছে বোধ হয়।

-মনে হয় তাই। তুমি একটার দিকে আবার চেষ্টা করো। দূরে কোথাও না গেলে দুপুরে নিশ্চয়ই খেতে আসবে। আমি এখন একটা জরুরী কাজ নিয়ে বসবো।

ইলিয়াস তাঁর হাত ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করেন। সাঙ্কেতিক চিঠির প্রতিলিপি। আজই আজমল চিঠিটা পেয়েছে। তিনি কিছু সময়ের মধ্যেই ওটার পাঠোদ্ধার করেন। চিঠির প্রয়োজনীয় অংশ তিনি একটা কাগজে টুকে নেন-

-শ্যামের চাঁদমুখ ও ফিগার এখন আরো সুন্দর হয়েছে। তাই এখন তাকে আমরা শ্যামসুন্দর ডাকি। অভিনয়ে সে এখন প্রায় তার শুরুর সমকক্ষ। এপ্রিলের পনেরো তারিখে তাকে সম্বর্ধনা দেয়া হবে। সে অনুষ্ঠানে তুমি অবশ্যই উপস্থিত থাকবে। আগের দিন সন্ধ্যা সাতটায় তুমি পাহাড়তলী ডাকঘরের সামনে থাকবে। তোমার হাতে থাকবে প্লেয়ার্স সিগারেটের টিন। আমার লোকের হাতে থাকবে ডাইরেক্টরী পঞ্জিকা। প্রশ্ন করা হবে :- ‘পাহাড়তলীর মেলায় হাতী পাওয়া যায়।’ উত্তর দিতে হবে:- ‘হ্যাঁ, মাটির হাতী পাওয়া যায়।’ পরের দিন অনুষ্ঠানকক্ষের প্রবেশদ্ধারে প্রহরীর প্রশ্ন :-‘কত নম্বর।’ উত্তর:- ‘তিন তিরিশে নাই।’

-আব্দুল বারেক খুবই ভালো ড্রাইভার। সে ভালো আছে। ইলিয়াস বারবার পড়ে হেঁয়ালিবুলির সঠিক অর্থ বের করার চেষ্টা করেন।

শ্যাম সবুজ রঙের একশ’ টাকার নোট, চাঁদমুখ নোটের ওপরের চাঁদের ছবি, ফিগার=১০০ সংখ্যা-এগুলো আগেই তিনি বের করেছেন। এই চিঠিটায় নতুন সাঙ্কেতিক শব্দ হচ্ছে, শ্যামসুন্দর, অভিনয়, গুরু এবং সম্বর্ধনা। নিবিষ্ট মনে চিন্তা করেন ইলিয়াস। তাঁকে চিন্তামগ্ন দেখে রোকসানা চুপ করে বসে থাকে খাটের এক পাশে। অনেকক্ষণ পরে তাঁর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তিনি মনে মনে বলেন, -একশ’ টাকার নোটকে সম্ভবতঃ আরো সুন্দর করে জাল করা হয়েছে। তাই নাম রাখা হয়েছে শ্যামসুন্দর। শ্যামসুন্দর অর্থাৎ একশ’ টাকার নোটের সমকক্ষ। সম্বর্ধনা বলতে কি বোঝাচ্ছে? বোধহয়, নতুন জালনোট তৈরির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।

ইলিয়াস হাসিমুখে তাকান রোকসানার দিকে।

-নতুন কিছু পেয়েছো মনে হয়?

-হ্যাঁ, পেয়েছি। ভালো জিনিসই পেয়েছি।

-আমাকে বলবে না?

-না, এখন বলা যাবে না।

রোকসানা জানে, একজন ঝানু ডিকেকটিভ তার বউকেও তার গোপনীয় কাজের কথা বলে না।

দুপুরেও বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে রোকসানা সদানন্দ ক্লাবের ওপর নজর রাখে। রুমটা এখনো তালাবন্ধ। ক্লাবে যাতায়াতকারী লোকদের মাঝে তার আকাঙ্ক্ষিত মুখটি দেখা যায় না।

সন্ধ্যার পরে আবার বাইনোকুলার নিয়ে বসে রোকসানা। কিন্তু তখনও রুমটা তালাবন্ধ দেখা যায়। রাত্রে খাওয়া শেষ করে আবার সে তার কাজে বসে। অবশেষে সাড়ে ন’টার পর একটা লোককে দরজা খুলতে দেখা যায়। ঘরের ভেতর গিয়ে লোকটা সুইচ টিপে বাতি জ্বালায়। দরজার দিকে মুখ ঘোরাতেই রোকসানা চমকে ওঠে। প্রায় দেড় মাস আগে বানপুরে দেখা সেই মুখ। ডিমনস্ট্রেটার বিমল বাবুর মতো চেহারা লোকটার। বানপুরে এ লোকটাই তার বাবাকে চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়েছিল।

রোকসানা চোখ থেকে বাইনোকুলার নামায়। ইলিয়াস চিৎ হয়ে শুয়ে ছাদের দিকে চেয়ে আছে, এক মনে গুন গুন করে গাইছে কোনো গানের কলি। সে হাততালি দিয়ে ইলিয়াসের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ইলিয়াস তার দিকে তাকাতেই সে তাকে হাতের ইশারায় ডাকে।

-দ্যাখো তো, ইনিই সেই তিনি কিনা? আমার তো মনে হয়, লোকটাকে আমি ঠিকই চিনতে পেরেছি।

ইলিয়াস বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখে বলেন, হ্যাঁ, ইনিই সেই তিনি। লোকটা বহুলোকের সর্বনাশ করেছে। বানপুরে গিয়ে বহু রিফিউজী পরিবারকে ভারতীয় টাকার বদলে জাল নোট গছিয়েছে।

লোকটাকে আজ রাত্রেই অ্যারেস্ট করা দরকার।

-উঁহু। এখনো সময় হয়নি। ওকে এখন ধরলে ওর দলের অন্য অপরাধীরা সাবধান হয়ে যাবে। তাদের আর তখন ধরা যাবে না।

-তা হলে কবে কিবাবে অ্যারেস্ট করবে?

-দেখা যাক সুযোগ একদিন পাবোই।

ইলিয়াস আবার বলেন, আর আধ ঘণ্টা আগে লোকটা ফিরে এলে আজই ঢাকা ফিরে যাওয়ার ট্রেন ধরতে পারতাম।

-ট্রেন আবার কখন আছে?

-কাল সকাল সাড়ে আটটায়। শোনো, আমি ডাক বাংলোয় যাচ্ছি। তুমি দরজা ভালো করে বন্ধ করে-

-উঁহু, আমি একা থাকতে পারবো না। ভীষণ ভয় লাগে।

-ভয় লাগে! আমি থাকলে ভয় লাগবে না?

-না। তুমি কি গুণডা, না বাঘ-ভালুক যে তোমাকে ভয় লাগবে?

মুচকি হাসিভরা মুখ ফিরিয়ে সে আবার বাইনোকুলারে চোখ লাগায়।

ঢাকায় একদিন থেকে ইলিয়াস আবার হাটহাজারী আসেন। শিশির ভেতর পাওয়া এই ক’দিনের চিঠি দেখবার জন্যে তিনি উদগ্রীব। মহিউদ্দীন তারিখ অনুযায়ী সাজানো চিঠিগুলো এনে তাঁর সামনে রাখে। তিনি একটা একটা করে পড়ে যান।

২৬ মার্চ: আজ দুপুরে কাঠের বড় পেটি নিয়ে একটা ট্রাক এসেছিল। সাথে ছিলেন সেজো সায়েব। গ্যারাজের পেছনের- ‘শাটার ডোর’ তুলে ট্রাকটাকে ঢালু রাস্তা দিয়ে নিচের দিকে যেতে দেখেছি। বাড়িটার নিচে আরো দু-এক তলা আছে বলে মনে হয়। পেটির লেখা দেখে বুঝলাম, নিউইয়র্ক থেকে কোনো ম্যাশিন এসেছে।

২৭ মার্চঃ কর্তারা জানে, আমি নাম সই করা ছাড়া লেখাপড়া কিছু জানি না। তাই আমার সামনে তারা ইংরেজিতে কথা বলতে দ্বিধা করে না। আজ সকালে বড় সায়েব ও মেজো সায়েব চাটগাঁ যাওয়ার পথে গাড়ির পেছনের সীটে বসে ইংরেজিতে আলাপ করছিলেন। তাদের কথা থেকে জানা গেল, ১৫ই এপ্রিল এখানে একটা অনুষ্ঠান হবে। তাদের নিয়েই আর. এম. এস-এ গিয়েছিলাম। মেজো সায়েব একই রকম খামে সাতটা চিঠি ডাকে পাঠালেন।

২৮ মার্চ: আজ দুপুরে আমার রুমের মেজেতে কান পেতেছিলাম। নিচে কোনো ম্যাশিন চলার শব্দ পেলাম।

২৯ মার্চ: জুয়েল প্রিন্টিং প্রেস থেকে দু’জন মেকানিক নিয়ে সেজো সায়েব এসেছিলেন। অফিস-বাড়িটার পশ্চিম দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে তারা কোথায় গেলেন, জানি না। মনে হয়, ওদিকে নিচে যাওয়ার সিঁড়ি আছে। ৩০ মার্চ: জীপের ড্রাইভারের নাম আরমানুল্লা। তার আজ জ্বর হয়েছে।

তাই আজ বিকেলে মেজো সায়েবের ডিউটি করেছি। তিনি জামাল খান রোডের ৩৫/২ বাড়ি থেকে ছয় বোতল’গ্রান্টস রয়েল’ হুইস্কি কিনেন। তারপর লাল খাঁ বাজারের এক দোকান থেকে শিক কাবাব কিনে আমরা টিলায় আসি রাত আটটায়। বোতলগুলো নিয়ে মেজো সায়েবের সাথে অতিথিশালায় ঢুকেছিলাম। সেখানে বড় সায়েব ও সেজো সায়েব বসেছিলেন। রাত বারোট পর্যন্ত তিনজনেই খুব টেনেছেন। বড় সায়েবকে আমি ও সেজো সায়েব ধরাধরি করে তার শোবার ঘরে শুইয়ে দিয়ে আসি। অতিথিশালায় পাঁচটা রুম। মেজো ও সেজো আজ বাসায় যাননি। তারা আজ রাতে অতিথিশালায় শুয়ে আছেন।

৩১ মার্চ: নতুন খবর নেই।

০১ এপ্রিল: জীপটার নম্বর এখন CH 1938

০২ এপ্রিল: আজও গেলাসের পার্টি ছিল। মেজোও সেজো সায়েবকে তাদের বাসায় পৌছে দিয়ে এসেছি। মেজোর বাসার ঠিকানা: ১৪, নিবীনচন্দ্র সেন স্ট্রীট, চট্টগ্রাম শহর, সেজোর ঠিকানা: ২৭/৩ গনেশ দাস লেন, চট্টগ্রাম শহর।

০৩ এপ্রিল: নতুন খবর নেই।

-তুমি চিঠিগুলো পড়েছো তো? ইলিয়াস জিজ্ঞেস করেন মহীউদ্দীনকে।

-হ্যাঁ, পড়েছি।

-ট্রাকে করে কি জিনিষ নিয়েছে বলে মনে হয় তোমার? নোট ছাপাবার ম্যাশিন নয় তো?

-আমার তো তাই মনে হয়।

-তা’হলে তো কাস্টম অফিসে খোঁজ নিতে হয়, কি ধরনের প্রিন্টিং ম্যাশিন ইম্পোর্ট করেছে। তারপর একটু থেমে বলেন, নাহ, দরকার নেই। আমরা কাস্টমস-এ অনুসন্ধান করছি-খবরটা কোনো রকমে ওদের কানে গেলে সর্বনাশ হবে।

-স্যার, তোতলা দরবেশের খবর কাগজে পড়লাম। দরবেশ সেজে কিভাবে এতো দিন আমাদের চোখে ধুলো দিয়েছে ব্যাটা। আমি মনে করেছিলাম নোট জালিয়াত দলের সাথে ওর সম্পর্ক আছে।

-আমিও প্রথমে তাই মনে করেছিলাম।

-স্যার, তা’ হলে প্রথম সাঙ্কেতিক চিঠিটা তোতলা দরবেশ নেয়নি। আলী রেজা সায়েবের অসাবধানতার জন্যেই ওটা হারিয়ে গিয়েছিল।

-তোতলা দরবেশও নিতে পারে।

-ও কি জন্যে নেবে স্যার?

-ওই যে কথায় বলে না, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। এক অপরাধীর সাঙ্কেতিক চিঠি হাত করেছি। তাই মাসতুতো ভাইদের জন্যে দরদ উথলে উঠেছিল মনে হয়।

রফিকের পাঠানো ঠিকানাগুলোর সঠিক অবস্থান দেখে আসার জন্যে মহিউদ্দীন মোটর সাইকেল নিয়ে চাটগাঁ চলে যায়। ইলিয়াস রোজ নিজে গিয়ে শিশি নিয়ে আসেন। কিন্তু কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর পাওয়া যায় না। মহিউদ্দীনকে হাটহাজারী রেখে ৮ এপ্রিল ইলিয়াস ঢাকা চলে যান।

ড্রাইভার আব্দুল বারেকোর দেখা শোনার ভার একজন ওয়াচারের ওপর দিয়ে তিনি আবিদ ও দু’জন ওয়াচার নিয়ে পরের দিনই রংপুর চলে যান।

সদানন্দ ক্লাবের এ. চৌধুরী ওরফে লুৎফর রহমানের ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখবে আবিদ ও দু’জন ওয়াচার। ১৪ এপ্রিল পাহাড়তলী পৌঁছতে হলে তাঁকে ১২ বা ১৩ এপ্রিল রংপুর থেকে রওনা দিতে হবে। সে যে পথেই যাক, তাকে রাস্তায়ই গ্রেফতার করতে হবে। তিস্তারমুখঘাট হয়ে গেলে বাহাদুরাবাদের ফেরীতে উঠবার আগে আর গোয়ালন্দ হয়ে গেলে স্টীমারে উঠবার আগে গ্রেফতার করতে হবে। ইউনিফর্ম পুলিশের সাহায্য অবশ্যি নিতে হবে। গ্রেফতারের খবর কোনোমতেই সংবাদপত্রে প্রকাশ করা চলবে না। আবিদকে এ ব্যাপারে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে আজমলকে নিয়ে ইলিয়াস ঢাকা চলে আসেন এবং সেদিনই রাত্রে আজমল ও মনোয়ারকে নিয়ে জীপে করে চাটগাঁ রওনা হন।

ওয়াচার জহুর অফিসারদের পাঁচজন গার্ড নিয়ে ট্রেনে রওনা হবে ১৩ এপ্রিল রাত্রে।

জীপটা ইলিয়াসকে হাটহাজারী নামিয়ে দিয়ে চাটগাঁ শহরে চলে যায়। আজমল ও মনোয়ার চিটাগাং পুলিশ ক্লাবে গিয়ে ওঠে। মহিউদ্দীন শিশির ভেতর পাওয়া চিঠিগুলো রাখে ইলিয়াসের সামনে। ১১ এপ্রিলের চিঠিটা গুরুত্বপূর্ণ। বড় সায়েব ও মেজো সায়েবের ইংরেজি কথোপকথন থেকে জানা গেছে, নিমন্ত্রিতদের এক দল আসবে সন্ধা সাতটায় আর একদল ন’টায়। পাহাড়তলী ডাকঘরের সামনে থেকে তাদের গাড়িতে তুলে চোখে কালো কাপড় বেঁধে বাদুরটিলার অতিথিশালায় নিয়ে যাওয়া হবে।

১২ ও ১৩ এপ্রিলের সংগৃহীত চিঠিতে প্রয়োজনীয় কোনো খবর পাওয়া যায় না। ১৪ই এপ্রিল ভোরে ইলিয়াস নিজে গিয়ে শিশি নিয়ে আসেন। শিশি থেকে চিঠি বের করে তিনি পড়েন।

১৩ এপ্রিল: আজ সন্ধ্যায় টিলায় ফেরার পথে অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যাপার নিয়ে বড় সায়েব ও মেজো সায়েবের মধ্যে ইংরেজিতে কথা হচ্ছিল। মেজো সায়েব বললেন, জামাল খান রোডের যে লোকটি আজ হুইস্কি দেবে বলেছিল, সে তা দিতে পারেনি। আগামীকাল বিকেল তিনটায় লোকটি বারো বোতল- ‘গ্রান্টস রয়েল’ হুইস্কি দিবে।

ইলিয়াসের নির্দেশ মতো ১৪ এপ্রিল ভোরে জীপ নিয়ে আজমল ও মনোয়ার হাটহাজারী থানায় আসে। ইলিয়াস সেখানে গিয়ে থানার অফিসার-ইনচার্জের সাথে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করেন। তারপর তিনি পুলিশ সুপারের সাথে দেখা করতে চলে যান চাটগাঁ শহরে।

বিকেল সাড়ে তিনটা। CH 1638 নম্বরের জীপটা জামাল খান রোড থেকে বেরুতেই মোটর সাইকেলে আসীন একজন পুলিশ সার্জেন্ট জীপটা থামাবার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ড্রাইভার আরো জোরে একসেলারেটারে চাপ দেয়। জীপটা তীব্র বেগে ছুটে চলে। সার্জেন্ট ও ট্রাফিক কনষ্টেবলরা জোরে হুইল্ বাজায়। সার্জেন্টের মোটর সাইকেল ও পুলিশের দুটি প্যাট্রল জীপ CH 1638 নম্বরের জীপটাকে অনুসরণ করে এবং মিনিট দশেকের মধ্যে সেটাকে আটকাতে সক্ষম হয়।

পুলিশ জীপটায় তল্লাসী চালিয়ে বারো বোতল বেআইনী হুইস্কি ও দশ কার্টন বিদেশী সিগারেট পায়। সার্জেন্ট জীপের-বু বুক চাইলে ড্রাইভার তা দেখাতে পারে না। জামসেদ ও ড্রাইভারকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালী থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। জীপটাকেও আটক করা হয়। মোটর ভেহিকল্স রেজিস্ট্রেশান অফিসে টেলিফোন করে জানা যায় CH 1638 জীপ নয়, একটি অস্টিন কার। সে কারটির মালিকও অনেকদিন আগে বদল হয়ে গাড়িটা এখন খুলনায়। জীপের আরোহী ও ড্রাইভারের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ: ১. ইচ্ছাকৃতভাবে ও অসৎ উদ্দেশ্যে গাড়ির রেজিস্ট্রেশান নম্বর পরিবর্তন ২. অবৈধভাবে চোরাই চালানকৃত মদ ও সিগারেট বহন ৩. পুলিশের নির্দেশ অমান্য এবং ৪. অত্যধিক গতিতে বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালনা। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে জামসেদ ও ড্রাইভার আরমানুল্লার বিরুদ্ধে থানায় এজাহার লেখা হয় এবং তাদের থানা হাজতে নিয়ে রাখা হয়।

অনেক অনুনয় বিনয় করে জামসেদ একটা টেলিফোন করার অনুমতি চায়। ইলিয়াস সাদা পোশাকে অফিসার-ইন-চার্জের কামরায় বসে ছিলেন। চোখের ইশারায় তিনি অফিসার-ইন-চার্জকে টেলিফোন করার অনুমতি দিতে বলেন।

জামসেদকে হাজত থেকে বের করে আনা হয়। সে কান্না জড়ানো কণ্ঠে টেলিফোন করে তার ম্যানেজিং ডাইরেক্টরকে বলে, স্যার, আমাকে ও আরমানুল্লাকে পুলিশ এ্যারেস্ট করেছে। জীপটাও আটক করেছে।…. হ্যাঁ স্যার। আচ্ছা দিচ্ছি। অফিসার-ইন চার্জের দিকে তাকিয়ে জামসেদ বলেন, আপনার সাথে আমাদের ম্যানেজিং ডাইরেক্টার কথা বলতে চান। অফিসার-ইন-চার্জ রিসিভারটা হাতে নিয়ে বলেন, হ্যালো, হ্যাঁ, অপরাধ তো সাংঘাতিক। এদের বিরুদ্ধে চার-চারটে অভিযোগ।….না, জামিন দেয়া যাবে না। ….না….না অসম্ভব।…. কিছুতেই সম্ভব নয়।… ঠিক আছে, আপনি তাঁর সাথে কথা বলতে পারেন।… আচ্ছা দিচ্ছি।

অফিসার-ইন-চার্জ রিসিভারটা আবার জামসেদের হাতে দেন। জামসেদ বলেন, স্যার….না বন্ধ করার দরকার নেই। জুলহাস ও নতুন ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিন। হ্যাঁ,…. আমার স্টীল ক্যাবিনেটের ডানদিকের নিচের ড্রয়ারে আছে। হ্যাঁ ওটার একটা চাবি তো আপনার কাছে আছে।….আচ্ছা স্যার।

জামসেদকে আবার হাজতে পোরা হয়।

অফিসার-ইন-চার্জ ইলিয়াসকে বলেন, স্যার, পেণ্ডওয়ালা আমাকে শাসাচ্ছিল। বলছিল, সে হোম মিনিস্টারকে টেলিফোন করবে।

-করতে দিন টেলিফোন। নির্ভীর কন্ঠ ইলিয়াসের।

১৪ এপ্রিল, সন্ধ্যা সাতটা। ভক্সল গাড়িটা চালিয়ে আবদুল বারেক ওরফে রফিক পাহাড়তলী ডাকঘরের সামনে এসে থামে। ভেতরে বসে আছে অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার জুলহাস। চারজন লোককে দেখা যায়। তাদের হাতে প্লেয়ার্স সিগারেটের টিন। জুলহাস হাতে ডাইরেক্টরী পঞ্জিকা নিয়ে নামে। তাকে দেখে চারজনই এগিয়ে আসে। সে তাদের ভেতর থেকে একজনকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে নিচু গলায় প্রশ্ন করে, পাহাড়তলীর মেলায় হাতী পাওয়া যায়।

সিগারেটের টিন হাতে লোকটি বলে, হ্যাঁ, মাটির হাতী পাওয়া যায়।

জুলহাস লোকটিকে গাড়িতে গিয়ে বসতে বলে।

তারপর একজন একজন করে দূরে নিয়ে গিয়ে সে একই প্রশ্ন করে। সঠিক উত্তর পেয়ে সবাইকে গাড়িতে তুলে নেয়। তার নির্দেশে ড্রাইভার সবার চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে গাড়ি ছেড়ে দেয়।

গাড়িটা আবার আসে ন’টার সময়। একইভাবে আরো চারজনকে যাচাই করে গাড়িতে তুলে বাদুরটিলার অতিখিশালায় নিয়ে যাওয়া হয়।

অতিথিদের জন্যে মহার্ঘ পানীয় ও রসনা-তৃপ্তিকর খাদ্যের ব্যবস্থা ছিল অতিথিশালায়। তাদের দেখাশুনার ভাব ছিল জুলহাসের ওপর। অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে পানাহার চলে। দু’জন ছাড়া সব অতিথিই মাত্রাতিরিক্ত হুইস্কি খেয়ে বেসামাল।

পরদিন ভোর আটটায় নাশতার টেবিলে মাত্র দু’জন উপস্থিত হয়। আর সবাই তখনো ঘুমে অচেতন। ন’টার সময় জুলহাস তাদের দরজায় জোরে কড়া নাড়তে থাকেন। তারা টলতে টলতে বাথরুমে যায়, প্রাতঃকৃত্য সমাপন করে। তাদের নাশতা খেয়ে তৈরি হতে হতে প্রায় দশটা বেজে যায়।

জুলহাস অতিথিশালার পশ্চিমদিকের একটা দরজা খুলে এক মিনিট অন্তর একজন করে অতিথি সে দিকে পাঠিয়ে দেন।

নিচে নামবার সিঁড়ির মুখে সশস্ত্র প্রহরী। আগত অতিথিকে সে প্রশ্ন করে,

-কতো নম্বর?

-তিন তিরিশে নব্বই।

একজন একজন করে অতিথিরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। আলোয় ঝলমল একটা কক্ষে গিয়ে তারা চারদিকে চোখ বুলায়। কক্ষটির পশ্চিমদিকে প্রায় দেয়াল ঘেষে একটা গদিআঁটা চেয়ার ও তার সামনে একটা ছোট টেবিল। টেবিলটার সামনে অল্প দূরে দুই সারিতে দশখানা গদিআটা চেয়ার। বোঝা যায়, এসব চেয়ার-টেবিল শুধু আজকের অনুষ্ঠানের জন্যে এখানে আনা হয়েছে।

কক্ষটির পুবদিকের অনেকটা জায়গা নীল পর্দা দিয়ে ঢাকা। সকলের শেষে জুলহাস এসে সবাইকে বসতে বলে নিজেও একটা চেয়ারে বসে পড়েন।

ঠিক সোয়া দশটায় বড় সায়েব কক্ষে প্রবেশ করেন। জুলহাসের সাথে সবাই উঠে দাঁড়ায়।

-আপনারা বসুন। বড় সায়েবের গম্ভীর কন্ঠ। তিনি চেয়ারে বসে সবার দিকে নজর বুলিয়ে নেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আমার প্রিয় এজেন্টবৃন্দ, আপনাদের কাউকেই এর আগে দেখার সুযোগ আমার হয়নি। আপনাদের সাথে যোগযোগ ছিল একমাত্র আমাদের মার্কেটিং ম্যানেজারের। তিনি জরুরী কাজে বাইরে গেছেন। তাই তিনি এ অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। অপনারা একজন একজন করে দাঁড়িয়ে আপনাদের পরিচয় দিন। ডানদিক থেকে শুরু করুন।

-আমার নাম শামসুল হক, বরিশাল থেকে এসেছি।

-আমি মোহাম্মদ হানিফ, খুলনা থেকে এসেছি।

-আমি রজব আলী, ময়মনসিংহ থেকে এসেছি।

-আমার নাম লুৎফর রহমান, রংপুর থেকে এসেছি।

-আমার নাম তোজাম্মেল হক, রাজশাহী থেকে এসেছি।

-আমি নোয়াখালী থেকে এসেছি। আমার নাম আমানতউল্লাহ।

-আমি কোরবান আলী, কুমিল্লা থেকে এসেছি।

-আমার নাম রওশন চৌধুরী, বাড়ি সিলেট।

-আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আপনারা এতোদিন নানা অসুবিধের মধ্যে কাজ করেছেন। এর প্রধান কারণ আমাদের তৈরি নিম্নমানের জিনিষ। এবার আমরা উন্নতমানের জিনিস সরবরাহ করতে পারবো। জিনিসের মান উন্নত করার জন্য আমরা বিদেশ থেকে অত্যাধুনিক ম্যাশিন আমদানী করেছি। এবার আর আপনাদের কোনো অসুবিধেই হবে না। নমুনা হিসেবে আমরা কিছু জিনিস তৈরি করেছি। আপনারা দেখুন, কী নিখুঁত জিনিস আমরা তৈরি করেছি।

বড় সায়েব তাঁর ব্রীফকেস থেকে কতগুলো নোট বের করেন। জুলহাস উঠে গিয়ে সেগুলো এনে একটা একটা করে এজেন্টদের হাতে দেয়। তারা নোট দেখে গুঞ্জন করে ওঠে, সুন্দর চমৎকার। তাদের সকলের মুখে সন্তুষ্টির হাসি।

বড় সায়েব আবার বলতে শুরু করেন, আগে যে ত্রুটিগুলো ছিল, তা এগুলোতে নেই। কিভাবে এগুলো তৈরি হয় তা জানতে আপনারা নিশ্চয়ই খুব উৎসুক। তাই এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আপনাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। চলুন, এবার আমরা দেখবো কিভাবে, কেমন করে এগুলো তৈরি হয়।

বড় সায়েবের পেছনে পেছনে সবাই গিয়ে দাঁড়ায় পর্দায় ঢাকা জায়গাটার সামনে। বড় সায়েব পর্দা উন্মোচন করতেই জুলহাসের সাথে সবাই হাততালি দেয়। বড় সায়েব হাত উঠিয়ে ইশারা করতেই ম্যাশিন চালু হয়ে যায়। অল্পক্ষণ পরেই মুদ্রিত একশ’ টাকার নোট বেরিয়ে আসতে শুরু করে। বড় সায়েবের সাথে সবাই আবার হাত তালি দেয়।

ম্যাশিন চলতে থাকে। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে অনেকক্ষণ ধরে। বড় সায়েব আট প্যাকেট নোট তৈরি রাখতে বলেন। প্রতি প্যাকেটে থাকবে দশ বাণ্ডিল একশ’ টাকার নোট।

বড় সায়েবের সাথে সবাই আবার নিজ নিজ চেয়ারে গিয়ে বসে। আবার শুরু হয় বড় সায়েবের ভাষণ-এবার থেকে আপনাদের কাছে আরো বেশি করে এ জিনিস পাঠানো হবে। আজ থেকে আপনাদের কমিশনও ৩০% থেকে বাড়িয়ে ৩৫% করা হলো। অনেক জিলায় আমাদের এজেন্ট নেই। বিশ্বস্ত লোক পেলে এজেন্ট এর সংখ্যা বাড়ানো হবে। নোটের প্যাকেট নিয়ে আসে জুলহাস। বড় সায়েবের নির্দেশে প্রত্যেক অতিথিকে একটা করে প্যাকেট দেয়া হয়।

বড় সায়েব বলেন, প্রত্যেক প্যাকেটে দশ বাণ্ডিল করে একশ’ টাকার নোট আছে এক প্যাকেটে এক লাখ টাকা। এই এক লাখ টাকা চালাতে পারলে কমিশন পাবে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। আপনারা এখন থেকে সোল কেনার ব্যাপারে বেশি তৎপর হবেন। কারণ আসল নোট আর জাল নোট-সবই তো কাগজ। বিশ্ববাজারে এগুলোর মূল্য কি? এদেশের কারেন্সি অন্য দেশে চলে না। সুতরাং আমাদের এ নোট দিয়ে সোনা কিনবেন।

সিনেমার গানের অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা যায়। কোনো সিনেমা হলে নতুন সিনেমা শুরু হচ্ছে। মাইকে তারই ঘোষণা শোনা যায়, আজ থেকে তসবির মহলে-তসবির মহলে শুরু হচ্ছে রা-1-1-জ-মুকু-ট, রা-1-1-জ-মু-কু-ট।

তসবির মহলে রা-া-জ-মুক-ট।

বড় সায়েব আবার শুরু করেন, আপনারা মনে রাখবেন, অর্থনৈতিক সাফল্যের ওপর নির্ভর করে রাজনৈতিক সাফল্য। অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করে আমরা দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবো। এখন থেকেই আপনারা এই লাইনে চিন্তা-ভাবনা করবেন।

-প্রিয় এজেন্টবৃন্দ, আপনারা সচেষ্ট হলে, নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে আমরা অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করবো, রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করবো। দেশের কর্তৃত্ব আসবে আমাদের হাতে। পুরো দেশটা আসবে আমাদের মুঠোর ভেতর।

-হ্যাণ্ডস আপ।

রিভলবার উঁচিয়ে ধরেন ইলিয়াস ও মহিউদ্দীন। গম্ভীর কলজে কাঁপানো কণ্ঠে ইলিয়াস বলেন, তুমিই এখন আমাদের মুঠোর ভেতর। কেউ নড়বে না। নড়লেই গুলি করবো।

সবাই হাত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কেউ ঠকঠক করে কাঁপছে। একটু পরেই সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে প্রবেশ করে রফিক। তাদের দেখে গেটের প্রহরী বন্দুক ফেলে আত্মসমর্পণ করে।

সবাইকে হাতকড়া লাগাচ্ছে ইউনিফর্মধারী পুলিশ। হঠাৎ কক্ষের বাতি নিভে যায়। নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে যায় সারা ঘর। কিছুই দেখা যায় না চোখে।

ইলিয়াস পকেট থেকে টর্চলাইট বের করে জ্বালিয়ে দেখেন, পেগুওয়ালা নেই। লোকটা গেলো কোথায়?ত

পেণ্ডওয়ালা সেখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলো তার পেছনেই সুইচবোর্ড। স্পষ্টই বোঝা যায় সে পিঠের চাপে সুইচগুলো অফ করেছে। সুইচ টিপে বাতি জ্বালান ইলিয়াস। কয়েকজন আসামী অন্ধকারে পালাবার চেষ্টা করছিল। পুলিশ ও তাঁর লোকেরা যখন আসামীদের হাতকড়া লাগাতে ব্যস্ত তখন ইলিয়াস এখান থাকে বেরুবার দরজা খুঁজছেন।

কুমটার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা দরজা। ইলিয়াস সেদিকে ছুটে যান। কিন্তু দরজাটা অন্যদিক থেকে বন্ধ। তিনি দরজাটা ভাঙবার চেষ্টা করেন। দু’জন কনস্টেবল এসে বুট পায়ে কয়েকটা লাখি মারতেই দরজাটা ভেঙে যায়। ইলিয়াস এক হাতে টর্চ ও অন্য হাতে রিভলবার নিয়ে এগিয়ে যান। তাঁর পেছনে যায় রফিক। একটা ঢালু গুহাপথ ক্রমশঃ নেমে গেছে পশ্চিমদিকে। ইলিয়াসের তেমন তাড়া নেই। পশ্চিম পাশের জেনারেটার রুমের কাছে তিনজনকে নিয়ে আজমলকে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ম্যারটিজ লক দেখেই তাঁর সন্দেহ হয়েছিল। তাঁর অনুমান ঠিকই হয়েছে। ভেতর থেকে খুলে বেরুবার জন্যেই দামী তালাটা লাগানো রয়েছে। ইলিয়াস যেতে যেতে হঠাৎ বাইরের আলোর ঝলক দেখতে পান। মানুষের চেঁচামেচিও শুনতে পান। ইলিয়াস গুহাপথ পার হয়ে জেনারেটার রুমের ভেতর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন।

পেণ্ডওয়ালাকে ধরে ফেলেছে আজমল। লোকটা তার রিভলভার থেকে গুলি ছুঁড়েছিল। গুলিটা আজমলের কানের পাশ দিয়ে চলে গেছে-দ্বিতীয় গুলি করবার আর সুযোগ সে পায়নি।

ছ’জন জালনোট চালানকারী জুলহাস, একজন ম্যাশিনম্যান, দু’জন টেকনিশিয়ান ও তিনজন প্রহরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেউ পালাতে পারেনি।

ইলিয়াসের হাত ব্যাগ একটা ছোট্ট অটোমেটিক ক্যামেরা ছিল। সেটা দিয়ে তিনি অনেকগুলো ফটো তুলেছেন। মহিউদ্দীনের হাতব্যাগে ছিল ছোট্ট একটা টেপরেকর্ডার। পেণ্ডওয়ালার ভাষণ রেকর্ড করা হয়েছে তাতে।

সারাটা বাড়ি তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হয়। জাল নোট ছাড়াও নানা রকমের কেমিক্যালস, কয়েক রীম মজবুত দামী কাগজ, নোটের আকারে কাটা কড়কড়ে কাগজ, চল্লিশ হাজার টাকার কারেন্সী নোট যেগুলো সম্ভবতঃ খাঁটি নোট এবং তিনটা ব্যাংকের চেকবই ও কাগজপত্র পাওয়া যায়। কয়েকজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে সেগুলো সীজ করেন থানার কয়েকজন সাব-ইন্সপেক্টর। বাড়িটা সীল করে, পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করে চোদ্দজন আসামী ও সীজকরা জিনিসপত্র পুলিশের হেফাজতে দিয়ে দেন ইলিয়াস। তারপর পুলিশ বাহিনীর সাথে তিনি তাঁর অফিসার, ওয়াচার ও গার্ডদের নিয়ে স্থান ত্যাগ করেন।

রংপুরের এ. চৌধুরী ওরফে লুৎফর রহমানকে ১৩ এপ্রিল তিস্তামুখঘাট থেকে গ্রেফতার করেছিল আবিদ। তাকে ঢাকা এনে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

চাটগাঁ থেকে ঢাকা ফিরে এসেই ইলিয়াস সরাসরি সেন্ট্রাল জেলে-টেস্ট আইডেন্টিফিকেশান প্যারেড’-এর ব্যবস্থা করেন। জাফর আহমদ, রোকসানা এবং বানপুরে একইভাবে প্রতারিত তিনজন শরণার্থী অনেক লোকের ভেতর থেকে এ. চৌধুরী ওরফে লুৎফর রহমানকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়।

তদন্ত শেষ করতে আরো কিছুদিন লাগবে। প্রতারিত আরো কিছু লোককে দিয়ে চাটগাঁয়ে ধৃত ছ’জন জালনোট চালানকারীকে সনাক্ত করাতে হবে। এ জন্যে আরো টি. আই. প্যারেডের ব্যবস্থা করতে হবে। ইলিয়াস একটা অন্তবর্তীকালীন রিপোর্ট দাখিল করেন কোর্টে। সেই সাথে রোকসানার বাবা জাফর আহমদের জামিনের জন্যেও সুপারিশ করেন। জামিন মঞ্জুর করতে কোর্ট ইন্সপেক্টর এবার কোনো রকম আপত্তিই করেন না। জাফর আহমদ সেদিনই সেন্ট্রাল জেল থেকে বেরিয়ে আসেন।

সন্ধ্যার পরপর ইলিয়াস বৈঠকখানায় বসে বাদুরটিলায় তোলা ফটোগুলো দেখছিলেন। এমন সময় রোকসানা আসে।

-আসসালামু আলায়কুম। আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এলাম। রোকসানা বলে,-বাবা খুবই ক্লান্ত, তাই তাঁকে নিয়ে এলাম না।

-স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় শেষ হয়ে গেছে বলেই বুঝি আবার ‘আপনি’ শুরু হয়েছে? ইলিয়াস হাসেন। ‘ভালো আছেন তো ‘আপনি?’

-নাহ্, বড্ড বিচ্ছিরি শোনাচ্ছে, অস্বাভাবিক শোনাচ্ছে।

-তা’হলে?

-তুমিই চলুক।

-শুধু আমার দিক থেকে? উঁহু, সে এক তরফায় আমি রাজী নই।

-তাহলে দো-তরফাই চলুক।

ইলিয়াস পাশের সোফা দেখিয়ে বলেন, বসো।

সোফায় বসতে বসতে রোকসানা বলে, কী দ্যাখছো ওগুলো?

ইলিয়াস কিছু না বলে কয়েকটা ফটো তার দিকে এগিয়ে দেন। রোকসানা ফটো দেখে অবাকই হয়। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে সে বলে, এই লোকগুলোই জাল নোট চালায়? আরে! নোট ছাপাবার ম্যাশিনের ফটোও তুলেছো! ওদের আস্তানায় কি করে ঢুকলে?

-ওরা উন্নতমানের জাল নোট তৈরির ম্যাশিন বসিয়েছিল। তারই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ওরা ওদের জালনোট চালানকারী এজেন্টদের দাওয়াত করেছিল। রংপুরী সেই এজেন্ট, যে তোমাদের ঠকিয়েছিল, তাকে আগেই পাকড়াও করে তার বদলে ঢুকে পড়েছিলাম ওদের আস্তানায় একজন সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে।

-একজনের বদলে দু’জন! ওরা বুঝতে পারেনি, চিনতে পারেনি যে তোমরা ওদের লোক নও?

-এজেন্টদের চিনতো একমাত্র ওদের মার্কেটিং ম্যানেজার। কতজনকে দাওয়াত করেছিল-সেটাও সে ছাড়া আর কারো জানার কথা নয়। তাই তাকে আমরা আগেই পাকড়াও করেছিলাম অন্য অপরাধের জন্যে। সাতজন অতিথির জায়গায় আটজন কেন-এ প্রশ্ন করলে বলে দিতাম আমার সাব-এজেন্টকে নিয়ে এসেছি।

ইলিয়াস আরো কয়েকটা ফটো রোকসানার দিকে এগিয়ে ধরে বলেন, এই দ্যাখো, আরো ফটো।

-এই প্যাকেটগুলোর ভেতর কি?

-একশ’ টাকার জালনোট।

-নোট দেখিয়ে একটা লোক বক্তৃতা দিচ্ছে। কে লোকটা?

-এ লোকটাই জাল নোট বানাতো। পালের গোদা।

-লোকটা কি বলছিল তার বক্তৃতায়?

-শুনবে?

-হ্যাঁ, শুনবো।

-চলো তা’ হলে।

ইলিয়াস রোকসানাকে নিয়ে তাঁর শোবার ঘরে যান। বোতাম টিপে তিনি টেপরেকর্ডারটা চালিয়ে দেন।

-আমার প্রিয় এজেন্টবৃন্দ, আপনাদের কাউকেই এর আগে দেখার সুযোগ আমার হয়নি। আপনাদের সাথে যোগাযোগ ছিল একমাত্র আমাদের মার্কেটিং ম্যানেজারের।…….

রোকসানা তন্ময় হয়ে শুনছে ইলিয়াসের পাশে দাঁড়িয়ে। ভাষণের মাঝে

হঠাৎ তসবির মহলে নতুন ছবি- ‘রাজমুকুট’ শুরু হওয়ার অস্পষ্ট ঘোষণা শুনে সে বলে ওঠে,-এ আবার কি?

-পুলিশবাহিনী এসে পড়েছে, আমার জন্যে তারই সঙ্কেত।

…..প্রিয় এজেন্টবৃন্দ, আপনারা সচেষ্ট হলে, নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে আমরা অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করবো, রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করবো। দেশের কর্তৃত্ব আসবে আমাদের হাতে। পুরো দেশটা আসবে আমাদের মুঠোর ভেতর।

-হ্যাণ্ডস আপ! তুমিই এখন আমাদের মুঠোর ভেতর। কেউ নড়বে না। নড়লেই গুলি করবো।

ইলিয়াসের বজ্রগম্ভীর কণ্ঠ চিনতে পারে রোকসানা। সে মুচকি হেসে তার দু’হাত উঁচিয়ে বলে, গুলি করো না, প্লীজ। আমি এখন তোমাদের মুঠোর

ভেতর। ইলিয়াসের মুখে স্মিত হাসি। তিনি তাঁর দু’হাত দিয়ে রোকসানার দু’হাত আকর্ষণ করে ফিসফিসিয়ে বলেন,-মুঠোর ভেতর না, বুকের ভেতর।

ইলিয়াসের বুকে মাখা রেখে রোকসানা পরম প্রীতিতে তাঁকে জড়িয়ে ধরে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024