সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০২:২০ অপরাহ্ন

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক  বন্দোপধ্যায় ( প্রথম কিস্তি )

  • Update Time : রবিবার, ১০ মার্চ, ২০২৪, ২.১০ এএম

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো।   ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না। 

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য

 

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক  বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।
দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।
 
দিবারাত্রির কাব্যে
মানিক  বন্দোপধ্যায়
সকাল সাতটার সময় রূপাইকুড়ার থানার সামনে হেরম্বের গাড়ি দাঁড়াল।
বিনা পর্যন্ত মোটরে আসতে তার বিশেষ কষ্ট হয়নি। কিন্তু রাত বারোটা থেকে এখন পর্যন্ত গরুর গাড়ির ঝাঁকানিতে সর্বাঙ্গ ব্যথা ধরে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে শরীরটাকে টান করে দাঁড়িয়ে হেরম্ব আরাম বোধ করল। এক টিপ না নিয়ে সে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।
পুব আর পশ্চিমে কেবল প্রান্তর আর দিগন্ত। মাঝে মাঝে দু’একটি গ্রামের সবুজ চাপড়া বসানো আছে, বৈচিত্র্য শুধু এই। উত্তরে কেবল পাহাড়। একটি ছ’টি নয়, ধোঁয়ার নৈবেদ্যের মতো অজস্র পাহাড় গায়ে গায়ে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে- অতিক্রম করে যাওয়ার সাধ্য চোখের নেই, আকাশের সঙ্গে এমনি নিবিড় মিতালি। দক্ষিণে প্রায় আধমাইল তফাতে একটি গ্রামের ঘনসন্নিবিষ্ট গাছপালা ও কতকগুলি মাটির ঘর চোখে পড়ে। অনুমান হয় যে, ওটিই রূপাইকুড়া গ্রাম। গ্রামটির ঠিক উপরে আকাশে এখন রূপার ছড়াছড়ি। তবে সেগুলি আসল রূপা নয়, মেঘ।
গাড়ি দাড়াতে দেখে থানার জমাদার মতিলাল বেরিয়ে এসেছিল। হেরম্বকে সে-ই সসম্মানে অভ্যর্থনা করল।
একটু অর্থহীন নিরীহ হাসি হেসে বলল, ‘আজ্ঞে না, বাবু নেই। বরকাপাশীতে কাল একটা খুন হয়েছে, ভোর ভোর ঘোড়ায় চেপে বাবু তার তদারকে গেছেন। ওবেলা ফিরবেন-ঘরে গিয়ে আপনি বস্তুন, আমি জিনিসপত্র নামিয়ে নিচ্ছি। এ কিষণ! কিষণ! ইধার আও তো।’
আপিস ও সিপাহীদের ছোট ব্যারাকটির মধ্যে গম্ভীর লালিত্যহীন থানার বাগান। বাগানের শেষপ্রান্তে দারোগবাবুর কোয়ার্টার। চুনকাম-করা কাঁচা ইটের দেয়াল, তলার দিকটা মেঝে থেকে তিন হাত উঁচু পর্যন্ত আলকাতরা মাখানো। চাল শণের। এ বছর বর্ষা নামার আগেই চালের শণ সমস্ত বদলে ফেলায় সকালবেলার আলোতে বাড়িটিকে ঝকঝকে দেখাচ্ছে। বাড়ির সামনে চওড়া বারান্দা।
ভিতরে যাবার দরজার পর্দা ফাঁক করে একটি সুন্দর মুখ উকি দিচ্ছিল।
হেরম্ব বারান্দার সামনে এগিয়ে আসতে খসে-পড়া ঘোমটাটি মাখায় তুলে দেবার প্রয়োজনে মুখখানা এক মুহূর্তের জন্য আড়ালে চলে গেল। তারপর পর্দা সরিয়ে আস্ত মানুষটাই বেরিয়ে এল বারান্দায়।
আগ্রহ ও উত্তেজনা সংযত রেখে সহজভাবেই বলল, ‘আসুন। রাস্তায় কষ্ট হয়নি ?’
‘হয়েছিল। এই মুহূর্তে সব ভুলে গেলাম সুপ্রিয়া।’
‘আমায় দেখেই ?’ কোমল হাসিতে স্বপ্রিয়ার মুখ ভরে গেল, ‘বিশ্বাস করা একটু শক্ত ঠেকছে। যে রাস্তা আর যে গাড়ি, আসবার সময় আমি শুধু কাঁদতে বাকি রেখেছিলাম। পাচ বছর যার খোঁজ-খবর নেওয়ার দরকার মনে করেননি, তাকে দেখে অত কষ্ট কেউ ভুলতে পারে ?’
‘আমি পারি। কষ্ট হলে যদি সহজে অবহেলাই করতে না পারব, পাচ বছর তবে তোর খোজ-খবর নিলাম না কেন?’
‘কত সংক্ষেপে কত বড় কৈফিয়ত! মেনে নিলাম ভাববেন না কিন্তু। আপনার সঙ্গে আমার ঢের বাগড়া আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আর কথা নয়। ভেতরে চলুন। জামা খুলে গা উদলা করে দিন, পাথা নেড়ে আমি একটু হাত ব্যথা করি। স্নান করবেন তো? আপনার জন্যে এক টব জল তুলে রেখেছি। ইদারা থেকে তোলা কিনা, বেশ ঠাণ্ডা জল। স্নান করে আরাম পাবেন।’
স্বপ্রিয়ার কথা বলার ভঙ্গীটি মনোরম। সকালবেলাই এখন একশ’ চার ডিগ্রি গরমে মানুষ সন্তপ্ত হয়ে আছে। কিন্তু স্বপ্রিয়ার যেন একটি দার্জিলিঙের আবহাওয়ার আবেষ্টনী আছে। এ গরমেও তার কথার মাধুর্যের এক কণা বাষ্প হয়ে উড়ে যায়নি, তার কণ্ঠে শ্রান্তির আভাস দেখা দেয়নি। তার ইদারার জলের মতোই সেও যেন জুড়িয়ে আছে।
বাইরের ঘরের ভিতর দিয়ে অন্দরের বারান্দা হয়ে হেরম্বকে সে একেবারে
তার শোবার ঘরে নিয়ে গেল। যেতে যেতে হেরম্ব লক্ষ্য করে দেখল, চারিদিকে একটা অতিরিক্ত খযামাজা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ভাব। ঘর ও রোয়াকের ধোয়া মেঝে সব শুকিয়ে উঠেছে, সাদা কালো দেয়ালে কোথাও একটু দাগ পর্যন্ত নেই। জলের বালতি, ঘটি-বাটি, বসবার আসন প্রভৃতি টুকিটাকি জিনিসগুলি পর্যন্ত কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে স্বস্থানে অবস্থান করছে। স্থানভ্রষ্ট একটি চামচও বোধহয় এ বাড়ির কোথাও আবিষ্কার করা যাবে না। ঘরে ঢুকে স্বপ্রিয়া বলল, ‘ওই ইজিচেয়ারটাতে বসে সবচেয়ে আরাম হয়।
জামা খুলে কাত হয়ে এলিয়ে পড়ুন। ছারপোকা নেই, কামড়াবে না।’ হেরম্ব জামা খুলে ইজিচেয়ারটাতে বসল! এলিয়ে পড়ার দরকার বোধ করল না।
‘আমার আরামের আর কি ব্যবস্থা রেখেছিস বল তো?’
স্বপ্রিয়া সত্যসত্যই পাখা নিয়ে তাকে বাতাস করা শুরু করে বলল, ‘আরামের ব্যবস্থার কথা আর বলবেন না, হেরম্ববাবু। বিশ মাইলের মধ্যে চা’টি পর্যন্ত কিনতে পাওয়া যায় না, এমন বুনো দেশ। যে ক’দিন থাকবেন আপনাকে কষ্ট করেই থাকতে হবে।’-সে একটু হাসল-‘তবে কষ্ট আপনি সহজেই অবহেলা করতে পারেন, এই যা ভরসার কথা। নইলে মুশকিলে পড়তাম।’
স্বপ্রিয়ার এ ঘর সাজানো, ছবির মতো সাজানো। বিছানার ধবধবে চাদরে কোথাও একটি কুঞ্চন নেই, বালিশগুলি নিটোল। দেয়ালের গায়ে পেরেকের শেষ গর্তটি চুনের তলে অদৃপ্ত হয়েছে। এদিকে টেবিলে স্বপ্রিয়া ও তার স্বামীর প্রসাধন-সামগ্রীগুলির একটি কোনদিনই হয়তো আর একটির গায়ে ঠেকে যাবে না, সেলাইয়ের কলের ঢাকনিটি চিরদিন এমনি ধূলিহীন হয়েই থাকবে। প্রতিদিন সুপ্রিয়া কতক্ষণ ঘর সাফ করে আর গোছায় হেরম্ব কল্পনা করে উঠতে পারছিল না।
স্বপ্রিয়ার পাখার বাতাসে স্নিগ্ধ হতে হতেও সে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল।
এক সময় একটু আচমকাই সে জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘দোকানের মতো ঘর সাজিয়েছিস কেন ?’
‘দোকানের মতো!’
‘দোকানের মতো না হোক, বাড়াবাড়ি আছে একটু। তোর ভাল লাগে?’
‘কি জানি।’
‘কি জানি! ভাল লাগে কিনা জানিসনে কি রকম?’
‘অত বুঝিনে। মুদ্রাদোষের মতো হয়ে গেছে। না করেই বা কি করি বলুন। সারাদিন একটা কিছু নিয়ে থাকতে হবে তো মানুষের? একটা ছেলে দিয়ে ভগবান আবার কেড়ে নিলেন। বই-টই পড়তে আমার ভাল লাগে না। এই সবই করি। কিন্তু-‘ সুপ্রিয়ার কথা বলার মধুর ভঙ্গী ফিরে এল, ‘আমার কথা কেন? আগে বলুন আপনার মা কেমন আছেন ?’
‘মা আশ্বিন মাসে স্বর্গে গেছেন।’
স্বপ্রিয়া চমকে বলল, ‘কি সর্বনাশ!’ তার দু’চোখ সজল হয়ে উঠল।
হেরম্ব বলল, ‘মরবার আগে মা তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন।’
স্বপ্রিয়ার পাখা থেমে গিয়েছিল। আবার সেটা নাড়তে আরম্ভ করে বলল, ‘আমাকে বড় ভালবাসতেন। আপনাকে হেরম্ববাবু বলার জন্য সকলের কাছে গাল খেয়েছি, তিনিই শুধু হেসে বলতেন, পাগলী মেয়ে।’ হেরম্ব বলল, ‘তখন তুই পাগলীই ছিলি সুপ্রিয়া।’
স্বপ্রিয়া চিন্তামগ্না হয়ে পড়েছিল, জবাব দিল না।
সুপ্রিয়া ভারি গৃহস্থ মেয়ে।
গোয়ালা আজ কি কারণে এত বেলাতেও আসেনি। স্বপ্রিয়া নিজেই দুরস্ত গরুর বাঁট টেনে হেরম্বের চায়ের দুধ বার করল। উঠানের একপাশে বরমার বেড়ায় ঘেরা স্নানের জায়গা। হেরম্ব সেখানে স্নান করছিল। এই সময় বাইরে এসে তার দুধ দোয়া দেখে অবাক্ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সুপ্রিয়া বলল, ‘বলক তোলা টাটকা দুধ খাবেন একটু? ভারি উপকারী। উনি রোজ খান। দুইব বেশি করে ?’
হেরম্ব বলল, ‘বলক তোলা দুধ শিশুতে খায়। অশোক বাড়ি ফিরলে তাকে খাওয়াস। এ কাজটা শিখলি কবে?’
‘এ আবার শিখতে হয় নাকি!’
‘হয়। কারণ, শিখিনি বলে আমি পারব না।’
স্বপ্রিয়া হেসে বলল, ‘পারবেন। দুধ দেবার জন্যে ভোর থেকে গরু আমার হামলাচ্ছে, বাঁটে হাত দিলে দুধ ঝরবে। তবে আপনাকে কাছেই ঘেঁষতে দেবে কিনা সন্দেহ-ও তোবে হয়তো।’
‘কাছে গেলে তো! চাউনি দেখে ভাল বোধ হচ্ছে না।’
‘বড় দুরন্ত। দু’বেলা দড়ি ছিড়বে, ধরতে গেলে শিং নেড়ে তেড়ে আসবে। কত মোটা শেকল দিয়ে বাঁধতে হয়েছে দেখছেন না? আমি থেতে দি’ বলে আমায় কিছু বলে না।’
স্বপ্রিয়া সস্নেহে তার গরুর গলা চুলকে দিল। বলল, ‘ঘরেই আয়না চিরুনি আছে।’
গরুর সামনে কয়েক আঁটি খড় ফেলে দিয়ে সে রান্নাঘরে গেল। কাল রাত্রে ছানা কেটেছিল, তাই দিয়ে তৈরি করলে সন্দেশ, সন্দেশ ভাল হল না বলে তার যে কি দুঃখ।
হেরম্বকে খেতে দিয়ে বলল, ‘আপনি থাবেন কিনা, তাই আজ শত্রুতা
করেছে।’
হেরম্ব সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘আহা হোক না, খাব বই তো নয়।’
‘খাবার জন্যই তো খাবার, কিন্তু তাই বলে যা তা দেওয়া যায়? মিহি না হলে সে আবার সন্দেশ! কাল রাত্রে, পড়লাম ফিট হয়ে, নইলে রাত্রেই করে রাখতাম। সারা রাত ফেলে রেখে সে ছানায় কি সন্দেশ হয়?’
হেরম্ব খাওয়া বন্ধ করে বলল, ‘তোর না ফিট সেরে গিয়েছিল?’
‘গিয়ে তো ছিল, এ বছর আবার হচ্ছে। কাল নিয়ে দু’বার হল। রান্নাঘরে ছানা ডলছি, হঠাৎ মাথার মধ্যে এমনি ঝিমঝিম করে উঠল! তার পর আর কিছু মনে নেই! জ্ঞান হতে দেখি পাড়ে আর দাই গায়ে বালতি বালতি জল ঢালছে, রান্নাঘর ভেসে একেবারে পুকুর ?’
‘চা আনি।’ হেরম্বকে কথা বলার অবকাশ না দিয়ে সুপ্রিয়া রান্নাঘরে চলে গেল।
চা এনে সে অন্য কথা পাড়ল।
‘র’চিতে ক’দিন ছিলেন?’
‘চারদিন।’
5’এখানে কতদিন থাকবেন?’
‘একদিন।’
স্বপ্রিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘রক্ষে পেলেম। গেলেই বাঁচি।’
চায়ে চুমুক দিয়ে বাঁ হাতের তালুতে চিবুক ঘষে হেরম্ব বলল, ‘আমাকে
তুই ক’দিন রাখতে চাস ?’
‘দিন? বছর বলুন!’
একথা হেসে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। স্বপ্রিয়া আকস্মিকতা পছন্দ
করে না। ওর হিসাবে দিন নেই, মাস নেই বছর দিয়ে ও জীবনকে ভাগ
করেছে। ওর প্রকৃতির কল্পনাতীত সহিষ্ণুতা হেরম্বের অজানা নয়।
তবু তাকে বলতে হল, ‘বছর নয়, মাস নয়, সপ্তাহও নয়। একদিন। শুধু আজ।’
স্বপ্রিয়া কথাটা বিশ্বাস করতে পারল না।
‘ওবেলাই চলে যাবেন?’
‘না, কাল সকালে।’
অনেকক্ষণ নীরব থেকে সুপ্রিয়া বলল, ‘একদিন থাকার জন্য এমন করে আপনার আসার দরকার কি ছিল? পাঁচ বছর খোঁজ নেননি, আরও পাঁচ বছর নয় না নিতেন।’
চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে কাপড়ে মুখ মুছে হেরম্ব বলল, ‘তাতে লাভ কি
হত রে?’
স্বপ্রিয়া পলকহীন চোখে চেয়ে থেকে বলল, ‘আপনি বাড়িতে এলে
বাইরের ঘরে বসিয়ে এক কাপ চা আর একটু সুজি পাঠিয়ে দিতাম। মনে
মনে বলতাম, আপদ বিদেয় হলেই বাঁচি।’
হেরম্ব একটু হেসে বলল, ‘আচ্ছা, এবার দশ বছর পরে আসব। মনে
তোর ক্ষোভ রাখব না, সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া আস্তে আস্তে বলল, ‘আপনি তা পারেন। ছেলেমানুষ পেয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমায় যখন বিয়ে দিয়েছিলেন, তখনি জেনেছিলাম আপনার
অসাধ্য কর্ম নেই।’
হেরম্ব প্রতিবাদ করে বলল, ‘আমি তোর বিয়ে দিইনি স্বপ্রিয়া, তোর বাবা দিয়েছিলেন। হ্যাঁ রে, বিয়ের সময় তোকে একটা উপহারও বোধহয় আমি দিইনি। দিয়েছিলাম?’
স্বপ্রিয়া শেষ কথাটা কানে তুলল না। বলল, ‘বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন বই কি। আমাকে ভজিয়ে ভজিয়ে রাজী করেছিল কে? কার মুখের বড় বড় ভবিষ্যদ্বাণী শুনে আমি ভেসে গিয়েছিলাম। কি সব প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কথা! কত কথার মানে বুঝিনি। তবু শুনে গা শিউরে উঠেছিল! আচ্ছা, সে সব
কথা অভিধানে আছে?’
জবাব দিতে হেরম্বকে একটু ভাবতে হল। স্বপ্রিয়ার ঝগড়া করার ইচ্ছা নেই এটা সে টের পেয়েছিল। কিন্তু তার অনেক দিনের জমানো নালিশ, কলহ না করলেও নালিশগুলি ও জানিয়ে রাখবে। না জানিয়ে ওর উপায় নেই। মনের নেপথ্যে এত অভিযোগ পুষে রাখলে মানসিক সুস্থতা কারো বজায় থাকে না। এখনকার মতো কথাগুলি স্থগিত রাখলেও সুপ্রিয়ার চলবে না। সে কাল চলে যাবে, ছ’চার বছরের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনায় সুপ্রিয়া বিশ্বাস করে না। যা বলার আছে এখুনি সব বলে দিয়ে
বাকি দিনটুকু নিশ্চিন্ত মনে অতিথির পরিচর্যা করবার সুযোগটাও সে বুঝি সৃষ্টি করে নিতে চায়। তার সংক্ষিপ্ত উপস্থিতির সময়টুকুর মধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়বার কারণটা সে গোড়াতেই বিনষ্ট করে দিতে চায়।
চোখের জলের মধ্যে স্থপ্রিয়ার বক্তব্য শেষ হবে কিনা ভেবে হেরম্ব মনে
মনে একটু ভীত হয়ে পড়েছিল।
‘তোর ভালর জন্য যতটুকু বলার দরকার তার বেশি আমি কিছুই বলিনি,
স্বপ্রিয়া।’
‘না বললে আমার মন্দটা কি হত? স্কুলে পড়ছিলাম, লেখাপড়া শিখে চাকরি করে স্বাধীনভাবে জীবন কাটাতাম। আপনি আমাকে তা করতে দেননি কেন?’
হেরম্ব মাথা নেড়ে বলল, ‘তোর সহ্য হত না, স্বপ্রিয়া।’
স্বপ্রিয়া তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন হত না? পাঁচ বছর এই বুনো দেশে পড়ে থাকা সঙ্গ হচ্ছে, পেট ভরাবার জন্য পরের দাসীবৃত্তি করছি, গরুবাছুরের সেবা করে আর ঘর গুছিয়ে জীবন কাটাচ্ছি, ঝিমিয়ে পড়েছি একেবারে। নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালে আমার সহ্য হত না কেন?’
হেরম্ব বলল, ‘দাসীবৃত্তি করছিস নাকি?’
সুপ্রিয়া তার সহিষ্ণুতা অক্ষুণ্ণ রেখে বলল, ‘ধরতে গেলে, কথাটা তাই দাড়ায় বই কি!’
হেরম্ব আবার মাথা নেড়ে বলল, ‘না, তা দাঁড়ায় না। দাঁড়ালেও পৃথিবীসুদ্ধ সব মেয়ে হাসিমুখে যে কাজ করছে, তার বিরুদ্ধে তোর নালিশ সাজে না। চাকরি করে স্বাধীনভাবে জীবন কাটানো তুই হয়তো খুব মজার ব্যাপার মনে করিস। আসলে কিন্তু তা নয়। আর্থিক পরাধীনতা স্বীকার করবার সাহস যে মেয়ের নেই তাকে কেউ ভালবাসে না। তাছাড়া,-‘ এইখানে ইজিচেয়ারের দুইদিকের পাটাতনে কনুইয়ের ভর রেখে হেরম্ব সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ল, ‘তাছাড়া, স্বাধীনতা তোর সইত না। কতকগুলি বিশ্রী কেলেঙ্কারি করে জীবনটাকে তুই মাটি করে ফেলতিস।’
স্বপ্রিয়া সংক্ষেপে শুধু বললে, ‘ইস্!’
‘ইস্ নয়। ওই তোর প্রকৃতি। পনের বছর বয়সেই তুই একটু পেকে গিয়েছিলি, হুপ্রিয়া। বাইস-তেইশ বছর বয়সে মেয়েরা সারা জীবনের একনিষ্ঠতা অর্জন করে, তোর মধ্যে সেটা পনের বছর বয়সে এসেছিল। তখনই তোর জীবনের ছটো পথ তুই একেবারে স্থির করে ফেলেছিলি। তার একটা হল লেখাপড়া শিখে স্বাধীন হয়ে থাকা, আর একটা-‘ হেরম্বকে একটু থামতে হল, ‘-অন্যটা এক অসম্ভব কল্পনা।’
স্বপ্রিয়া আবার পলকহীন চোখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘অসম্ভব কেন?’
হেরম্ব চেয়ারে কাত হয়ে এলিয়ে পড়ল। ‘যা তুই, রান্নাঘর থেকে একবার ঘুরে আয়গে। ভাগ।’
হেরম্বের আদেশে নয়, আতিথ্যের প্রয়োজনেই স্বপ্রিয়াকে একসময়ে রান্নাঘরে যেতে হল। মনে তার কঠিন আঘাত লেগেছে। সংসারে থাকতে হলে সংসারের কতকগুলি নিয়ম মেনে চলতে হয়, এটা সুপ্রিয়া জানে এবং মানে। বিয়েই যখন তার করতে হল তখন মোটা মাইনের হাকিম অথবা অধ্যাপক অথবা পয়সাওয়ালা ডাক্তারের বদলে একজন ছোট দারোগার সঙ্গে তাকে গেঁথে দেওয়া হল কেন ভেবে তার কখনো আপসোস হয়নি। বিয়ে ব্যাপারে বাধ্য হয়ে মানুষকে যে সব হিসাব ধরতে হয় সেদিক থেকে ধরলে কোন ছেলেমেয়েই সংসারে ঠকে না। এক বড় দারোগা যাচাই করতে এসে তাকে পছন্দ করেনি। তার নাকটা যে বোঁচা সে অপরাধও সেই বড় দারোগার নয়। একটি চোখা নাকের জন্য কষ্ট করে বড় দারোগা হয়ে তাকে বাতিল করে দেওয়াটা সুপ্রিয়া তার অন্যায় মনে করে না। তবু তার কিশোর বয়সের কল্পনাটি অসম্ভব কেন, স্বপ্রিয়া তার কোন সঙ্গত কারণ আবিষ্কার করতে পারেনি।
তার হতাশ বেদনা আজও তাই ফেনিল হয়ে আছে। চেনা মানুষ, জানা মানুষ, একান্ত আপনার মানুষ। যে নিয়মে অচেনা অজানা ছোট দারোগা তার স্বামী হল, ওই মানুষটির বেলা সে নিয়ম খাটবে কেন? ও খাটতে দেবে কেন? একি বিস্ময়কর অকারণ অন্যায় মানুষের! কেন, ভালবাসা বলে সংসারে কিছু নেই নাকি? সংসারের নিয়মে এর হিসাবটা গুজবার ফাঁক নেই নাকি?
স্বপ্রিয়া ভাবে। এত ভাবে যে বছরে তার দু’তিনবার ফিট হয়।
স্বপ্রিয়াকে ডালভাত রাঁধতে হয় না, একজন পাড়ে সিপাহী বেগার দেয়।
চলবে ….

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024