শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:২৪ পূর্বাহ্ন

জীবন আমার বোন (পর্ব-৫৪)

  • Update Time : বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪, ১২.০০ পিএম

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

দেবো না! এক মুহূর্তে ব্যারিকেড হ’য়ে যায় খোকা; আমরা রক্ত দিতে শিখিনি! যে দেশ রক্ত দাও, রক্ত দাও ব’লে দু’শো বছর ধ’রে চিৎ- কার ক’রে চলেছে আমাদের কেউ নয় সে, দেশমাতৃকা তুই নস! যে দেশ কেবলমাত্র জন্মান্ধ রাক্ষসপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে লক্ষ লক্ষ দরিদ্রকে তোড়ের মুখে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ভূরিভোজের উৎসবে নিমন্ত্রণ করে হাঙরকে, তাকে বিশ্বাস নেই, দেশমাতৃকা তুই নস!

প্রবলভাবে আলোড়িত হ’তে থাকে খোকা।

দু’পাশের গাছপালা লক্ষ লক্ষ সবুজ টুপিপরা স্বেচ্ছাসেবক এখন খোকার কাছে। তার মনে হ’লো নির্বিকার স্বেচ্ছাসেবকেরা জড় ভাঙছে এখন। ফিশফিশ ক’রে বলছে, ‘আপনার মানসিক শান্তি ও শৃঙ্খলার দায়িত্ব আপনার নিজের, ষড়যন্ত্র চলছে!’

অসম্ভব দীর্ঘ হাঁ হাঁ খাঁ খাঁ চৈতালী দুপুর লাঠি হাতে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে গাছগুলো, পাখিরা উড়ে যাও, নীড় রচনা করতে পারবে না এখন এখানে, কালবৈশাখী আসন্ন!

তপ্ত বাতাসের হলকা গাছের পাশ কাটিয়ে কি তীব্র ব’য়ে যাচ্ছে! অনেক উঁচুতে উঠেছে আকাশ, ফেলে দিয়েছে সব মই; সকল নিস্তব্ধতার ভিতর রক্তশূন্য ফ্যাকাশে ভয় নিষ্পলক চোখে ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকিয়ে থাকে। কে চায় তার গায়ে আঁচড়টি লাগুক? বাংলাদেশ, তুমি শুয়ে আছো অর্ধেন্দু দস্তিদার হ’য়ে, থেকে থেকে

কাতরাচ্ছো, বোমা বিস্ফোরণে নিদারুণ ক্ষত-বিক্ষত তোমার মুখ; তোমার মুখ পুড়ে গেছে। বাংলাদেশ, তুমি ম’রে গেছ প্রীতিলতার মতো বিষপান করে। বাংলাদেশ, তুমি বুলেটবিদ্ধা আনোয়ারা, কোলের শিশুকে স্তন দিতে চাও? বাংলাদেশ, তুমি রাক্ষসী, একটা শালিকের মতো শিকার করেছো মতিয়ুরকে। বাংলাদেশ তুমি কারফিউ, গভীর রাতে যার বস্ত্র হরণ করতে গিয়ে মারা পড়েছি আমরা। তুমি টর্নেডো, বাংলাদেশ তুমি সাইক্লোন, বারবার সমুদ্রে ভাসিয়ে দাও তুমি আমাদের, হাঙরের পাকস্থলীতে ব’সে সুর ক’রে তেলওয়াত করি আমরা।

তুমি গর্ভিণী পুলোমা, বাংলাদেশ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে রাক্ষস কাম, একটু পরেই সে তোমাকে বলাৎকারের চণ্ড লালসায় হাত মুচড়ে হিড় হিড় ক’রে টেনে নিয়ে যাবে গভীর নিভৃত অরণ্যে। বাংলাদেশ তুমি কিছুই নও, আবার তুমি সব; তুমি বাংলামদের একটা বোতল, মাতাল হবার তুঙ্গ অভিপ্রায়ে খালি ক’রে গড়িয়ে দিয়েছি তোমাকে, এখন পায়ে পায়ে গড়াবে তুমি। বাংলাদেশ তুমি একটা শস্তা মদের দোকান, কে শুঁড়ি কে-বা তার সাক্ষী তার কোনো হিশেব নেই সেখানে।

বাংলাদেশ তুমি একটা ছমছমে ঘুটঘুটে বেশ্যালয়, যার সব কুঠরি এক একটি বেলীর বাগান, যেখানে কখনো কাউকে ভূতে পায়, যেখানে জং ধরা কজার মতো কর্কশ হিজড়েরা খ্যামটা নাচে, যেখানে ষাট বছরের বেতো মাসী নাঙ ধরে, যেখানে তোবড়ানো বদনায় সাতনরীর হার ঝুমকা অনন্ত কানপাশা, যেখানে তাস পাশা জুয়া কড়িখেলা, যেখানে উপদংশ আর সন্ন্যাস রোগ, যেখানে শিকড় তুকতাক ঝাড়ফুঁক ঢোলের মতো মাদুলি, যেখানে ক্ষুধার্ত কাঁকের ঠোঁটে গর্ভপাতের লাল নাড়ি, যেখানে ঝুলকালিধরা ঘুলঘুলির টিমটিমে প্রদীপের শিখা বরাবর উদ্বন্ধনে ঝোলা জোড়াপা শূন্যে দোল খায়।

লাল পেটিকোটের কষি আলগা ক’রে বজবজে ঠান্ডা কুয়োতলায় নীল-সবুজ শ্যাওলায় উদোম বুকে-পিঠে-বগলে ভোসা কিংবা গামছা কিংবা ছোবড়া কিংবা চিবানো শজনে কিংবা দূর্বা কিংবা চড়ুইপাখির বাসা ডলছো তুমি, বাংলাদেশ তুমি একটা লক্ষ বছরের বেতো ডাইনী মাসী, ঘেয়োকুত্তার মতো নাঙ ধরেছো এক হাজার, ঘাটের মড়ার মতো নাঙ ধরেছো এক হাজার, ধোয়াঘাটের মুলোর মতো নাঙ ধরেছো এক হাজার, আর তোমার থলথলে পেটের রবরবা চর্বিতে সুড়সুড়ি না দিয়ে, তোমার সিংহমার্কা তামার পয়সা লালপলা আর কড়িগাঁথা ঘুনসি জড়ানো গরুগাড়ির চাকার ক্ষতে দুষ্ট কোমরের খরখরে তেঁতুলেবিছায় তেল মালিশ না ক’রে, খালপাড়ে যাবার অছিলায় বদনা হাতে সেই সব নাঙ ফতুর ক’রে দিয়েছে তোমাকে তিন হাজারবার!

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024