মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
মাইগ্রেশন টু নো-হোয়্যার, তুমি একটা ছবি বাংলাদেশ; কতোগুলো খঞ্জ-যাদের দেহ যুদ্ধের একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, ক্রাচে ভর দিয়ে উড়ে চলেছে হাওয়ায়, সম্মুখে দিগন্ত, যা অসম্ভব ধূসর মূক ও বধির, তীব্রভাবে ছুটছে। হাওয়ার উজানে ছিন্নভিন্ন মলিন পোশাকের পাল তুলে দৃপ্ত খেলোয়াড়ের মতো বারবার নেচে রুণ দিগন্তের অন্ধকার পরিব্যাপ্ত বিশাল অনিশ্চয়তার কুহকে ছুটে চলেছে। এখন আর তুমি মোদিল্লিয়ানির সেই দীর্ঘায়িত সুঠাম রতিমঞ্জরি নও, আত্মতৃপ্ত নির্ভার নিদ্রার আলস্যে যা মদিরার কুঞ্জ হ’য়ে আছে (নিদ্রা তার নগ্নতাকে ঢেকে রেখেছে, ল্যাটিনে ব’সে একদিন মনে হয়েছিলো কথাটা) পুরু বিছানায়, যেখানে একটি টিকটিকিও এখন ঠিক ঠিক ঠিক ক’রে উঠবে না পাছে শিরশিরিয়ে ওঠে আলস্যময় নিদ্রা; এমন কি নির্দয় নিয়তি যে-শুধুমাত্র একটি দোমড়ানো সেপ্টিপিন কুড়িয়ে পরম সার্থকতায় ফিরে যাবে সেও।
মোদিল্লিয়ানির এই ছবিটি তার প্রিয়। ক্ষীণ কটিতট থেকে প্রসারিত একটি উজ্জ্বল নির্লিপ্ত রাস্তা, এই রাস্তাই নিয়ে যাবে উরঃস্থলের মধ্যভাগে, যেখানে ধর্মাধর্মের উপাসনালয়, পরম পবিত্র সুষুপ্তি। কি নিটোল, কি তুঙ্গ, অচঞ্চল; এমন কোমল যা সামান্য একটি দুর্বাকুচির আচ্ছাদনও সইতে অক্ষম। স্তন তো নয়, অম্লান দু’টি’স্তূপ, কলরবহীন এক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন; কবিতার যা আত্মা, পরিশ্রান্ত কিন্তু স্বপ্নময়, হৃদয়ে যা ভার হ’য়ে থাকে সর্বক্ষণ, কিন্তু সুরম্য সুগোল, যেন পবিত্র সমাধি মন্দির, খালি পায়ে যেতে হবে ওখানে, যেন পাশাপাশি অঞ্জু আর মঞ্জুর কবর।
ধূলিময় মাতাল হাওয়া গরগর ক’রে নাক ঘ’ষে গেল খোকার শরীরে। মনে হয় একটা প্রাচীন রথ নারীদের বর্ষব্যাপী উৎসবান্তে সিথেরা থেকে হাওয়ায় ভেসে চলেছে। ছাগচর্ম আচ্ছাদিত এক একটি স্মৃতি নৃত্যগীত গীতনৃত্যে উল্লোল রমণীর মতো ক্রমাগত কানের দু’পাশে তাম্বুরা বাজাতে থাকে। শুকনো পাতার গন্ধে বাতাস ভরপুর, যেন ঝাঁঝালো মদের গন্ধ, কখনো কটু, কখনো তীব্র, কখনো চুল ধ’রে, নাড়া দিয়ে যায়।
চলন্ত রিকশা থেকে কখন যে স্বপ্নসলিলে ঝুপ ক’রে প’ড়ে গিয়েছে খোকা তা টের পেল না:
অনেক অনেকদিন আগের কথা, এক দেশে এক সেগুনবাগিচা ছিলো, সেখানে এক নীলাভাবী ছিলো। একদিন এক নির্জন দুপুরে আমি কাঁচুমাচু খোকাব্যাঙ সেই নীলাভাবীর বাড়িতে রুরুরুরু গিয়েছিলাম। একা, সেই নীলাভাবী, যার শরীর পুষ্পকরথের মতো, যার ঠোঁটে বিদূমের আভা, একা ছিলো। যখন নীলাভাবীকে রুরুরুরু একা পেলাম, আশ্চর্য খুব আশ্চর্যভাবে এক অতিবেল তন্দ্রার রুরু কোমলতার ভিতর আমার মনে হ’লো, এখন এই মুহূর্তে এখানে যা যা নেই, অনুপস্থিত, আমাকে চোখে চোখে রাখে, পাহারা দেয়, দিবালোক যেমন পাহারা দেয় অরণ্যকে। উহুরু! আমি চিৎকার ক’রে উঠলাম। ইন্দ্রিয়ের অন্তঃপুরের সঞ্চারমান মূর্ছা একগুচ্ছ গোলাপ হ’য়ে রুরু রুরু শোভা পাচ্ছিলো বাবেলের বুরুজের মতো ফুলদানিতে; তির তির তির তির ক’রে তখন তা কেঁপে উঠলো তিনকোনা চিৎকারে। উন্মাদনার অন্ধকারে দিব্য বিভা হ’য়ে রুরুরুরু ঝল্ল্সে উঠলো সেই ঘর। পাখির হালকা পালক ছড়ানো ঘরময়, এবং একটি বিড়াল, নরোম যার শরীর, কামদ উষ্ণতায় ভরপুর।
Leave a Reply