‘শুক্ত’ হলো বিভিন্ন প্রকারের সব্জি মিশানো একটি সুস্বাদু খাদ্য। এটা সাধারনত খাবার পরিবেশনের শুরুতেই দেয়া হয়।
গ্রীষ্মের শুরুতেই বিভিন্ন সব্জি ,মসলাযুক্ত মাংস, মাছ এবং ডালের সাথে শুক্তেরও কদর বেড়ে যায়।
বাঙ্গালী রান্নার মধ্যে মিষ্টান্নটা অন্যতম। সাধারন বাঙ্গালী খাবারের মধ্যে ভাত, ডাল , মাছ, মুরগী অথবা খাসীর মাংসের ডিস উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এর মধ্যে একটা গড়মিল ও আছে।মূল খাবার শুরুর আগে বাঙ্গালীরা একটা তেঁতো খাবারের স্বাদ নেয়। এমনই একটি খাবার হলো শুক্ত যা বিভিন্ন রকম সব্জি মিশিয়ে রান্না করা হয়।শুক্তটা খাওয়া হয় সাধারনত খাবারের রুচি বাড়ানোর জন্যে।
এটি রান্না করতে সাধারনত: সজনে ডাটা ও করল্লার প্রয়োজন হয়। এর সাথে আবার দুধ এবং ঘি ও মেশানো হয় এর স্বাদ বাড়ানোর জন্যে।
পশ্চিম বাংলায় শুক্ত রান্নার রেসিপি আবার সব এলাকায় এক নয়। নিজস্ব এলাকার স্বাদের উপরে একে প্রকার রান্না ভিন্নতা আছে। কিন্তু একটা জিনিষ খুবই কমন সেটা হলো এর রান্নায় মেথির দানা, কালন্জি, জিরা, কালি সারসন, এবং পাঁচফোড়ন লাগবেই। আবার কালি সারসনের বদলে এখন রাঁধুনি ব্যবহার করেন অনেকেই।
রিতুপর্না পাটগিরি, সহকারী অধ্যাপক, আইআইটি, গৌহাটি এবং শেফ অনন্যা ব্যানার্জি এর সাথে আলাপ করে জানা যায়, “আমরা শুক্তের অরিজিন, ইতিহাস এবং স্বাদ সম্পর্কে গবেষণা করেছি। আমরা খুজে পেয়েছি কিভাবে এই সুস্বাদু খাবারটি আমাদের মূল খাবার শুরুরর আগে এতটা গুরুত্তপূ ণ হয়ে ওঠে।”
এর শুরু এবং পুষ্টিগুণ
শুক্ত’র ধারণা আসলে পর্তুগিজ খাবার মেনু থেকে আসে কারন ষোঢ়শ শতাব্দিতেই বাংলা পর্তুগীজদের কলোনি ছিল। কিন্তু রিতুপর্ণা বলেন, যাইই হোক ,বাংলার অনেক খাদ্য গবেষক, ব্লগারস, এবং লেখক এই যুক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, শুক্ত আসলে আয়ুর্বেদিক একটি আইটেম।কারন এর তেতো স্বাদই এর প্রমাণ দেয়। এধরনের তেতো স্বাদ একমাত্র আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রেই প্রেসক্রাইব করে।
উৎসবে এর ভোজন
আয়ুর্বেদিক ঔষধে করল্লা হলো এর ভারসাম্য রক্ষার অনন্য উপাদান। এটি রক্ত প্রবাহ বাড়ায়, হজম বৃদ্ধি এবং লিভারের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অনন্য ভূমিকাও পালন করে।এটিতে আঠে ভিটামিন A, B1, B2, এবং C। এতে আরো আছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ, কপার এবং পটাসিয়াম।
তাই, এর প্রচলন শুরুর দিকটার সাথে পর্তুগীজদের কোনো অবদান নেই বলে ব্লগার , গবেষক এবং লেখকরা এর সাথে তীব্র বিরোধিতা করেছেন। ।অনেক বাঙ্গালী মঙ্গল কাব্যে শুক্তের রেফারেন্স টানা হয়েছে বল শুনেছেন। এমনকি, ১৩শ থেকে ১৮শ শতকের বাংলা ধর্ম শিক্ষার কাব্যগ্রন্থে এমনটি উল্লেখ আছে যে, প্রভূ শিব দেবী অন্নপূর্ণাকে শুক্ত রেঁধে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন।
আমরা শেফ অনন্যার কাছে শুক্তের প্রকৃত স্বাদের ভারসাম্যটা কিভাবে হয় তা জানতে চেয়েছিলাম। তিনি এভাবে ব্যাখ্যা করলেন-
হরেক উপাদান :
করল্লা, বেগুন, কাঁচা কলা, মুল এবং মিষ্টি আলু একসাথে করতে হবে। দুধ, সরিষা আর সব তরকারীর মিশ্রনকে এমনভাবে মেশাতে হবে যাতে করল্লার তেতো স্বাদের ভারসাম্য ঠিক থাকে।
মসল্লার ভারসাম্য: রান্নাটি যেন অতিরিক্ত কোন কিছুর টের না পাওয়া যায় সে জন্যে সরিষার দানা, পাঁচফোড়ন , আদা বাটা অবশ্যই পরিমাণ মতো মেশাতে হবে।
রান্নার প্রণালী: অতিরিক্ত সময় ধরে রান্না বা কম সময়ে রান্না উভয়েই এর স্বাদ ও সুবাস নষ্ট করে দিতে পারে।প্রতিটা সব্জি এর সেদ্ধ হওয়ার সঠিক সময় যাতে পায় সেই অনুপাতে করতে হবে। তাহলে এর স্বাদ ঠিক থাকবে।
ধারাবহিকতা ধরে রাখা: শুক্ত রান্নায় স্যুপ থাকাটা একটা মূল বিষয়। এটা যাতে না বেশী জলযুক্ত না খুব শুকনা থাকে । এ দুটি ঠিক না থাকলে এর স্বাদ ও সুবাস দুটোই নষ্ট হয়ে যায়।
বিচিত্র স্বাদ এবং ধারাবাহিকতা:
শেফ ব্যানার্জি বলেন, “শুক্ত রান্নায় ফ্লেভারের ভারসাম্যটা ধরে রাখতে চাইলে শুসাবধানে রান্নার মাধ্যমে হয়ে থাকে। কারন, তেতো করল্লা সমস্ত রান্নাটাকে নিয়ন্ত্রণ করে।”
বাংলা থেকে বাহিরে
প্রফেসর রিতুপর্ণা বলেন, “বাংলার বাইরেও বিভিন্ন এলাকার মানুষ বিভিন্ন উপাদানে শুক্ত রান্না করেন। কেউ পূর্ভ ভারতেীয়রা যেখানে করল্লার প্রাচুর্য্য আছে সাথে পাঁচ ফোড়ন এবং রাঁধুনি তারা একরকম রান্না করেন। আবার কোথাও পপি বীজও মিশিয়ে অনেকে রান্না করেন।”
যে কোনো অনুষ্ঠানে যেমন বিয়ে বাড়ি, শিশুর অন্যপ্রাসন, সপ্তমী অথবা অষ্টমী পুজোর খাবার শুক্তটা খাবারের প্লেটে সবার প্রধান আকর্ষনের বিষয় বস্তুই হয়ে ওঠে।
আস্তে আস্তে অথবা কম তাপে রান্না করা শুক্ত বেশী ঘ্রাণ ছড়ায়। তবে, মোদ্দা কথা একদম ফ্রেশ উচ্চমানের সরিষা বাটা এর প্রকৃত স্বাদ এনে দিতে পারে।
Leave a Reply