শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৪ পূর্বাহ্ন

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-১৩০)

  • Update Time : শনিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৪, ১১.০০ পিএম

শ্রী নিখিলনাথ রায়

সুতরাং ফিলখানার বর্তমান অবস্থান দেখিয়া সেই শিবিরসন্নিবেশের স্থাননির্ণয় করিতে হইলে, এইরূপ অনুমান হয় যে, এক্ষণে যে স্থানে দাদপুরের নীলকুঠী আছে, তাহারই সম্মুখে প্রসিদ্ধ বাদসাহী সড়কের পূর্ব্ব পার্শ্বে উক্ত শিবির সন্নিবেশিত হইয়াছিল। দাদপুরেরও এক্ষণে অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে। ভাগীরথী পূর্ব্বে দাদপুর হইতে প্রায় অর্দ্ধক্রোশ পশ্চিমে প্রবাহিতা ছিলেন, এক্ষণে পূর্ব্বদিকে সরিয়া আসিয়া তাহার কিয়দংশ গর্ভস্থ করিয়াছেন। দাদপুরে কতকগুলি কবর ছিল; বেভারিজ সে গুলি পলাশীতে হত ইংরেজদিগের কবর বলিয়া অনুমান করেন; কিন্তু দাদপুরের প্রাচীন লোকদিগের নিকট তৎ- সমুদায় নবাবের কর্মচারিগণের কবর বলিয়া শুনা যায়। নবাববাটী ও নবাব-বাঁওড় ভাগীরথীর গর্ভস্থ হইয়া এক্ষণে পশ্চিমতীরে চররূপে পরিণত হইয়াছে। দাদপুর হইতে এক ক্রোশ দক্ষিণে ফরীদতলা নামক স্থান, ফরীদতলা ফরীদপুর নামক গ্রামের পূর্ব্বে।

এই ফরীদতলায় ফরীদ সাহেব নানে জনৈক ফকীরের সমাধিভবন আছে।, সমাধিভবনের প্রবেশ দ্বার পূর্ব্বমুখে অবস্থিত; একটি বৃহৎ গম্বুজের নীচে ফরীদ সাহেবের সমাধি। ফরীদ সাহেবের সমাধির পশ্চাদ্ভাগে সমাধিভবনের মধ্যেই সিরাজের প্রিয় ও বিশ্বাসী সেনাপতি মীরমদন শান্বিত রহিয়াছেন। এইরূপ শুনা যায় যে, ফরীদতলা মুসল্যানদিগের একটি প্রসিদ্ধ উপাসনাস্থান বলিয়া, মীরমদন তথায় সমাহিত হইতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন। ফরীদ সাহেবের সমাধির মধ্যে মধ্যে সংস্কার হইয়া থাকে; কিন্তু মীরমদনের সমাধির প্রতি কাহারও তাদৃশ মনোযোগ দেখা যায় না। তাঁহার সমাধি প্রায়ই অসংস্কৃত অবস্থায় বিরাজ করিয়া থাকে। মুর্শিদাবাদে বেরূপ সিরাজের সমস্ত স্মৃতিচিহ্নের দুর্দশা ঘটিয়াছে, তাঁহার প্রিয় ও বিশ্বাসী সেনাপতি মীরমদনের সমাধির অবস্থাও সেইরূপ। মুসলমানগণ ফরীদ সাহেবের সমাধিসংস্কারের সহিত মীরমদনের সমাধিটির সংস্কার অনায়াসেই করিতে পারেন।

মীরমদনের প্রতি কি জন্য তাঁহারা উপেক্ষা প্রদর্শন করেন, বুঝিতে পারা যায় না। যিনি চিরদিন প্রভুভক্ত থাকিয়া, প্রভুর কল্যাণোদ্দেশেই রণক্ষেত্রে জীবন বিসর্জন দিয়াছিলেন, তিনিও যে সাধারণের নিকট সর্ব্বতোভাবে পূজ্য, এ কথা, বোধ হয়, নূতন করিয়া বলিবার প্রয়োজন নাই।  সম্প্রতি পূর্ববিভাগ-কর্তৃক তাহার সংস্কার হইতেছে শুনা গিয়াছে। মীরমদনের বীরত্বকাহিনী ও পলাশীযুদ্ধের কথা পলাশী-অঞ্চলে অদ্যাপি গ্রাম্য কবিতায় গীত হইয়া থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর পলাশীপ্রান্তরের অনেক পরিবর্তন ঘাটলেও অভাপি তাহা স্বকীয় বিশাল কার বিস্তার প্রান্তরে প্রায় উত্তমরূপে তৃণাদিও জন্মে না; লইয়া তৃণরাশি ও শন্তপুঞ্জের হরিৎ শোভা থাকে। স্থানে স্থানে দুই চারিটি বৃক্ষও উত্তপ্ত বক্ষঃস্থলে ছায়াপ্রদান করিতেছে। করিয়া ধূ ধূ করিতেছে।

কোন কোন স্থানে কতকদূর নয়নের তৃপ্তিসম্পাদন করিয়া জন্মগ্রহণ করিয়া, পলাশীর মধ্যে মধ্যে দুই একখানি ক্ষুদ্র গ্রাম স্থাপিত হইয়া ইহার পূর্ব্ববিস্তৃতির লঘুতা সম্পাদন করিয়াছে। ভাগীরথীতীরস্থ বাঁধটি প্রান্তরের প্রাচীরস্বরূপে অবস্থিত আছে। বাঁধের নীচে কতকটা চরভূমি এবং কতক প্রাচীন প্রান্তর ও নদীর অবশেষ দৃষ্ট হয়। চরের নীচেই ভাগীরথী ধীরে ধীরে প্রবাহিতা হইতেছেন। বর্ষাকালে উক্ত চরভূমি ভাগীরথীসলিলে প্লাবিত হইয়া যায়। পলাশী- প্রান্তরের মধ্যস্থলে এখনও পলাশীযুদ্ধের অনেক গোলা গুলি প্রোথিত হইয়া আছে। ভূমিকর্ষণসময়ে পলাশীপ্রান্তরের বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ হইলে, তৎসমুদায় মানবচক্ষুর গোচরীভূত হইয়া থাকে। যে সমস্ত ইংরেজ ও ইংরেজললনাগণ পলাশীর নিকট দিয়া জলপথে বা স্থলপথে গতায়াত করিয়া থাকেন, তাঁহারা বিজয়স্তম্ভের নিকট উপস্থিত হইয়া জয়ধ্বনিতে প্রান্তর প্রতিধ্বনিত করিয়া তুলেন। বৃক্ষশাখায় উপবিষ্ট পক্ষিগণ সে ধ্বনিশ্রবণে চমকিত হইয়া কলরব করিতে করিতে দিগদিগন্তে উড়িয়া যায়। বর্তমান সময়েও পলাশী প্রান্তর ইংলণ্ডীয় নরনারীগণের নিকট তীর্থস্থানরূপে বিরাজ করিতেছে।

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024