শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৩ পূর্বাহ্ন

পিপাসা

  • Update Time : শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৪, ৭.০৩ পিএম
আবু ইসহাক

সোয়েটার বুনতে বুনতে জোহরা বেগম বলেন, তারপর?

তারপর বিকেল বেলা ম্যানেজার সায়েব বাসায় ফিরে আসেন।

দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে জোহরা বেগম বলেন, সাড়ে ছ’টা। হাসান, তোর গল্পটা পরে শুনব। ঢাকা রেডিওতে এ সময়ে বাঙলা গান হওয়ার কথা, দেখি যদি পেয়ে যাই।

রেডিওর সুইচ টিপে মিটারের কাঁটা ২৫-৪ মিটারে ঘোরান জোহরা বেগম। কোন শক্তিশালী বেতার কেন্দ্র থেকে ইংরেজি বাজনা ভেসে আসছে। কাঁটাটা আরো একটু ডান দিকে ঘোরান। আরবী না কোন্ এক ভাষায় গান শোনা যাচ্ছে। এবার নরম হাতে এক স্কুল এক চুল করে বাঁ দিকে ঘোরান কাঁটা। হ্যাঁ, এই তো ভেসে আসছে। সুর শুনে শুধু বোঝা যায় বাঙলা গান, কথা বোঝা যায় না ভালো করে। কেন্দ্রটি একে তো দুর্বল, তা ছাড়া বারোশ’ মাইলের ব্যবধান।

দু’দিকের দুটো শক্তিশালী বেতার কেন্দ্র বড় গোলমাল করছে। গানের কথা স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবু সুরের প্রবাহ মনে-প্রাণে আবেগ জাগায়। সুরের কোমল স্পর্শে হৃদয়ের তন্ত্রীগুলো সুরেলা হয়ে উঠে। জোহরা বেগম তন্ময় হয়ে শুনছেন। অদূরে একটা চেয়ারের ওপর বসে শুনছে হাসানও।

ফিস্ফিস্ আওয়াজ আসছে ডান পাশের কোন আরবদেশীয় বেতার কেন্দ্র থেকে। বাঁ পাশের কেন্দ্র থেকে ইংরেজি বাজনা ফোড়ন কাটছে মাঝে মাঝে। কখনো বিদ্‌ঘুটে শব্দ করছে, যেন ধমকাচ্ছে, থামাতে চাইছে গান। জোহরা বেগম বিরক্ত হন। মনে মনে বলেন,-রেডিও জুড়ে এত জায়গা থাকতে এরকম গা ঘেঁষাঘেঁষির কি দরকার? যা না তোরা, ঐ তো খালি পড়ে রয়েছে আরো কত কত মিটার।

ইংরেজি বাজনা এবার আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। বাঙলা গানের গলা টিপে ধরেছে যেন। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠ থেকে কাটা-কাটা আওয়াজ বেরুচ্ছে। জোহরা বেগম চুল পরিমাণ ডান দিকে ঘোরান নির্দেশক কাঁটা। কিন্তু ঐ দিকে তখন আরবী খবর শুরু হয়ে গেছে। বাঙলা গান আর শোনা যায় না এখন।

বাঁ দিকে ইংরেজি। ডান দিকে আরবী। দু’দিকের দুটি শক্তিশালী বেতার কেন্দ্রের চাপে দম বন্ধ হয়ে মরে গেছে ঢাকা কেন্দ্রের বাঙলা গান। জোহরা বেগম বিরক্তির সাথে রেডিও সুইচ বন্ধ করেন। হাসানের দিকে চেয়ে বলেন, না, আর হল না। এ রকম টুটি চেপে ধরলে কি আর বাঁচা যায়। নে, এবার তোর গল্পটা আবার শুরু কর, হাসান।

হাসার অসমাপ্ত গল্পটা আবার শুরু করে-

-ম্যানেজার সায়েব বিকেল বেলা অফিস থেকে ফিরে আসেন। একটা পরিচিত ক্ষুধা-উদ্রেককারী গন্ধ নাকে এসে লাগে তাঁর। তিনি রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যান। বলেন, কি গো মুরগী রান্না হচ্ছে, তা-ই না? দেখলে, কি রকম নাক আমার?

-হ্যাঁ, এই তো রান্না শেষ করলাম। তোমার অতিথি কখন আসবে। -আমার অতিথি। আকাশ থেকে পড়েন ম্যানেজার। কিসের অতিথি?

-কেন! কে নাকি আজ খাবে? মুরগী কিনে পাঠিয়ে দিয়েছে, আর-

-মুরগি কিনে পাঠিয়েছি আমি? না তো!

-হ্যাঁ, একটা লোক আজ দশ-এগারোটা সময় মুরগিটা দিয়ে যায় আর বলে যায়-তোমার অফিসের কোন বন্ধু নাকি আজ রাত্রে খাবে আমাদের বাসায়।

-নাঃ! আমি পাঠাইনি তো। ভুল করে কার বাসারটা আমাদের বাসায় দিয়ে গেছে।

-আরে, লোকটা যে রেডিওটা নিয়ে গেছে! বলে,-

-রেডিওটা নিয়ে গেছে!

-হ্যাঁ, বলে-

-এই রে সর্বনাশ করেছে। হায়-হায়-হায়! কি বলে নিল?

-বললে, রেডিওটা নাকি সরান দরকার। তাই সাহেব ওটা নিয়ে যেতে বলেছেন।

স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন।

কিছুক্ষণ পরে ম্যানেজার সায়েব এজাহার দিতে থানায় চলে যান। তাঁর যাওয়ার বিশ-পঁচিশ মিনিট পরে দুটো লোক বাসায় এসে বলে, দারোগা সায়েব আমাদের পাঠিয়েছেন। চোর যে মুরগি দিয়ে গেছে সেটা থানায় নিয়ে যেতে হবে।

গিন্নী বলেন,-মুরগি তো রান্না হয়ে গেছে!

-হ্যাঁ, রান্না করা মুরগি পাতিলসহ নিয়ে যেতে বলেছেন আপনাদের সায়েব। তিনি দারোগা সায়েবের ওখানে বসে আছেন। এগুলো নাকি মামলার আলামত হবে।

লোক দুটো পাতিলসহ মুরগির মাংস নিয়ে চলে যায়।

রাতে খেতে বসে ম্যানেজার বলেন, রেডিওটা গেল। রেডিও আর হবে না কোনদিন। এবার দাও, বাটপাড়ের মুরগির রানে কামড় দিয়ে কিছুটা উসুল করি।

গিন্নী হাঁ করে তাকান স্বামীর দিকে।

-কি, এভাবে তাকাচ্ছ কেন?

-মুরগির গোস্ত থানায় নিয়ে গেল যে দু’জন লোক!

-থানায় নিয়ে গেল!

-হ্যাঁ। বললে, থানার দারোগা পাঠিয়েছেন। মামালার আলামত না কিসের জন্যে লাগবে। তুমিই নাকি পাতিলসহ নিয়ে যেতে বলেছ? -আমি বলেছি!

একেবারে থ বলে যান স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই।

-অদ্ভুত গল্প তো! বলেন জোহরা বেগম।-বাটপাড়ের এ গল্প কোথেকে যোগাড় করলি?

-আজ আমাদের ব্যারাকের একজন বলেছিল গল্পটা। সত্যি কি বানানো, বলতে পারি না।

সত্যিই হবে। তোর গল্প শুনে হুশিয়ার হওয়া গেল, যা হোক। আমার রেডিওটা ধরে টান দিলেই হয়েছিল আর কি। এই বনবাসে এটাই যে আমার সাথী।

রেডিওটা জোহরা বেগমের একমাত্র সাথী, সেটা জানে হাসানও। তাঁকে সাবধান করার উদ্দেশ্য নিয়েই সে গল্পটা বলেছে। গল্পটা তাদেরই স্কোয়াডের একজন বলেছিল আজ। শুনেই সে ছুটে এসেছে দেড় মাইল পথ।

-পৌনে সাতটা বেজে গেছে। খবরটা ধর তো, বাবা।

হাসান উঠে গিয়ে রেডিওটা সুইচ টিপে মিটার ঠিক করে।

বাঙলায় খবর হচ্ছে।

শুধু খবরের জন্যেই খবর শোনেন না জোহরা বেগম। খবর শুনতে বসে তাঁর মনে হয় কে যেন মাতৃভাষায় কথা বলছে। সিন্ধু প্রদেশের ধূলিমলিন শহর হায়দারাবাদ। এ শহরে তিন বছর কেটে গেছে জোহরা বেগমের। শহরবাস করলেও বনবাসের মতই কাটছে তাঁর জীবন। বনবাস কথাটা তিনিই ব্যবহার করেন। তাঁর স্বামী মিষ্টার মেহবুব উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী। স্বামীর সাথে তাঁর দেখা হয় খুবই কম। ভোর ন’টায় যখন তাঁর ঘুম ভাঙে, তখন মেজাজ প্রায়ই দুরস্ত থাকে না। ছোট হাজরি খেয়ে অফিসে যান। দুপুরের খাওয়া অফিসে বসেই সারেন। তারপর অফিস থেকে সোজা ক্লাবে চলে যান। ক্লাব থেকে ফেরেন রাত দুপুরের পর। আর তাঁর সাথে দেখা হয়েও কোন লাভ নেই। মিস্টার মেহবুব ইংরেজিতে কথা বলতেই পছন্দ করেন। বাঙলা প্রায় বলেনই না। তাঁর বিশ্বাস, বাঙলায় কথা বলার বদভ্যাস না ছাড়লে ইংরেজিতে বাকপটুতা অর্জন সম্ভব নয়। এ বদঅভ্যাস যাদের আছে, তারা ইংরেজি বলে হোঁচট খেয়ে খেয়ে। পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি হয়ে আসায় সুবিধে হয়েছে তাঁর। এখানে বাংলা বলবার দরকারই হয় না। বাইরে তো নয়ই, ঘরেও না। স্বামী-স্ত্রীর কথাবার্তার এক অংশ হয় ইংরেজিতে, আর এক অংশ বাঙলায়। ইংরেজি বলবার মত শিক্ষা অবশ্য জোহরা বেগমের আছে। কিন্তু ইচ্ছে করেই তিনি ইংরেজি বলেন না। বাঙলা ভাষার ওপর স্বামীর অবজ্ঞা তাঁকে ভালবাসতে শিখিয়েছে মাতৃভাষাকে।

জোহরা বেগমের একমাত্র সন্তান আনোয়ার। মেহবুব সাহেব ইংরেজি কায়দায় বলেন ‘এনভার’। সে লন্ডনের এক ইস্কুলে পড়ে। মায়ের মাতৃভাষা-প্রীতি ছেলের মধ্যেও সংক্রামিত হতে পারে, এ ভয় তাঁর সব সময় ছিল। তাই কথা শেখার আগেই মায়ের স্নেহ-ক্রোড় থেকে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ছ’বছর বয়স পর্যন্ত ছিল গভর্নেসের কাছে। তারপর চার বছর কেটেছে মারীর এক ইস্কুলে। নানা ভাষার আবর্তের মধ্যে পড়ে ছেলে বাংলা ভাষার এক বর্ণশঙ্কর সৃষ্টি করেছে। তারপর ছেলে দশে পা দিতেই নিজে গিয়ে রেখে এসেছেন লন্ডনের এক ইস্কুলে। সে আজ ছ’বছরের কথা।

জোহরা বেগমের একঘেঁয়ে নিঃসঙ্গ জীবন কাটে রেডিও শুনে আর বাঙলা বই পড়ে। ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে বাঙলা বই আনিয়ে নেন। বার বার পড়তে পড়তে সেগুলো প্রায় মুখস্ত হয়ে যায়। যখন বই থাকে না, তখন রেডিওটাই হয় একমাত্র সাথী। এ সাথী একাই শুধু কথা বলে। এর সাথে কথা বলে মনের ভার হালকা করা যায় না।

আজ ছ’মাস হল হাসানকে পেয়েছেন। আরো সঠিকভাবে বলা যায়, আবিষ্কার করেছেন। একদিন দুপুর বেলা জানালার পাশে বসে জোহরা বেগম কলকাতা রেডিওর বাঙলা গান শুনছিলেন। বাইরের দিকে তাকাতেই দেখতে পান একটি ছেলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনছে। তার দিন কয়েক পরে আবার দেখলেন ছেলেটাকে। তারপরও একদিন। তিনি কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। চাকরকে দিয়ে ডাকিয়ে আনলেন ছেলেটাকে। সে ভড়কেই গিয়েছিল। বাঙালী ছেলে। সামরিক বাহিনীর একজন সাধারণ সেপাই। জোহরা বেগম বুঝতে পারলেন এই প্রবাসে ছেলেটি তাঁরই মত নিঃসঙ্গ, বাঙলায় কথা বলার জন্যে তারই মত পিপাসায় কাতর।

মাতৃ-হৃদয়ের সঞ্চিত স্নেহ এতদিন পরে প্রকাশের পথ পায়। আদর-যত্নে প্রথম দিনই ছেলেটিকে তিনি আপন করে নেন। দু’জনের প্রাণের নিরুদ্ধআবেগ এবার মাতৃভাষায় রূপ পায়। হাসান তাকে ‘মা’ বলে ডাকে আজকাল। ‘মা’-এই মধুর ডাকটির জন্য কতকাল

উপোসী ছিল তাঁর মন। এখন মনে হয়-তাঁর নারী জন্ম একেবারে ব্যর্থ হয় নি। হাসান মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে আসে। কখনো পুরোটা দিন, কখনো বিকেলটা কাটিয়ে ‘নাইট রোল-কলের’ আগেই ব্যারাকে ফিরে যায়।

রেডিও পাকিস্তান, করাচী। বাঙলায় খবর প্রচারিত হচ্ছে। একটু পরেই বাঙলা গান। যে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি বাঙলাভাষী, সে দেশের রাজধানীর বেতার কেন্দ্র থেকে রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টায় তিন মিনিটের একটি মাত্র বাঙলা গান দেয়া হয়। এ গানটির জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকে করাচী আর পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবাসী অগণিত বাঙালি। এমন স্পষ্ট আওয়াজে বাঙলা গান শোনার সৌভাগ্য আর তাদের হয় না।

জোহরা বেগম সোফায় নড়েচড়ে বসেন।

সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিট। ইংরেজিতে ঘোষণা শোনা যায়, ‘জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ডিরেক্টর তাঁর সাম্প্রতিক পাকিস্তান সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবেন।’

-এই হয়েছে! বাঙলা গান আজ আর হল না। জোহরা বেগমের কথায় হতাশা ফুটে ওঠে।

-কেন, মা? হাসান বলে।

-বক্তৃতা হবে এখন। তুই কলকাতা ধর দেখি।

হাসান মিটারের কাঁটা কলকাতা কেন্দ্রের ওপর চড়ায়। সেখানে তখন হিন্দি গান চলছে।

-নে, বন্ধ কর রেডিও। রেগে বলেন জোহরা বেগম।-চল এবার খেতে যাই। তোর তো আবার ফিরে যাওয়ার সময় হল।

জোহরা বেগম শুতে যাবেন এমন সময় মেহবুব সায়েব আসেন।

আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে?

হ্যাঁ, আজই ‘কেবল’ পেলাম। ইংরেজিতে জবাব দেন মেহবুব সায়েব। এনভার আসছে। ওদের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। করাচী এয়ারপোর্টে নামবে পরও সন্ধ্যায়। এঐ দিন ভোরবেলা করাচী যাব।

-আমিও যাব।

-তুমি আর কি করতে যাবে এতদূরে? এলেই তো দেখতে পাবে। আর তা

ছাড়া- -তা ছাড়া কি?

-তা ছাড়া ঐ ধরো আজকালকার ‘এটিকেট’। কিছুই তো শিখলে না। শিখতে চেষ্টাও করলে না। -ও শিখে কাজ নেই।

হ্যাঁ, কাজ তো নেই-ই। ছেলে এসে যখন বলবে, ম্যামি, হাউ ডু ইউ ডু?- কি বলে উত্তর দেবে তখন?

-কেন? বলব, ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?

-তবেই হয়েছে আর কি! শোনো, তোমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়ে অসুবিধেয় ফেলতে চাইনে। আর-আর আমিও হাস্যাস্পদ হতে চাইনে। সেখানে আমার দু’ একজন বন্ধুও থাকবেন। তাদের কাছে-

-থাক, থাক, তুমি একাই যাও। তোমাকে হাস্যাস্পদ করার ইচ্ছে আমার নেই।

জোহরা বেগম তাঁর শোবার ঘরে আরাম কেদারায় বসে একটা বাঙলা বই-এর পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। বই-এর পাতায় কিছুতেই মনঃসংযোগ করতে পারছিলেন না তিনি। আনোয়ার এসেছে আজ দু’দিন। নিজের রক্তমাংস দিয়ে গড়া প্রাণপুত্তলী এখন বড় হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার কথা-বার্তা চাল-চলনের কৃত্রিমতা মনকে পীড়া দেয়। কোথায় যেন কিসের অভাব-তিনি ঠিক বুঝতে পারেন না। তাঁর সন্দেহ জাগে, একেই কি তিনি পেটে ধরেছিলেন?

-ম্যামি, মে আয় কাম ইন্?

-আয়। ঐ চেয়ারটা টেনে নিয়ে বোস।

আনোয়ার একটা চেয়ার টেনে নিয়ে মায়ের সামনে বসে। -ম্যামি, বোলো তো, ড্যাডি ইংলিশ ছিখেছিল কুধার থে?

-কেন?

-আজ এক বাত করার সুময় সোয়িং ম্যাশিনকে বুলছিলেন শিউইং মেশিন-অ লাফিং স্টক।

জোহরা বেগম বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে তাকান ছেলের দিকে।

আনোয়ার আবার বলে, জিস দিন ড্যাডি এয়ার পোর্টে যেয়েছিলেন, হামার ছাথে ছিল হামার এক ক্লাসমেট। যো করাচী আছলো। তার ড্যাডি ইরাক এমব্যাসির মিলিটারী অ্যাট্যাশেই। হামি ইনট্রডিউস করিয়ে দিলম। ড্যাডি যা বুললেন। মী গ্যাড, ডি প্রনানসিয়েশান। জুনে হামার এমুন এমুন এমুন রাগ হয়েছিল। অ্যাট্যাশেইন্ডে বুলছিলেন ‘এটাচী’, কৃ-দেইতাকে বুলছিলেন ‘কোপ-ডি-টাট’, ডিডিজ্বনকে ডিভিশান। হায়দেরাবাদ ডিভিশান। হামার ফ্রেন্ড কি বুলবে, বোলো তো। সোচবে, কুধারকার এক নেটিভ। এ নেটিভ অব-

-আনোয়ার। জোহরা বেগম ধমকে ওঠেন। বিলেত থেকে বাঁদর হয়ে এসেছিস। অপ্রত্যাশিত ধমকে থতমত খেয়ে উঠে বেরিয়ে যায় আনোয়ার-

-মা?

-কে হাসান? আয় বোস।

হাসান ভেতরে এসে আনোয়ারের পরিত্যক্ত চেয়ারে বসে পড়ে।

জোহরা বেগম বলেন, ঢাকা ধর দেখি, হাসান। কিছু একটা পাওয়া যেতেও পারে।

হাসান ঢাকা কেন্দ্র ধরে। সেখানে উর্দু গান হচ্ছে।

-চলতে দে। এর পরে বাংলা গান পাওয়া যেতে পারে। বলেন জোহরা বেগম।

উর্দু গান শেষ হওয়ার পর পর। পল্লীগীতি শুরু হয়:

এই না দ্যাশের মাটিতে যে শ্যামল বিছান পাতা।

এই না দ্যাশের আসমানে রে

আছে মেঘের ছাতা।

এই প্রবাসে পল্লীগীতিই সব চেয়ে ভালো লাগে জোহরা বেগমের। পল্লীর সুর যেভাবে নাড়া দেয়, এমন আর কোনটাই দেয় না।

গান চলছে। মোহাবিষ্ট হয়ে শুনছেন জোহরা বেগম। আবেশে তাঁর চোখ বুজে আসে। তাঁর মন গানের পাখায় ভর দিয়ে মানস বিহার করছে ছায়া-শ্যামল বাঙলায়। সেখানে নদী বয়ে চলেছে। উজান-ভাটি করছে কত শত নৌকো। ভাটিয়ালী সুরে গান গাইছে মাঝিরা। মাঠে কাজ করছে কৃষক। পল্লীবধূরা কলসী কাঁখে ঘরের পানে যাচ্ছে। ঘটাং করে আওয়াজ হয় রেডিওতে। হঠাৎ জোহরা বেগমের আবেশ ভেঙে যায়।

আনোয়ারের চোখে চোখ পড়তেই সে বলে, ম্যামি, বি.বি.সি. ধরছি। ডান্স-এর বাজনা আছে এখুন। ইউ উইল লাইক ইট।

জোহরা বেগম কিছু বুঝবার আগেই ‘রক্-এন-রোল’ বাজনা শুরু হয়ে গেছে আর

আনোয়ার বাজনার আগেই নাচতে শুরু করেছে।

-হাসান, বন্ধ কর, বন্ধ কর রেডিও। চেঁচিয়ে ওঠেন জোহা বেগম।

আনোয়ারের নাচ থেমে যায়। সে হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকে মা-র থমথমে গম্ভীর

মুখের দিকে। সে বুঝতে পারে না, কি অপরাধ সে করেছে।

পুরানা লালুক্ষেত, করাচী

৩রা চৈত্র, ১৩৬৪ মার্চ, ১৯৫৭

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024