শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৪০ অপরাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৯)

  • Update Time : মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০৬ এএম
জীবনকথা
শ্বশুরবাড়ি যাইবার সময় নতুন বধূ যে কৃত্রিম কান্না করিত তাহা শুনিয়া মুরব্বিরা পর্য্যন্ত হাসিয়া খুন হইতেন। নতুন বউকে বাঁশের কচি পাতা দিয়া নথ গড়াইয়া দিতাম, গাবের মুখের চোকলা দিয়া মালা গাঁথিয়া দিতাম। বুনো পুঁই-লতার পাকা ফল ঘষিয়া নতুন বধূর হাত-পা রাঙা করিয়া দিতাম। ইহাতেই সেই খেলাঘরের বধূরা যে খুশি হইত আজকাল হাজার টাকার জড়োয়া গহনা পাইয়াও কোনো বধূর মুখে তেমন খুশি দেখিতে পাই না।
আমাদের বাড়ির ধারে তাঁতিপাড়ায় গভীর জঙ্গল ছিল। সেখান হইতে আমি আর আমার চাচাতো ভাই কাউয়ার ঠুটি লইয়া আসিতাম। কাউয়ার ঠুটি এক রকমের লাল রঙের মিষ্টি ফল। ইহা কাকদের বড়ই প্রিয়। একবার এই ফল পাড়িতে আমার চাচাতো ভাই নেহাজদ্দীনের মাথায় কাকে ঠোকর দিয়াছিল। জঙ্গলের ভিতর হইতে সজারুর কাঁটা সংগ্রহ করিয়া আনা তখনকার দিনে আমাদের মধ্যে একটি রোমাঞ্চকর ঘটনা ছিল। বনে বনে বারোমাসে বারো ফসল পাকিত। গাবের ফল পাকিলে আমরা পাড়িয়া আনিয়া খাইতাম। ডুমকুর গাছে ডুমকুর পাকিলে আমরা সেই গাছের পাশেই প্রায় সারাদিন কাটাইতাম। ডুমকুরের মালা গাঁথিয়া গলায় পরিতাম। আর সেই মালা হইতে একটা একটা করিয়া পাকা ফল ছিঁড়িয়া খাইতাম।
জ্যৈষ্ঠ মাসে যখন গাছে গাছে কাঁদিভরা খেজুর পাকিত আমরা খুব ভোরে উঠিয়া তলা হইতে তাহা কুড়াইয়া আনিতাম। এই খেজুর যেদিন বেশি কুড়াইয়া আনিতে পারিতাম, মা তাহার সঙ্গে চালভাজা মিশাইয়া ঢেঁকিতে কুটিয়া ছাতু করিয়া দিতেন। এই সামান্য খাবার তখনকার দিনে কি লোভনীয়ই না ছিল। বনের মধ্যে গ্রীষ্মকালে শেওড়া গাছে শেওড়া ফল পাকিত। হলদে হলদে পাকা ফলে সমস্ত গাছে আলো ঝলমল করিত। মনে হইত যেন কোনো রাজকন্যা গা ভরিয়া গহনা পরিয়া বনের মধ্যে বসিয়া আছে। কলরব করিয়া সব ছেলেমেয়ে মিলিয়া আমরা সেই ফল খাইতাম। আমের দিনে আমাদের সবচাইতে আনন্দ ছিল।
আমাদের বাড়ির আশেপাশে কারও বাড়িতে আমগাছ ছিল না। আমরা কারিকর পাড়ায় যাইয়া আম কুড়াইয়া আনিতাম। মেঘলা করিয়া ঝড় আসিলে আমাদের কি আনন্দ হইত। আমি আর নেহাজদ্দীন মুরব্বিদের সমস্ত বাধা ঠেলিয়া বাহির হইয়া যাইতাম আম কুড়াইতে। কাঁচা পাকা আমগুলি কুড়াইয়া আমরা যখন বাড়ি ফিরিতাম তখন তাঁতিদের বউরা, ছেলেরা পিছন হইতে আমাদিগকে গালিগালাজ করিত। আমরা গ্রাহ্য করিতাম না। তাঁতিরা আয়েশপ্রিয়। সেই ঝড় জলে আমতলায় আসিতে সাহস করিত না।
তাঁতিপাড়ায় হদু মল্লিকের দুইটি বড় বড় তালগাছ ছিল। হদু মল্লিকের পুত্রবধূ নাকি কবে সেই তালগাছের সঙ্গে গলায় দড়ি বাঁধিয়া আত্মহত্যা করিয়াছিল। সেই গাছের নিকট দিয়া যাইতে ভয়ে আমাদের গা ছমছম করিত। লোকের মুখে শুনিতাম, রাত্র হইলে সেই বউ নাকি তালগাছের উপর দাঁড়াইয়া মাথায় এলোচুল মেলিয়া দেয়। এই তালগাছের একটি এখনও জীবিত আছে। রাত্রকালে এই তালগাছের তলা দিয়া যাইতে আমার গা ছমছম করিত। কিন্তু গা ছমছম করিলে কি হইবে। বর্ষাকালে টুবটুব করিয়া গাছ হইতে পাকা পাকা তাল পানিতে পড়ে। পাকা তাল খাইতে কতই মিঠা। আমি আর নেহাজদ্দীন ঠিক করিলাম, কাল রাত থাকিতে উঠিয়া তাল চুরি করিতে যাইব। সারাদিন ভরিয়া কলাগাছ কাটিয়া কলার ভেলা তৈরি করিলাম। প্রথম মোরগ ডাক দিতেই নেহাজদ্দীনের কুক্ শব্দ শুনিতে পাইলাম। বাজান তখনও ঘুমাইয়া আছেন। আস্তে আস্তে দম বন্ধ করিয়া বিছানা হইতে উঠিয়া আসিলাম।
(চলবে)……..

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024