শ্রী নিখিলনাথ রায়
কিঞ্চিৎ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন বোধ করিয়াছিলেন। সহসা এক ঘটনা উপস্থিত হইল। রাজার অধীনতায় যে সমস্ত সৈন্য ছিল, অনেক দিন হইতে তাহারা বেতন প্রাপ্ত হয় নাই। তৎকালে এইরূপ নিয়ম ছিল যে, সৈন্যদিগের বেতন বাকী পড়িলে, তাহারা প্রজাগণের নিকট হইতে উহা গ্রহণ করিবার অনুমতি পাইত। উদয়নারায়ণের সৈন্যগণ তাহাই আরম্ভ করিল। কিন্তু সেই উপলক্ষে রাজসাহী প্রদেশে ঘোর অত্যাচারের স্রোতঃ প্রবাহিত হইল। সৈন্যগণ নিরীহ প্রজাগণকে উৎপীড়ন করিতে লাগিল। নিঃসহায় দরিদ্র প্রজাবর্গ ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিল। এই সংবাদ নবাবের কর্ণগোচর হইলে, তিনি গোলাম মহম্মদ ও -উদয়নারায়ণকে এই সুযোগে দমন করিতে কৃতসংকল্প হইলেন।
রাজা উদয়নারায়ণ গোলাম মহম্মদের এতদূর বশীভূত হইয়াছিলেন যে, তিনি সৈন্যগণের অত্যাচারের কোন প্রতিবিধান করেন নাই। নবাব এই ছল পাইয়া, উভয়কেই শাস্তি প্রদানের ইচ্ছা করিলেন; এতদ্ব্যতীত অনেক দিন হইতে রাজসাহী প্রদেশের রাজস্ব প্রেরিত হয় নাই। অচিরে মহম্মদ জান নামক এক জন সৈন্যাধ্যক্ষের অধীনতায় এক দল সৈন্য রাজসাহী প্রদেশে প্রেরিত হইল। রাজা উদয়নারায়ণ এই সংবাদে স্তম্ভিত হইলেন; তিনি কি করিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। সামান্য কারণে তাঁহার প্রতি নবাবের বিদ্বেষ-বহ্নি প্রজ্বলিত হওয়া তিনি আশ্চর্য্য বিবেচনা করিলেন। গোলাম মহম্মদ তাঁহার দোলায়মান চিত্তকে উত্তেজিত করিবার জন্য নানা প্রকার উৎসাহ বাক্য প্রয়োগ করিতে লাগিল। মুর্শিদকুলীর অন্যায় ব্যবহার ও জমিদার-গণের প্রতি অত্যাচারের কথা স্মরণ করাইয়া, গোলাম মহম্মদ রাজাকে সমরক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার জন্ম বারংবার অনুরোধ করিতে লাগিল।
রাজার অন্ততম সৈন্নাধ্যক্ষ কালিয়া জমাদারও নিতান্ত নীরব ছিল না। রাজা উভয় সৈন্যাধাক্ষের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত হওয়ায় নবাবের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিলেন। বিশেষতঃ নবাব রাজাকে সৈন্তগণের অত্যাচার নিবারণ করিতে অনুরোধ না করিয়া, কিংবা সে বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞাসা না করিয়া, যখন একেবারে তাঁহার বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করিয়াছেন, তখন তিনি নবাবের গূঢ় উদ্দেশ্য হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার যে, যশোগরিমা দিন দিন পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় বৃদ্ধি পাইতেছিল, নবাব তাহারই ধ্বংসের জন্য ব্যগ্র হইয়াছেন। এই সমস্ত বিবেচনা করিয়া তিনি গোলাম মহম্মদের কথায় সম্মত হইলেন। হিন্দু জমীদারগণের প্রতি অযথা অত্যাচারের স্মৃতিও তাঁহার হৃদয়মধ্যে এক ঘোর বিপ্লব উপস্থিত করিল। তিনি তাহাতে উত্তেজিত হইয়া, অদম্য ভাগীরথী প্রবাহের ন্যায় নবাবসৈন্যের সমক্ষে সামান্ত শৈলবৎ দণ্ডায়মান হইলেন। কিন্তু সেই স্রোতে তাঁহাকে চিরদিনের জন্য ভাসিয়া যাইতে হইয়াছিল। উভয় সেনাপতির সহিত পরামর্শের অল্প কাল পরে উদয়নারায়ণ বড়নগর পরিত্যাগ করিয়া সুলতানাবাদের অন্তর্গত বীরকিটি-নামক স্থানে তাঁহার সুরক্ষিত বাসভবনে বাস ও তাহার নিকটবর্তী জগন্নাথপুরের গড়ে সৈন্য স্থাপন করেন। বীরকিটি এক্ষণে বর্তমান সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গ।
ক্ষিতীশবংশাবলিচরিতে উদয়নারায়ণের সহিত যুদ্ধসম্বন্ধে যাহা লিখিত আছে, এস্থলে তাহারই সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদত্ত হইতেছে। উক্ত পুস্তকে। • উদয়নারায়ণ, গোলাম মহম্মদ ও মহম্মদ জানের পরিবর্তে, উদয়চাঁদ,…………।
Leave a Reply