শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৭:০৫ পূর্বাহ্ন

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-১৭)

  • Update Time : শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১১.০০ পিএম

শ্রী নিখিলনাথ রায়

 

পূর্ব্বে আরও সুন্দর বোধ হইত, এক্ষণে বৃক্ষাদির সংখ্যা অধিক হওয়ায়, মুর্শিদাবাদের সুন্দর চিত্রকে অনেকটা আবৃত করিয়া ফেলিয়াছে। তথাপি এক্ষণে যাহা আছে, তাহাও বড়ই মনোরম বলিয়া বোধ হয়। বিস্মৃতির ছায়াময় স্তর হইতে অনেক দিনের স্মৃতির অস্ফুট আলোকের ন্যায় সেই বহুদূরবিস্তৃত শ্যামল পত্ররাজির মধ্যে মুর্শিদাবাদের প্রধান প্রধান প্রাসাদ গুলির ছবি বড়ই সুন্দর বোধ হইয়া থাকে। অনেকক্ষণ ধরিয়া সেই মনোরম চিত্র দেখিতে ইচ্ছা হয়। গত ভূমিকম্পে এই মিনারের শীর্ষদেশ ভগ্ন হইয়াছে। হয়ত মুর্শিদকুলী খাঁর শেষ বিরাট্ কীর্ত্তি অচিরকাল মধ্যেই ধূলিরাশিতে পরিণত হইবে। যাঁহা হইতে মুর্শিদাবাদের নাম ও গৌরব, যিনি মুর্শিদাবাদকে বাঙ্গলার রাজধানী করিয়া সমগ্র জগতে স্বীয় গৌরব-গাথা প্রচার করিয়া- ছিলেন, মুর্শিদাবাদ হইতে যদি তাঁহার শেষ চিহ্ন চিরদিনের জন্য লয়প্রাপ্ত হয়, তাহা হইলে ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বলিতে হইবে। জানি না, কাটরার মসজেদের সংস্কার আর হইবে কি না! যদিও অনেক অর্থব্যয়ের সম্ভাবনা বটে, তথাপি, মুর্শিদাবাদের স্থাপয়িতার শেষ চিহ্ন সর্ব্বতোভাবে রক্ষা করা একান্ত আবশ্যক। এখন কেবল, তাঁহার সমাধিটির মধ্যে মধ্যে সংস্কার হইয়া থাকে।

কাটরা মজেদ হইতে পশ্চিম দিকে কিছু দূরে আর একটি মজেদ অসম্পূর্ণ অবস্থায় রহিয়াছে; তাহাকে ফৌতি মজেদ কহে। মুর্শিদের দৌহিত্র নবাব সরফরাজ খাঁ উক্ত মজ্জেদ নির্মাণ করিতে করিতে আলিবর্দী খাঁর সহিত যুদ্ধার্থে গিরিয়া প্রান্তরে গমন করেন। কিন্তু তাঁহাকে আর জীবিত অবস্থায় প্রত্যাগমন করিতে হয় নাই। তদবধি মস্জেদটি অসম্পূর্ণ অবস্থার অবস্থান করিতেছে। ইহা কাটরার পঞ্চগম্বুজ মজেদের অনুকরণে নির্ম্মিত হইতেছিল। ইহার পাঁচটি গম্বুজের মধ্যে দুইটি আজও বর্তমান আছে। সেই অসম্পূর্ণ মজ্জদও ভগ্নদশায় পতিত; বিশেষতঃ এক্ষণে জঙ্গলে আবৃত হইয়া ব্যাঘ্রাদি হিংস্র জন্তুর আবাসস্থান হইয়া উঠিয়াছে।

কাটরার দক্ষিণপূর্ব্বদিকে দুইটি অশ্বত্থতরুর, অথবা একটি অশ্বত্থ- তরুর দুইটি সংলগ্ন কাণ্ডের মধ্যস্থলে এক বিশাল কার্মান অবস্থিতি করি- তেছে। এই কামানের নাম জাহানকোষা বা জগজ্জয়ী। এই স্থানে মুর্শিদকুলী খাঁর কামানাদি রক্ষিত হইত বলিয়া কথিত আছে। সেই জন্য এই স্থানটিকে আজিও সাধারণে তোপখানা কহিয়া থাকে। এই তোপ- খানার উত্তর দিয়া একটি ক্ষুদ্র নদী সর্পগতিতে আপনার ক্ষুদ্র কলেবরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ তুলিয়া আপন মনে বহিয়া যাইতেছে। জাহানকোষা অনেকদিন পর্যন্ত ধরণীবক্ষে স্বীয় বিশাল বপুঃ বিস্তার করিয়া অবস্থিতি করিতেছিল; ইহার পার্শ্বে অশ্বথ বৃক্ষ জন্মিয়া জাহানকোষাকে ভূতল হইতে কতকটা উর্দ্ধে উত্তোলন করিয়াছে। কামানটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১২ হাত হইবে বেড় তিন হাতের অধিক, মুখের বেড়টি ১ হাতের উপর।

অগ্নিসংযোগ-ছিদ্রের ব্যাস ১৪ ইঞ্চি হইবে। কামানের গাত্রে ফারসী ভাষায় খোদিত ৯ খণ্ড পিত্তলফলক আছে। ৩ খণ্ড অশ্বত্থবৃক্ষের কাণ্ড মধ্যে প্রবিষ্ট, অবশিষ্ট কয়েকখানিও অস্পষ্ট হইয়া পড়িয়াছে। পিত্তল- ফলকে বাঙ্গলার শাসনকর্তা ইস্লাম খাঁর গুণবর্ণনা ও কামানের নির্মাণা- দাদি খোদিত আছে। এইরূপ লিখিত আছে যে, এই জাহানকোষা সাজাহানের রাজত্বকালে ও ইস্লাম খাঁর বাঙ্গলা-শাসনের সময়, জাহা- ঙ্গীরনগরে দারোগা শের মহম্মদের অধীন হরবল্লভ দাসের তত্ত্বাবধানে জনার্দন কর্মকারকর্তৃক ১০৪৭ হিঃ, ১১ই জমাদিয়স্ সানি মাসে নির্মিত হয়। ইহা ওজনে ২১২ মণ; ইহাতে ২৮ সের বারুদ লাগিয়া থাকে। জাহানকোষাকে এক্ষণে হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতিই সিন্দুরাদি লেপন করিয়া পূজা করিয়া থাকে। ঢাকায় ইহা অপেক্ষা আরও একটি বিশাল তোপ ছিল; তাহা এক্ষণে নদীগর্ভে পতিত। বিষ্ণুপুর প্রভৃতি স্থানেও বৃহৎ তোপের কথা শুনা গিয়া থাকে। আমাদের দেশে পূর্ব্বে যেরূপ শিল্পের উন্নতি হইয়াছিল, অনুসন্ধান করিলে, এখনও তাহার অনেক চিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায়। বাঙ্গলার শিল্পের দিন দিন যেরূপ অবনতি হইতেছে, তাহাতে লোকে ইহার পূর্ব্ব-শিল্পের কথা প্রবাদ- বাক্য বলিয়া মনে করিবে।

 

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-১৬)

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-১৬)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024