স্বদেশ রায়
সমাজের কিশোররা যারা শুধু কোমলমতি নয়, তাদের মুখেও থাকে একটা পবিত্রতার ছাপ। আমরা রবীন্দ্রনাথের মায়ার খেলায় এক কিশোর উত্তীয়কে চিনি, সে যাকে ভালোবাসার নয়, মনে মনে তাকেই ভালোবেসে তার মূল্য স্বরূপ নিজের জীবন দিয়ে যার মুর্তি ওই কিশোর হৃদয়ের গভীরে একেছিলো, তাকে তার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে মিলনের সুযোগ করে দেয়।
রবীন্দ্রনাথের আরেক কিশোরকে পাই রক্তকরবী নাটকে যেখানে কাঁচের ঘরে আটকে পড়া রাজাকে জাগানোর জন্যে নন্দীনির আপ্রান চেষ্টা, সেই জাগানিয়া নন্দীনিকে সে সব সময়ই ডাকে। আর তাকে যখন জিজ্ঞেস করে নন্দিনী, তুই আমাকে এত ডাকিস কেন? সে সরল উত্তর দেয়, আমার যে ডাকতে ভালো লাগে।
মানুষের দুই সুকুমার বৃত্তি প্রেম আর সত্যকে জাগরুক করা। দুইকে হৃদয়ের সবটুকু এমনকি প্রাণ বলি দিয়েও তার অংশ হয় কিশোর। কৈশরের এই সত্য বা শিব মুর্তি রবীন্দ্রনাথ আরো এঁকেছেন। যার উদাহরণ দিতে গেলে লেখাটি রবীন্দ্রনাথের লেখায় কিশোর মানসের দিকে চলে যাবে।
তবে রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের যেতে হবে, প্রকৃতি কিশোর মনোজগতকে কোন সত্যেও সুন্দরের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয় তা বোঝার জন্যে। তাই দেখা যায়, রাষ্ট্র বিপ্লব, সমাজ বিপ্লব শুধু নয়, যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নামে তখন কিশোররা তরুণদের সঙ্গে সমানতালে, কখনও অগ্রগামী থাকে।
ভারত উপমহাদেশে যে ব্রিটিশ শাসন চেপে বসেছিলো, যাকে কেউ কোনদিন আঘাত করতে পারবে এমনটি ধারনার বাইরে চলে গিয়েছিলো, সেখানেও সমস্ত মন প্রাণ ও জীবন সমর্পন করে প্রথম আঘাত হানে কিশোর ক্ষুদিরাম।
পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলন স্বাধীনতার পথে যে ঘটনার মধ্যে দিয়ে দ্রুত মোড় নেয়, তাও ঘটেছিলো মতিয়ুর নামের এক কিশোরের প্রাণও মন সমর্পন করে জীবন দেবার ফলে।
মানব জীবনের এই সুন্দরতম সময়, যে সময়ে মানব শিশুরা বহন করে -সেই সময়টা যদি তাদের গ্যাং হিসেবে চিহ্নিত হতে হয়। তাদের হাতে যদি অবৈধ অস্ত্র ওঠে। তাদের কারণে যদি সমাজ, প্রশাসন,রাজনীতি এমনকি পরিবার নষ্টের পথে যায়- তাহলে এ দায় কার?
রবীন্দ্রনাথের কিশোর উত্তীয় থেকে মতিয়ুর অবধি সকলের প্রান আছে, একটি উদ্দাম কৈশোর আছে। তবে তাকে তো সে নিজে পরিচালিত করতে পারে না। যেমন পারে না কচি লাউয়ের ডগাটি নিজে সোজা হয়ে দাঁড়াতে। কেউ না কেউ তাকে আশ্রয় দেয়, তাকে চালিত করে।
আজ যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী কিশোর গ্যাং এর বিষয়ে প্রতিটি পরিবারকে হুশিয়ার করেছেন, তখন আর চোখ বুঝে থাকার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া মিডিয়াতে এই কিশোর গ্যাং এর রিপোর্ট হচ্ছে ২০০৪, ২০০৫ থেকে। ২০০৫ থেকে ২০১২ অবধি রাজধানীর উত্তরা, বসুন্ধুরা সহ বহু জাগয়ার এই কিশোর গ্যাং এর রিপোর্ট আমি আমার রিপোর্টার দিয়ে করিয়েছি। তাই কিশোর গ্যাং হঠ্যাত্ করে একদিন এ সমাজে হয়নি। প্রায় আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই কিশোর গ্যাং এ সমাজে। হয়তো আরো বেশি হবে। যেমন ১৯৯৫ এর দিকে ঢাকার শাহজাহানপুর এলাকায় সন্ধ্যার দিকে একটি রাস্তায় শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সেটা একটা গলিই ছিলো। গলির ভেতরের একটি মসজিদ থেকে ওই সময়ে এক ভদ্রলোক নামাজ সেরে ফিরছিলেন। আমাকে দেখেই বুঝতে পারেন, এ এলাকার নই আমি। অনেকটা ধমকের স্বরে বলেন, কোথায় যাচ্ছেন। সামনের দিকে বলেতই তিনি আরো জোরে ধমক দিয়ে আমাকে তখনই গলি থেকে বের হতে বলেন। পরে জানতে পারি, ওই গলিগুলো এক শ্রেনীর কিশোরের দখলে। আর তারা ওই সন্ধ্যায় সেখানে ফেনসিডিল বিক্রি করে। সেখানে যাওয়া মানেই বিপদ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই কিশোররা তো নিজের টাকায় ফেনসিডিল আনছে না। তারা তো বাহক আর বিক্রেতা মাত্র। তাহলে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত কারা? তাদেরকে তিরিশ বছরেও চিহ্নিত করা হয়নি।
২০০৯ সালে উত্তরার বেশ কয়েকটি ঘটনা রিপোর্ট করিয়েছিলাম, কিশোর গ্যাং কয়েকটি গাড়ি নিয়ে একটি গাড়িকে আটকে দিয়ে ওই গাড়ির মালামাল ছিনতাই করে। কখনও সুযোগে পেলে গাড়িও ছিনতাই করে। তারপরে গাড়ির অংশ খুলে তারা বিক্রি করে। যারা গাড়ি নিয়ে এই কাজ করছে- তারা হয় স্বচ্ছল ঘরের ছেলে, না হয় কেউ না কেউ তাদের গাড়ী সরবরাহ করছে।
জেলা শহর, উপজেলা শহরগুলোতে এখন কিশোর গ্যাংদের বড় অংশ দামী স্কুটার ব্যবহার করে। আর সদর্পে তারা যখন যায় তখন রাস্তার সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।
এদের প্রতি পরিবারের দায় আছে। প্রথম দায় পরিবারের। কারণ, পরিবার সঠিক লক্ষ্য রাখলে তারা হয়তো এ পথে যেতো পারতো না। তবে কিশোরকে অভিজ্ঞতার জন্যে পরিবার থেকে বের হতে হবে। এখন পরিবার থেকে বের হয়ে সে যদি দেখতো, তাদের অগ্রজরা কেউ বিজ্ঞান ক্লাব করছে, কেউ নাটক করছে, কেউ বা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছে। এখন ডিজিটালে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও এগিয়েছে, তাই পাড়ায় পাড়ায় ডিজিটাল লাইব্রেরি গড়ে উঠতে পারে। সেখানে ভালো সিনেমা থেকে শুরু করে ভালো বই পড়ার সুবিধা গড়ে উঠতে পারে। এমনকি গড়ে উঠতে পারে সিনেমা তৈরিরও ক্লাব। সে সব কি তারা পাচ্ছে?
যেমন আশির দশকের আগে পুরানো ঢাকায়, পাড়ায় পাড়ায় নাটক, ফুটবল টিম, ব্যডমিন্টন টিম, টেবিল টেনিস টিম- এমনকি ব্যায়ামাগারও ছিলো। আশির দশকে একটি বিশেষ ছাত্র সংগঠনের সহায়তায়, ওই সবের বদলে বিভিন্ন রুমে ও ক্লাবে চালু হলো ভিসি্আরের মাধ্যমে ব্লু ফিলম দেখানো। এক টিকেটে তিনটি করে। পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা করে কিশোর ও তরুণরা তা দেখা শুরু করলো। আর ধীরে ধীরে তারা বেরিয়ে গেলো বাবা মায়ের হাত থেকে। অন্যদিকে তাদের চারপাশে শত শত বছর ধরে একটি কিশোরকে উত্তীয়, ক্ষুদিরাম বা মতিউর হবার যে পরিবেশ গড়ে উঠেছিলো তা যেন কয়েক লহমায় তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়লো।
তারপরে অনেক সরকার পার হয়েছে এ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার ওপর দিয়ে। সমাজরে সবটুকু এখন রাজনীতিবিদদের ও প্রশাসনের দখলে। তারাই রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ থেকে বঙ্গবন্ধু গবেষক সবই। তবে তারা কেউই যে সমাজ নিয়ে, কিশোরদের নিয়ে ভাবেনি তার প্রমান আজ প্রধানমন্ত্রীকে কিশোর গ্যাং এর কথা বলতে হচ্ছে।
আর এই কিশোর গ্যাং কি শুধু সমাজ প্রশ্রয় দিচ্ছে, শিক্ষায়তনও কি প্রশ্রয় দিচ্ছে না? আজ ছাত্রকে কত মার্কস দিতে হবে তাও ডিকটেড করছে ছাত্ররা। যে শিক্ষক পরীক্ষা নিচ্ছেন তিনি অসহায়। তাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। পৃথিবীর কোন দেশে এমন ঘটনার কোন নজির নেই। প্রাচীন প্রবাদ আছে, রঙ্গ ভরা বঙ্গ দেশ। এগুলো তো রঙ্গ বলে হেসে উড়িয়ে দেবার কোন সুযোগ নেই। বরং এই যে খাদ তৈরি করা হচ্ছে, এই খাদ একদিন কতটা গভীর হতে পারে, সেখানে কী হারে সমাজের কোন কোন অংশ ডুবে যেতে পারে তা কি এখন আমরা ভেবে দেখছি?
কিশোর গ্যাং বাস্তবে এ মুহূর্তে আইন ও পরিবার কঠোর হয়ে থামানোর সুযোগ কি আছে? কারণ, মানব সমাজে মানুষের বেড়ে ওঠার সঙ্গে তো শুধু রাষ্ট্র আর আইন বড় বিষয় নয়, আরো শত সহস্র উপাদান একটি সমাজ সভ্যতার ভেতর দিয়ে অর্জন করে। এখন কিশোর গ্যাং শুধু নয়, আরো অনেক কিছু বন্ধ করার জন্যে সমাজের কতটুকু সুস্থ উপাদান আর অবশিষ্ট আছে সেটাই কি আগে চিহ্নিত করা দরকার নয়?
অথচ সমাজের প্রতি কান পাতলে শোনা যায়, সে যেন ডুবে যাওয়া সূর্যের মতো বলছে, কে লইবে মোর কার্য? না, কোন মাটির প্রদীপ কোথাও মুখ খুলছে না।
লেখক: জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present world ।
Leave a Reply