শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:০৩ পূর্বাহ্ন

ত্রিপুরা রাজ্য

  • Update Time : শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭.৪৯ পিএম

সুপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়

 

নাম ও সীমা

প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নাম ও সীমা নানা সময়ে নানা কারণে পরিবর্তিত হয়েছে একাধিকবার। অন্যান্য রাজ্যের মত ত্রিপুরা রাজ্যের নামও বরাবর এক ছিল না। সীমাও পরিবর্তিত হয়েছে বহুবার। বর্তমানে যে সব অঞ্চল বা জেলাকে আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশভুক্ত বলে জানি, কোন না কোন সময়ে ঐ সব অঞ্চলের মধ্যে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি প্রভৃতি জেলা দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্যের এবং মোগল অধিকারের পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সতের শতকের প্রথম দিকেই (১৬২৮ খ্রীষ্টাব্দ) ঐ সব জেলা ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। চাকলা রোশনাবাদ গঠিত হয় সমতল ত্রিপুরার কয়েকটি পরগণা নিয়ে এবং ঐ চাকলা ত্রিপুরার রাজাদের জমিদারীতে পরিণত হয়।

ত্রিপুরার ‘মাণিক্য’ বংশীয় রাজাদের রাজত্বের সূচনাকালেও দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের কোনও অঞ্চলের নাম ত্রিপুরা ছিল না। ঐসব অঞ্চল ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকেও পট্টিকের (কুমিল্লা), হরিকেল (শ্রীহট্ট অথবা ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম), বঙ্গ ও সমতট প্রভৃতি নামে সুপরিচিত ছিল। দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল এগারো শতকের শেষভাগ থেকে গুপ্ত, বর্ম, দেব, খড়া ও চন্দ্র প্রভৃতি স্বাধীন রাজাদের অধিকারভুক্ত ছিল। সুতরাং ত্রিপুরার রাজবংশের আখ্যানমূলক কাব্য ‘রাজমালা’র মহাভারত-খ্যাত চন্দ্রবংশীয় রাজা যযাতির ত্রিপুর নামে এক বংশধরের নাম অনুসারে প্রাচীনকালে ত্রিপুরা রাজ্যের উল্লেখ বস্তুতঃ কাল্পনিক কাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়। প্রসঙ্গক্রমে একথাও বলা যায় যে, প্রাচীন ত্রিপুরী রাজ্যের সঙ্গেও এই রাজ্যের কোন সংযোগ অকল্পনীয় কারণ, ঐ ত্রিপুরী রাজ্য মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের কাছাকাছি আধুনিক তৈওয়ার-এর প্রাচীন নাম বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে এই রাজ্যের রাজারা তিপ্রা উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত এবং ঐ গোষ্ঠিবাচক ‘তিপ্রা’ শব্দটি থেকেই দেশবাচক সংস্কৃত ‘ত্রিপুরা’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। সংস্কৃত ‘ত্রিপুরা’ শব্দটির দেশ অর্থে প্রয়োগ ‘মাণিক্য’ রাজাদের উপর হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব সূচিত করলেও ‘তিপ্রা’ শব্দটি থেকে ‘ত্রিপুরা’ শব্দটির উদ্ভব সংশয়াতীত নয়। যে উপজাতি সম্প্রদায়কে বর্তমানে ‘তিপ্রা’ নামে অভিহিত করা হয় তাঁদের গোষ্ঠিগত নাম আগে ‘তিগ্রা’ ছিল না। তাঁরা নিজেদের বোড়ো গোষ্ঠিভুক্ত অন্যান্য সম্প্রদায়ের মত ‘বরক’ বা মানুষ বলেই জানতেন। যেমন গারো উপজাতীয়দের নাম ছিল ‘মন্দি’ বা মানুষ। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাসকারী তিগ্রা সম্প্রদায়ের মানুষ ‘মুরুৎ’ নামেই পরিচিত। এই রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালী হিন্দুদের মুখে মুখে দেশবাচক সংস্কৃত ‘ত্রিপুরা’ শব্দটির জাতিবাচক রূপান্তর হিসাবে ‘তিগ্রা’ কথাটির উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা অমূলক নয়। অর্থাৎ সংক্ষেপে বলা যায়, পনের শতকের কিছু আগে-পরে ত্রিপুরার মাণিক্যরাজারা হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির অনুরাগী হন এবং ঐ সময় থেকেই ত্রিপুরাকে একটি প্রাচীন হিন্দুরাজ্য রূপে প্রতিপন্ন করার জন্য দেশবাচক প্রাচীন ত্রিপুরা নামটি গ্রহণ করেন এবং এই ত্রিপুরা শব্দটি থেকে ‘তিগ্রা’ শব্দের উদ্ভব হতে পারে।

হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়ার আগে এবং এই পার্বত্য রাজ্যের পত্তনকালে এই রাজ্য ও রাজাদের উপজাতীয় নাম ছিল বলে জানা যায়। যেমন রাজাদের নাম ছিল ডাঙ্গর ফা, আচোঙ্গ ফা, খিচোঙ্গ ফা ইত্যাদি। রানীদের নামের ক্ষেত্রে ‘ফা’র (প্রভু) বদলে শুধু ‘মা’ শব্দটি যুক্ত হোত যেমন খিচোঙ্গমা। দেশের অঞ্চল বিশেষের নাম ছিল ‘হিউৎ’, ‘বিউং’ ইত্যাদি। মাণিক্যবংশীয় রাজাদের রাজত্ব সুরু হওয়ার সময় এই রাজ্যের কি নাম ছিল তা সঠিক জানা যায় না। রাজ্যবাচক ত্রিপুরা শব্দটির প্রথম ব্যবহার দেখা যায় রাজা ধন্যমাণিকেরা ১৪১২ শকে (১৪৯০ খ্রীঃ) প্রচারিত একটি মুদ্রায়।

 

 

‘মাণিক্য’ রাজাদের ঐতিহাসিক রাজত্বকালের নিদর্শন হিসাবে প্রথম ধর্মমাণিক্য প্রদত্ত ১৩৮০ শকের (১৪৫৮ খ্রীঃ) একটি তাম্রলিপির উল্লেখ করা হয়। ঐ তাম্রলিপিতে ধর্মমাণিক্যকে মহামাণিক্যের পুত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে বলে ডক্টর মজুমদার সিদ্ধান্ত করেন যে, ‘রাজমালা’য় বর্ণিত রাজা ত্রিপুরের ৯৩তম বংশধর ছেদুম্ ফা-র প্রপৌত্র ডাঙ্গর ফা এবং প্রথম ধর্মমাণিক্য অভিন্ন রাজা। ধর্মমাণিক্যের প্রপিতামহ ছেথুম্ ফা-ই ১৪৩১ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে কোন এক সময়ে বাংলার সুলতানদের দুর্বলতার সুযোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্টের মধ্যবর্তী বিস্তৃত ভূভাগ জয় করে নতুন রাজ্যের পত্তন করেন। প্রতিষ্ঠাকালে এই রাজ্যের সীমা কতদূর বিস্তৃত ছিল তা সঠিক বলা যায় না। তবে প্রথম ধর্মমাণিক্যের তাম্রলিপি, প্রথম রত্নমাণিক্যের মুদ্রা ও প্রথম বিজয়মাণিক্যের রাজত্বকালে রাজার মাতুলানী পুণ্যবতীর তাম্রলিপি থেকে বলা যায় যে, প্রথমাবস্থায় এই রাজ্য রাঙামাটি (বৰ্তমান উদয়পুর অঞ্চল) ও সমতল ত্রিপুরার কুমিল্লা জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকগণের মতে ত্রিপুরার ‘মাণিক্য’ রাজারা তিব্বতীয়- বর্মী গোষ্ঠির বোড়ো শাখাভুক্ত। ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে বোড়োরা প্রথম বসতি স্থাপন করেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। ক্রমশঃ শক্তিবৃদ্ধির ফলে তাঁরা আসামের নওগাঁ ও কাছাড় জেলা অধিকার করেন এবং শ্রীহট্ট জেলা দখলের পর তাঁরা আরও দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে অধিকার বিস্তার করেন এবং সেখান থেকে কুমিল্লা ও সম্ভবতঃ নোয়াখালি জেলা পর্যন্ত জয় করেন।

তথাকথিত তিপ্রা সম্প্রদায়ভুক্ত বিজয়ী গোষ্ঠীর রাজ্য যে পার্বত্য ত্রিপুরার দক্ষিণাংশ থেকে সমতল ত্রিপুরার কুমিল্লা প্রভৃতি অঞ্চলের মধ্যেই সীমায়িত ছিল তা জানা যায় প্রথম ধর্মমাণিক্য ও পুণ্যবতীর তাম্রলিপি ও প্রথম রত্নমাণিক্যের মুদ্রা থেকে। ত্রিপুরার রাজাদের শ্রীহট্ট ও জয়ন্তিয়া-খাসিয়া বিজয়ের সংবাদ পাওয়া যায় অনেক পরে দ্বিতীয় বিজয়মাণিক্যের রাজত্বকালে। তার আগে ত্রিপুরার রাজাদের চট্টগ্রাম জয়ের প্রথম সংবাদ পাওয়া যায় ধন্যমাণিক্যের রাজত্বকালে। সতের শতকের সূচনাকালেই মাণিক্যরাজাদের রাজ্যসীমা দক্ষিণ দিকে সঙ্কুচিত হতে আরম্ভ করে এবং সম্ভবত সেই সময়ের কিছুকাল আগে থেকেই পার্বত্য ত্রিপুরার রাজ্যসীমা উত্তর ও পূর্ব দিকে বিস্তৃত হয়।

ত্রিপুরায় ঐতিহাসিক যুগের সূচনা: প্রথম ধর্মমাণিক্য

প্রথম ধর্মমাণিক্য ওরফে ডাঙ্গর ফা ১৩৮০ শকে (১৪৫৮ খ্রীঃ) এক তাম্রশাসনে কৌতুকপ্রমুখ আটজন ব্রাহ্মণকে উনিশ দ্রোণ জমি দান করেন কুমিল্লায় ধর্মসাগর নামে জলাশয় প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে। তাম্রলিপিতে উপরোক্ত সংবাদ ছাড়া ধর্ম- মাণিক্যের রাজ্য ও রাজত্বকাল সম্বন্ধে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ‘ত্রিপুর- বংশাবলী’ ও ‘রাজমালা’র মতে ধর্মমাণিক্য ১৪৩১ খ্রষ্টাব্দ থেকে ১৪৬২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মহামাণিক্য। বাংলার মুসলমান সুলতান জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের (১৪১৮-৩৩ খ্রীঃ) এক মুদ্রার ভিত্তিতে অনুমান করা হয় যে, ত্রিপুরা রাজ্যের কতকাংশ সাময়িকভাবে তাঁর রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। প্রথম ধর্মমাণিক্যের রাজত্বকালে বাংলার সুলতান ছিলেন রুকনুদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৫-৭৬ খ্রীঃ)। ধর্মমাণিক্যের পরে ত্রিপুরার রাজা হন প্রথম রত্নমাণিক্য। তাঁর ১৩৮৬, ১৩৮৮ ও ১৩৮৯ শকের মুদ্রা ও বহু তারিখবিহীন মুদ্রা পাওয়া গেছে। রত্নমাণিক্যের রাজধানী ও তাঁর ধর্মবিশ্বাস, সম্বন্ধে বহু তথ্যাদি ঐ সব মুদ্রা থেকেই পাওয়া যায়। ১৩৮৬ শক অর্থাৎ ১৪৬৪ খ্রীষ্টাব্দের মুদ্রাটির লেখন ও চিত্রণ দুইই অভিনব। ঐ মুদ্রার লেখনে আছে: ‘শ্রীচতুর্দশদেব চরণপর’ এবং চিত্রণে আছে চোদ্দটি লম্ব রেখা। এই লেখন ও চিত্রণ মিলিয়ে রাজা যে উপজাতীয় কুলদেবতা হিসাবে চতুর্দশ দেবদেবীর ভক্ত ছিলেন তা সুষ্পষ্ট হয়। ১৩৮৮ ও ১৩৮৯ শকে প্রচারিত মুদ্রাগুলিতে কিন্তু নারায়ণ, দুর্গা, পার্বতী-পরমেশ্বর প্রভৃতি হিন্দু দেবদেবীর প্রতি রাজার ভক্তি নিবেদনের কথা পাওয়া যায়। কয়েকটি তারিখবিহীন মূদ্রাতেও রাজার নাম ছাড়াও ‘শ্রীনারায়ণ-চরণ-পর’ লেখন দেখা যায়। ঐ ধরনের মুদ্রাগুলি এবং ১৩৮৬ শকে প্রচারিত আর এক ধরনের মুদ্রাতেও ‘নারায়ণ-চরণ-পর’ লেখন থেকে অনুমিত হয় যে, রত্নমানিক্য শুধু যে অচিরে হিন্দুধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হন তাই নয়, বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মমতের কোনও গোঁড়ামীকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। প্রথম রত্নমাণিক্যই ত্রিপুরার একমাত্র রাজা যাঁর মুদ্রায় টাকশাল-তথা-রাজধানীর নাম জানা যায়। ১৩৮৬ শকে উৎকীর্ণ মুদ্রায় রত্নপুর ছিল রাজধানী। রত্নপুর বর্তমান উদয়পুরের অন্তর্গত।

স্মাজমালা’র মতে রত্নমাণিক্য গৌড়ের দরবার থেকে প্রত্যাবর্তনকালে বহু বঙ্গ- দেশীয় নবশাক ও স্ত্রীকরণকে সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং রাঙামাটির রত্নপুর, যশপুর ও হীয়াপুর প্রভৃতি স্থানে কয়েক হাজার বাঙালীকে বসবাস করান। রত্নমাণিক্যের গোঁফগমনের তথ্য সমসাময়িক কোন ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তবে তাঁর মৃত একজন সংস্কৃতিসম্পন্ন ও হিন্দু মনোভাবাপন্ন রাজার পক্ষে প্রামিজায়গা দিয়ে বসবাস করানো আদৌ অসম্ভব নয়। রাজ্যে হিন্দু-বাঙালিদের রস্তযাগিকোর শেষ মুদ্রার তারিখ ১৩৮৯ শক অর্থাৎ ১৪৬৭-৬৮ খ্রীষ্টাব্দ। তাঁর রাহ্মত্বের শেষ সীমা সম্বন্ধে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য এখনও মেলেনি। প্রায় কুড়ি একুশ বৎসর পরে ১৪১০ শকে (১৪৮৮-৮৯ স্ত্রীঃ) পুণ্যবতীর নামে প্রদত্ত ভূমিদানের এক তাম্রলিপি থেকে জানা যায় তখন ত্রিপুরার রাজা ছিলেন বিজয়মাণিকা। তাম্রলিপি অনুসারে পুণ্যবতী ছিলেন রাজার মাতুলানী ও দৈত্যনারায়ণ-পত্নী। ঐ দৈত্যনারায়ণ (সম্ভবত সেনাপতি) যে খুবই শক্তিশালী ছিলেন এবং নাবালক রাজাও যে সেনাপতির হাতের ক্রীড়নক ছিলেন, এমন অনুমান অমূলক নয়। প্রথম বিজয়মাণিক্যের রাজত্বকাল যে ১৪১১ শকে (১৪৮৯ খ্রীঃ) শেষ হয় তা জানা যায় ঐ বৎসরে উৎকীর্ণ মুকুটমাণিক্যের মুদ্রা থেকে। তাঁর মুদ্রায় অঙ্কিত গরুড়, মূর্তি থেকে মনে হয় তিনি বৈষ্ণব ধর্মানুরাগী ছিলেন। ঠিক এক বৎসর পরে ১৪১২ শকে উৎকীর্ণ ধরমাণিক্যের মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। ঘন ঘন রাজা পরিবর্তনের মূলে রাজমালা’য় উল্লিখিত সেনাপতিদের প্রাধান্য ও চক্রান্ত থাকাও অসম্ভব নয়।

 

 

‘ ধরমাণিক্য সিংহাসনে বসেন ১৪৯০ খ্রীষ্টাব্দে। মুদ্রা থেকে জানা যায় তিনিই সর্বপ্রথম ‘ত্রিপুরেন্দ্র’ উপাধি গ্রহণ করেন। প্রথম শক্তিশালী রাজা হিসাবে তিনি রাজোর পূর্ব সীমান্তের কুকিদের দমন ও রাজশক্তি সংহত করার পর রাজ্য সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে বাংলার সুলতান হুসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রীঃ) সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি প্রথমে নোয়াখালি জেলার খণ্ডল পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং এই প্রাথমিক বিজয়ের পর ১৫০৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘বিজয়ীন্দ্র’ উপাধিসূচক মুদ্রা উৎকীর্ণ করেন। ধন্যমাণিক্যের দ্বিতীয় অভিযান শুরু হয় ১৫১৩-১৪ খ্রীষ্টাব্দে চট্টগ্রাম অধিকারের সময়। প্রাথমিক জয়ের পর ত্রিপুরী বাহিনীকে গৌড়াই মল্লিকের সেনাপতিত্বে গঠিত শক্তিশালী সুলতানী ফৌজের সম্মুখীন হতে হয়। গৌড়াই মল্লিকের পাল্টা আক্রমণে বিজিত এলাকা ছাড়াও রাজ্যের কিছু অংশও হারাতে হয় ধরমাণিক্যকে। ধন্দ্রমাণিক্য কিছুকাল পরে আবার চট্টগ্রাম আক্রমণ করেন এবং এবার হৈতান খাঁর নেতৃত্বে গুলতানী ফৌজ প্রথমে গোমতী নদীর তীরবর্তী এলাকা পর্যন্ত দখল করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুলতানী ফৌজকে ছয়কড়িয়া পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করতে হয়। এই সময় ধন্দ্রমাণিক্য নানা বলি উপচারে চতুর্দশ দেবদেবীর পূজা দেন। এরপর ১৫১৪-১৫ খ্রীষ্টাব্দে ধামাণিক্য পুনরায় চট্টগ্রাম দখল করেন।

ধন্দ্রমাণিক্য শুধু যে একজন পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন তাই নয়, উপজাতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির সঙ্গে হিন্দু-ধর্ম সংস্কৃতির সংমিশ্রণেও তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ত্রিপুরায় মন্দির নির্মাতা রাজা হিসাবে তাঁর নামই সর্বাগ্রগণ্য। তিনি রাজ্যে প্রথম চতুর্দশ দেবদেবীর মন্দির ও হিন্দু দেবী অম্বিকার মন্দির নির্মাণ ও মূর্তি স্থাপন করেন। এই অম্বিকা দেবী ত্রিপুরায় বহুকালাবধি ত্রিপুর-সুন্দরী দেবী নামেই বাঙালী ও উপজাতীয় ভক্তদের পূজা পাচ্ছেন। ‘রাজমালা’র মতে ধন্যমাণিক্য স্বর্ণময়ী ভুবনেশ্বরী মৃতি নির্মাণ করেন গোপনে পূজার উদ্দেশ্যে। প্রথম দিকে হিন্দু দেবীমূর্তির পূজায় সতর্কতা অবলম্বন ঐ তথাকথিত গোপনীয়তার কারণ হতে পারে। ধন্ধমাণিক্য বহিত্রিপুরায় তীর্থভ্রমণ করেন এবং সেই সূত্রে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর পরিচয় গভীর হয় বলে মনে করা যায়। ‘রাজমালা’র মতে তিনি চতুর্দশ দেবদেবীর পূজায় নরবলী প্রথা রদ করেন এবং হিন্দু পৌরাণিক ধর্মগ্রন্থ ‘উৎকল খণ্ড পাঁচালী’ ও ‘প্রেত-চতুর্দশী’ বাংলায় অনুবাদ করান। ‘রাজমালা’র মতে ধন্যমাণিক্যের মহিষী সৈনিক রমণীদের মদ্যপান করিয়ে তাদের মত্ত অবস্থা দেখে আনন্দ পেতেন। সে সময় প্রতি পয়সায় দুই সের মদ পাওয়া যেত। সুরাসক্তি নারীদের মধ্যেও অপ্রতুল ছিল না। ঐ অনুবাদের কোন পুঁথি অবশ্য পাওয়া যায় নি।

ধক্ষমাণিক্য ১৪৪২ শকে অর্থাৎ ১৫২০-২১ খ্রীষ্টাব্দে উদয়পুরে দেবী অম্বিকার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ বৎসরেই তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র দেবমাণিক্য সিংহাসনে বসেন। তাঁর ১৪৪২ শকের মুদ্রা প্রচারিত হয় ভুলুয়া বা নোয়াখালি বিজয়ের পর ‘দুরাশার’ স্নান উপলক্ষে। দেব- মাণিক্যের সুবর্ণগ্রাম বা সোনারগাঁও বিজয় উপলক্ষে উৎকীর্ণ ১৪৫০ ও ১৪৫২ শকের মুদ্রাও পাওয়া গেছে। দেবমাণিক্য গুপ্তঘাতকের হস্তে নিহত হলে তাঁর পুত্র ইন্দ্রমাণিক্য কিছুকালের জন্য রাজা হন কিন্তু তাঁর রাজত্বকাল যে ১৪৫৪ শকের কোন একসময়ে শেষ হয় তা জানা যায় দ্বিতীয় বিজয়মাণিক্যের ১৪৫৪ শকের মুদ্রা আবিষ্কারের ফলে।

ত্রিপুরার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা দ্বিতীয় বিজয়মাণিক্যের রাজত্বকালে রাজ্যের সীমা সর্বাধিক বিস্তৃত হয়। তিনি এক পাঠান অশ্বারোহী সৈন্যদল গঠন করেন এবং শ্রীহট্ট, জয়ন্তিয়া ও খাসিয়া প্রভৃতি রাজ্যের রাজাদের পরাজিত করেন। ১৪৭৯ থেকে ১৪৮৫ শকের মধ্যে উৎকীর্ণ মুদ্রাগুলি থেকে জানা যায় যে রাজ্যজয়ের অভিলাষে তিনি কররাণী সুলতানদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং সুবর্ণগ্রাম বিজয় ও পদ্মানদী পর্যন্ত অভিযান চালান।

আবুল ফজল প্রণীত ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে ত্রিপুরা রাজ্য ও ত্রিপুরার রাজা সম্বন্ধে কিছু বিবরণ আছে। ‘আইন-ই-আকবরী’র মতে ভাটা প্রদেশের এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড তিপ্রা উপজাতীয়দের বাসভূমি ছিল। ঐ উপজাতীয়দের শাসকের নাম বিজয়মাণিক। সর্দার বা দলের প্রধানের উপাধি ছিল ‘মাণিক’। সম্ভ্রান্তবংশীয়দের উপাধি ছিল ‘নারায়ণ’। বিজয়মাণিক্যের দুইলক্ষ পদাতিক সৈন্য ও একহাজার রণহস্তী ছিল। মোগল সম্রাট আকবর ছাড়াও কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণ বিজয়মাণিক্যের সমসাময়িক ছিলেন। দরং রাজবংশাবলীর মতে নরনারায়ণ ত্রিপুরার রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। কিন্তু এই বক্তব্যের অন্যত্র সমর্থন পাওয়া যায় না।

বিজয়মাণিক্যের ১৪৮২ শকের অর্ধনারীশ্বর মূর্তিযুক্ত মুদ্রা এবং ১৪৮৫ শকের সিংহাসনের উপর গরুড়ারূঢ় চণ্ডীমূর্তিযুক্ত মুদ্রা শুধু যে মুদ্রায় মূর্তিশিল্পের চরমোৎকর্ষের পরিচয় বহন করে তাই নয়, সেই সঙ্গে হিন্দু দেবদেবীর ধ্যানমূর্তি সম্বন্ধে সুষ্পষ্ট ধারণা ও শৈব ও শাক্ত মতের সমন্বিত ধর্মমতে রাজার সুদৃঢ় আস্থার কথাও জানা যায়। তিনি উদয়পুর সন্নিহিত হীরাপুরে গোপীনাথের মূর্তি স্থাপন উপলক্ষে ব্রাহ্মণদের প্রচুর অর্থ ও ভূমিদান করেন। মুদ্রায় বিজয়মাণিক্যের লক্ষ্মী, বিজয়া ও বাক্ বা সরস্বতী নামে তিন রানীর উল্লেখ আছে।

বিজয়মাণিক্যের রাজত্বকালে ভারত পরিক্রমাকারী বিদেশী পর্যটক ব‍্যাল্ফ, ফিচ বলেন, রেকন ও রেমি রাজ্যের মগগণ ত্রিপুরার রাজায় তুলনায় বেশি শক্তিশালী হয়ে প্রাটো গ্রান্ডো বা চট্টগ্রাম প্রায়ই দখল করে নিতেন।

দ্বিতীয় বিজয়মাণিক্যের পুত্র অনন্তমাণিক্য সিংহাসনে বসেন ১৪৮৫ শকের শেষ দিকে। তাঁর ১৪৮৬ শকের (১৫৬৪ খ্রীঃ) গরুড়বাহিত বিষ্ণু মূর্তি ও ১৪৮৭ শকের (১৫৬৫ খ্রীঃ) সিংহমূর্তি অঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া গেছে। মুদ্রায় রানী রত্নাবতীর নাম আছে।

অনন্তমাণিক্যকে হত্যা করে তাঁর স্বশুর গোপীপ্রসাদ শাসন এবং উদয়মাণিক্য নামে সিংহাসনে বসেন বেশ কিছুকাল পরে। ১৪৮৯ শক। রানীর নাম হীরাবতী। ক্ষমতা দখল করেন তাঁর মুদ্রার তারিখ উদয়মাণিক্য রত্বপুর থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন চন্দ্রপুরে। রাজার নামে রাজধানীর নতুন নাম হয় উদয়পুর। ‘রাজমালা’র মতে উদয়মাণিক্যের রাজত্বকালে মোগল সৈন্য চট্টগ্রাম অধিকার করে নেয়। পরবর্তী রাজা প্রথম জয়মাণিক্যের মুদ্রা থেকে জানা যায় উদয়মাণিক্য প্রায় সাত-আট বৎসর রাজত্ব করেন।

জয়মাণিক্য ওরফে লোকতর ফা-র রাজত্বকাল চার বৎসরের বেশি স্থায়ী হয়নি। তিনি দেবমাণিক্যের পুত্র অমরমাণিক্যের হাতে নিহত হন।

দ্বিতীয় বিজয়মাণিক্যের পর ত্রিপুরার উল্লেখযোগ্য রাজা অমরমাণিক্য। তাঁর ১৪৯৯ শকের (১৫৭৭ খ্রীঃ) অভিষেক মুদ্রায় রানী অমরাবতীর নাম আছে। অমরমাণিকা শ্রীহট্ট বিজয়ের পর ১৫০৩ শকে (১৫৮১ খ্রীঃ) শ্রীহট্ট বিজয় উল্লেখে মুদ্রা প্রচার করেন। ইতিপূর্বে ১৫০২ শকের এক মুদ্রায় ‘দিগ্বিজয়ী’ বিরূদ থেকে ‘রাজমালা’য় বর্ণিত অমরমাণিক্যের ভুলুয়া, বাকলা, সরাইল, তরপ প্রভৃতি স্থানের জমিদারদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার সম্ভব বলে মনে হয়। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে অমরমাণিকা আরাকানের রাজা মেং ফলুং (সিকান্দার শাহ)-এর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি একদিকে আরাকানী ফৌজ ও অন্যদিকে বাংলার সুবেদারের আক্রমণ প্রতিহত করেন।

১৫০৮ শকে আরাকানী সৈন্যদলের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের কিছুকাল পরে অমরমাণিক্য আত্মহত্যা করেন ও তাঁর পুত্র প্রথম রাজধরমাণিক্য বসেন সিংহাসনে। রাজধরের ১৫০৮ শকের মুদ্রায় মহিষী সত্যবতীর নাম পাওয়া যায়। মগ- পরিত্যক্ত উদয়পুরে রাজধরমাণিক্য ধর্মচিন্তায় এতই বিভোর হয়ে পড়েন যে তাঁকে দিবারাত্র কীর্তন শোনাবার জন্য আটজন ব্রাহ্মণ নিযুক্ত হ’ন। এই প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে রাজ্যে আবার মোগল উৎপাত শুরু হয় এবং পরবর্তী রাজা যশোধরমাণিক্যের রাজত্বকালে রাজ্যে চরম বিপর্যয় দেখা দেয়।

যশোধরমাণিক্যের ১৫২২ শকে উৎকীর্ণ ‘বংশীবাদক কৃষ্ণমূর্তি’ সমন্বিত মুদ্রা প্রমাণ করে যে, পিতার মত যশোধরও ছিলেন বিষ্ণুভক্ত। তাঁর মুদ্রায় লক্ষ্মী, গৌরী, জয়া নামে একাধিক মহিষীর নাম আছে। রাজধরমাণিক্যের সময়ে রাজ্যে মোগল উৎপাতের কথা আগেই বলা হয়েছে। ঐ উৎপাত ১৬১৮ খ্রীষ্টাব্দে ব্যাপক আক্রমণ রূপে দেখা দেয়। মোগল সুবেদার ইব্রাহিম খাঁ ফতে জঙ্গ স্থল ও জলপথে ত্রিপুরা আক্রমণ করেন দিল্লীর দরবারে রাজস্ব হিসাবে হাতী না পাঠানোর অজুহাতে।

‘বাহার-ই-স্তান-ঘাইবী’-র বর্ণনা অনুসারে ত্রিপুরার বিরুদ্ধে ছ’টি স্থলবাহিনী ও একটি নৌবাহিনী পাঠানো হয়। প্রথম স্থল বাহিনীতে মীর্জা ইসফানদিয়া-র নেতৃত্বে ২৭০০ অশ্বারোহী, চার হাজার গোলন্দাজ ও কুড়িটি রণহস্তী ছিল। মীর্জা মুরউদ্দীন-এর নেতৃত্বে গঠিত দ্বিতীয় স্থলবাহিনীতে ছিল তিন হাজারেরও বেশী অশ্বারোহী, পাঁচহাজার গোলন্দাজ ও পঞ্চাশটি রণহস্তী। এ ছাড়া নৌসেনাধ্যক্ষ বাহাদুর খাঁর অধীনে তিন হাজার রণতরী সমন্বিত এক বিপুল নৌবাহিনীও এগিয়ে আসে স্থলবাহিনীর সহায়তা করতে।

 

 

ঐ বিপুল শত্রুবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশে ত্রিপুরার রাজা মাত্র একহাজার অশ্বারোহী, ছয় হাজার পদাতিক ও দুই হাজার রণহস্তী নিয়ে রুখে দাঁড়ান। ত্রিপুরার রাজার উদ্দেশ্য ছিল রাতের অন্ধকারের সুযোগে অতর্কিতে উদয়- পুরে মীর্জা ইস্কানদিয়া-র শিবির আক্রমণ করা। উদয়পুরের পথে দ্বিতীয় মোগল- বাহিনীরও সন্ধান পেয়ে রাজা উদয়পুরে পৌঁছে দ্বিতীয় মোগল নৌবাহিনীর গতি- রোধের চেষ্টা করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং রাজা যশোধরমাণিক্য মীর্জা মুরউদ্দীনের হাতে বন্দী হন। মীর্জা নুরউল্লাকে উদয়পুরে মোগল থানাদার হিসাবে নিযুক্ত করে বিজয়ী সেনাপতি ইব্রাহিম খাঁ ১৬১৮ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে হাতির পাল ও রাজবন্দীদের নিয়ে উদয়পুর ত্যাগ করেন। রাজা প্রথমে কাশী ও পরে মথুরায় নির্বাসিত হন।

উদয়পুরে মোগলদের স্বল্পকালীন অবস্থানের সাক্ষ্য হিসাবে গোমতী নদীর উত্তরতীরে একটি অসমাপ্ত ভগ্ন মসজিদ আজও দেখা যায়। লোকে এই মসজিদকে ‘মোগল মসজিদ’ বলে জানে। এছাড়া শ্রীহট্টের বিখ্যাত সন্ত বদর আউলিয়ার সম্মানে মোগলদের তৈরী ‘বদর মোকাম’ আজও উদয়পুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। ‘রাজমালা’র মতে ত্রিপুরার পশ্চিম সমতল এলাকা এইভাবে দুই বৎসর মোগলদের অধীনে থাকে। ১৯২৮ শ্রীষ্টাব্দে উদয়পুরের শাসনকর্তা গুরউল্লার নামে হরনগর নামে একটি নতুন পরগণা সৃষ্টি হয় এবং অধিকৃত চারটি পরগণা (উদয়পুর সহ) নিয়ে গঠিত হয় সরকার উদয়পুর। মোগলবাহিনী নাকি মহামারীর উপদ্রবে উদয়পুর ত্যাগ করে। ১৬২৬-২৭ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন মহামাণিক্যের পুত্র গগন ফা-র বংশোদ্ভব কল্যাণমাণিক্য। কল্যাণমাণিক্যের ১৩৪৭ শকের (১৬২৫-১৬২৬ খ্রীঃ) সিকি, অর্ধ ও পূর্ণ টঙ্ক মূদ্রা পাওয়া গেছে। পূর্ণমুদ্রায় রানী কলাবতী ও তাম্রলিপিতে অপর রানী সহরবতীর নাম দেখা যায়। কল্যাণমাণিক্যের মুদ্রার বিপরীত দিকে শিবলিঙ্গ খোদিত। কল্যাণমাণিক্যের রাজত্বকাল ত্রিপুরার ইতিহাসে কয়েকটি কারণে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কামিং সাহেবের মত অনুসারে বাংলার শাসনকর্তা সুজাউদ্দৌল্লা কল্যাণমাণিক্য রাজা হওয়ার সময় ত্রিপুরা আক্রমণ করলেও সম্রাট শাজাহান দিল্লীর সিংহাসনে বসার (১৯২৮ খ্রীঃ) আগে বিশেষ সুবিধা করতে পারেন নি। সম্ভবতঃ ১৬২৮ শ্রীষ্টাব্দেই চারটি পরগণা সমন্বিত সরকার উদয়পুরের জমিদারী সত্ত্ব ১৯,৮৬০ টাকা বার্ষিক রাজস্ব প্রদানের শর্তে কল্যাণমাণিক্যকে দেওয়া সাব্যস্ত হয়। এর অর্থ কল্যাণমাণিক্য বেশিদিন মোগল প্রাধান্ত অস্বীকার করতে পারেন নি। ১৬২৮ খ্রীষ্টাব্দের চুক্তি এই কথাই প্রমাণ করে যে কল্যাণমাণিক্যকে অচিরেই সুজাউদ্দৌল্লার বক্তৃতা স্বীকার করতে হয়।

কল্যাণমাণিক্যই ত্রিপুরার প্রথম রাজা যিনি বাংলা ভাষায় তাম্রশাসন প্রদান দুরু করেন। ১৫৬৩ শকে (১৬৪১, খ্রীঃ) প্রদত্ত তাম্রলিপি এ যাবৎ প্রাপ্ত কল্যাণমাণিক্যের প্রাচীনতম তাম্রলিপি। এই সব তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিকর জমি দান করে জঙ্গলাকীর্ণ মুরনগর পরগণায় বসতি গড়ে তোলেন। নিজে শৈবধর্মাশ্রিত হলেও কল্যাণমাণিক্য ১৫৭৩ শকে (১৬৫১ খ্রীঃ) উদয়পুরে গোপীনাথের মন্দির নির্মাণ করেন এবং তাঁর নির্দেশে দুই সুযোগ্য পুত্র গোবিন্দদেব ও জগন্নাথদেব মাতা সহরবতীর স্বর্গকামনায় বিষ্ণুমন্দির নির্মাণ করেন। ‘রাজমালা’র মতে কল্যাণমাণিক্য ধর্মঠাকুরের নামে একটি মঠও নির্মাণ করান এবং তুলা-পুরুষ দান উপলক্ষে সোনা-দানা, হাতি-ঘোড়াও দান করেন।

১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পর গোবিন্দমাণিক্য রাজা হন। তাঁর ঐ বৎসরের সিকি ও পূর্ণ টঙ্ক মুদ্রায় শিবলিঙ্গ অঙ্কিত দেখা যায়। তাঁর সিংহাসনারোহণের সময় নিয়ে মতভেদ আছে কিন্তু ১০৭০ ত্রিপুরাদের এক তাম্রলিপি ও মন্দিরলিপির ভিত্তিতে বলা যায় যে ১৫৮২ শকের বৈশাখ মাসেই তিনি সিংহাসনে বসেন। ‘রাজমালা’র মতে কল্যাণমাণিক্য শেষদিকে রাজ্যশাসনের দায়িত্ব যুবরাজ গোবিন্দের উপর ন্যস্ত করে ধর্মচর্চায় দিন কাটান। যুবরাজ গোবিন্দের ১৬৫৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রদত্ত তাম্রশাসনে ‘রাজমালা’র মন্তব্যের সমর্থন মেলে।

গোবিন্দমাণিক্য সিংহাসনে বসার পর একজন প্রতিনিধিকে নবাব দরবারে (মুর্শিদাবাদ) পাঠাতে হয়। এই প্রথাকে বলা হয় ‘তুল’ প্রথা। বৈমাত্রেয় ভাই ছত্রমাণিক্যকে প্রতিভূস্বরূপ মুর্শিদাবাদে পাঠানো ছাড়াও গোবিন্দমাণিক্যকে রাজস্ব হিসাবে পাঁচটি করে হাতি পাঠাতে রাজী হতে হয়। এ সত্বেও মোগল রাজশক্তি তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ইতস্ততঃ করেন নি যখন ছত্রমাণিক্য বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ অর্থাৎ হাতির সংখ্যা বৃদ্ধি করার শর্তে মোগল সহায়তায় ত্রিপুরার রাজা হতে চান। ছত্রমাণিক্য শুধু মোগলদের কাছ থেকেই সৈন্য সহায়তা পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। দেবালয়ে পূজার বলি বন্ধ করার জন্য রাজাদেশ জারী হওয়ার ফলে রাজা ও পুরোহিত প্রধান চণ্ডাই-এর মধ্যে বিরোধ বাধে। চণ্ডাই রাজার বিরুদ্ধাচরণের জন্য ছত্রমাণিক্যের পক্ষাবলম্বন করেন এবং প্রজাদের মনে রাজার প্রতি বিদ্বেষ সংক্রমণে তৎপর হন। ছত্রমাণিক্য সেই সুযোগে মোগলবাহিনীর সহায়তায় ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। ‘রাজমালা’র মতে গোবিন্দমাণিক্য ভ্রাতৃবিরোধ এড়ানোর জন্য বিনা বাধায় সিংহাসন ও দেশত্যাগ করেন। কিন্তু কৈলাসচন্দ্র সিংহের মতে গোবিন্দমাণিক্য রাজধানী ত্যাগ করলেও তাঁর পুত্র রামদেবমাণিক্য ছত্রমাণিক্যকে স্বসৈন্যে বাধা দেন এবং পরাজিত হয়ে উদয়পুর ত্যাগ করেন।

নক্ষত্রদেব ছত্রমাণিক্য নামে ১৫৮৩ শকে মুদ্রা প্রচার করেন। গোবিন্দমাণিক্য ও জগন্নাথমাণিক্য কর্তৃক ১৫৮৩ শকের কার্তিক মাসে নির্মিত বিষ্ণুমন্দিরের শিলালিপি প্রমাণ করে যে, নক্ষত্রমাণিক্য তখনো পর্যন্ত ত্রিপুরা আক্রমণে উদ্যত হন নি।

ছত্রমাণিক্যের রাজত্ব, পাঁচ-ছয় বৎসর স্থায়ী হয়েছিল। তাঁর শাসনকালে ত্রিপুরার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যায় সেই সময়ে ভারত পর্যটনকারী ফরাসী পরিব্রাজক ট্যাভারনিয়ের বিবরণে। তাঁর মতে ত্রিপুরায় বিদেশীদের উপযুক্ত কোন জিনিস নেই। সেখানে সোনার খনি আছে বটে তবে সে সোনা নিকৃষ্ট ধরনের। এ ছাড়া খুব নিকৃষ্ট ধরনের রেশমও পাওয়া যায়। ঐ উৎপন্ন সোনা ও রেশম রাজা চীনদেশে পাঠান ও তার বিনিময়ে আমদানী করেন রূপা। ঐ রূপায় ত্রিপুরার মুদ্রা তৈরি হয়। প্রজাদের কাছ থেকে রাজা কোন কর আদায় করেন না, তবে সাধারণ প্রজাদের রাজার খনি বা রেশম খামারে বৎসরে ছয়দিন কাজ করতে হয়।

ছত্রমাণিক্যের রাজত্বকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো হালাম উপ- জাতীয়দের ‘সেঙ্গচাম’ বা ‘সাঙ্গাচেপ’ সম্প্রদায়ভুক্তদের বশীভূত রাখার উদ্দেশ্যে ১৫৮৪ শকে একটি ধাতুনির্মিত অশ্বারোহী যোদ্ধমূর্ত্তি প্রদান। ঐ অশ্বপৃষ্ঠে প্রাক্তন রাজা বিজয়মাণিক্যের (যিনি সাখাচেপ ও থাঙ্গাচেপ সম্প্রদায় দু’টিকে রাজার প্রসন্নতার নিদর্শন হিসাবে ধাতুনির্মিত হস্তী ও ব্যাঘ্র মূর্তি প্রদান করেন) নাম, হালাম সম্প্রদায়ের নাম, সর্দারের নাম ও ছত্রমাণিক্য কর্তৃক উপহার প্রদানের উল্লেখ আধা সংস্কৃত ও আধা বাংলায় উৎকীর্ণ করা হয়। ঐ প্রতীকগাত্রের লিপি থেকে আরও জানা যায় যে ছত্রমাণিক্য ‘ত্রিপুরেন্দ্র’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।

১৬৬৭ খ্রীষ্টাব্দের শেষ দিকে ছত্রমাণিক্যের মৃত্যুর পর গোবিন্দমাণিক্য দ্বিতীয়বার সিংহাসনে বসেন। ঐ সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যে মোগল প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিলালিপি থেকে জানা যায়, গোবিন্দমাণিক্যের অন্যতম মহিষী গুণবতীদেবী উদয়পুরে তিনটি বিষ্ণুমন্দির স্থাপন করেন। গোবিন্দমাণিকা মেহেরকুল পরগণায় বহু নিষ্কর জমি দান করেন। ১০৮৩ ত্রিপুরাদের ২২শে কার্তিক প্রদত্ত এক তাম্রলিপি থেকে জানা যায় তিনি ১৬৭৬-৭৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। রামদেব কর্তৃক পুনর্নবীকৃত ১৫৯৮ শকের ১লা চৈত্রের তাম্রলিপি থেকে গোবিন্দের মৃত্যু ও রামদেবের রাজা হওয়ার সঠিক তারিখ মেলে।

গোবিন্দমাণিক্যের পূর্বোক্ত তাম্রলিপি ও রামদেব মাণিক্যের ১৫৯৮ শকের মুদ্রা থেকে জানা যায় তিনি ১৬৭৭ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। রামদেবমাণিক্য রাজা হওয়ার পর সামরিক শক্তিবৃদ্ধি করে ১৬৮২ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে শ্রীহট্ট আক্রমণ করেন।

কিন্তু মোগলদের কাছে পরাজিত হয়ে দিল্লীর বাদশাহকে তিনটি হাতী ভেট দিয়ে খুশি করতে হয় তাঁকে। বহুপ্রাচীন তথাকথিত ত্রিপুরা সুন্দরী দেবীর মন্দিরের সংস্কার ও বিষ্ণুমন্দির প্রভৃতি নির্মাণ রামদেব মাণিক্যের অন্যতম স্মরণীয় কীতি।

রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে রামদেবমাণিক্য চিরাচরিত কুলপ্রথাগত ‘যুবরাজ’ পদ ছাড়াও ‘বড়ঠাকুর’ নামে একটি নতুন পদ সৃষ্টি করেন। অদূর ভবিষ্যতেই এই পদটি সিংহাসন নিয়ে অন্তদ্বন্দু ও মামলা মোকদ্দমার প্রধান কারণ হয়ে উঠে।

দ্বিতীয় রত্নমাণিক্যের ১৬০৭. শকের মুদ্রা পাওয়া গেছে। ঐ মুদ্রা ছাড়াও ঐ শকে অর্থাৎ ১৬৮৫ খ্রীষ্টাব্দের এক তাম্রলিপি থেকে তাঁর রাজত্ব সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ঐ তাম্রশাসনে রত্নমাণিক্যকে ‘নূপকূল-তিলক’ বলে অভিহিত করা হয়। তাঁর বিভিন্ন তাম্রলিপির বয়ান থেকে অনুমান করা যায় যে, সে সময় ত্রিপুরার রাজনৈতিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয় ও রাজা মোগল-প্রভাব অনেকাংশে কাটিয়ে উঠতেও সমর্থ হন। তাঁকে শুধু নুরনগর পরগণার জন্যই জমিদার হিসাবে রাজস্ব দিতে হতো এবং সেই রাজস্বও রাজাকে ফিরিয়ে দেওয়া হতো সামরিক জায়গীর হিসাবে। তিনি সুরনগর পরগণায় ভূসম্পত্তি দান করেন।

রত্নমাণিক্যের রাজত্বকালে যুবরাজ চম্পকরায় সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন। রত্নমাণিক্যের পিতার রাজত্বকালের শেষ দিকে নরেন্দ্রমাণিক্য ওরফে দ্বারিকাঠাকুর সাময়িকভাবে সিংহাসন অধিকার করেন কিন্তু পরে মোগল সহায়তায় রামমাণিক্য সিংহাসন ফিরে পান ও নরেন্দ্র ঢাকায় কারারুদ্ধ হন। নরেন্দ্র ঐ অপমান ভুলতে পারেননি। রত্নমাণিক্যের রাজত্বের গোড়ার দিকে মোগল কর্তৃপক্ষকে বেশি রাজস্ব প্রদানের প্রলোভনে বশীভূত করে ১৬১৫ শকে আবার সিংহাসন দখল করেন। এই দুর্দৈবকালে রত্নমাণিক্য বনে আশ্রয় নেন। যুবরাজ চম্পকরায় ঢাকায় গিয়ে মোগল কর্তৃপক্ষকে খুশি করেন ও মোগল সৈন্যের সহায়তায় নরেন্দ্রকে চণ্ডিগড়ের যুদ্ধে পরাজিত করেন। প্রায় দুই বৎসর পরে রত্নমাণিক্য আবার সিংহাসন ফিরে পান আর নরেন্দ্র আবার ঢাকায় বন্দী থাকেন। রত্ন- মাণিক্য যে ১৬১৭ শকের (১৬৯৫ খ্রীঃ) আশ্বিন মাসের আগেই ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি আত্ম- বিক্রয়ের দলিল থেকে।

দ্বিতীয় রত্নমাণিক্যের রাজত্বকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো আসামের রাজার সঙ্গে দূত বিনিময়। আসামের রাজা স্বর্গদেও রুদ্রসিংহ মোগলদের বিরুদ্ধে হিন্দু রাজাদের ‘ঐক্যবদ্ধ করার এক পরিকল্পনামত ত্রিপুরার রাজার সমর্থন ও সখ্য কামনা করেন। সেই যুগে রাজনৈতিক স্বার্থে আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের ঐ যোগাযোগ উল্লেখযোগ্য। ঐ যোগাযোগের সূত্রপাত ১৭০৯ খ্রীষ্টাব্দে। আসাম-রাজের দূত দ্বিতীয়বার ত্রিপুরায় আসেন ১৭১২ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে। তাঁদের থাকাকালেই রত্নমাণিক্য আবার সিংহাসন-চ্যুত হন তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই ঘনশ্যাম বড়ঠাকুরের ষড়যন্ত্রের ফলে। ঘনশ্যামঠাকুর মে মাসে মহেন্দ্রমাণিক্য নামে সিংহাসন দখল করেন। মহেন্দ্রের ১৬৫৪ শকের (১৭১২-১৩ থীঃ) মুদ্রা পাওয়া গেছে।

আসামের দূতেরা তৃতীয়বার ত্রিপুরায় আসেন ১৭১৫ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। তখন দ্বিতীয় ধর্মমাণিক্য ত্রিপুরার রাজা। তাঁর ১৬৩৬ শকের (১৭১৪-১৫ খ্রীঃ) মুদ্রা পাওয়া গেছে। ১৭১৫ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে আসামের দূতগণ ত্রিপুরা ত্যাগ করেন। প্রায় নয় বৎসর পরে তাঁদের ত্রিপুরা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতার বিবরণ ‘ত্রিপুর দেশের কথালেখ’ প্রকাশিত হয়। ঐ বিবরণ থেকে সমকালীন ত্রিপুরা রাজ্যের ভৌগোলিক, অর্থনীতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার দুর্লভ চিত্র পাওয়া যায়।

আসামের দূত ত্রিপুরায় আসেন কাছাড়ের মধ্যে দিয়ে। কাছাড়ের রাজধানী তখন খাসপুর। খাসপুর থেকে আসার পথে রাঈরুঈ, তৈজলপাড়া, কুমজঙ্গ, দেওগাঙ্গ প্রভৃতি পর্বতশ্রেণী তাঁদের অতিক্রম করতে হয়। সেই সময় ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রাঈরুঈ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রূপিণী নদী ছিল ত্রিপুরা ও কাছাড় রাজ্যের সাধারণ সীমানা। আসামের দূতেরা ১৬৩২ শকাব্দের (১৭১০ খ্রীঃ) আষাঢ় মাসে পৌঁছান কৈলাসহর পরগণায়। সেখান থেকে রাজধানী উদয়পুর ছিল তখন আটদিনের পথ।

সে সময় ত্রিপুরার অধীনস্থ এলাকা রাঈরুঈ ছিল মণিপুর-কাছাড় ও ত্রিপুরার এক আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য কেন্দ্র। ঐ বাণিজ্য কেন্দ্রে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে পিতল, তামাক পাতা, শুকনা সুপারী, শুটকী মাছ প্রভৃতি দ্রব্য- সামগ্রী বিক্রীর জন্য পাঠানো হতো। সেখানে ছিল হালাম উপজাতীয়দের বাস। উপজাতীয় সর্দার ছাড়াও সেখানে রাজার লস্কর নামে কর্মচারী থাকতো। হালাম এলাকার পর কুকি এলাকা। সেই এলাকার রাজার পক্ষ থেকে ক্ষমতা প্রয়োগকারী সর্দারকে বলা হতো মুন্নী। এই সব পর্বতে বসবাসকারী উপজ্ঞাতীয়দের রাজাকে কর হিসাবে প্রতি বৎসর হাতীর দাঁত, খেস কাপড়, গোলমরিচ, কার্পাস ও গবয় দিতে হোত। আসামের দূতেরা মনু নদী পার হয়ে কেপায় উপস্থিত হন। কের্পা থেকে রাজধানীর নিকট পর্যন্ত বসবাসকারী লোকদের বলা হতো ত্রিপুরা। তাঁরা বার্ষিক চার টাকা করে কর দিতেন রাজাকে।

আসামের দূতেরা ত্রিপুরা রাজ্যের শাসনব্যবস্থার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা থেকে জানা যায় রাজাই তখন প্রশাসনের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। পদমর্যাদায় যুবরাজের স্থান রাজার পরেই। যুবরাজের আদেশ রাজ্যের সর্বত্র কার্যকর হয়। কর ও খাজনা, জিনিসপত্র, হাতী-ঘোড়া, সিপাহী ইত্যাদির ব্যবস্থা করতেন তিনি। যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালনার দায়িত্বও ছিল যুবরাজের।

বড়ঠাকুরের পদ যুবরাজের নিচে। অধঃস্তন পদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে উজীর নাজীর, নেমুজীর অর্থাৎ নায়েব-উজীর ও কোতোয়ালের নাম উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া একজন হিন্দু দেওয়ানও ছিলেন। দেশদেশান্তর থেকে আগত লোকজনের সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বলতেন এবং রাজ্যের যাবতীয় লেখাপড়ার কাজ চালাতেন। যাবতীয় রাজভাণ্ডারের উপর কর্তৃত্ব করতেন খানসামা বড়ুয়া। ত্রিপুরার শাসন ব্যবস্থা মোটামুটি আসাম রাজ্যের মতই ছিল বলা যায়।

‘ত্রিপুর দেশের কথালেখ’ ত্রিপুরা রাজ্যের আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্বন্ধে নানা নির্ভরযোগ্য তথ্যে সমৃদ্ধ হলেও রাজবংশের যে ক্রমপঞ্জী এই বিবরণে স্থান পেয়েছে রাজাদের মুদ্রার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তা গ্রহণীয় নয়। এই বিবরণমতে রাজা রত্নমাণিক্য এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁর পুত্র অমরমাণিক্য তাঁর স্থানাভিষিক্ত হন। তবে দ্বিতীয় রত্নমাণিক্যের সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনার বিবরণ অবশ্যই বহুলাংশে নির্ভরযোগ্য।

মহেন্দ্রমাণিক্যের ১৬৫৪ শকের (১৭১২-১৩ খ্রীঃ) মুদ্রা পাওয়া গেছে। আসামের দূতেরা দ্বিতীয়বার ত্রিপুরায় আসেন ১৭১২ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে।

তাঁদের ত্রিপুরায় অবস্থানকালেই রাজার বৈমাত্রেয় ভাই ঘনশ্যাম বড়ঠাকুর ঢাকার মুরাদ বেগ ও মীর্জা মহম্মদ সফি চম্পক রায়ের সময় পাওনা হাতী না পাঠানোর অজুহাতে ঘনশ্যাম ঠাকুরের সঙ্গে সসৈন্যে রাজধানীতে উপস্থিত হন এবং বিনা বাধায় রত্নমাণিক্য বন্দী হন এবং মহেন্দ্রমাণিক্য নামে ঘনশ্যাম ঠাকুর সিংহাসন দখল করেন। মহেন্দ্রমাণিক্যের আদেশে রত্নমাণিক্যকে হত্যা করা হয়। মহেন্দ্রমাণিক্য এক বৎসর দুই মাস রাজত্বের পর পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর দুর্জয়সিংহ যুবরাজ ধর্মমাণিক্য নামে সিংহাসনে বসেন। ধর্মমাণিক্যের ১৬৩৮ শকের (১৭১৪-১৫ খ্রীঃ) মুদ্রা পাওয়া গেছে। তিনি এক-চতুর্থাংশ থেকে এক-বত্রিশাংশ পর্যন্ত বিভিন্ন মূল্যের মুদ্রা প্রচারের কৃতিত্ব দেখান। এই সব মুদ্রা সম্ভবতঃ কড়ির পরিবর্তে ব্যবহৃত হত। দ্বিতীয় ধর্মমাণিক্যের রাজত্বকাল ছিল সংঘাতবহুল। রাজা হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই (১৭১৫-১৬ খ্রীঃ) যে তিনি জমিদারী সত্ত্ব হারান তার প্রমাণ পাওয়া যায় জনৈক মুরাদ বেগের তালুকদারী বণ্টনের কাগজপত্র থেকে। ঐ মুরাদ বেগ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে নুরনগরের নাম মুরাদনগরে পরিবর্তন করে। ধর্মমাণিক্যের ১৭১৫- ১৬ খ্রীষ্টাব্দে ভূমিদানের উল্লেখ পাওয়া যায় কৈলাসহর পরগণায়। তিনি যে কয়েক বৎসরের মধ্যে জমিদারী সত্ত্ব ফিরে পান তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৭২২ খ্রীষ্টাব্দে মেহেরকুল পরগনায় ভূমিদানের সনদ থেকে।

 

নবাব দরবারে বার্ষিক রাজস্ব হিসাবে হাতী পাঠানো বন্ধ করে ধর্মমাণিক্য মোগলদের বিরাগভাজন হন এবং সেই সুযোগে ভাগিনেয় জগতরাম প্রথমে মগদের সহায়তায় ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। সে আক্রমণ অবশ্য রাজসৈন্য প্রতিহত করে। তারপর জগতমাণিক্য বেশি হাতী দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোগল সাহায্য প্রার্থনা করেন। মোগল সেনাবাহিনী নিয়ে মীর হাবিব অতর্কিতে রাজধানী আক্রমণ করলে রাজসৈন্য ছত্রভঙ্গ হয় এবং রাজা পর্বতে আশ্রয় নেন। এইভাবে সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্য মোগল অধিকারভুক্ত হয়। জগতমাণিক্য রাজা হন বটে তবে মোগল পক্ষের একজন থানাদারও নিযুক্ত করা হয়। মীর হাবিব বহু হাতী ও লুণ্ঠিত ধনসম্পদ নিয়ে ঢাকায় ফিরে যান।

 

মীর হাবিবের ত্রিপুরা আক্রমণ ও জগতমাণিক্যের রাজত্বকাল সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। কিন্তু জগতমাণিক্যের আদেশে মুকুন্দ কর্তৃক ‘ক্রিয়াযোগসার’-এর বাংলা অনুবাদ থেকে জানা যায় যে জগতমাণিক্য ১৬৪৭ শকের (১৭২৫-২৬ খ্রীঃ) শেষ দিকে সিংহাসন লাভ করেন। সুতরাং মীর হাবিবের ত্রিপুরা আক্রমণ নিঃসন্দেহে এর পূর্ববর্তী ঘটনা।

চাকলা রোশনাবাদের জরিপ ও বন্দোবস্ত-এর বিবরণ প্রণেতা কামিং সাহেবের মতে মহম্মদ শাহের রাজত্বকালে বাংলার শাসনকর্তা মুর্শিদকুলি খাঁ ১৭২২ খ্রীষ্টাব্দে সরকারগুলিকে বিভিন্ন চাকলার অন্তভুক্ত করেন। সেই সময় সরকার উদয়পুর ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। ত্রিপুরা রাজ্যের উপর মোগল রাজশক্তির প্রাধান্য সে সময় যে কতখানি বৃদ্ধি পায় তা জানা যায় ত্রিপুরার রাজাকে ‘নজর’ প্রদান করে ‘খেলাত’ গ্রহণের প্রথা থেকে।

১৭২৮-২৯ খ্রীষ্টাব্দে ধর্মমাণিক্য আবার সিংহাসন ফিরে পান এবং জগতমাণিক্য সুজাউদ্দীন কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয় এবং চন্দ্রমণিঠাকুর মুকুন্দমাণিক্য নামে রাজা হন। এই সময় থেকেই ত্রিপুরার সিংহাসন নিয়ে রাজবংশীয়দের মধ্যে প্রবল অন্তদ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্র শুরু হয় এবং মোগল কর্তৃপক্ষ তাতে পুরাপুরি ইন্ধন যোগাতে থাকেন। জানা যায় না। সম্ভবতঃ কোন হন এবং পরে আত্মহত্যা করেন। সংক্রান্ত সনদ পাওয়া গেছে। মুকুন্দমাণিক্যের রাজত্বকাল সম্বন্ধে বিশেষ কিছু আক্রমণকালে তিনি মোগল সৈন্তের কাছে বন্দী মুকুন্দমাণিক্যের ১৭২৯-৩০ খ্রীষ্টাব্দে ভূমিদান দ্বিতীয় জয়মাণিক্যের ১৬৬১ শকের (১৭৩৯-৪০ খ্রীঃ) মুদ্রা তাঁর সিংহাসনে বসার সময় সূচিত করে। সনদ থেকে জানা যায় তিনি কৈলাসহর পরগণায় ভূমিদান করেন। প্রায় পাঁচ বৎসর রাজত্ব করার পর মুকুন্দমাণিক্যের পুত্র পাঁচকড়ি ঠাকুর মোগল সহায়তায় জয়মাণিক্যকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন দখল করেন। (১৭৪৪ খ্রীঃ) প্রচারিত মুদ্রা থেকে জানা দ্বিতীয় ইন্দ্রমাণিক। ঠাকুর ইন্দ্রমাণিক্য নামে সিংহাসনে বসেন। ১৬৬৬ শকে যায় পাঁচকড়ি তিনি সুখে রাজ্যভোগ করতে পারেন নি, কারণ জয়মাণিক্য মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সিংহাসন পুনর্দখলের চেষ্টায় বারবার আক্রমণে ইন্দ্রমাণিক্যকে অস্থির করে তোলেন। তাছাড়া ইন্দ্রমাণিক্যের রাজত্বকালেই দক্ষিণ শিক পরগণার স্থানীয় প্রধান সমসের গাজী এক শক্তিশালী সৈন্যদল গঠন করে নিজেকে রোশনাবাদের শাসনকর্তা রূপে ঘোষণা করেন এবং কিছুকালের মধ্যেই উদয়পুর আক্রমণ ও লুঠতরাজ চালান। সমসেরের কাছে পরাজিত ইন্দ্রমাণিক্য রাজ্য ছেড়ে মুর্শিদাবাদ যাত্রা করলে গাজী নিজেকে উদয়পুরের রাজা বলে প্রচার করেন। সমসের সম্ভবত ১৭৪৬ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিপুরা অধিকার করেন। তখন তৃতীয় বিজয়মাণিক্য রাজা ছিলেন।

প্রথমদিকে প্রজাদের বিরোধিতা কৌশলে প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে গাজী নিজে সিংহাসনে না বসে দ্বিতীয় ধর্মমাণিক্যের প্রপৌত্র লক্ষ্মণমাণিক্যকে নামে রাজা করেন। বছর তিনেক পরে গাজী নিজে সিংহাসনে বসেন এবং নিজের শাসন ক্ষমতা স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে রোশনাবাদের রাজস্ব বেশি পরিমাণ ও নিয়মিত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। গাজীর রাজত্ব প্রায় সাত বৎসর চলেছিল। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিও সমসেরের রাজ্য অধিকারের অনুকূল ছিল। বর্গী দমনে ব্যস্ত নবাবের টাকার প্রয়োজন যে সবচেয়ে বেশি সে কথা উপলব্ধি করেই সমসের রোশনাবাদের রাজস্ব হিসাবে প্রচুর অর্থ প্রেরণ করেন।

অল্পকালের মধ্যেই তিনি শাসনব্যবস্থার সংস্কারে মন দেন এবং প্রত্যেক পরগনার জন্ম নতুন শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। প্রজাদের সুখসুবিধার জন্য তিনি এক সেরের ওজন বিরাশী সিক্কায় বেঁধে দেন এবং প্রত্যেক বাজারে প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের নির্দিষ্ট বিক্রয়মূল্যের তালিকা প্রদর্শন বাধ্যতামূলক ভাবে চালু করেন। ঐ তালিকা থেকে জানা যায় তখন চাল ও লংকার মূল্য ছিল সের প্রতি এক পয়সা, তেল সের প্রতি তিন আনা ও ঘি পাঁচ আনা। চাকলা রোশনাবাদের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু ব্যক্তি নিষ্কর জমি লাভ করেন গাজীর রাজত্বকালে।

ক্ষমতাপন্ন সমসেরের রাজত্বকালের শেষদিকে কিন্তু ত্রিপুরা, শ্রীহট্ট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি প্রভৃতি অঞ্চলে ডাকাতি, লুঠতরাজ ইত্যাদির ফলে ব্যাপক ত্রাসের সঞ্চার হয়। নানা অভিযোগের ফলে মুর্শিদাবাদের নবাবের আদেশে ঢাকার শাসনকর্তা সমসেরকে গ্রেপ্তার করে মুর্শিদাবাদে পাঠান। সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। ‘কৃষ্ণমালা’র মতে ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দে সমসের নিহত হন। সমসেরের রাজত্বকালেই ইংরেজ কোম্পানী ত্রিপুরার পাহাড়ে উৎপন্ন কার্পাসজাত বস্ত্রের বাণিজ্য করার জন্য সমতল ত্রিপুরায় দুটি বাণিজ্যাগার স্থাপন করেন। কিন্তু সমসেরের হত্যার পরে অবস্থার সহসা উন্নতি হয়নি কারণ আব্দুল রজক নামে তার প্রধান অনুগামী নিজেকে রোশনাবাদের শাতনকর্তা রূপে ঘোষণা করে রাজসৈন্যের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালাতে থাকে। অবশ্য কিছুকাল পরে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রজ্জক তেজপুর পালিয়ে যান। সেখানে ডাকাতির অপরাধে বন্দী ও নিহত হন।

রাজ্যে এই বিশৃঙ্খলা চলার সময় জয়মাণিক্যের ভাই হরিমণিঠাকুর মোগল সহায়তায় তৃতীয় বিজয়মাণিক্য নামে রাজা হন। অবশ্য প্রকৃত শাসনক্ষমতার অধিকারী হন মোগল খানদার।

মোগল কর্তৃপক্ষই আবার কৃষ্ণমণিঠাকুরকে ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে কৃষ্ণমাণিক্য নামে রাজা হতে সাহায্য করেন। রাজত্ব লাভের পরে উদয়পুর নিরাপদময় জেনে তিনি রাজধানী পুরানো আগরতলায় স্থানান্তরিত করেন। নবাবের অনুমোদন ক্রমেই সিংহাসনে বসলেও কৃষ্ণমাণিক্যের অবস্থা এমনই ছিল যে নবাবের সামান্য ফৌজদার পর্যন্ত তাঁকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল। কার্যত ত্রিপুরার রাজার চেয়ে নবাবের ফৌজদারের স্বার্থরক্ষার জন্য অনুরুদ্ধ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্তৃপক্ষ ত্রিপুরা অধিকারের জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠান। কোম্পানীর বাহিনী এসে পৌঁছানোর আগেই অবশ্য নবাবের দেওয়ান ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। ইংরেজ সেনাপতি ম্যাথুজ সসৈন্যে উপস্থিত হলে রাজা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। অতঃপর ত্রিপুরার রাজস্বের হিসাবনিকাশ করে প্রথম বছরের রাজস্ব এক লক্ষ এক সিকা টাকা ধার্য করা হয় এবং ত্রিপুরার প্রথম রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন র‍্যালফ, লিক। কৃষ্ণমাণিক্যকে গদীচ্যুত করে বলরামমাণিক্যকে রাজা করা হয়। ১৭৬৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার তদানীন্তন গভর্নর হ্যারী ভেরেলস্ট-এর সহায়তায় কৃষ্ণমাণিক্য আবার সিংহাসন ও জমিদারী ফিরে পান। কৃষ্ণমাণিকা জমিদারী লাভ করার পর মন্ত্রিদের এক একটি পরগণার শাসন কর্তৃত্ব দেন বলে ‘কৃষ্ণমালা’য় উল্লেখ আছে। অবশ্য ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে বাংলাদেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে ত্রিপুরার সমতল অংশের বেসামরিক কর্তৃত্ব ইংরেজ কোম্পানীর করতলগত হয়। কৃষ্ণমাণিক্য প্রদত্ত বহু নিষ্কর ভূমিদানের কাগজপত্র পাওয়া গেছে। তিনি এমন কি সমসের গাজী প্রদত্ত নিষ্কর দানও বহাল রাখেন। দ্বিতীয় রত্নমাণিক্যের আরজ ‘সতের রত্ন’ মন্দির নির্মাণের কাজ কৃষ্ণমাণিক্যের সময়ে শেষ হয়। ‘কৃষ্ণমালা’ কাব্য থেকে জানা যায় যুবরাজ হরিমণির মৃত্যু হলে কৃষ্ণমাণিক্য রাজধরকে স্বীয় উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।

কৃষ্ণমাণিক্যের মৃত্যু হয় ১৭৮৩ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে। ঐ সময়ে যুবরাজ রাজধর ডাকাত দলকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ইংরেজ সরকার কর্তৃক কারারুদ্ধ হন। কৃষ্ণমাণিক্যের রাণী জাহ্নবীদেবী রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। এবং প্রায় ছ’বছর শাসনকর্তৃত্ব পরিচালনা করেন। তখন সমতল ত্রিপুরার রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করতেন রেসিডেন্ট লিক সাহেব।

রাজধরের সঙ্গে রেসিডেন্ট লিক সাহেবের মতান্তর ক্রমশই তীব্র আকার ধারণ করে। লিক সাহেবের রিপোর্টের ভিত্তিতে ইংরেজদের চক্রান্তে রাজধরকে বহু নিগ্রহ সহ্য করতে হয়। ১৭৮১ শ্রীষ্টাব্দের ২৪শে ডিসেম্বরে বোর্ড অফ রেভিনিউর কাছে লেখা কমিটির চিঠি থেকে জানা যায় যে, রাজধরমাণিক্য ছ’বছর কলকাতা থাকাকালেও কিছুকাল কারারুদ্ধ ছিলেন। তাহলে কি তিনি একাধিকবার কারারুদ্ধ হন?

 

 

কৃষ্ণমাণিক্যের জীবিতকালেই রাজস্ব সংক্রান্ত ইংরেজ কালেক্টরের নির্দেশ লঙ্ঘনের জন্য রাজধরমাণিক্য সম্বন্ধে বোর্ড অফ রেভেনিউ যে কি ধারণা পোষণ করতেন তা জানা যায় বোর্ডের ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে মার্চ তারিখের কার্যবিবরণী থেকে। ঐ বিবরণীতে লেখা হয়: “A nephew of the Rajah who attended for the purpose of making the late settlement is now in Calcutta and has offered in the Rajah’s name to pay up a part of the balance immediately and give security for the reve- nues in future upon the express condition of the recall of the Resident.”

বোর্ডের কাছে পাঠানো লিক সাহেবের রিপোর্টে সমতল ত্রিপুরার কৃষকদের দলে দলে বাস্তুভিটা ছেড়ে যাওয়ার উল্লেখ করার সময়ে রাজস্ব বৃদ্ধি ছাড়াও রাজধরের কলিকাতা থাকার খরচ পূরণের জন্য আরও করবৃদ্ধির আশংকার উল্লেখ করলেও ইংরেজ কোম্পানীর রাজস্ব বৃদ্ধি ও আদায়ের জন্য পীড়াপীড়িই বোধহয় প্রজাদের বাস্তুত্যাগের প্রধান কারণ ছিল।

রাজধরমাণিক্যের বিরুদ্ধে ইংরেজ কর্মচারীদের ক্রোধ যতই পুঞ্জীভূত হচ্ছিল বোর্ড অফ রেভিনিউ-এর দপ্তরে তাঁর সম্বন্ধে অভিযোগের ফিরিস্তিও ততই বিচিত্র ও ব্যাপক আকার ধারণ করছিল। আলেকজাণ্ডার মেকেজীর মতে একদল ডাকাতকে আশ্রয়দানের অপরাধে ১৭৮৩ খ্রীষ্টাব্দে তাঁকে চট্টগ্রামে বন্দী রাখা হয়। ডেপুটি গভর্নর ১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দে ২৭শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের কাছে যে আদেশ পাঠান তাতে ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দ রাজধরমাণিক্যের গ্রেপ্তারের বৎসর হিসাবে উল্লেখিত। বোর্ড অফ রেভেনিউ-এর কাছে ১৭৯২ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিপুরার কালেক্টরকে লেখা চিঠিতে স্পষ্টই বলা হয় যে রাজধরের বিচার ও মুক্তির কারণ সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র পাওয়া যায় নি।

দ্বিতীয় রাজধরমাণিক্যের ১৭০৭ শকের (১৭৮৫-৮৬ খ্রীঃ) মুদ্রা থেকে তাঁর সিংহাসন লাভের কথা জানা যায়। সিংহাসনের অধিকার নিয়ে দুর্গামণি ঠাকুর তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করেন তার নিষ্পত্তি করেন ওয়ারেন হেস্টিংস। রাজধরমাণিক্যকে রাজা ও দুর্গামণিকে যুবরাজ বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আইনতঃ রাজা হলেও রাজধরমাণিক্যকে জমিদারীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এথেকেই বোঝা যায় যে জমিদারীর রাজস্ব নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে তখনো কোন বোঝাপড়া হয়নি। প্রায় দশ বৎসর পরে রাজধর- মাণিক্য জমিদারীর অধিকার লাভ করেন। তাঁর আমলে রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদের চর্চা হয়েছিল বলে জানা যায়।

রাজধরের মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে আবার মামলা সুরু হয় তাঁর পুত্র রামগঙ্গা ও দুর্গামণির মধ্যে। সদর দেওয়ানী আদালতের ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৩শে মার্চের রায় অনুসারে দুর্গামাণিক্য সিংহাসন পান। দুর্গামাণিক্যের সময় থেকেই ইংরেজ সরকার সিংহাসন প্রাপ্তির অনুমোদন হিসাবে ত্রিপুরার রাজাদের কাছ থেকে ‘নজর’ আদায় সুরু করেন।

দুর্গামাণিক্যের মৃত্যু হয় ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দে। তখন সিংহাসনের দাবীদার রামগঙ্গা ছাড়াও শম্ভুচন্দ্র এবং আরো অনেকেই। ব্রিটিশ আদালতের রায় অবশ্য রামগঙ্গার অনুকূলে যায় এবং রামগঙ্গামাণিক্য সিংহাসনে বসেন। কিন্তু শম্ভুচন্দ্র আদালতের রায় না মেনে পাহাড় জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে কুকিদের সহায়তায় ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধ চালান। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের অভ্যুত্থানেও তিনি ইন্ধন যোগান। ফলে তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পার্বত্য প্রজাদের সহায়তায় শম্ভুচন্দ্র আত্মগোপনে সমর্থ হন।

শ্রীহট্ট সীমান্তবর্তী রাজার এলাকার মধ্যে দিয়ে কিছু বৈরী কুকি প্রায়ই ইংরেজ শাসনাধীন শ্রীহট্টের গ্রামাঞ্চলে গিয়ে হানা দিত। এর ফলে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে রাজার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠে। ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ রাজাকে জানান যে, তাঁর এলাকাধীন বাজার নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন যাতে বহিরাগতরা শ্রীহট্টের গ্রামাঞ্চলে ঢুকতে না পারে। রাজার পক্ষ থেকে ঐ দায়িত্ব অস্বীকার করা হয়। ফলে ইংরেজদের পক্ষ থেকে ১৮২২ খ্রীষ্টাব্দে একতরফাভাবে রাজগী ত্রিপুরা ও ইংরেজ শাসনাধীন শ্রীহট্টের মধ্যবর্তী চা-বাগিচা সহ এক বিরাট সমতল এলাকা রাজার এক্তিয়ার বহির্ভূত বলে ঘোষণা করা হয়। এই ব্যাপারে রাজার প্রতিবাদ ইংরেজ কর্তৃপক্ষ অগ্রাহ্য করেন। ত্রিপুরার রাজবংশের ইতিহাস রচয়িতা স্যাণ্ডস্ সাহেব কুশিয়ারা নদীর দক্ষিণে রাজ্যের উত্তরাংশের এক বিস্তৃত এলাকাকে এইভাবে পৃথক করা ‘ত্রিপুরা শ্রীহট্ট সীমান্তে ভূখণ্ড ডাকাতি’ বলে বর্ণনা করেছেন।

কাশীচন্দ্রমাণিক্যের রাজত্ব তিন বৎসর মাত্র স্থায়ী হয়। তাঁর রাজত্বকালে (১৮২৭ খ্রীঃ) শম্ভুচন্দ্র ঠাকুর সিংহাসন দখলের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হিসাবে পচিশ হাজার টাকা জমায় পার্বত্য এলাকায় চাষাবাদের অনুমতি চান কিন্তু ইংরেজ সরকার পার্বত্য ত্রিপুরা রাজস্ব হিসাব বহির্ভূত স্বাধীন রাজ্যের অঙ্গ বিবেচনায় সে আবেদন অগ্রাহ্য করেন।

কৃষ্ণকিশোরমাণিক্যের ১৭৫২ শকের (১৮৩০ খ্রীঃ) মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। তিনি পুরানো আগরতলা থেকে রাজধানী বর্তমান স্থানে (নতুন হাবেলী) স্থানান্তরিত করেন। তিনি স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রায় ৬৩৯০ নজর দেন।

রাজ্যের অভ্যন্তরে ও জমিদারী চাকলা রোশনাবাদের মধ্যে বাঁশ, তুলা ইত্যাদির উপর রাজার শুল্ক আদায়ের অধিকারের যৌক্তিকতা নিয়ে ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে কোম্পানীর কর্মচারীদের মধ্যে বহু লেখালেখি চলতে থাকে। চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার ঐ অভিযোগে ত্রিপুরা দখলের কড়া সুপারিশও করেন। কিন্তু ১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দে ডেপুটি গভর্নর জেনারেল এক চিঠিতে অধঃস্তন কর্মচারীদের সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে পার্বত্য ত্রিপুরা স্বাধীন রাজ্য এবং রাজ্যের অভ্যন্তরে যে কোন প্রকার শুল্ক আদায়ে রাজার অধিকার অবশ্য স্বীকার্য।

কৃষ্ণকিশোরমাণিক্যের শাসনকালে রাজ্যের পূর্ব ও উত্তরাংশের পার্বত্য কুকি সম্প্রদায়ের একাংশ তাদের সর্দার শিব্বতের নেতৃত্বে নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে রাজকর দেওয়া বন্ধ করে। কুকি সম্প্রদায়ের জন্য অংশ অবশ্য বিদ্রোহে যোগ দেয় নি।

১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দে লাল চোক্কার নেতৃত্বে একদল কুকি মণিপুরের কোচাবাড়ি গ্রামে ব্যাপক নরহত্যা ও লুঠতরাজ চালায়। ব্রিটিশ সরকার কুকি দমনে ত্রিপুরার রাজার সাহায্য চান। রাজা তাঁর অক্ষমতা জানালে বিদ্রোহীদের পেছনে রাজার সমর্থন আছে এই সন্দেহে ক্যাপটেন ব্ল‍্যাকউডের নেতৃত্বে শ্রীহট্ট থেকে এক পদাতিক বাহিনী পাঠানো হয় ত্রিপুরায়। লাল চোকলার গ্রাম অবরুদ্ধ ও রসদ সরবরাহ বন্ধ করা হয়। আত্মসমর্পণের পর লাল চোকলার বিচার ও সাজা হয়।

কৃষ্ণকিশোরমাণিক্য শাসনকার্যে মন না দিয়ে আমোদ-আহলাদ, শিকার ইত্যাদিতে মত্ত থাকেন। ফলে তাঁর মৃত্যুকালে (১৮৪৯ খ্রীঃ) রাজ্য ও জমিদারীর অবস্থা হয়ে উঠে শোচনীয়।

সিংহাসনে বসার পর নানা অর্থনীতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ঈশানচন্দ্রমাণিক্যকে। কিন্তু নিজে কোন সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট না হয়ে তিনি গুরু বিপিনবিহারী গোস্বামীর হাতে রাজ্য শাসনের ভার ছেড়ে ‘দেন। গুরু পূর্বপ্রদত্ত বহু নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত করে রাজ্যের আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি করেন, কিন্তু নবনিযুক্ত দেওয়ান বলরাম হাজারী ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ত্রিপুরী সম্প্রদায় যুবরাজ উপেন্দ্রচন্দ্রের উস্কানীতে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহীরা পরীক্ষিৎ ও কীর্তির নেতৃত্বে বলরামের বাড়ী আক্রমণ করলে বলরাম পালিয়ে বাঁচে আর তার অনুগামী শ্রীদাম নিহত হয়। পরে অবশ্য বলরাম ধৃত ও কীর্তি নিহত হয় রাজার সমর্থকদের হাতে।

১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই ডিসেম্বর ৩৪ নং দেশী পদাতিক সৈন্যরা চট্টগ্রাম কোষাগার লুঠ করার পর ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা অভিমুখে যাত্রা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ত্রিপুরার মধ্যে দিয়ে কুমিল্লায় পৌছে সেখানকার ভারতীয় সিপাহীদের বিদ্রোহে প্ররোচনা দেওয়া ও সেখান থেকে একই উদ্দেশ্যে মণিপুর যাওয়া। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সেই সংবাদ পেয়ে ত্রিপুরার রাজাকে সিপাহীদের ত্রিপুরায় প্রবেশ রোধ ও অনুপ্রবেশকারীদের বন্দী করার নির্দেশ পাঠান। তদনুসারে রাজকীয় আদেশও জারী করা হয়। ওয়েবস্টার সাহেবের মতে বিদ্রোহীরা উদয়পুর পার হয়ে কুমিল্লা যাওয়ার পথ অবরুদ্ধ দেখে আবার জঙ্গলপথে উত্তর দিকে এগিয়ে যায়। উত্তরাঞ্চলে তাদের বাধা দেওয়ার জন্য সৈয়াদল পাঠান। কৈলাসচন্দ্র সিংহের মতে, কিছু সিপাহী আগরতলায় ধরা পড়ে। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ তাদের ফাঁসী দেন কুমিল্লায়। কিন্তু বিদ্রোহীদের সঙ্গে রাজার যোগাযোগ আছে এই সন্দেহে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দী করতে উদ্যত হন। অবশ্য বিচারক মেটকাফের মধ্যস্থতায় সে চেষ্টা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি বলে জানা যায়। রাজা প্রকৃতই বিদ্রোহীদের কোনরকম সহায়তা করেন কিনা তা সঠিক জানা যায় না।

১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি এক সশস্ত্র বৈরী কুকিদল খণ্ডল থানার অন্তর্গত ছাগলন্যা গ্রাম আক্রমণ করে নির্বিচারে নরহত্যা ও লুঠতরাজ চালায়। পনেরটি গ্রাম লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়। দেড়শোর বেশি লোক নিহত ও বহু স্ত্রীলোক বন্দী হয়। গুণাগাজী নামে এক স্থানীয় সর্দারের প্রতিরোধের ফলে কুকিরা শেষপর্যন্ত নিরস্ত হয়। সরকারী রিপোর্ট ও মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, এই আক্রমণের প্রকৃত নায়ক ছিলেন রাজবংশীয় কয়েকজন বিক্ষুদ্ধ লোক। সাধারণভাবে কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারও দুপতুং সম্প্রদায়ের কুকিদের প্রতি অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ হয়েই তারা ঐ আক্রমণ চালায় বলে প্রকাশ। বৈরী কুকিরা ছিল রতন পুঁইঞার অনুগামী।

পার্বত্য রিয়াং সম্প্রদায়ের লোকেরা খণ্ডলের বাঙালী মহাজনদের কাছ থেকে প্রয়োজনমত ঋণ নিত। পরপর কয়েক বৎসর ফসল না হওয়ায় তারা ঐ ঋণ পরিশোধে অসমর্থ হয় এবং মহাজনদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রতন পুঁইঞার নেতৃত্বে কুকিদের সঙ্গে যোগ দেয়। ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এক ব্রিটিশ সৈন্যদল রতন পু’ইঞার গ্রাম আক্রমণ করে। রতন পু’ইঞার দল মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়িয়ে পোড়া মাটি নীতি অনুসরণ করে। কুকিদের একটা বড় দল একসময় উদয়- পুরের কাছাকাছি একটা বাজার লুট করে ও কয়েকটি গ্রামের উপর হামলা চালায়। এই ঘটনার পর ত্রিপুরার ‘হিল সুপারিনটেন্ডেন্ট’ রাজার সঙ্গে আলোচনার পর কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। সেগুলি হলো: ১। কুড়িজন রক্ষী থাকবে এমন পাঁচটি সীমান্ত চৌকি স্থাপন, ২। ফেনীতে ১৫০ জন রক্ষীর আস্তানা স্থাপন, ৩। রক্ষীদের জন্য ছয়জন ড্রিল সার্জেন্ট নিয়োগ, ৪। জমি জরিপের ব্যবস্থা।

ঈশানচন্দ্রমাণিক্যের ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যুর পর বীরচন্দ্রমাণিক্য শাসন ক্ষমতা লাভ করলেও সিংহাসন নিয়ে রাজবংশীয়রা আদালতে একাধিক মামলা দায়ের করেন। ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে বিঘাতের প্রিভি কাউন্সিল বীরচন্দ্রের অনুকূলে রায় দেওয়ার আগেও অবশ্য বীরচন্দ্র কার্যতঃ রাজা হিসাবে শাসনক্ষমতা পরিচালনা করেন। তাঁর ‘মহারাজা’ খেতাব ছিল ব্যক্তিগত। ১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দে ১২৫টি স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে তিনি এই খেতাব পান।

প্রকৃতপক্ষে নজরাণা প্রদানের রেওয়াজ মোগল আমলেই দেখা যায়। ইংরেজরাও সেই নজীরে দুর্গামাণিক্যের কাছ থেকে প্রথম নজর আদায় করেন। কৃষ্ণকিশোরমাণিক্যকে সিংহাসনে বসার সময় ৬৩॥- মূল্যের স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা নজর দিতে হয়। ক্রমশই এই নজরের পরিমাণ যে বাড়তে থাকে বীরচন্দ্রমাণিক্যের দেওয়া নজরের পরিমাণ থেকেই তা বুঝা যায়। কৈলাসচন্দ্রসিংহ ‘নজরাণা রেজেলেউশন’ নামে ইংরেজীতে লেখা একটি দলিলের উল্লেখ প্রসঙ্গে লেখেন যে, কোন রাজার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রাজা হলে তাঁকে রাজ্যের এক বছরের রাজস্বের অর্ধেক দিতে হতো। পুত্রের স্থলে অন্য কেউ সিংহাসনে বসলে তাঁকে দিতে হতো ‘একবছরের পুরো রাজস্ব। বলাবাহুল্য যে, বীরচন্দ্রমাণিক্য ঈশানচন্দ্রের ভাই ছিলেন। কাজেই তাঁর ক্ষেত্রে নজরের পরিমাণ বৃদ্ধি অপ্রত্যাশিত ছিল না।

 

 

এতাবৎকাল ইংরেজ সরকারের সঙ্গে কোন চুক্তি না থাকার ফলে যেটুকু সার্বভৌমত্ব ত্রিপুরা রাজারা ভোগ করে আসছিলেন প্রকৃতপক্ষে সিংহাসনের দাবীর মীমাংসায় দ্বিতীয় রাজধরমাণিক্যের সময় থেকেই সেই সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয় এবং ইংরেজ সরকার সেই সময় থেকেই নজর প্রথার নামে ত্রিপুরার রাজকোষ থেকে অর্থগ্রহণ সুরু করেন। শুধু তাই নয়, ত্রিপুরার পূর্বোক্ত সার্বভৌমত্ব যাতে বিলুপ্ত হয় সেই উদ্দেশ্যে ঈশানচন্দ্রমাণিক্যের মৃত্যুর পর বীরচন্দ্রের কার্যতঃ রাজত্বকালে ‘ট্রিগণমেট্রিক্যাল সার্ভে’র সাহায্যে প্রথম ত্রিপুরা রাজ্যে জরিপের ব্যবস্থা করেন ব্রিটিশ সরকার। জরিপের কাজ শেষ হলে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ত্রিপুরাকে ‘স্বাধীন ত্রিপুরা’ না বলে ‘পার্বত্য ত্রিপুরা’ নামে অভিহিত করা হয়।

জমাতিয়া উপজাতীয়গণ আধুনিক কালে চাষাবাদ সুরু করার আগে রাজকীয় সৈন্যদলে কাজ করতেন। যুদ্ধের একটা সুপ্ত চেতনা তাঁদের মধ্যে বরাবরই ছিল। রাজার হাজারী ওয়াখি রায়-এর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে। কর দেওয়া বন্ধ করা

ছাড়াও তাঁরা উদয়পুরের রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করেন। সেই আকস্মিক আক্রমণে বিব্রত রাজা উদয়পুর ত্যাগ করেন এবং আগরতলা থেকে বিদ্রোহ দমনের জন্য সৈন্যদল পাঠানো হয়। কিন্তু রাজকীয় সৈন্য বিদ্রোহীদের কাছে পরাজিত হয়। তখন মুরছই ও হাপুই নামে দু’জন কুকি সর্দারকে বিদ্রোহ দমনে নিযুক্ত করা হয়। প্রায় ৬০০ কুকি সৈন্য নিয়ে কুকি সর্দারেরা আনুমানিক ২০০ জমাতিয়া বিদ্রোহী- দের আক্রমণ করে এবং সকলকে হত্যা করে। বিদ্রোহী সর্দার পরীক্ষিৎ বন্দী হন। শোনা যায়, কুকিরা বিজয়ের স্মারক হিসাবে জমাতিয়াদের দুশো মুণ্ড কেটে আগরতলায় নিয়ে আসে। বিদ্রোহীরা প্রশমিত হলে রাজা পরীক্ষিৎকে মার্জনা করেন।

ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্বাংশে লুসাই উপজাতীয়দের বাস। এই লুসাইদের বারবার আক্রমণের হাত থেকে ত্রিপুরা ও ব্রিটিশ এলাকার জনজীবন ও সম্পত্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে লুসাইদের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক অভিযান চালান। এরপর লুসাইদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে ত্রিপুরার পূর্বসীমান্তের অন্তর্গত একটা বড় অংশ রাজ্যের বাইরে চলে যায়। নতুন ব্যবস্থা অনুসারে ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে সাময়িকভাবে তিপাইমুখ-এর প্রায় ৮০ মাইল পশ্চিমে লঙ্গাই নদীকে ত্রিপুরা রাজ্যের শেষ সীমানারূপে চিহ্নিত করা হয়। রাজার পক্ষ থেকে এই সীমানা নির্ধারণে আপত্তি প্রকাশ করে লঙ্গাই-এর বদলে ধনেশ্বরী নদীকে সীমানা রূপে ধার্যের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু সে আবেদনে কোন ফল হয় না। শেষে ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে আসামের চীফ কমিশনার জানান যে, লুসাইদের আস্তানার খুব কাছাকাছি সীমানা ধার্য হলে সংঘর্ষের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া ঐ বিচ্ছিন্ন এলাকায় যথাযথভাবে চৌকি রাখার ব্যয়বহন রাজার পক্ষে সম্ভব হবে না মনে করেই ইতিপূর্বে ধার্য সীমানাই পাকাপাকিভাবে নির্ধারিত হোল।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024