বিনষ ঘোষ
বাদশাহ ঔরঙ্গজীবের পিতা সাজাহান দিল্লী শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন, নিজের নাম অমর করার জন্য। নতুন রাজধানীর নামকরণ তাঁর নামেই হবে, এই ছিল তাঁর বাসনা করেছিলেনও তাই। দিল্লী শহর যখন নতুন তৈরি হল, তখন তার নাম রাখা হল ‘শাহজাহানাবাদ’, সংক্ষেপে ‘জাহানাবাদ’। । প্রাচীন দিল্লীর ধ্বংসাবশেষের উপর নতুন দিল্লী নগরী গড়ে উঠলো। হিন্দুস্থানে এখন আর কেউ দিল্লীকে ‘দিল্লী’ বলেন না, ‘জাহানাবাদ’ বলেন। ‘জাহানাবাদ’ নতুন নাম, এখনও বাইরে তেমন পরিচিত হয়নি, তাই ‘দিল্লী’ নামেই আমি এখানে তার বর্ণনা করছি।
দিল্লী নতুন শহর, যমুনা নদীর তীরে বেশ প্রশস্ত জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। লোয়ের নদীর সঙ্গে যমুনার তুলনা করা যায়। যমুনার তীরে শহরটি গড়ে উঠেছে ঠিক যেন একফালি চাঁদের মতন, দুটি কোণ দুই দিকে এসে তীরের সঙ্গে মিশেছে। এক দিকে নৌকোর একটি সেতু দিয়ে অন্য তীরে যাওয়া যায়। । আমি নিজে শহরের এই ঘুরে দেখেছি, তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগেনি। যদিও আমি ঘোড়ায় চড়ে ঘুরেছিলাম তাহলেও ঘণ্টায় এক লীগের বেশি জোরে যাইনি। শহরতলির কথা বলছি না, কেবল দিল্লী শহরের কথা বলছি। শহরের তুলনায় শহরতলির আয়তন আরও অনেক বড়। শহরের একদিকে প্রায় লাহোর পর্যন্ত সারবন্দী গৃহশ্রেণী চলে গেছে-প্রাচীন শহরের বিস্তৃত ধ্বংসাবশেষ এবং তিন-চারটি ছোট ছোট শহরতলি অঞ্চল।
দুর্গের অভ্যন্তর
অন্তদুর্গের মধ্যে রাজপ্রাসাদ আছে, জেনানামহল আছে এবং আরও অন্যান্ত সব রাজকীয় বিভাগাদি আছে। তার বিস্তৃত আলোচনা যথাসময়ে করব। দুর্গটি অর্ধবৃত্তাকার। সামনে নদী। প্রাসাদ ও নদীর মধ্যে বালুকাময় প্রশস্ত ব্যবধান। এই প্রশস্ত স্থানে, নদীতীরে হাতির লড়াই হয়, বাদশাহ দেখেন। আমীর-ওমরাহ, রাজামহারাজাদের সৈন্যসামন্তের কুচকাওয়াজ হয়। এসব অবশ্য বাইরে থেকে দেখতে যতটা জমকালো মনে হয়, আসলে ততটা নয়। আমার ধারণা, পরিমিত পরিমাণে যুদ্ধোপকরণ নিয়ে এই ধরনের আত্মরক্ষার দুর্গ সহজেই ধ‚লিসাৎ করা যায়।
যেসব হিন্দু রাজা মোগল বাদশাহের বশ্যতা স্বীকার করেছেন এবং তার জায়গীর বা তনখা পান, তাঁরা প্রতি সপ্তাহে যখন দিল্লীতে কুচকাওয়াজ করতে আসেন তখন এই বাগের মধ্যে তাঁবু ফেলে থাকেন। প্রধানতঃ এই রাজারা রাজপুত রাজা। দুর্গের মধ্যে সাধারণতঃ ওমরাহ ও মনসবদাররা কুচকাওয়াজ করার জন্য অবস্থান করেন।
বাজারের গণৎকার
‘কাছেই একটি বাজার আছে যেখানে এমন কোনো জিনিস নেই যা পাওয়া যায় না। বিচিত্র সব পণ্যদ্রব্য নানাদেশ থেকে আমদানি হয় সেখানে। জিনিসের মতন নানারকমের সব লোকজনেরও সমাবেশ হয় সেইখানে। যতরকমের ভÐ, বুজরুক, হাতুড়ে বৈস্ত, জাদুকর ইত্যাদি রাজ্যে আছে সব এসে জমা হয় বাজারে। গণৎকার ও জ্যোতিবীদেরও বেশ ভিড় হয় এবং তাদের মধ্যে হিন্দুও আছে মুসলমানও আছে। ভ‚ত ভবিষ্যৎ বর্তমানের এই সব বিচক্ষণ ব্রহ্মজ্ঞানীরা মাটিতে শতরঞ্জ বা আসন পেতে চুপ করে বসে থাকে, হাতে থাকে নানারকমের কাঁটাকম্পাস, সামনে খোলা থাকে অদৃষ্টশান্তের একটি বিশাল গ্রন্থ এবং তার পাশে থাকে গ্রহ-উপগ্রহাদির স্থানাঙ্কিত একটি চিত্রপট। যাত্রীরা তাই দেখে আকৃষ্ট হয় এবং মনে করে যে গণৎকাররা যেন ভগবানের সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। তাদের মুখ দিয়ে যা উচ্চারিত হবে তা কখনও মিথ্যা হতে পারে না, সাধারণ লোকের এই বিশ্বাস। অত্যন্ত গরীব যারা তারা হয়তো সামান্য একটি পয়সা দিয়েই তাদের ভবিষ্যৎ জানবার সুযোগ পায়। আমি দেখেছি, স্ত্রীলোকেরাও হাত দেখাতে ও ভাগ্য গণাতে আসে। আপাদমস্তক সাদা ওড়নায় ঢেকে স্ত্রীলোকেরা বাজারে এসে গণৎকারের সামনে হাত বার করে বসে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে এমন কোনো গোপন কথা নেই যা তারা ঈশ্বরের ম‚র্তিমান প্রতিনিধি এই গণৎকারদের কাছে বলে না।
আমি শুধু এখানে প্রকাশ বাজারের গণৎকারদের কথা বললাম। যারা রাজা-বাদশাহ, আমীর-ওমরাহদের দরবারে আনাগোনা করে, তারা বাজারের গণৎকারের মতো স্বপ্নবিত্ত নয়। তারা রীতিমত ধনী বাক্তি এবং প্রতিপত্তি তাদের যথেষ্ট। যেমন অর্থ তাদের, তেমনি তাদের খাতির ও খ্যাতি। শুধু হিন্দুস্থানে নয়, সমগ্র এশিয়া মহাদেশের প্রায় সর্বত্র আমি এই কুসংস্কারে মোহমুগ্ধ দেখেছি সাধারণ লোককে, সর্বস্তরের লোককে।
বাইরের শহর
বাদশাহী বাগের সামনে শহরের যে দুটি রাজপথ এসে মিশেছে বলে আগে উল্লেখ করেছি, তাদের প্রন্থ পঁচিশ-ত্রিশ পায়ের বেশি নয়। আঁকাবাঁকা পথ নয়, সরলরেখার মতন সোজা পথ, যতদ‚র দৃষ্টি যায় ততদ‚র দেখা যায়। যে পথটি লাহোর ফটক পর্যন্ত গেছে তার দৈর্ঘ্য অনেক বেশি। ঘরবাড়ির দিক থেকে দুটি রাজপথের দৃশ্য প্রায় এক। আমাদের দেশের ‘প্লেস রয়ালে’র মতন, রাস্তার দুই দিকেই তোরণশ্রেণী। পার্থক্য শুধু এই যে, হিন্দুস্থানের তোরণগুলি কেবল ইটের তৈরি এবং উপরে কেবল একটি চাতাল ছাড়া আর কোনো গৃহ নেই।
আরও পাঁচটি রাস্তা আছে শহরের মধ্যে, কিন্তু যে দুটি রাস্তার কথা বলেছি আগে, তাদের মতন লম্বা বা চওড়া নয়। অন্যান্য দিক থেকে রাস্তাগুলি দেখতে প্রায় একইরকম বলা চলে। এছাড়া আরও অনেক ছোটোখাটো রাস্তা ও অলি- গলি আছে, তোরণও আছে রাস্তায় অনেক। কিন্তু রাস্তাগুলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজাবাদশাহের তৈরি বলে তাদের পরিকল্পনার মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য- বোধের পরিচয় নেই।
আগুন যখন লাগে এবং বছরে দু-একবার লাগেই, তখন চারিদিকে শহরময় অতি সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। সার। দিল্লী শহর জুড়ে মনে হয় যেন আগুন জ্বলছে। এই গত বছরেই এক ভয়াবহ অগ্নিকাÐ ঘটেছিল দিল্লীতে, প্রায় ষাট হাজার খড়ের ঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। গ্রীষ্মকালে যখন মধ্যে মধ্যে ঝড় বইতে থাকে তখনই আগুন লাগে বেশি, এবং ঝড়ের জন্মই আগুন অতিদ্রæত ভয়াবহ ব্যাপক রূপ ধারণ করে। গত বছর এইভাবে তিন বার আগুন লাগে দিল্লী শহরে (অর্থাৎ ১৬৬২ সালে )।
স্ত্রীলোক এত অসহায় ও লাজুক যে ঘরে আগুন লাগলেও বাইরে বেরিয়ে মুখ দেখাতে তারা লজ্জা পায়। সেইজন্য জেনানামহলের স্ত্রীলোকরা অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগুনে পুড়ে মারা যায়।
মধ্যযুগের শহর
দিল্লীর এইসব মাটির চালাঘরের আধিক্যের জন্য আমার সব সময় মনে হয়, দিল্লী আধুনিক অর্থে শহর ও নগর নয়, কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি মাত্র। অথবা মনে হয়, দিল্লী একটি বিরাট সামরিক শিবির, তা ছাড়া কিছু নয়।
এইবার ভিতরের ঘরের বর্ণনা দিচ্ছি। ভাল ভাল বাড়ির ভিতরের ঘরের মেঝের উপর প্রায় চার ইঞ্চি পুরু গদি পাতা, তার উপরে সাদা ধবনবে চাদর বিছানো থাকে, গ্রীষ্মকালে এবং শীতকালে সিল্কের কার্পেট। ঘরের বিশেষ কোণে আরও ছোট ছোট দু-একটি গদি পাতা থাকে, এবং তার উপর সুন্দর ফুললতাপাতার কারুকাজকরা চাদর বিছানো থাকে। এগুলি গৃহগামীর নিজের বসবার জন্য, অথবা তাঁর বিশেষ সম্মানিত অতিথিঅভ্যাগতের জন্য। এইসব ফরাসের উপর ভাল ভাল তাকিয়া ফেলা থাকে, দিব্য হেলান দিয়ে বসে গল্পগুজব করার জন্য। নানারকমের কারুকাজকরা ভেলভেটের তাকিয়া, মখমল ও সাটিনের তাকিয়াই বেশি।
কিন্তু মানুষ বা জন্তুজানোয়ারের কোনো চিত্র অঙ্কিত নয়। মানুষ বা জানোয়ারের চিত্র সিলিং-এ আঁকা নাকি ধর্মনিষিদ্ধ। এই হল সংক্ষেপে দিল্লী শহরের ঘরবাড়ির বিবরণ এবং সুন্দর বাড়ির বিস্তৃত পরিচয়।
দোকানপত্তরের কথা
দোকান-সাজানো ব্যাপারেই যেন দিল্লীর ব্যবসায়ীরা অভ্যস্ত নয়। কদাচিৎ এক-আধটি দোকান এরকম দেখা যায়, যেখানে ভাল ভাল দামী রেশমী বস্ত্র, সোনারুপোর জরির কাজ করা নানারকমের ঝালর, শিরস্ত্রাণ ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু এরকম একটি দোকানের বদলে পঁচিশটি দোকান দেখা যায় যেখানে কিছুই সাজানো থাকে না দেখবার মতন। মাটির পাত্রভরা তেল, ঘি, মাখন, বস্তা বস্তা চাল গম ছোলা ডাল ইত্যাদি নানারকমের খাস্ত মজুত করা থাকে স্ত‚পাকারে। এসব অধিকাংশই হল হিন্দু ভদ্রলোকশ্রেণীর খাচ্ছ, যাঁরা মাংস খান না বেশি। দরিদ্র নি¤œশ্রেণীর মুসলমানরাও অবশ্য তাই খায় এবং সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে অধিকাংশেরই এই খাদ্য খেতে হয়।
এছাড়া একটি ফলের বাজার আছে, যা বাস্তবিকই দেখবার মতন। ফলের বাজারে দোকানের সংখ্যাও যথেষ্ট এবং গ্রীষ্মকালে এইসব দোকান নানারকমের ফলে ভর্তি হয়ে যায়। । কতরকমের ফল তার ঠিক নেই-পেস্তা, বাদাম, আখরোট, খুবানী ইত্যাদি।
গ্রীষ্মকালে তরমুজের দাম সস্তা হয়, কিন্তু তখন খুব ভালো জাতের তরমুজ সংগ্রহ করাও খুব কষ্টকর।
আম্রফল বা আম গ্রীষ্মকালে মাস দুই খুব সস্তা হয় এবং প্রচুর পরিমাণে পাওয়াও যায়। কিন্তু দিল্লী অঞ্চলে বিশেষ ভাল আম তেমন পাওয়া যায় না। ভাল-ভাল উৎকৃষ্ট আম আসে বাংলাদেশ থেকে, আর গোলকুÐা ও গোয়া থেকে
ময়রার দোকান দিল্লী শহরে অনেক আছে, কিন্তু মিষ্টান্নের তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, রুচি বা আস্বাদ কোনো দিক থেকেই নেই। মিষ্টান্ন খারাপ তো বটেই, তা ছাড়া মাছি ও ধুলোতে ভর্তি-আহারের যোগ্য নয়।
কের মতন হয়। আমাদের এখানকার রুটির সঙ্গে তার কোনো তুলনাই করা চলে না।
ভাল জাতের খাসী মোরগ তেমন পাওয়া যায় না, একরকম দুর্লভই বলা চলে। ওদেশের মানুষের জীবজন্তর প্রতি দয়াটা যেন একটু বেশি মনে হয়।
দিল্লী অঞ্চলের লোকেরা সেরকম ভাল মৎস শিকারী নয়। মাছ ধরতে ভাল জানে না। মধ্যে মধ্যে ভাল মাছ বাজারে আমদানি হয়, কিন্তু তার অধিকাংশই সিঙ্গী ও রুই মাছ। দিল্লী শহরে কোনো মধ্যবর্তী স্তরের বা অবস্থার লোকের অস্তিত্ব নেই। দুই শ্রেণীর লোক দিল্লীতে সাধারণতঃ বেশি দেখা যায়। হয় উচ্চশ্রেণীর ধনী লোক, আর না-হয় নি¤œশ্রেণীর দরিদ্র লোক।
ভোজনের বিবরণ
আমি নিজে যথেষ্ট টাকা উপার্জন করি এবং খরচ করতেও কুণ্ঠিত হই না। কিন্তু তা সত্তে¡ও প্রায় এমন অবস্থা হয় যে আমার অদৃষ্টে কোনো খায় জোটে না। বাজারে কিছুই পাওয়া যায় না অধিকাংশ দিন এবং যা-ও বা পাওয়া যায় তা ধনিকদের ভুক্তাবশেষ বা উচ্ছিষ্ট ছাড়া কিছু নয়। ভোজনপর্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যে মদ, তাও দিল্লীর একটিমাত্র দোকানে পাওয়া যায়, আর কোথাও পাওয়া গায় না। অথচ মদ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেতে পারে, কারণ দেশী আঙুর থেকে হিন্দুস্থানে বেশ উত্তম মদ তৈরি হয়। কিন্তু তা সত্তে¡ও মদ বাইরের দোকানে বিক্রি হয় না, কারণ হিন্দুদের শাস্ত্র ও মুসলমানদের শরিয়তে মদ্যপান নিষিদ্ধ।
কারিগরদের কথা
দিল্লীতে সুদক্ষ কারিগরদের ভাল কারখানা বেশি নেই। অন্ততঃ সেদিক থেকে গর্ব করার মতন বিশেষ কিছু নেই দিল্লীর। তার মানে, ভাল ভাল কারিগর যে ভারতবর্ষে নেই তা নয়। সুদক্ষ কারিগর ভারতের প্রায় সর্বত্রই আছে । উঁচুদরের কারুশিল্পের প্রচুর নিদর্শন দেখা যায়, যা কারিগররা যন্ত্রপাতি বিশেষ না থাকা সত্তে¡ও, এবং কোনো গুরুর কাছ থেকে কোনোরকম শিক্ষা না পেয়েও তৈরি করে।
সুতরাং কেবল প্রতিভার অভাবের জন্যই যে দিল্লী শহরে ভাল শিল্পকলার নিদর্শন তেমন দেখা যায় না, তা নয়। শিল্পীরা যদি প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও উৎসাহ পেতেন, তাহলে ভারতবর্ষে শিল্পকলার আশ্চর্য বিকাশ হত। কিন্তু কোনো উৎসাহই ভারতীয় শিল্পীরা পান না। সাধারণতঃ শিল্পীরা অবজ্ঞার পাত্র এবং তাঁদের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মেহনতের জন্য তাঁরা উপযুক্ত মজুরিও পান না। ধনী লোক যাঁরা, তাঁরা সন্তায় জিনিস কিনতে চান, অর্থব্যয় করতে চান না। কোনো আমীর বা মনসবদার যদি কোনো কারিগরকে দিয়ে কিছু কাজ করাতে চান, তাহলে তাকে বাজার থেকে লোক পাঠিয়ে ধরে নিয়ে আসেন।
যে সব শিল্পীর প্রতিষ্ঠা আছে বা মর্যাদা আছে, তাঁরা সাধারণত: রাজা-বাদশাহের অনুগ্রহজীবী, অথবা বড় বড় আমীর-ওমরাহ তাঁদের পৃষ্ঠপোষক। তাঁরা একটু ভাল খেতে পরতে পান ও আরামে থাকেন। তাঁদেরই প্রতিষ্ঠা হয়। তা না হলে অর্থাৎ রাজা-বাদশাহের মতন পৃষ্ঠপোষক না থাকলে শিল্পীর কোনো কদর নেই হিন্দুস্থানে।
রাজপ্রাসাদের বর্ণনা
রাজদুর্গের মধ্যে বেগমনহল ও অন্যান্য রাজকীয় ভবন আছে।
দুর্গের প্রবেশদ্বারের এমন কোনো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নেই। দুটি বড় বড় পাথরের হাতি আছে দুদিকে। একটি হাতির উপর চিতোরের রাজা জয়মলের প্রস্তর প্রতিম‚র্তি, অন্যটির উপর তার ভাইয়ের। এই দুজন দুঃসাহসী বীর ও তাঁদের বীর জননী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন, কারণ আকবর বাদশাহ যখন চিতোর অবরোধ করেছিলেন তখন তাঁরা অমিতবিক্রমে যে দুর্ভেন্ন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তা অতুলনীয়।সেই প্রতিরোধ যখন চ‚র্ণ হয়ে গেল, যখন দেশ- রক্ষার আর কোনো উপায় রইল না, তখন তাঁরা তাঁদের জননীসহ যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হননি। তবু তাঁরা উদ্ধত শত্রæর কাছে আত্ম- সমর্পণ করেননি। মাথা উঁচু করেই তাঁরা মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন। তাঁদের এই অপ‚র্ব বীরত্বে মুগ্ধ হয়েই তাঁদের শত্রæরা এই মর্মরম‚র্তি তৈরি করেছিল। যখনই আমি এই দুটি হাতির পিঠে এই বীরের মর্মরম‚র্তির দিকে চেয়ে দেখি তখন আমার এমন এক অনুভ‚তি জাগে মনে, যা আমি ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না।
এই প্রবেশদ্বার দিয়ে নগরদুর্গের মধ্যে প্রবেশ করলে একটি সুদীর্ঘ প্রশস্ত রাস্তা দেখা যায় সামনে। রাস্তাটির (দিল্লীর প্রাচীন ‘চাঁদনি চক্’ নামে রাস্তাটি) মাঝখান দিয়ে একটি জলের খাল বয়ে গেছে। রাস্তার দু পাশে লম্বা উঁচু বাঁধ প্রায় পাঁচ-ছয় ফুট উঁচু এবং চার ফুট চওড়া। অন্য দুর্গদ্বার দিয়ে ভিতরে ঢুকলে আরও একটি লম্বাচওড়া রাস্তা দেখা যায়। তারও দুদিকে বেশ উঁচু ও প্রশস্ত বাঁধ দেওয়া আছে। কেবল বাঁধের পাশে সারবন্দী তোরণের বদলে আছে দোকান।
রাস্তাটি আসলে একটি বাজারই বলা চলে। গ্রীষ্মে ও বর্ষায় বিশেষ কোনো অসুবিধা হয় না, কারণ রাস্তাটির উপরে ছাদ আছে। আলোবাতাসের অভাব নেই। ছাদের মধ্যে যথেষ্ট বড়-বড় ফাঁক আছে আলোবাতাস প্রবেশের জন্য।
এই রকম আরও অনেক বড়-বড় উঁচু বাঁধ ও তাঁবু আছে নগরের মাধ্য। সাধারণতঃ ব্যবসাবাণিজ্যের লেনদেন ও আফিসের কাজকর্মের স্থান হিসেবে সেগুলি ব্যবহার করা হয়।
কারখানার বর্ণনা
বড়-বড় হলঘর অনেক জায়গায় দেখা যায়। তাকে ‘কারখানা’ বলে।২২ কারিগরদের ওয়ার্কশপের নাম কারখানা। কোনো হলঘরে দেখা যায় স‚চিশিল্পের কাজ হচ্ছে, ওস্তাদ তদারক করছেন। কোনো হলঘরে স্বর্ণকাররা কাজ করছে, কোথাও চিত্রকররা। কোখাও বার্নিশ, পালিশ ও লাক্ষার কাজ হচ্ছে। কোথাও চর্মকার, দরজী ও স‚ত্রধররা কাজ করছে। কোথাও কাজ করছে রেশম-ব্রকেডের কারিগররা, কোথাও স‚² মসলিন ইত্যাদি কাপড় তৈরি হচ্ছে এইভাবে কারখানার নির্জন হলঘরের কোণে সকলের অগোচরে একাগ্রচিত্তে মেহনত করে তাদের জীবনের দিনগুলি কেটে যায়। জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা বলে কারও কোনো কিছু থাকে না এবং নিজেদের জীবনযাত্রার কোনোরকম উন্নতির জন্যেও কেউ সচেষ্ট হয় না। যে অবস্থা ও পরিবেশের মধ্যে তারা জন্মায়, সেই অবস্থার মধ্যেই তারা সারাজীবন একভাবে থাকে। স‚চিশিল্পী যে, সে তার পুত্রকেও স‚চিশিল্পের শিক্ষা দেয়; স্বর্ণকার যে, সে তার পুত্রকে করে স্বর্ণকার এবং শহরের বৈস্ত যে, সে তার পুত্রকেও বৈদ্য করতে চায়। সমধর্মী শিল্পীগোষ্ঠীর মধ্যেই সকলে বিবাহাদি করে। এই সামাজিক বিবি হিন্দু-মুসলমান উভয় স¤প্রদায়ের কারিগররা কঠোরভাবে পালন করে।
সম্রাট সন্দর্শনের প্রথা
সিংহদরজার উল্টো দিকে, কোর্ট পার হয়ে, সামনে বিরাট একটি হলঘর। হলঘরের মধ্যে সারবন্দী স্তম্ভ। ছাদ ও স্তন্ত দুই-ই সুন্দরভাবে চিত্রিত, সোনার কাজকরা। অপ‚র্ব দেখতে। জমি থেকে বেশ উঁচুতে হলঘরটি তৈরি, প্রচুর আলোবাতাস খেলে। তিনদিক খোলা, বাইরের চত্বরটির দিকে। মধ্যে একটি প্রাচীর, তার ওপাশে বেগমমহল। প্রাচীরের মধ্যস্থলের কাছাকাছি মানুষের চেয়েও উঁচু একটি বেদী-মঞ্চ এবং সেখানে জানালার মতন একটি বড় গবাক্ষ খাছে। সেইখানে সম্রাটের সিংহাসন। প্রতিদিন প্রায় মধ্যাহ্নকালে সম্রাট সেই সিংহাসনে এসে একবার করে বসেন। মোগল সম্রাট প্রতিদিন একবার করে সকলকে দর্শন দেন, উচ্চ-নিচু ভেদাভেদ নির্বিশেষে।
সমবেত প্রজাদের মধ্যে থেকে যেসব আবৃদ্ধি-আবেদনপত্র পেশ করা হয়, সেগুলি সম্রাটের কাছে এনে, তাঁর সামনেই পড়া হয় যাতে তিনি শুনতে পান। তারপর আবেদনকারীদের প্রত্যেককে একে-একে সম্রাটের সামনে ডাকা হয়, তিনি নিজে স্বচক্ষে তাদের দেখেন এবং সামনা-সামনি অনেক সময় অধিকাংশ ন্যায় অন্যায়ের বিচার করেন। অন্যায়ের জন্য অপরাধীদের দÐও দেন। সপ্তাহে একদিন নিভৃতে বসে তিনি সাধারণ প্রজাদের ভিতর থেকে দশজনের আবেদনপত্র নিজে বিচার করেন। আদালতখানাতেও সপ্তাহে একদিন কয়ে যান এবং সেখানে সাধারণতঃ দুজন কাজীর সঙ্গে বসে আবেদন-অভিযোগের বিচার করেন। সম্রাটের এই কাজগুলি দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, এশিয়ার সম্রাটদের বর্বরতা ও অবিচার সম্বন্ধে আমাদের মতন বিদেশীদের যে ধারণা আছে তা সম্প‚র্ণ সত্য নয়।
মোসাহেবির নমুনা
এখানে তার উল্লেখ না করা অন্যায় হবে। সেটা হল, মোসাহেবি, স্তোকবাক্য ও প্রশস্তি। সম্রাটের মুখ দিয়ে যখনই কোনো একটি কথা বেরোয়, তা সে যে কথা বা যত নগণ্য কথাই হোক না কেন, সঙ্গে সঙ্গে সমবেত লোকসভায় তার ধ্বনি- প্রতিধ্বনি হতে থাকে। প্রধান ওমরাহরা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে আশমানের দিকে হাত বাড়িয়ে, দেবতার আশিস্-প্রার্থীর মতন কাতরকণ্ঠে ‘কেরামৎ, কেরামৎ’ ধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকেন। অর্থাৎ প্রভু কি কথাই বললেন, কেউ আর কোনোদিন এমন কথা বলেননি, বলবেনও না কোনোদিন। কি আশ্চর্য কথা। কি সুবিচার। কি দ‚রদৃষ্টি। পারক্ষভাষায় একটি লোকপ্রবাদ আছে, তার অর্থ হল: ‘শাহ যদি বলেন দিনটাকে রাত, তাহলে সঙ্গে-সঙ্গে অন্যেরা কদবেন, আহা। কি সুন্দরই না চাঁদ উঠেছে আকাশে, কি চমৎকার তারার ঝলমলানি।’ মোগল দরবারেও ঠিক তাই হয়ে থাকে। স্তাবকতা মোসাহেবি যেন অস্থিমজ্জায় সকলের মিশে রয়েছে, সর্বস্তরের লোকের মধ্যে।
গোসলখানার বর্ণনা
আমখাসের বিশাল হলঘরের ভিতর দিয়ে আর একটি নিভৃত ঘরে যাওয়া যায়, তার নাম ‘গোসলখানা’। গোসলখানা হাতমুখ ধোওয়া ও স্নানাদি করার ঘর বলা হয়। গোসলখানায় অবশ্য সকলের প্রবেশ নিষেধ, এবং তার আয়তনও আমখাসের মতন বিশাল নয়। তা না হলেও ঘরটি বেশ বড়, হলঘরের মতন এবং চমৎকারভাবে রঙীন চিত্র ও নক্শায় সুশোভিত, দেখতে অতি সুন্দর ও মনোরম।
স¤্রাট দৈনিক একবার করে বাইরের সকলের সামনে ‘দর্শন’ দেবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেন। কারণ রাজ্যের আভ্যন্তরিক অবস্থা তখন এমন ভয়াবহ ছিল যে একদিন তিনি দর্শন না দিলেই বাইরে তাঁর মৃত্যুর গুজব পর্যন্ত রটনা হতে পারত এবং গণবিদ্রোহ ও ব্যাপক বিশৃঙ্খলার মধ্যে তার অনিবার্য প্রতিক্রিয়াও দেখা দিত।
হারেম
এইখার আপনাকে মোগল বাদশাহের হারেম বা জেনানা-মহলের সামান্য পরিচয় দেব। কিন্তু জেনানা-মহলের গৃহবিন্যাস বা স্থাপত্যাদি সম্বন্ধে কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই, কোনো পর্যটকেরই নেই। সম্রাটের সেই হারেমের অন্দরমহল দেখার সৌভাগ্য কারও হয়নি আজ পর্যন্ত। মধ্যে মধ্যে দিল্লী থেকে সম্রাট যখন চলে যেতেন বাইরে, তখন আমি দু-একবার অনেক চেষ্টা করে জেনানা-মহলের মধ্যে ঢুকেছি এবং কিছুটা দেখেছি।
খোজারা বলল-জেনানা-মহলে সুন্দর সুন্দর সব কামরা আছে। বেশ বড় বড় কামরা, প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র, এক কামরার সঙ্গে অন্য কামরার কোনো যোগাযোগ নেই। কামরার বাহার ও বাইরের পরিপাটিও আছে যথেষ্ট। যেমন জেনানা, তেমনি তাঁর কামরা।
আমখাসের উৎসব
আমখাসের হলঘরের প্রান্তে সিংহাসনের উপর সম্রাট বাজপোশাক পরে উপবেশন করেন। সাদা ধবধবে সার্টিনের মের্জাই গায়ে, রেশম ও সোনার সু² কারুকাজ করা তার উপর। শিরস্ত্রাণও স্বর্ণখচিত কাপড়ের তৈরি, মাথার গোড়ায় নানা আকারের হীরে বসানো। মধ্যে একটি ওরিয়েন্টাল ‘পুষ্পরাগ’ বা পোখরাজ, স‚র্যের কিরণের মতন ছাতি বিস্ফারিত হয়ে আসে তার ভিতর থেকে। তুলনা হয় না তার সৌন্দর্যের। গলায় একটি মুক্তার মালা, উদর পর্যন্ত লম্বা। হিন্দুস্থানের অন্যান্য ভদ্রলোকরাও এরকম মালা পরেন, প্রবালের মালা। সিংহাসনের দুটি পায়া একেবারে নীরেট সোনার, তার উপর হীরে, পান্না, চুনি তারার মতন ছড়ানো। কতরকমের মণিমুক্তারত্ব এবং তার ম‚ল্যই বা কত, তা সঠিকভাবে আমি আপনাকে বলতে পারব না, কারণ আমি জহুরী নই এবং সবরকমের মণিরতœ সকলের পক্ষে চেনাও মুশকিল। তবে আমার মনে হয়, সিংহাসনটির ম‚ল্য অন্তত: চার কোটি টাকার কম নয়।
উৎসবের তৃতীয় দিনে সম্রাট এবং সম্রাটের পরে তাঁর আমীর-ওমরাহরা দাঁড়িপাল্লায় নিজেদের ওজন করান। দাঁড়িপাল্লা ও বাটকারা দুই নীরেট সোনার তৈরি। আমার বেশ মনে আছে, যে বছরের কথা আমি বলছি, সেই বছরের উৎসবের সময় সম্রাট ঔরঙ্গজীবের ওজন নিয়ে যখন দেখা গেল যে তার আগের বছরের তুলনায় দুই পাউÐ বেড়েছে, তখন সকলে তুম‚ল হর্ষধ্বনি করে উঠলো।
হারেমের মেলার বর্ণনা
এই উৎসবের সময় হারেমে বা জেনানা-মহলে একটি অদ্ভুত ধরনের মেলা হয়। মেলা পরিচালনার দায়িত্ব নেন আমীর ওমরাহদের পতœীরা, সাধারণত তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে রূপবতী স্ত্রী যাঁরা তাঁরা। বড় বড় আমীর-ওমরাহ ও মনসবদারদের সুন্দরী ভার্যারাই হারেমের এই বিচিত্র মেলার পরিচালিকা। যে সমস্ত দ্রব্য মেলায় সাজানো হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জরীর ফুললতাপাতা- তোলা রেশমী কাপড়, ভাল ভাল স‚চীশিল্প, সোনার কারুকাজ-করা শিরস্ত্রাণ, দামী মলিন ইত্যাদি সব বিলাদের সামগ্রী। মেলার বিশেষত্ব হল, সুন্দরী পরিচালিকারা (আমীর ও মনসবদারদের স্ত্রী) বিচিত্র বেশবিন্যাস করে বেচাকেনার কাজ করেন। মেলার প্রধান আকর্ষণ হল, কেনাবেচার চমৎকার হাস্যকর অভিনয়টি।
এইভাবে কেনাবেচার একটা রংতামাসা চলতে থাকে মেলার মধ্যে। সম্রাটের বেগমরা সস্তায় কেনার আগ্রহ আরও যেন বেশি করে দেখান এবং নানারকম অভিনয় করেন দর নিয়ে। মধ্যে মধ্যে আমীর-পতœী ও সনসবদার-পতœীদের সঙ্গে সম্রাট ও তাঁর বেগমদের দরাদরি ও তর্কবিতর্ক রীতিমত কলরবে পরিণত হয় এবং সমস্ত ব্যাপারটি মিলে একটি চমৎকার কৌতুকনাট্যের অভিনয় করা হয় বলে মনে হয় কাঞ্চন বালার কাহিনী যে নর্তকীদের নিয়ে আসতেন নাচগানের জন্য, তাদের ‘কাঞ্চন’ বলত। কাঞ্চনবর্ণ রূপসী যুবতী মেয়ের দল। বাইরে থেকে হারেমের মধ্যে তাদের সম্রাট নিয়ে আসতেন এবং রাতভোর আটকে রেখে দিতেন। তারা কিন্তু বাজারের বারাঙ্গনা নয়। গৃহস্থ ও ভদ্রঘরের মেয়েই বেশি। আমীর-ওমরাহ ও মনসবদারদের বিবাহোৎসবে এরা নাচগান করার জন্য আমন্ত্রিত হয়। অধিকাংশ কাঞ্চনবালা বেশ সুন্দর দেখতে, পোশাক-পরিচ্ছদে সুসজ্জিত, এবং নৃত্যগীতকলায় রীতিমত পারদর্শী। যেমন নাচিয়ে, তেমনি গাইয়ে। দেহের গড়ন ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমন নরম ও কোমল যে নৃত্যের প্রতিটি ভঙ্গিমা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে যেন লীলায়িত হয়ে ওঠে। তাল ও মাত্রাজ্ঞানও চমৎকার। কণ্ঠের মিষ্টতাও অদ্ভুলনীয়। অথচ এই কাঞ্চনবালারা সাধারণ ঘরের মেয়ে। সম্রাট সাজাহান তাদের যে শুধু মেলাতেই নিয়ে আসতেন তা নয়। প্রতি বুধবারে আমখাসে তাদের হাজিরা দিতে হত সম্রাটের সামনে। এটা নাকি অনেক কালের প্রাচীন প্রথা। সম্রাট সাজাহান কেবল তাদের একবার চোখে দর্শন করেই মুক্তি দিতেন না। প্রায়ই তিনি সারারাত, তাদের আটকে রাখতেন এবং রাজকর্মের শেষে তাদের নৃত্যগীত উপভোগ করতেন, তাদের সঙ্গে মস্করা করে সময় কাটাতেন।
দিল্লীর মসজিদ ও সরাই
এইবার দুর্গ ত্যাগ করে আবার শহরে ফিরে যাই, কারণ দিল্লী শহরের দুটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যের নিদর্শনের কথা উল্লেখ করতে ভুলে গেছি। তার মধ্যে একটি হল জুম্মা মসজিদ। ৩৫ শহরের মধ্যে একটি উঁচু টিলার উপর প্রতিস্টিত বলে মসজিদটিকে দ‚র থেকে অদ্ভুত দেখায়। টিলার উপরটা আগেই সমতল করে নেওয়া হয়েছিল এবং তার আশেপাশের অনেকটা জায়গা পরিষ্কার করে স্কোয়ারের মতন করা হয়েছিল। এইখানে চারটি বড় বড় রাস্তা এসে চারদিক থেকে মিলিত হয়েছে মসজিদের ঠিক চারিদিকে। মসজিদের প্রধান ফটকের ঠিক সামনে একটি, পিছন দিকে একটি, দুপাশের দুটি ফটকের সামনে আর দুটি রাস্তা। তিন দিকের তিনটি ফটকে উঠতে হলে পঁচিশ থেকে ত্রিশটি করে সিঁড়ি পার হতে হয়। পিছন দিকটি একেবারে টিলার সঙ্গে লাগানো, যেন একসঙ্গে গেঁথে তোলা। তিনটি ফটকই শ্বেতপাথরের তৈরি, দেখতে অতি সুন্দর এবং তার দরজাগুলিতে তামার পাত বসানো। প্রধান ফটকটি অন্যান্য ফটকের তুলনায় অনেক বেশি জমকালো দেখতে এবং তার উপর ছোট ছোট সাদা মিনার আছে অনেক। দেখতে অপ‚র্ব দেখায়।
দিল্লীর বেগমসরাই
সম্রাট সাজাহানের জ্যেষ্ঠা কন্যা বেগমসাহেবা এই সরাইটি তৈরি করেছিলেন বলে এর নাম বেগমসরাই। শুধু বেগমসাহেবা নন, ওমরাহরাও এইভাবে শহরের শ্রীবৃদ্ধি করতে চেষ্টা করেন। বেগমসরাই অনেকটা খোলা স্কোয়ারের মতন, চারিদিকে তোরণপথ। তোরণগুলি রাজপ্রাসাদের তোরণের মতন, কেবল পৃথকভাবে পার্টিশন দেওয়া। ভিতরে ছোট ছোট কামরা আছে অনেক। ধনী পারসী, উজবেক ও অন্যান্য বিদেশী বণিকদের বিশ্রামের স্থান এই সরাই। কামরা খুলে তাঁরা সরাইয়ে স্বচ্ছন্দে নিরাপদে থাকতে পারেন, কারণ রাতে প্রধান ফটকটি বন্ধ করে দিলে ভিতরে প্রবেশ করা যায় না। চমৎকার ব্যবস্থা অতিথিদের জন্য।
(ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের ১৬৬৩ সালের জুলাই মাসে তার বন্ধু ফ্রান্সের ম’শিয়ে ও লা ভেয়ারের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন যা ১৬৬৩ সালের দিল্লির একটি ছবি। বিনয় ঘোষের লেখা থেকে তারই সংক্ষিপ্ত রূপ)
Leave a Reply