১২:৩৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০০)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৪০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫
  • 63

নজরুল

মুসলিম সমাজের শ্রেষ্ঠ কবিকে আমার দেশ এইভাবে সম্মান জানাইল। এইজন্যই আধুনিক মুসলিম সমাজে বড় লেখক বা বড় কবির আগমন হয় নাই। মিশর, তুরস্ক, আরব-কোনো দেশেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকের উদয় হইতেছে না। অথচ ইসলামের আবির্ভাবের প্রারম্ভে আমাদের সমাজে কত বিশ্ববরেণ্য মহাকবির আবির্ভাব ঘটিয়াছিল। হাফিজ, রুমি, সাদি, ওমর খৈয়াম এঁদের লেখা পড়িয়া জগৎ মোহিত। কিন্তু আজ কি দেখিতেছি? সমস্ত মুসলিম জগতে কোথা হইতেও প্রতিভার উদয় হইতেছে না। প্রতিভাকে বড় ও পুষ্ট করিয়া তুলিবার মতো মানসিকতা আমাদের সমাজ-জীবন হইতে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। বনে-জঙ্গলে আগাছার অন্তরালে বহু ফুল ফুটিয়া থাকে।

কে তাহাদের সন্ধান রাখে? ফুলের বাগান করিতে হইলে উপযুক্ত মালীর প্রয়োজন ফুলগাছের তদবির তালাশি করিবার প্রয়োজন। গাছের গোড়া হইতে আগাছা নষ্ট করিয়া দিতে হয়। গোড়ায় পানি ঢালিতে হয়। তবেই ফুলের গাছে ফুল ফোটে, সেই ফুলের গন্ধে দুনিয়া মাতোয়ারা হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে যদি ভুলেও দু-একটা ফুলগাছ জন্মে আমরা গোড়ায় পানি ঢালা দূরের কথা, কুঠার লইয়া তাহাকে আঘাত করিতে প্রবৃত্ত হই। নজরুল-জীবনের সঙ্গে যাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তাঁরা সকলেই একথার সাক্ষ্যদান করিবেন। নজরুলের কবিজীবনের আবির্ভাবের সময় আমাদের সমাজ যে কুৎসিত ভাষায় কবিকে আক্রমণ করিয়াছে, যেভাবে তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছে, তাহার কণ্টকক্ষতগুলি মহাকাল কবির কাব্যের সঙ্গে বহন করিয়া চলিবে। অনাগত যুগের কাব্য-রসগ্রাহীদের কাছে আমরা সেইজন্য হেয় হইয়া থাকিব।

যাক এসব কথা। কবি কিন্তু আসন্ন ভোটযুদ্ধে বড়ই আশাবাদী ছিলেন। আমি লোক-চরিত্র কিছুটা জানিতাম। আমাদের সমাজের মানসিকতার কথাও অবগত ছিলাম। তাই কবির মনকে আগে হইতেই পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করিবার জন্য তৈরি রাখিতে চেষ্টা করিতেছিলাম। কিন্তু সবই বৃথা। পির বাদশা মিঞার সমর্থন-চিঠি তিনি পাইয়াছেন। আরও বহু মুসলিম নেতা কবিকে সমর্থন করিয়াছেন। কিন্তু মুসলিম-সমাজের কাগজগুলি বহুদিন হইতে তাঁহার বিরুদ্ধে যে বিষোদ্গার করিতেছিল, তাহার ধাক্কায় শত শত বাদশা মিঞা যে ভাসিয়া যাইবেন-এই বয়স্ক-শিশুকে তাহা আমি কেমন করিয়া বুঝাইব?

প্রথম ভোটের দিন কবিকে ভোটগ্রাহক অফিসারের সামনে বসাইয়া দিলাম। কবির সামনে গিয়া ভোটাররা ভোট দিবেন। মনে একটু ভরসা ছিল, কবিকে সামনে দেখিয়া ভোটাররা হয়তো তাঁহাকে সমর্থন করিবেন। কবি সন্ধ্যাবেলায় আসিয়া আমাকে বলিলেন, বহু লোক তাঁহাকে ভোট দিয়াছেন; তাঁহাদের মুখ দেখিয়াই নাকি কবি ইহা বুঝিতে পারিলেন। পরদিন সকালে আমরা নদীতে গোসল করিতে চলিয়াছি। কবি আমাকে বলিলেন, “দেখ জসীম, ভেবে দেখেছি, এই ভোটযুদ্ধে আমার জয় হবে না। আমি ঢাকা চলে যাই। দেখি, অন্ততপক্ষে জামানতের টাকাটা যাতে মারা না যায়।”

তখন আমার বড়ই হাসি পাইল। জয়ী হইবেন বলিয়া কাল যিনি খুশিতে মশগুল ছিলেন, হারিয়া গিয়া জামানতের টাকা মার যাওয়ার চিন্তা আজ তাঁহার মনে কোথা হইতে আসিল? ব্যবহারিক জীবনে এই বয়স্ক-শিশুটি সারা জীবন ভরিয়া এমনি ভুল করিয়া প্রতি পদক্ষেপে নানা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হইয়াছেন।

দুপুরের গাড়িতে কবি চলিয়া গেলেন। মনটা বড়ই খারাপ হইয়া গেল। হঠাৎ এমন করিয়া কবির সাহচর্য হইতে বঞ্চিত হইব, তাহার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

একবার পরলোকগত সরোজিনী নাইডুর সঙ্গে কবি আর হেমন্তকুমার সরকার আমাদের ফরিদপুরে আসিলেন। সরোজিনী নাইডু একদিন পরেই চলিয়া গেলেন। কবিকে আমরা কয়েকদিন রাখিয়া দিলাম।

আমি তখন ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়ি। আমরা সকল ছাত্র মিলিয়া কবিকে কলেজে আনিয়া অভিনন্দন দিব স্থির করিলাম। আমাদের প্রিন্সিপাল কামাখ্যাচরণ মিত্র মহাশয় খুশি হইয়া আমাদের প্রস্তাবে রাজি হইলেন।

 

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০০)

১১:০০:৪০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫

নজরুল

মুসলিম সমাজের শ্রেষ্ঠ কবিকে আমার দেশ এইভাবে সম্মান জানাইল। এইজন্যই আধুনিক মুসলিম সমাজে বড় লেখক বা বড় কবির আগমন হয় নাই। মিশর, তুরস্ক, আরব-কোনো দেশেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকের উদয় হইতেছে না। অথচ ইসলামের আবির্ভাবের প্রারম্ভে আমাদের সমাজে কত বিশ্ববরেণ্য মহাকবির আবির্ভাব ঘটিয়াছিল। হাফিজ, রুমি, সাদি, ওমর খৈয়াম এঁদের লেখা পড়িয়া জগৎ মোহিত। কিন্তু আজ কি দেখিতেছি? সমস্ত মুসলিম জগতে কোথা হইতেও প্রতিভার উদয় হইতেছে না। প্রতিভাকে বড় ও পুষ্ট করিয়া তুলিবার মতো মানসিকতা আমাদের সমাজ-জীবন হইতে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। বনে-জঙ্গলে আগাছার অন্তরালে বহু ফুল ফুটিয়া থাকে।

কে তাহাদের সন্ধান রাখে? ফুলের বাগান করিতে হইলে উপযুক্ত মালীর প্রয়োজন ফুলগাছের তদবির তালাশি করিবার প্রয়োজন। গাছের গোড়া হইতে আগাছা নষ্ট করিয়া দিতে হয়। গোড়ায় পানি ঢালিতে হয়। তবেই ফুলের গাছে ফুল ফোটে, সেই ফুলের গন্ধে দুনিয়া মাতোয়ারা হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে যদি ভুলেও দু-একটা ফুলগাছ জন্মে আমরা গোড়ায় পানি ঢালা দূরের কথা, কুঠার লইয়া তাহাকে আঘাত করিতে প্রবৃত্ত হই। নজরুল-জীবনের সঙ্গে যাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তাঁরা সকলেই একথার সাক্ষ্যদান করিবেন। নজরুলের কবিজীবনের আবির্ভাবের সময় আমাদের সমাজ যে কুৎসিত ভাষায় কবিকে আক্রমণ করিয়াছে, যেভাবে তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছে, তাহার কণ্টকক্ষতগুলি মহাকাল কবির কাব্যের সঙ্গে বহন করিয়া চলিবে। অনাগত যুগের কাব্য-রসগ্রাহীদের কাছে আমরা সেইজন্য হেয় হইয়া থাকিব।

যাক এসব কথা। কবি কিন্তু আসন্ন ভোটযুদ্ধে বড়ই আশাবাদী ছিলেন। আমি লোক-চরিত্র কিছুটা জানিতাম। আমাদের সমাজের মানসিকতার কথাও অবগত ছিলাম। তাই কবির মনকে আগে হইতেই পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করিবার জন্য তৈরি রাখিতে চেষ্টা করিতেছিলাম। কিন্তু সবই বৃথা। পির বাদশা মিঞার সমর্থন-চিঠি তিনি পাইয়াছেন। আরও বহু মুসলিম নেতা কবিকে সমর্থন করিয়াছেন। কিন্তু মুসলিম-সমাজের কাগজগুলি বহুদিন হইতে তাঁহার বিরুদ্ধে যে বিষোদ্গার করিতেছিল, তাহার ধাক্কায় শত শত বাদশা মিঞা যে ভাসিয়া যাইবেন-এই বয়স্ক-শিশুকে তাহা আমি কেমন করিয়া বুঝাইব?

প্রথম ভোটের দিন কবিকে ভোটগ্রাহক অফিসারের সামনে বসাইয়া দিলাম। কবির সামনে গিয়া ভোটাররা ভোট দিবেন। মনে একটু ভরসা ছিল, কবিকে সামনে দেখিয়া ভোটাররা হয়তো তাঁহাকে সমর্থন করিবেন। কবি সন্ধ্যাবেলায় আসিয়া আমাকে বলিলেন, বহু লোক তাঁহাকে ভোট দিয়াছেন; তাঁহাদের মুখ দেখিয়াই নাকি কবি ইহা বুঝিতে পারিলেন। পরদিন সকালে আমরা নদীতে গোসল করিতে চলিয়াছি। কবি আমাকে বলিলেন, “দেখ জসীম, ভেবে দেখেছি, এই ভোটযুদ্ধে আমার জয় হবে না। আমি ঢাকা চলে যাই। দেখি, অন্ততপক্ষে জামানতের টাকাটা যাতে মারা না যায়।”

তখন আমার বড়ই হাসি পাইল। জয়ী হইবেন বলিয়া কাল যিনি খুশিতে মশগুল ছিলেন, হারিয়া গিয়া জামানতের টাকা মার যাওয়ার চিন্তা আজ তাঁহার মনে কোথা হইতে আসিল? ব্যবহারিক জীবনে এই বয়স্ক-শিশুটি সারা জীবন ভরিয়া এমনি ভুল করিয়া প্রতি পদক্ষেপে নানা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হইয়াছেন।

দুপুরের গাড়িতে কবি চলিয়া গেলেন। মনটা বড়ই খারাপ হইয়া গেল। হঠাৎ এমন করিয়া কবির সাহচর্য হইতে বঞ্চিত হইব, তাহার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

একবার পরলোকগত সরোজিনী নাইডুর সঙ্গে কবি আর হেমন্তকুমার সরকার আমাদের ফরিদপুরে আসিলেন। সরোজিনী নাইডু একদিন পরেই চলিয়া গেলেন। কবিকে আমরা কয়েকদিন রাখিয়া দিলাম।

আমি তখন ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়ি। আমরা সকল ছাত্র মিলিয়া কবিকে কলেজে আনিয়া অভিনন্দন দিব স্থির করিলাম। আমাদের প্রিন্সিপাল কামাখ্যাচরণ মিত্র মহাশয় খুশি হইয়া আমাদের প্রস্তাবে রাজি হইলেন।

 

চলবে…..