সারাক্ষণ রিপোর্ট 
ইন্দোনেশিয়ার বন উজাড়ের পেছনে আর-ভি শিল্প
ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও দ্বীপে শত সহস্র একর বনভূমি কেটে ফেলা হচ্ছে একটি বিশেষ কাঠের জন্য, যার নাম ‘লওয়ান’ বা ‘মেরান্তি’। এই কাঠ যুক্তরাষ্ট্রের মোটরহোম বা আর-ভি শিল্পে ব্যবহৃত হয়, বিশেষত আসবাব, দেয়াল ও ফ্লোর তৈরিতে।
দক্ষিণ ক্যারোলিনার চার্লসটনের আনা মন্টগোমারি ২০২০ সালে তার উইনেবাগো মিনিওয়িনি আর-ভি কিনেছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না, এর ভেতরে হয়তো বন উজাড়ের কাঠ রয়েছে। তিনি পরে প্রশ্ন তোলেন, “আমি ভেবেছিলাম ভালো একটি আর-ভি কিনেছি, কিন্তু এর বাস্তবতা কী?”
সুনগাই মাতামাতার ধ্বংসযজ্ঞ
বোর্নিওর পশ্চিম প্রান্তে সুনগাই মাতামাতা গ্রামসংলগ্ন প্রাচীন বনে খননযন্ত্র ও কাঠুরেরা ঢুকে পড়ে। আইন উপেক্ষা করে জলাভূমি শুকিয়ে ফেলা হয় এবং কয়েক দিনের মধ্যেই প্রায় ২,৮০০ ফুটবল মাঠের সমান বনভূমি ধ্বংস হয়ে যায়। স্থানীয় এক বন কর্মকর্তা সামসিদার সেই দৃশ্যকে “প্রলয়ের মতো” বলে বর্ণনা করেন।
এসব গাছ ছিল মেরান্তি প্রজাতির, যা যুক্তরাষ্ট্রে আর-ভি নির্মাণশিল্পে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এই কাঠ হালকা, আর্দ্রতা সহনীয় এবং নমনীয়, যা পাতলা আকারে কেটে আর-ভি-র অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় ব্যবহৃত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের আর-ভি শিল্প ও কাঠের চাহিদা
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আর-ভি তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। শুধু ২০২০ সালের পর থেকে দেশটি ইন্দোনেশিয়া থেকে ৯০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের লওয়ান আমদানি করেছে। সংরক্ষণকর্মীরা বলছেন, এর ফলে বন উজাড় দ্রুত বেড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে জীববৈচিত্র্য, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও জলবায়ুর ওপর।
আর-ভি শিল্প যদিও নিজেকে প্রকৃতি সংরক্ষণের সমর্থক হিসেবে উপস্থাপন করে, তবুও সরবরাহ শৃঙ্খলে অবৈধ কাঠ ঢুকে পড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উইনেবাগো দাবি করে তারা পরিবেশ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আর থর ইন্ডাস্ট্রিজ বলছে তারা অবৈধ কাঠ কিনে না। তবে বেশিরভাগ কোম্পানি অভিযোগের সুনির্দিষ্ট জবাব দেয়নি।
লওয়ান নিয়ে শিল্পের অবস্থান
আর-ভি ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, “লওয়ান শুধু পছন্দ নয়, বরং একটি অপরিহার্য উপাদান।” তাদের দাবি, বিকল্প উপকরণ পাওয়া গেলেও সেগুলো ভারী, ব্যয়বহুল এবং কাঠামোগত ঝুঁকি তৈরি করে।
তবে সংরক্ষণকর্মীরা বলছেন, টেকসইভাবে উৎপাদিত লওয়ান সহজলভ্য এবং দাম মাত্র ২০ শতাংশ বেশি হলেও তা আর-ভি-র সামগ্রিক দামে তেমন প্রভাব ফেলবে না।
মহামারির সময় চাহিদা বৃদ্ধির প্রভাব
মহামারির সময় যুক্তরাষ্ট্রে আর-ভি-র চাহিদা রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে যায়। বর্তমানে আশি লাখেরও বেশি আমেরিকান পরিবার আর-ভি ব্যবহার করছে। এর ফলে বোর্নিওর বনভূমি আরও দ্রুত উজাড় হতে থাকে।
ব্রিটিশ সংস্থা আর্থসাইট এবং ইন্দোনেশীয় সংগঠন অরিগা নুসান্তারা সরকারি নথি ও শিপিং রেকর্ড থেকে প্রমাণ দিয়েছে যে, ইন্দোনেশিয়ার উজাড় হওয়া বন থেকে সরাসরি কাঠ আমেরিকার আর-ভি কোম্পানিগুলোতে পৌঁছেছে।
পবিত্র বনভূমি ধ্বংস
ইন্দোনেশিয়া সরকার প্রায়শই জমি কোম্পানিগুলোকে কনসেশন হিসেবে দেয়, অনেক সময় স্থানীয়দের জমিও কেড়ে নেয়। পশ্চিম বোর্নিওর সাবার বাবু এলাকায় ডায়াক আদিবাসীরা যে পাহাড়ি বনকে পবিত্র মনে করত, সেটিও আংশিক ধ্বংস হয়ে গেছে।
গ্রামপ্রধান আন্দ্রেয়াস রাটিয়ুস বলেন, “আমাদের বিশ্বাস ছিল বড় গাছ কাটা যাবে না, প্রাণী বিরক্ত করা যাবে না।” কিন্তু ২০২০ সালে কোম্পানির কর্মীরা এসে পাহাড়ের অংশ কেটে ফেলে। প্রতিবাদকারীদের কিছু গ্রামবাসীকে পুলিশ আটক করে।
মারিয়া আদোহ নামের এক নারী জানালেন, তার ৫০ একর রাবার গাছের বাগান পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। এখন তিনি দিনমজুরির কাজ করে কোনো মতে বেঁচে আছেন।
জলবায়ু ও পরিবেশগত প্রভাব
২০২৩ ও ২০২৪ সালের মধ্যে সুনগাই মাতামাতা ও আশপাশের গ্রামে বন ধ্বংসের কারণে ২.৫ লাখ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়েছে, যা ৫০ হাজার গাড়ির বার্ষিক নির্গমনের সমান।
এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে পিটি মায়াওয়ানা পারসাদা নামের একটি কোম্পানি। আইন অনুযায়ী তাদের পিটল্যান্ড ধ্বংস করার অনুমতি ছিল না, কিন্তু তারা তা করেই ফেলেছে। ফলে জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বনভূমি মুছে গিয়ে সেখানে শিল্পউদ্ভিদ (অ্যাকাসিয়া) চাষ শুরু হয়।
বোর্নিওর বৃষ্টি-অরণ্যের দ্রুত ধ্বংস যুক্তরাষ্ট্রের আর-ভি শিল্পের চাহিদার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এই শিল্প এখন যুক্তরাষ্ট্রে উষ্ণমণ্ডলীয় কাঠের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। টেকসই উৎস থাকা সত্ত্বেও সস্তা কাঠের লোভে তারা পরিবেশের ক্ষতি করছে। এর ফলে শুধু বনভূমি নয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন ও বৈশ্বিক জলবায়ুর ওপরও গুরুতর প্রভাব পড়ছে।
