মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:২৬ পূর্বাহ্ন

ঢাকায় কত প্রকারের মসলিন ছিলো (২য় কিস্তি)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০২৪, ৬.৪২ পিএম

শিবলী আহম্মেদ সুজন

৪ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জেমস্ টেলরও উপরোক্ত রকমের মসলিন সমূহের নাম দিয়েছেন, যদিও সুতার সংখ্যা এবং মূল্যের পার্থক্য ছিল। এখন বিভিন্ন প্রকারের মসলিনের বিবরণ দেওয়া যাক:

মলমল খাস

প্রকৃতপক্ষে মোগল আমলের মলবুস খাসই আঠার শতক এবং তার পরবর্তী সময়ে মলমল খাস নামে পরিচিত ছিল। মলবুস খাসের নামের তাৎপর্য পূর্বে বর্ণনা করী হয়েছে। কিন্তু আঠার শতক থেকে মলমল খাস নামে একটি ভিন্ন প্রকারের মসলিন তৈরী হত, এবং এ কাপড় বিদেশে রপ্তানী হত। মলমল খাস-এ ১৮০০ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত সুতা ব্যবহৃত হত এবং সাধারণতঃ মলমল খাস আধা টুক্রায় তৈরী হত, অর্থাৎ এর দৈর্ঘ্য ছিল ১০ গজ এবং প্রস্থ ১ গজ। মোগল আমলে এ কাপড় অত্যন্ত সূক্ষ্ম ছিল, এত সূক্ষ্ম যে এর ওজন ৬।৭ তোলার বেশী ছিল না এবং একে ছোট অঙ্গুরীয়ের ভিতরে অনায়াসে নাড়াচাড়া করা যেত। ১৮৫১ সালে বিদেশে বিখ্যাত প্রদর্শনীতে এ জাতীয় যে মসলিনখানি প্রদর্শন করা হয়েছিল, তার ওজন ছিল আট তোলা। আঠার শতকে মোগল বাদশাহের জন্য তৈরী মলবুস খাস ছাড়াও অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম ও কম মিহি নানা রকমের মলমল খাস তৈরী হত। সেগুলি দামেও অনেক সস্তা ছিল। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক রপ্তানীকৃত মলমল খাস, ফাইন, ফাইন সুপার ফাইন, ফাইনলঙ্গ, সুপার ফাইন লঙ্গ ইত্যাদি নামে বিভক্ত ছিল এবং এদের সুতার সংখ্যা ১২০০ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত ও দাম ৭.৫০ থেকে ৪৭ টাকা পর্যন্ত উঠা-নামা করত।.

ঝুনা

জেমস টেলর মনে করেন যে, ঝুনা শব্দটি হিন্দি শব্দ ঝিনা (অর্থ-সূক্ষ্ম বা সরু) থেকে উদ্ভুত। ঝুনা কাপড় এত সূক্ষ্ম ছিল যে, এ কাপড় পরিধান করলেও দেহ নগ্নপ্রায় থাকত এবং কমসংখ্যক সুতা ব্যবহৃত হওয়ায় একে একটি সূক্ষ্ম জালের মত দেখাত। ইহা দৈর্ঘ্যে ২০ গজ এবং প্রস্থে ১ গজ ছিল এবং এতে প্রায় ১০০০ টানা সুতা থাকত এবং এর ওজন প্রায় ২০ তোলা ছিল। মোগল আমলে এর বিশেষ প্রচলন ছিল; ফরাসী পর্যটক ট্যভার্নিয়র এর উল্লেখ করে বলেছেন যে, ঝুনা কাপড় বিদেশী বণিকদিগকে রপ্তানী করতে দেওয়া হতনা এবং সাধারণতঃ এগুলি মোগল দরবারে পাঠান হত। ধনী ও বিত্তশালী দেশীয় লোকদের হারেমের মেয়েদের ঝুনা কাপড় ব্যবহার করার রেওয়াজ ছিল। নওয়াব-বাদশাহ বা বড় বড় আমীর-ওমরাহদের মহিষীরাও গরমের মৌসুমে ঝুনা মসলিনের জামা তৈরী করতেন। নর্তকী ও গায়িকারাও ঝুনা কাপড় পরত।

রঙ্গ

রঙ্গও ঝুনার মত জালী মসলিন। এতে ১২০০ সুতা থাকত এবং এর দৈর্ঘ্য ২০ গজ ও চওড়া ১ গজ ছিল এবং এর ওজন প্রায় ২০ তোলা ছিল।

আব-ই-রওয়ান

ফাসী শব্দ আব (পানি) এবং রওয়ান (প্রবাহিত) থেকে আব-ই-রওয়ান নামের উৎপত্তি। এ কাপড় এত সূক্ষ্ম ও পাতলা বুননী বিশিষ্ট ছিল যে ঢাকার তাঁতিরা “আব-ই-রওয়ান” বা “প্রবাহিত পানি” নাম দিয়ে এর সূক্ষ্মতা ও  শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ করত। বিদেশেও আব-ই-রওয়ান-এর বিশেষ নাম ছিল এবং বিদেশী বণিক কোম্পানীরা অপেক্ষাকৃত কম সূক্ষ্ম আব-ই-রওয়ান প্রচুর পরিমাণে রপ্তানী করত। আব-ই-রওয়ান সাদা জমিনে নক্সা বিহীন (plain) মসলিন এবং এর দ্বারা পড়ার জন্য জামা ইত্যাদি তৈরী হত। এ কাপড় লম্বায় ২০ গজ এবং চওড়ায় ১ গজ ছিল এবং সুতার সংখ্যা ৭০০ থেকে ১৪০০ পর্যন্ত উঠা- নামা করত। এর ওজন ছিল প্রায় ২০ তোলা। ১৭৭০ সালে উইলিয়াম বোল্ট তাঁর Consideration on Indian Affairs-এ লিখেছেন যে, ঢাকাবাসীরা আব-ই- রওয়ান সম্পর্কে দুইটি মুখরোচক গল্প বলতেন। ১ম, একবার সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর মেয়েকে নগ্নদেহে থাকার জন্য  গাল-মন্দ করেন। রাজকন্যা তখন প্রতিবাদ করে বলেন যে, তিনি তখন সাতটি জামা পড়ে ছিলেন। ২য়, একদিন একটা আব-ই-রওয়ান ঘাসের উপর শুকাতে দেওয়া হয়। কোন এক কৃষকের গরু ঐ মাঠে চড়তে গিয়ে বহু মূল্যবান আব-ই-রওয়ান খানির সাথে ঘাস খেয়ে ফেলে। এ অপরাধে রাগান্বিত হয়ে নওয়াব আলীবর্দী খান কৃষককে ঢাকা থেকে বের করে দেন।

সরকার-ই-আলি

আগেই বলা হয়েছে যে, প্রথম যুগে সরকার-ই-আলি কোন বিশেষ ধরনের কাপড়ের নাম ছিলনা; মোগল সম্রাটের জন্য তৈরী মসলিনকে যেমন সম্মানসূচক মলবুস খাস নাম দেওয়া হয়েছিল, বাংলার নওয়াবের জন্য তৈরী মসলিনকেও তেমনি সম্মান করে সরকার-ই-আলি বলা হত। বাংলার নওয়াবের সরকার-ই- আলি নামধারী জায়গীরের প্রাপ্য খাজনা থেকে মসলিন-এর মূল্য পরিশোধ করা হত বলেই হয়ত মসলিন-এর নামও সরকার-ই-আলি রাখা হয়েছিল। কিন্তু মলমল খাস-এর ন্যায় পরবর্তী কালে সরকার-ই-আলি নামধারী বিশিষ্ট প্রকারের মসলিনও তৈরী হত। সরকার-ই-আলি অত্যন্ত মিহি বুননী বিশিষ্ট ছিল এবং সূক্ষ্মতার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। ইহাও সাদা জমিন বিশিষ্ট (plain) ছিল এবং পরিধেয় জামা ইত্যাদি তৈরীর জন্য ব্যবহৃত হত। ইহা দৈর্ঘ্যে ১০ গজ এবং চওড়ায় ১ গজ ছিল; এর সুতার সংখ্যা ছিল ১৯০০ এবং ওজন ছিল প্রায় ১০ তোলা।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল করিম-এর বইয়ের সহায়তায় এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024