মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫৫ পূর্বাহ্ন

ঢাকায় কত প্রকারের মসলিন ছিলো (৫ম কিস্তি)

  • Update Time : রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪, ৩.৪২ পিএম

শিবলী আহম্মেদ সুজন

জেমস্ টেলরকে অবলম্বন করে উপরে মসলিনের একটি মোটামুটি সাধারণ বিবরণ দেওয়া হল। সমসাময়িক লেখকের বিবরণের অভাবে মোগল আমলে প্রকৃত পক্ষে মসলিন কত সূক্ষ্ম ও মিহি ছিল তার কোন সঠিক বা অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়না। ১৭৭২ সালে বোল্ট লিখেছেন যে, ঢাকার তাঁতিদের মতে মোগল বাদশাহদের জন্য তৈরী মলবুস খাস এত সূক্ষ্ম ছিল যে তা কল্পনারও অতীত। উদাহরণ স্বরূপ তারা এক খন্ড আব-ই-রওয়ান-এর উল্লেখ করেছেন যা বাদশাহ আওরঙ্গজেবের জন্য তৈরী করা হয়েছিল। এ কাপড়টির ওজন ছিল ৫ তোলা এবং এর মূল্য ছিল ৪০০ টাকা।৭ ১৮০০ সালে ঢাকার Commercial Resident জন টেলর কিন্তু ভিন্ন কথা বলেছেন।

তিনি বলেছেন যে, তিনি এমন কোন মসলিন দেখেন নি যার ওজন ২২ তোলার কম ছিল এবং মূল্য ২০০ টাকার বেশী ছিল। এই পরস্পর বিরোধী মতের সত্যতা নির্ধারণ করার কোন উপায় নাই, কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, জন টেলরের মত গ্রহণযোগ্য নয়। বোল্ট বা জন টেলর কেউ মোগল আমলে মসলিনের স্বর্ণযুগ দেখেন নি। বস্তুতঃপক্ষে বোল্ট এবং জন টেলরের আমলে মসলিন শিল্পের অবনতির সময়। বোল্ট ঢাকার তাঁতিদের যে উক্তি লিপিবদ্ধ করেছেন তাতে কিছু অতিরঞ্জন থাকলেও একথা সত্য যে আওরঙ্গজেবের সময় বা তৎপূর্ববর্তীকালে জন টেলরের সময় থেকে আরও অধিকতর সূক্ষ্ম বা অধিক মূল্যবান মসলিন তৈরী হত। মুর্শিদ-কুলী খান কর্তৃক বাদশাহ আওরঙ্গজেবের নিকট প্রেরিত মসলিনের যে বিবরণ জন টেলর নিজে দিয়েছেন তার কোন কোনটার মূল্য ২০০ টাকার বেশী ছিল।

৮ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তৈরী অর্ধ টুকরা একখানি মসলিন (১০ গজ X ১ গজ) ১৮৫১ সনে  বিদেশের প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়েছিল, এর ওজন ছিল ৮ তোলা।১ ঢাকা মিউজিয়ামে রক্ষিত মসলিনখানির দৈর্ঘ্য ১০ গজ এবং চওড়া ১ গজ, এর ওজন মাত্র ৭ তোলা। ১০ এতে মনে হয় জন টেলর বর্ণিত ওজনের চেয়েও কম ওজনের মসলিন জন টেলরের পরবর্তী সময়েও তৈরী হত। সুতরাং মসলিন শিল্পের স্বর্ণযুগে আরও সূক্ষ্মতর মসলিন তৈরী হওয়া অসম্ভব নয়।

১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দে জন টেলর সূক্ষ্মতম মসলিন তৈরীর চেষ্টা করেন। তিনি জঙ্গলবাড়ীর অত্যন্ত নিপুণ কয়েকজন তাঁতিকে একখন্ড করে মলমল খাস, জঙ্গল খাসা এবং সরকার-ই-আলি তৈরীর জন্য নিযুক্ত করেন। অল্প সময়ের মধ্যে মসলিন তৈরী শেষ হওয়ার জন্য এবং তাঁতিদের কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য তিনি প্রত্যেকটির’ অর্ধ টুকরা অর্থাৎ ১০ গজ তৈরী করতে বলেন এবং প্রত্যেক খন্ড কাপড়ের জন্য ২০০ টাকা করে মোট ৬০০ টাকা অগ্রিম মূল্য দেন। তাঁতিরা ওয়াদা করে যে তারা সুতার সংখ্যায় এবং অন্যান্য তাঁতের কাজে কোনরূপ ফাঁকি দেবেনা এবং অন্ততঃপক্ষে মোগল আমলের মলবুস খাসের অনুরূপ সূক্ষ্ম মসলিন তৈরী করবে।

তিন-চার মাস পরে কাপড় পেলে দেখা গেল যে, ঐ কাপড়গুলি মলবুস খাসের সমকক্ষ ত নয়ই, বরং জন টেলর কর্তৃক পরে সোনারগাঁও-এ তৈরী একখন্ড মসলিনেরও সমকক্ষ ছিলনা।১১ তাঁতিরা শুধু যে কাজে ফাঁকি দিয়েছে তা নয়, বরং সুতা সংগ্রহের ব্যাপারেও বিশেষ মনযোগ দেয়নি। কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণ হয় না যে, জন টেলর যে মসলিন তৈরী করেছিলেন তার চেয়ে সূক্ষ্মতর মসলিন ঢাকার তাঁতিরা তৈরী করতে অপারগ ছিল। কারণ জেমস্ টেলর- এর সময়েও এরচেয়ে সূক্ষ্মতর মসলিন তৈরী হত এবং জেমস্ টেলর প্রদত্ত নিম্ন তালিকা থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবেঃ ১২

মসলিন তৈরীর তারিখ দৈর্ঘ্য চওড়া সুতার সংখ্যা ওজন মূল্য

আওরঙ্গজেবের রাজত্ব

                                  কাল               ১০ গজ          ১ গজ         ১৮০০    ১০ তোলা        ১০০ টাকা

১৭৯০ ও ১৮০০ খৃঃ     “                       “                       “             “            ১২/২              ৮০ টাকা

১৮৫০ খৃষ্টাব্দ              “                       “                          “            “             ৮/২             ১০০ টাকা

উপরোক্ত উৎকৃষ্ট ধরনের মসলিন ছাড়া ঢাকায় মাঝারি রকমের কাপড়ও তৈরী হত। নিম্নে তাদের বিবরণ দেওয়া গেল।

বাস্তা

বাস্তা শব্দ ফার্সী এবং এর অর্থ বুনা। বাস্তা মোটা বুননী বিশিষ্ট কাপড়। সাধারণতঃ ত্রিপুরা জিলায় এবং ঢাকার প্রামাঞ্চলে যেমন কলাকোপায় বাস্তা কাপড় তৈরী হত। এর দৈর্ঘ্য ২২ গজ এবং চওড়া ১ গজ ছিল। দেশী লোকেরা বাস্তা দ্বারা চাদর তৈরী করত।

বুনী

বুনা থেকেই বুনী শব্দের উৎপত্তি। এ ভাবে বিচার করলে বাস্তা ও বুনী সমার্থক। বুনীর লাল ও কাল পাড় বা আঁচল থাকত। লাল পাড় বা আচল বিকন কাপড় হিন্দু মেয়েরা পরিধেয় শাড়ী রূপে ব্যবহার করত এবং মুসলমান মেয়েরা কাল পাড় বিশিষ্ট বুনী ব্যবহার করত।

একপাট্টা

এক পাট্টার অর্থ এক পাল্লা অর্থাৎ এক টুকরা কাপড়, যা হিন্দুরা গায়ের চাদররূপে ব্যবহার করত। এর দুখণ্ড কাপড় এক সাথে সিলাই করে ব্যবহার করলে তাকে দুপাট্টা বলা হত। এর দৈর্ঘ্য ২ থেকে ৩ গজ এবং চওড়া দেড় গজ ছিল।

জোড়

জোড়া শব্দ থেকে জোড় শব্দের উৎপত্তি। জোড় নামকরণের কারণ এই যে, এর এক জোড়া কাপড় একসাথে ব্যবহার করা হত। ব্রাহ্মণরা এর এক টুক্রা নাভির নিম্নভাগে এবং আর এক টুক্লা নাভির উপরিভাগে ব্যবহার করত।

শাড়ী

সে যুগের শাড়ী ও বর্তমান যুগের শাড়ী আকারে একই। শাড়ী লাল ও ক্লাল পাড় বিশিষ্ট ছিল। বুনীর মতই লাল ও কাল পাড় বিশিষ্ট শাড়ী যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলমান মেয়েরা ব্যবহার করত।

ধুতি

ধোওয়া শব্দ ধুতি শব্দের মূল। শাড়ীর মত ধুতিও আকারে এবং ব্যবহারে বর্তমান যুগের ধুতির মত ছিল। পুরুষরা ধুতি পরত এবং যেহেতু পরিধেয় কাপড় প্রত্যেকদিন গোসল করার সময় ধোওয়া হত সেহেতু তার নামকরণ করা হয়েছিল ধুতি।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল করিম-এর বইয়ের সহায়তায় এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024