সমাজের বা রাষ্ট্রের একটি স্থান কখনও আলাদা করে মেধাভিত্তিক তৈরি করা যায় না। আর তা আইন দিয়েও হয় না। মেধাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রগড়া মূলত একটা কালচার বা সংস্কৃতি। বিশেষ করে সমাজে এই সংস্কৃতি পরিস্ফূটিত হবার পরিবেশ না পেলে কখনই মেধার বিকাশ ঘটা সম্ভব নয়। যে কোন সংস্কৃতি মানব সমাজ ও সভ্যতার বিষয়। সমাজের সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে তা বেড়ে ওঠে।
সভ্যতার অতীতে রাজারা কেউ কেউ এই সংস্কৃতিকে বাধা দেয়নি। আবার অনেকে বাধা দিয়েছে। যে কোন সাহিত্য’র ভেতর দিয়ে ওই সময়ের সমাজ বা রাষ্ট্রের একটা ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। তাই মহাকাব্য রামায়নে দেখা যাচ্ছে, ঈশ্বর নিয়ে সংশয় তাড়িত বুদ্ধিজীবি বা ঋষি জাবালি তার স্ত্রীকে বলছে, দেখ, রাজা দশরথ বৃদ্ধ হয়ে গেছে, এখন রাম রাজা হবে। সে তো সবকিছু জনতুষ্টির জন্যে করবে। তাই রাজসভায় আর গুনীর কদর থাকবে না। তাই আগে থেকে হিমকূট পর্বতে চলে যাই।
এখান থেকে দুটো বিষয় স্পষ্ট হয়, এক, সব রাজা অতীতে মেধার মূল্যায়ন করতেন না, কিছু কিছু রাজা করতেন। দুই, জনতুষ্টির বিষয়টাতে কখনও মেধাকে গুরুত্ব দেয়া হয়।
অতীতের রাজারা এখন অতীত। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বয়সও পাঁচ’শ বছরের বেশি হতে চলেছে। এর বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীতে বেশ কয়েক ধরনের গণতন্ত্র ও কয়েক ধরনের স্বৈরতন্ত্র’র মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো পরিচালিত হচ্ছে।
গণতন্ত্রের মধ্যে যারা সব থেকে ভালো তারা জনতুষ্টির সঙ্গে মেধার যোগ ঘটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর যারা মধ্যম তারা শুধু জনতুষ্টির দিকে নজর দিচ্ছে। আর যারা নিম্মমানের তারা প্রয়োজনে জনতুষ্টি ও প্রয়োজনে স্বৈরতন্ত্রের মতো কঠোরতাকে ব্যবহার করছে।
এর বিপরীতে স্বৈরতন্ত্রে মেধার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সুযোগ নেই বললে চলে। নিতান্ত নিভৃতে গিয়ে ছাড়া মেধার চর্চা স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে বসে করা যায় না। হয়তো এ কারনেই অতীতে মুনি, ঋষিরা রাজার রাজ্য সীমানা ছেড়ে জঙ্গল বা পর্বতে চলে যেতেন। কারণ, স্বৈরতন্ত্র শুধুমাত্র আনুগত্য চায়। যা শুধু দাস শ্রেনীর থাকে। আর অনুগত মগজে কখনও মেধার বিকাশ ঘটার সুযোগ নেই। মেধার বিকাশের জন্যে, রবীন্দ্রনাথের ওই চিত্ত যেথা ভয় শুণ্য’র অণুকরনে বলা যায়, একটি ভয়শুন্য পরিবেশের প্রয়োজন পড়ে। পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ যে উচ্চ শির ও মুক্ত জ্ঞানের কথা বলেছেন এর বিকল্প পরিবেশে ও মননে মেধার বিকাশ সম্ভব নয়।
আর ভয়ের পরিবেশ রাষ্ট্র তৈরি করে ঠিকই তবে এককভাবে রাষ্ট্রকে দোষ দেয়া সঠিক নয়। পাশাপাশি সমাজের অনুশাসনের নামে রাষ্ট্র শাসনের ও রাজ্য জয়ের স্বার্থে পৃথিবিতে বিভিন্ন সময়ে পরজাগতিক কেন্দ্রিক যে অনুশাসন সৃষ্টি হয়েছে, তা শুধু বাহ্যিক ভয়ের পরিবেশ নয়, অন্তরের ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে। এবং ওই ভীত অন্তর কখনই মুক্ত জ্ঞানের রাজ্যে পৌঁছাতে পারে না। সে কুয়ার ব্যঙ হয়েই থাকে। এ ধরনের কুয়ার ব্যঙরা আর যাই হোক বিকশিত মেধার হয় না।
উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে যেভাবে মেধার বিকাশ পৃথিবীতে ঘটেছিলো এ মুহূর্তে সেভাবে ঘটছে না। এই সমস্যা শুধু কোন একটি দেশের নয়, বর্তমান পৃথিবীর। এর একটি কারণ, প্রযুক্তির বিকাশ এখন অর্থনীতির মূল উপাদান হয়ে উঠেছে। যে কারণে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও সার্বিকজ্ঞানকে মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এর মূল সমস্যাটি কোথায় তা এ মুহর্তে চিন্তা করা হচ্ছে না সঠিকভাবে। তাছাড়া অর্থনীতি নির্ভর প্রযুক্তির ব্যবসায়িক তাড়না সমাজ ও রাষ্ট্রকে কিছুটা হলেও অস্থির করেছে। এ অস্থিরতা মানব সভ্যতার ইতিহাসের নানা প্রেক্ষাপটে আসে। তারপরে আবার সভ্যতা ও সমাজ নিজেই তার নিজস্ব শক্তিতে কোন একটি বড় ঘটনার মাধ্যমে বদলে নেয়।
যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’র মতো বড় ঘটনা পৃথিবীর অনেক উপনিবেশ ধ্বংস করেছিলো। আবার ওই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে অর্থনৈতিক উপনিবেশ ও সামাজতান্ত্রিক উপনিবেশ গড়ে উঠেছিলো তার ভেতর সামাজতান্ত্রিক উপনিবেশের একটা বড় অংশ সোভিয়েতের পতনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছে। অর্থনৈতিক উপনিবেশ না হোক অর্থনৈতিক যুদ্ধ সভ্যতার অংশ। এর পতন ঘটবে না। তবে সুস্থ পরিবর্তন হবে। এবং এর ভেতর দিয়ে আবার সুস্থ মেধা বিকাশের সুযোগ অনেক উন্নত দেশে সৃষ্টি হবে।
এই সার্বিক পরিবর্তন ছাড়া প্রকৃত মেধা বিকাশের একটি সমাজ ও রাষ্ট্র সহজে আশা করা যায় না। ততক্ষণে জনতুষ্টি, আনুগত্য এগুলোই রাষ্ট্র ও সমাজে বড় হয়ে থাকবে।
আর এর পাশাপাশি আর এ বিষয়টি অনেক বড়, বাস্তবে মেধা কী? মেধা বিকাশের মূল বিষয় হলো, একজন কতটা গ্রহন করার ক্ষমতা রাখে এবং কতটা প্রতি মুহূর্তে গ্রহন করছে। কোন একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে পড়ে থেকে সেখানে কিছু সাধারণ বিষয় মুখস্থ করে কখনও মেধা বিকাশ ঘটে না। তাই যারা এই গন্ডির ভেতর তরুণ প্রজম্মকে রেখে দিচ্ছে তারাও যেমন মেধা বিকাশের পথে বাধা বা মেধাভিত্তিক কাজে বাধা। তেমনি যারা ওই গন্ডির ভেতর নিজের উচ্চতাকে হিসেবে করে মেধার বিচার করছে তারাও মেধাভিত্তিক সমাজ গড়ার পথে হাঁটছে না। কারণ, উভয়েই সৃজনশীলতার থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।
Leave a Reply