মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩৩ পূর্বাহ্ন

রাঙামাটির পথে পথে

  • Update Time : বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৪, ১০.২০ পিএম

শরীফ হোসেন

পাহাড় ঝর্ণা ও মেঘের রাজ্য বাংলার দক্ষিণ পূর্বের জেলা রাঙামাটি। চারদিকে উচু উচু সব পাহাড়,তার মাঝে বয়ে চলা কাপ্তাই লেক এবংপাহাড়ের মধ্যে গহিনে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য ঝর্নার সৌন্দর্য নিয়ে রাঙামাটি হাতছানি ভ্রমণ প্রেমীদের।রাঙামাটিতে রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান।যেমন -কাপ্তাই, ঝুলন্ত ব্রিজ, শুভলং ঝর্ণা,ন-কাটা ঝর্ন এবং ধূপপানি ঝর্নার মতো স্থান।যে স্থানগুলোতে পর্যটকরা বেশি ঘুরতে পছন্দ করে।

 ৪ জুলাই, বৃহস্পতিবার রাতে বন্ধু তুষারের সাথে রওনা হই রাঙামাটির গহিনে থাকা আকর্ষণীয় ধূপপানি ঝর্ণা দেখার উদ্দেশ্য। প্রথমে মিরপুর ১০ থেকে মেট্ররেলে সহযোগে করে মতিঝিল পৌছাই রাত ৯টায়।সায়দাবাদ থেকে রাত ১০ টায় আমাদের বাস ছেড়ে যাওযার কথা।

তাই আমরা মেট্রোরেল এর মতিঝিল স্টেশনে নেমে সেখান থেকে বাস সহযোগে সায়দাবাদ পৌছই, সেখানে আমাদের সাথে আরও চারজন যোগ দেয়। তারা হলো আমার বন্ধু তুষারের কলেজ ফ্রেন্ড- রামিম, রুবি,ইউসুফ এবং নাহিয়ান ।

ওদের সাথে পরিচিত পর্ব শেষ করার পর আমরা আমাদের হোস্ট এর সাথে সাক্ষাৎ করি। খুবই আন্তরিক এবং স্মার্ট একজন মানুষ। আমাদেরকে অল্প সময়ের মধ্যেই ট্যুরের প্লানিং এবং শিডিউল বুঝিয়ে দিলেন।

তার কথা-বার্তায় বোঝা যাচ্ছিলো সে যথেষ্ট অভিজ্ঞ লোক। আমরা প্রায় ৪০ জন একসাথে যাচ্ছি।একেকজন একেক জায়গা থেকে এসে আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন। ট্যুরের জন্য সবাই বেশ এক্সাইটেড ।

এরপর আধা ঘন্টা দেড়িতে ঠিক রাত সাড়ে দশটায় আমাদের বাস গন্তব্যর উদ্দেশ্য চলতে শুরু করল। লং একটা জার্নি হবে তাই আমি সবসময়কার মতোই সাথে- চিপস, কোক, চুইংগাম, মিনারেল ওয়াটার এবং কিছু ড্রাই ফ্রুট সঙ্গে নিয়ে নেই।

কানে হেডফোন লাগিয়ে পছন্দের গান চালিয়ে সিটটা একটু ফোল্ড করে জানালার বাহিরে চোখ রেখে, চিপস এবং -কোক খেতে খেতে, চিন্তার জগতে কখন যে হারিয়ে যাই, নিজেরও খেয়াল থাকেনা। অবশ্য এ বিষয়টা আমি খুব উপভোগ করি।

তখন ঠিক রাত ১টা।কুমিল্লা হাইওয়ে পেট্রোল পাম্পে বাস থামলো। ২০ মিনিটের ব্রেক দেওয়া হয়।আমরা আমাদের প্রয়োজন সেরে নেই।পেট্রোল পাম্পের পাশেই খাবার হোটেল।

সবাই হোটেলে গিয়ে ভারি খাবার খাচ্ছিলো।কিন্তু আমি বাসে ওঠার আগে হোটেল থেকে খাবার খেয়ে নেওয়ার কারনে, আমার কোনো ক্ষুধা নেই।

কিন্তু একটা জিনিস ব্রেকে আমার নিতেই হয়, সেটা হলো-কফি। আমি একজন কফি লাভার পারসন। কফি খেলে যেমন ঘুম চলে যায় ঠিক তেমনি রিচার্জড এবং রিফ্রেশ ফিল হয়।

তাই আমি কড়া করে একটি কফি অর্ডার করে পার্সেল কাপে কফি নিয়ে বাসে উঠি। বাস আমাদের গন্ত্যব্যের উদ্দেশ্য চলতে শুরু করে।

বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছিলো, বাস স্বাভাবিক গতিতে চলছিলো। অনেকক্ষন বাহিরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম তা বুঝে উঠতে পারিনি।

হঠাৎ আমার ঘুম ভাঙলো। ঘড়ির কাটায় ভোর ৫ টা। বাহিরে তাকিয়ে দেখি উঁচু, নিচু সুন্দর পাহাড়, আঁকাবাঁকা রাস্তায় ধীর গতিতে চলছে আমাদের বাস, ভোরের আলোয় পাহাড় গুলোকে এতোই সুন্দর লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।বাতাসে অন্যরকম প্রাকৃতিক এক ঘ্রান।

তখন বুঝতে পারলাম রাঙামাটি জেলার ভিতরে আমাদের বাস। পাশের সিটে বন্ধু তুষার ঘুমাচ্ছে , তুষারকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম।বললাম- বেটা ওঠ, বাহিরে দেখ,পাহাড়ি অঞ্চলে ভোরের এই চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখা সবার ভাগ্যে জোটেনা। ও উঠেই বাহিরে তাকিয়ে বললো মাশাল্লাহ, কি অপূর্ব দৃশ্য, মোবাইল বের করে ভিডিও করতে লাগলো।

ততক্ষণে অন্যান্য ব্যক্তিরাও ঘুম থেকে উঠে গেছে। সবাই বাহিরের মনোরম দৃশ্য তাদের ফোনে ধারণ করছে। প্রকৃতির এই অপরুপ দৃশ্য দেখে সকলেই ওয়াও, গ্রেট, মাশাল্লাহ বলছে এবং হৈচৈ করছে।

আমি একটু ব্যতিক্রম। আমি বাহিরের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, কিভাবে এতো উঁচু, নিচু পাহাড়ে মানুষ রাস্তা বানালো? বাহিরে তাকলে মনে হয় এই বুঝি কাটা পাহাড় ধসে পড়বে মাঝ রাস্তায়, আবার হঠাৎ এও মনে হয় এই বুঝি বাস এক্ষুনি পাহাড়ের তলদেশে পড়ে যাবে।মুহুর্তটা যেমন আনন্দের লাগছিলো তেমন ভয় ও হচ্ছিলো আমার। রাঙামাটির এই পাহাড়ি রাস্তাগুলো সত্যিই খুব অদ্ভুত।

সকাল ৬টা আমরা কাপ্তাই এর জেটিঘাট পৌছালাম। বাস যাত্রা আমাদের এই পর্যন্তই।আমাদের যেতে হবে বিলাইছড়ি উপজেলায় ।এখান থেকে প্রায় আড়াই ঘন্টার নৌ-পথ। আমাদের হোস্ট সাহেব আগে থেকেই দুটি ট্রলার বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন।

তাই ট্রলারে উঠার পূর্বেই -আমরা লেক সাইডের একটি রেস্টুরেন্টে  ব্রেকফাস্ট সেড়ে নেই। নাস্তায় ছিলো ডিম এবং খিচুড়ি। খাবারের স্বাদ ছিলো দারুন। আমি ডিম খিচুড়িকে ট্যুরের জাতীয় খাবার মনে করি। প্রত্যেক ট্যুরের ব্রেকফাস্টে এটি থাকবেই।

সকালের নাস্তা এবং কফি খেয়ে আমি ও আমার বন্ধুরা এবং সকল ট্যুরমেট উঠে পড়লাম ট্রলারে। দুইটি ট্রলারে ২০-২০ করে মোট ৪০ জন ছিলাম। ট্রলারের ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার সাথে-সাথেই যেনো অন্য এক জগতে  হারিয়ে গেলাম।

মেঘলা আকাশ, ঠান্ডা বাতাস,পাহাড়ের নৌসর্গিক সৌন্দর্য এর মধ্যদিয়ে বয়ে চলা কাপ্তাই লেকের তরী’তে করে ভেসে যাচ্ছি আমরা। একেকজন এক এক রকম এক্টিভিটি শুরু করে দিলো।

কিছু মানুষ গ্রুপ হয়ে সুখের গান গাচ্ছে আবার কেউ ছবি- ভিডিও করছে।কেউ কেউ তো গানের সাথে উথাল পাতাল নাচও শুরু করে দিয়েছে। অন্য ট্রলারে চেয়ে দেখি একই কান্ড। ওরাও মনের সুখে গান গাইছে নাচানাচি করছে।

ঠিক যেনো দেখে মনে হচ্ছে, এরা বহু বছর পর জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছে তাই খুশিতে আত্মহারা।অবশ্য, ঢাকার কৌলাহল পূর্ণ, একঘেয়েমি ব্যস্ত জীবন থেকে এমন প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে নিজেকে আবিষ্কার করলে একটু আনন্দ উন্মাদনা তো থাকবেই।

আর এদিকে আমি ট্রলারের  একদম অগ্রভাগে দুই পা নিচের দিকে ঝুলিয়ে মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছি।প্রায় ২ ঘন্টা ট্রলার সফর করার পর আমরা পৌছাই বিলহিছড়ি আর্মি ক্যাম্পে।

সেখানে সেনাবাহিনির ব্যক্তিবর্গ আমাদের NID কার্ড এর ফটোকপি এবং গার্ডিয়ান এর মোবাইল নাম্বার নেয় এবং কিছু নিরাপত্তামুলক দিক নির্দেশনা দেয়।

অতপর আমরা আবার ট্রলারে উঠি, ঠিক আধা ঘন্টা যাত্রার পর আমরা বিলাইছরিতে পৌছাই।এখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।আমরা ট্রলার থেকে নেমে ১০ মিনিট হাঁটার পর কটেজে পৌছাই। কটেজ এর নাম স্বপ্ন বিলাস।

কটেজে পৌছে আমরা ব্যাগপত্র রাখলাম ও কিছুক্ষন বিশ্রাম করার পর  প্রস্তুতি নিলাম ।আমাদের প্রথম গন্তব্য ন-কাটা ও মুপ্পোছড়া ঝর্না যা দেখার জন্য হাটতে হবে অনেক লম্বা পথ।উচু নিচু পাহাড়ি পথ,তার উপর আবার ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে।

সকলেই রেডি হয়ে কটেজের নিচে জড়ো হলাম আমাদের হোস্ট সাহেব আমাদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য একটি প্রারম্ভিক বক্তব্য দিলেন।মাজর বিষয় হচ্ছে, তিনি নাকি আমাদের সকলের পেছনে থাকবেন, আমিতো শুনে অবাক।হোস্ট কেনো পেছনে থাকবে?সে তো সামনে থেকে পথ দেখানোর কথা।

অতঃপর তিনি বললেন, ভাই ট্রেকিং ট্যুরে হোস্ট কে পিছেই থাকতে হয়, কারন হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একেকজন মাঁটিতে লুটিয়ে পড়ে ওগুলোকে আমার ঘাড়েই তুলতে হয়। কথাটি শুনে সকলেই হো হো করে হাসা শুরু করলো।

এরপর আমরা সকলে পথ চলতে শুরু করি।কয়েক মিনিট হাঁটার পর বুঝতে পারলাম এটি এমন একটি এরিয়া যেখানো কোনো সড়ক বা সোঁজা পথ নেই।

কাপ্তাই হ্রদ দিয়ে ভেসে আসা ছাড়া আর কোনো ওয়ে নেই।এটিকে পাহাড়ি একটি দ্বীপও বলা যায়।এখানে একটি  বাজার এবং একটি থানা আছে।মানুষের বসবাস তেমন একটা বেশি নেই।বলা যায়, প্রায় বেশির ভাগই উপজাতি।

আমি ও আমার বন্ধু তুষার টার্গেট নেই সবাই কে ছাড়িয়ে আমরা দুজন  আগে পৌছাবো। তাই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম।প্রায় ২ ঘন্টার কাদাপথ, ঝিরি পথ এবং পাথুরে রাস্তা পাড়ি দেওয়ার পর আমরা ন-কাটা ঝর্ণার দেখা পাই।

 সেখান থেকে আরও ২০ মিনিট পাহাড়ের উপরের দিকে ওঠার পর মুপ্পোছরার দেখা পাই।দুটি ঝর্ণাতে ২ ঘন্টার মতো সমর ব্যয় করলাম।

অতঃপর দুপুরের দিকে আমারা আবার একই পথ ধরে কটেজের যাওয়ার জন্য রওনা হলাম।বিকেলের শেষ ভাগে  কটেজে ফিরে আসলাম।বাকিরা আসতে একটু দেড়ি করলো।

প্রথমদিন এই দুই ঝর্না দেখে এসে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়লো।কারণ এর আগে কারো এত পরিমাণে হাঁটা কখনো হয়নি,তাও আবার উচু পাহাড় ,কর্দমাক্ত রাস্তায় হাঁটা বেশ কঠিন ছিলো।

সবাই ভাবছিলাম আমাদের ট্যুরের মূল গন্তব্য ধূপপানি ঝর্ণা যা বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়ন এর ওড়াছড়ির পাহাড়ি বনের অত্যন্ত গহিনে অবস্থিত।

কোনো সোজা পথ নেই।এখান থেকে আবার ট্রলারে করে ২ ঘন্টা যেতে হবে তারপর ট্রেকিং।এরই মধ্যে আমাদের হোস্ট সাহেব এসে বললেন সবাই বাহিরে আসুন বসে আড্ডা হবে।

পরে আমরা সেখানে যোগ দিলাম। সেখানে গান গাওয়া ,খোশগল্প আড্ডা এবং আজকের ট্যুরের বিষয়ে আলোচনা করা এসব কিছু বেশ ভালোই লাগছিলো।

এরপর আমি হোস্ট সাহেব কে জিজ্ঞেসা করলাম- কালকের প্লান কি? তিনি বললেন- সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেই ভালো। আগামীকাল ভোর ৪ টায় আমাদের উঠতে হবে,পরে এখান থেকে ভোর ৫টার মধ্যেই ট্রলারে করে আর্মি ক্যাম্পে পৌছাতে হবে।

ধূপপানি ঝর্নার এরিয়াতে যেতে এখান থেকে ২ ঘন্টা ট্রলার পারি দিতে হবে।অতপর ট্রলার থেকে নেমে আবার প্রায় দুই আড়াই  ঘন্টা পাহাড়ে ট্রেকিং হবে।

এই কথা শুনার পর একেকজনের মুখের প্রতিক্রিয়া দেখার মতো ছিলো।এসেছিলো আনন্দ করতে এখন বেচারা আফসোস করছে।

আমি মানুষিকভাবে প্রস্তুতি নিলাম,যেভাবেই হোক ধুপপানি ভ্রমণ করবোই।তাই ঠিক ১০টা বাজেই আমি ডিনার সেরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আমি আর আমার বন্ধু তুষার এক রুমে ঘুমালাম।

পরদিন ভোরে, হোস্ট সাহেব সকলকেই জাগিয়ে দিলেন।আমরা ব্যাগপত্র সঙ্গে করে নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম।ভোরের মিটি মিটি আলোতে হেটে হেটে ট্রলারে পৌছালাম।

আমাদের সাথে ধূপপানি ভ্রমণ নাকোচ করলো চারজন।তারা ভয় এবং দূর্বল ফিল করছে তাই তাদের কটেজে রেখেই আমরা বাকি ৩৬ জন রওনা হলাম।  চলতে শুরু করেছে আমাদের ট্রলার। তবে এবার আর ট্রলারে নাচ-গান হৈ-হুলোর নেই।

সবাই ঘুম ঘুম চোখে থমকে আছে। কেউ আবার ট্রলারে হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে আছে।আমি ট্রলারের উপরের ছাদে বসে ভোরের সৌন্দর্য্য এবং ভোরের মন ঠান্ডা করা বাতাস উপভোগ করছি।

প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা ট্রলার চলার পর আমাদের ট্রলার গিয়ে থামলোএকটি পাহাড়ি গ্রামে।সবাই নামলাম ট্রেকিং এর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। নেমেই শুধুমাত্র একটি টিনের তৈরি দোকান চোখে পড়লো।

ভিতরে চা, বিস্কুট, কেক সহ মুদি দোকানের প্রায় সব আইটেমই ছিলো।দুঃখের বিষয় হলো সেখানে কফি ছিলো না।তাই বাধ্য হয়ে এক কাপ চা খেলাম। এরপর ব্যাকআপ খাদ্য হিসেবে বিস্কুট, একটা মোজো, এবং চুইং গাম নিয়ে নিলাম।

তারপর আমাদের হোস্ট সাহেব সকলের উদ্দেশ্যে ব্রিফিং দিলেন এবং সকলে একসাথে হাঁটা শুরু করলাম।কাঁদা পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর যাওয়ার পর এই কাঁদা মাটির পথ শেষ হলো।

এবার পাহাড়ে ওঠার পালা।উপরে উঠে তাকিয়ে দেখি অনেকখানি লম্বা পাহাড়।কিছু করার নেই, উঠতে আমাকে হবেই।পূর্বের মতোই আমি ও আমার বন্ধু তুষার সবাইকে পিছে ফেলে আগে হাঁটছি।

আমাদের সাথে ছিলো স্থানীয় একজন উপজাতি গাইড।তিনি জঙ্গলের রাস্তা চিনেন।তাকে আমাদের দল ১০০০ টাকার বিনিময়ে আজকের পথপ্রদর্শক হিসেবে নিয়েছে।

উনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন এবং নিয়ে আসবেন।তার সাথে পাহাড়ের মধ্যে যতই পথ চলছি ততই যেনো নির্জনতা বেড়ে যাচ্ছে।

প্রায় দেড় ঘন্টা হাঁটলাম,আশেপাশে খালি জঙ্গল আর জঙ্গল।জনবসতিহীন পাহাড়।দূরে তাকলে দেখা যায় অন্য এক পাহাড়ের উপর মেঘ জমে বৃষ্টি ঝড়ছে, দৃশ্যটা খুবই দারুন লাগলো।

একটা ওয়াইল্ড লাইফ ফিল পাচ্ছিলাম।পথ চলতে চলতে গাইড মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম- এখানে কি মানুষের কোনো বসবাস নেই? আর এই গভীর জঙ্গলে কোনো হিংস্র জন্তু জানোয়ার আছে কি না?

তিনি একজন উপজাতি।তবে কিন্তু বাংলা ভাষাটা তিনি বেশ ভালোই বলতে পারেন।তিনি মুখে হলকা হাসি রেখে বললেন- মামা জনবসতি বা লোকজন নাই, তবে ধূপপানি ঝর্ণার আগে একটা ছোট্ট পাড়া পাবেন।

কয়টা উপজাতি পরিবার আছে তারা সেখানে বসবাস করে। আর হিংস্র প্রাণী তেমন নেই তবে বনবিড়াল,বুনো শুওর এবং বানর হঠাৎ দেখা যায়। শুনে মনে একটু ভয় কাজ করতে লাগলো।

পাহাড়ের এতো উচুতে এই ঘন জঙ্গলে যদি একটি বন বিড়াল সামনে এসে পড়ে তখন কি হবে? আমার বন্ধু তুষার এই প্রশ্নটা আমাকে করলো।

 তখন আমি বললাম ‘আরে বেটা ব্যাপার না, বিড়াল ব্যাটাকে বাঁশ দিয়ে এমন বাড়ি দিবো,এই রাঙামাটির জঙ্গল ছেড়ে সুন্দরবনের রাস্তা ধরবে।এটা শুনে বন্ধু তুষার ও গাইড মামা হে হে করে হাসলো।

এরপর অনেকখানি হাঁটতে হাঁটতে বাতাসের সাথে একটা হালকা আওয়াজ কানে এসে বাড়ি খেলো, মনে হলো ঝর্ণার আওয়াজ। আমি ও আমার বন্ধু জোরে জোরে ইয়েস, ইয়েস বলে চিৎকার শুরু করে দিলাম,এই বুঝি ঝর্ণার কাছাকাছি এসে পড়েছি।

আমরা তো আনন্দে আত্মহারা। আমাদের আনন্দঘন মুহূর্তে পানি ঢাললেন গাইড মামা।তিনি বললেন- ‘মামা আরও বেশখানিক পথ বাকি, ৩০-৪০ মিনিট লাগবে। এটা শুনে আমার ও তুষারের মাথায় হাত।

বলেন কি মামা! এখনো ৩০-৪০ মিনিট?

হ্যাঁ,মামা এই ঝর্ণার আওয়াজ দূর থেকেই শোনা যায়।এটি অনেক বড় ঝর্ণা।

তার কথা শুনে নিজেও একটু ভাবতে শুরু করলাম। ঝর্ণার এতদূরে অবস্থান করেও পানির শব্দ কান পর্যন্ত আসা অস্বাভাবিক কিছু না।

কারণ এখানে নেই শব্দ দূষণ, নেই, রিকশা-সাইকেল বা মোটরচালিত যান এর হর্ন,নাই কোনো চেঁচামিচি বা হই হুল্লোড়,চারদিকে সুনসান নিরবতা,একটু পর পর পাখির সুমধুর ডাক।

দূর পাহাড়ে মেঘের গর্জন,মাঝেমধ্যে বানরের হু হু করে ডাক,এ যেনো এক অন্য জগতে এসেছি।ভাবতে ভাবতে সামনে আগাতে থাকলাম।

এরপর আমরা এসে উপস্থিত হলাম পাহাড়ের এমন এক টিলায়, যেখানে কিছু উপজাতি পরিবারের বসবাস।এটা সেই জায়গা, যার কথা গাইড মামা বলেছিলেন যে ,ঝর্ণার আগে একটি উপজাতি পাড়া পাবো ।

দেখতে পেলাম ছোট ছোট বাচ্চারা লেবুর শরবত নিয়ে বসে আছে, কেউ কলার ছড়া  নিয়ে বসে আছে,কেউ কেউ আবার ডিম সিদ্ধ,কাঠাল,পেপে নানান রকম পাহাড়ি, ফল সাজিয়ে বসে আছে।সবই বিক্রির জন্য ও দাম খুবই সাশ্রয়ী।

দেখে খুবই ভালো লাগলো। ২০টাকা দিয়ে আমি এবং বন্ধু তুষার দুইজনার জন্য শরবত কিনে খেলাম,পরে কলা ও সিদ্ধ ডিম খেয়ে, গা ছেড়ে দিয়ে গাছের নিচে বসে পরলাম।

 একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক।বাকিরাও ততক্ষণে এক এক করে আসতে শুরু করেছে।যেসব খাবার দাবার নিয়ে উপজাতিরা বসেছিল তা নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো।

মানুষ এতই দুর্বল ও পিপাসার্ত হয়ে গিয়েছিলো যে সবাই দৌড়ে এসে জিনিসের দাম না জিজ্ঞেস করেই গপ গপ করে খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে।

এই বিরতিতে সকলের সাথেই পুনরায় দেখা হলো।সকলেই পৌছে আমাকে এবং তুষারকে বাহবা দিচ্ছিলো, এই দূর্গম পথ সবার আগে পাড়ি দেওয়ার জন্য।

আমি একটু নিজ থেকে এই পাড়াটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে করলাম।মনে একটু কৌতুহল জেগেছে জানতে যে এই পাহাড়ের গভীরে কিভাবে থাকেন তারা? খাদ্যের যোগান ই বা কিভাবে হয়?

পরে দেখলাম, বেশি না ৬ টির মতো পরিবার এখানে থাকে।বাঁশ এবং দিয়ে তৈরি উচু উচু জুম ঘর। সকলেরই গরু, ছাগল এবং শুওর আছে।

এখানে কোনো বাজার বা চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।এখানকার মানুষ দিনে একবার সেই জায়গায় যায়,যেখানে আমাদের ট্রলার থেমে আছে।

সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস মাচায় তুলে ঘাড়ে করে বহন  করে এই পর্যন্ত নিয়ে আসে এবং এখানে কোনো সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই বা টিউবয়েলও নেই। তারা ঝর্ণার পানি বা ঝিরি থেকে পানি সংগ্রহ করে থাকে।

আমিতো তাদের এই সংগ্রামী বৈচিত্রময় জীবন দেখে বড়ই অবাক। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। শহরে কতই না সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে চলি আমরা।

বিদ্যুৎ,প্রযুক্তি, চিকিৎসা, যানবাহন ইত্যাদির সকল কিছুর সুবিধা ভোগ করার পরও,সব হাতের নাগালে থাকা সত্ত্বেও আমাদের দুর্ভোগ আর আভিযোগের শেষ নেই। অথচ পাহাড়ে বসবাসরত উপজাতিরা সবকিছু থেকে বঞ্চিত থাকা সত্ত্বেও কি হাস্যচ্ছল।

এখন আর কিছুক্ষন হাঁটলেই নাকি আমরা পৌছে যাবো আমাদের বহু আকাঙ্খার ধুপপানি ঝর্ণার কাছে।যতই সামনে এগোচ্ছি ঝর্ণার আওয়াজ ততোই প্রখরভাবে কানে এসে বাড়ি খাচ্ছে।

কিছুক্ষন নিচের দিকে হাটলাম, পরে আবার উপরের দিকে ওঠার পর অবশেষে দৃশ্যমান সেই বহু প্রতিক্ষার নন্দিত সুন্দর ধুপপানি ঝর্ণা।

এটা অবশেষে দৃশ্যমান হওয়ায়, আমরা খুশিতে আত্মহারা।তবে, সবেমাত্র ঝর্ণা দৃশ্যমান।এর কাছে গিয়ে এবং এর পানিতে ভিজতে হলে আমাদের এখনো জটিল একটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

তা হলো আমারা আছি উচু স্থানে, ঝর্ণার কাছে যেতে হলে প্রায় ৬০-৭০ ফিট নিচে নামতে হবে, নামার পথটা সোজা নয়।একদম খাড়া বলা যায়।

তার উপর আবার কাঁদা খুবই রিস্কি পা একটু এদিক সেদিক হলেই,নিচে পড়ে গিয়ে বড় ধরণের ইঞ্জুরির শংকা।বুকে সাহস রেখে নামা শুরু করলাম আমি ও বন্ধু তুষার।

বাকিরা পেছনে আস্তে আস্তে নিচের দিক আসছিলো।মনে হচ্ছিলো মিলিটারি ট্রেনিংয়ে আছি। অতঃপর সব বাঁধা পেরিয়ে পৌছালাম সেই আকাঙ্খার জায়গাটিতে।

এর বিশালতা না দেখলে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়, প্রায় ১৫০ মিটার উচু থেকে ভূখন্ডে পানি ঝড়ছে ঝরে পড়ছে।

চারোদিকে দানব আকৃতির পাথর। উপর থেকে পানি নিচে পড়ে ঝিরি পথ দিয়ে কোথায় যাচ্ছে কারও জানা নেই।আমরা তরিঘরি করে ফোনে ছবি ও ভিডিও ক্যাপচার করতে নেমে পড়লাম।

ঝর্ণার শীতল পানিতে নিজেকে ভিজিয়ে নিলাম।এতদূর ট্র্যাকিং করে এই পর্যন্ত আসতে শরীরের অবস্থা ১২টা ছাড়িয়ে ১৩টা বেজে গিয়েছিলো, কিন্তু যখনই ঝর্ণার পানির স্পর্শ পেলাম সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছিলো নিমিষেই।

পাহাড়ি প্রকৃতির গহিনে আরন্যে এমন এক সুবিশাল অনিন্দ্য সুন্দর ঝর্ণাতে আসতে পেরে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হয়েছে। কারণ সবার জন্য এখানে আসা সম্ভব নয়।

 এটি সম্পূর্ণ একটি ট্রেকিং ট্যুর,এখানে আসার রাস্তার ঠিকানা নেই গুগল ম্যাপের কাছেও।আবার এখান থেকে ভারতের মিজোরাম সীমান্তের দুরুত্ব ১০-১৫ কিলোমিটার। কিন্তু সেখানে যেতে হলে আরও কষ্ট করতে হবে।

আমি এখানে আসাকে একটি থ্রিলিং-এডভেঞ্চার হিসেবে আখ্যায়িত করবো।প্রত্যেক পাহাড় প্রেমী ও ঝর্ণা প্রেমীদের ১ বারের জন্য হলেও এখানে আসা উচিত।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024