মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:২২ পূর্বাহ্ন

ইউরেনাস: পাশ ফিরে শুয়ে থাকা গ্রহ

  • Update Time : শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৪, ৮.০০ এএম

নাদিরা মজুমদার

সূর্য থেকে ইউরেনাস সৌর মণ্ডলের সপ্তম গ্রহ। এবং তৃতীয় বৃহত্তম গ্রহও সে। গ্রহের বিষুব রেখা বরাবর, পৃথিবীর চেয়ে চারগুণ চওড়া। অর্থাৎ চারটে পৃথিবীকে ইউরেনাসের ভেতরে অনায়াসে ঢোকানো যাবে। পরিমাণটি বা ব্যাস হলো প্রায় একান্ন হাজার একশো বিশ কিলোমিটার।

তার গায়ের বর্ণও চমৎকার নীল-সবুজ রঙের। এমন রঙে রঙ্গিন হওয়ার কারণ হলো প্রচুর পরিমাণ মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি। এই মিথেন সূর্যালোকের বর্ণালি থেকে লাল আলোকে শুষে নিচ্ছ এবং নীল আলোকে প্রতিফলিত করে মহাশূন্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা তাই নীল-সবুজ বা নীলাভ-সবুজাভ রঙে জড়ানো ইউরেনাসকে দেখি। এর বায়ুমণ্ডলের বিরাট অংশ প্রধানত হাইড্রজেন ও হিলিয়াম দিয়ে গঠিত বটে তবে তাতে রয়েছে বি-শা-ল পরিমাণ পানীয় জল, অ্যামোনিয়া ও মিথেন।

বৃহস্পতি ও শনি’র মতো ইউরেনাসও জোভিয়ান গ্রহ হলেও সচরাচর তাকে ‘হিম-দানব’ (ice giant) বলে ডাকা হয়। তাই ওর সম্বন্ধে ভুল ধারনা হতে পারে, বা আমাদেরকে বিভ্রান্তও করতে পারে। আসলে, ‘গ্যাস-দানব’ শনি বা বৃহস্পতি এবং পৃথিবী বা মঙ্গলের মতো শিলাজ (terrestrial) গ্রহগুলো থেকে ইউরেনাসএকেবারে ভিন্ন টাইপের গ্রহ। বা বলা যায় যে ইউরেনাস অনন্য দলভুক্ত গ্রহ একটি, এবং সৌর মণ্ডলের সর্বশেষ গ্রহ নেপচুনও অনন্য গ্রহের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ একে (ইউরেনাসকে) আমরা মাধ্যমিক বা মধ্যবর্তী ভরের গ্রহ বলে ডাকি, যার কারণ হলো যে শিলাজ গ্রহগুলোর চেয়ে তার ভর অনেক অনেক বেশি গুরুভার সম্পন্ন, আমাদের পৃথিবী যে ভর ধারন করে আছে, এর ভর তারচেয়ে পনেরো গুণ বেশি। আবার একই সময়ে, ইউরেনাস। বৃহস্পতি ও শনির মতো দুই গ্যাস-দানবের কাছে লিলিপুটের সঙ্গে তুলনীয়। বৃহস্পতি ও শনির ভর পৃথিবীর ভরের চেয়ে যথাক্রমে তিনশোগুণ ও প্রায় একশোগুণ বেশি। ইউরেনাস বাস্তবিকই একটি অনন্য গ্রহ এবং এই শ্রেণির গ্রহ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অত্যন্ত কম।

২৩.১. ১৯৮৬ তারিখে ভয়েজার ২-য়ের তোলা ইউরেনাস, সৌজন্যে: উইকিপিডিয়া, CCO

বিশালত্বের দিক দিয়ে সে আমাদের সৌর মণ্ডলে তৃতীয় স্থান দখল করে আছে বটে, কিন্তু অন্যান্য নক্ষত্রকে ঘিরে যেসব গ্রহের সন্ধান আমরা পাচ্ছি সেসব গ্রহের সাইজ গড়পরতা ইউরেনাসের সমান বা অনুরূপ। তাই ইউরেনাসকে আমরা যদি যত্ন সহকারে ভালো মতো জানতে পারি তবে মহাজগতের অন্যান্য সৌর মণ্ডল সম্বন্ধে আমরা জ্ঞান অর্জন করতে পারবো। সেইসঙ্গে, আমাদের সৌর মণ্ডলটির অনন্যতা বিষয়ে একটি উপলব্ধি হবে আমাদের। কবে কখন যে এর জন্ম হলো এবং সূর্য থেকে এ-তো এ-তো দূরে রয়েছে অথচ এ-তো অজস্র জল কোথেকে এলো?, আমরা সঠিকভাবে জানি না।

মোটামুটিভাবে, আমাদের সৌর মণ্ডলের গ্রহগুলোর অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রাচীন সভ্যতাগুলো অবহিত ছিলো এবং সেগুলোর কাহিনি লিপিবদ্ধ ছিলো। বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি এবং ইউরেনাসও প্রাচীন সভ্যতার জ্ঞানিগুণিজন পর্যবেক্ষণ করেছেন। এবং স্থানীয় হালচাল ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গ্রহগুলোর নামকরণ হয়েছে। যাহোক, রেনেসাঁ উত্তর ইউরোপে গ্রহগুলোর নামকরণে রোমান বা রোমকদের পৌরাণিক কাহিনির দেবদেবির নামে গ্রহগুলোর ল্যাটিনভিত্তিক নাম প্রাধান্য পায়। কোনো গ্রহই প্রাচীন সভ্যতার বা ইউরোপের রেনেসাঁ পূর্ব প্রাচ্য দেশীয় জ্যোতিবিজ্ঞানের স্মৃতি বহন করছে না। যাহোক, ১৭৮১ সালে ইংরেজ জ্যোতির্বিদ স্যর উইলিয়াম হার্শেল যখন টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে ধূমকেতুর সন্ধান করছিলেন তখন তিনি ঘটনাক্রমে ইউরেনাস- কে পুনবিষ্কার করেন। ‘পুনআবিষ্কার’ হলেও প্রচলিত ঐতিহ্য অনুসারে গ্রহের নামকরণের অধিকার পান হার্শেল। সেসময়ে ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন তৃতীয় জর্জ। হার্শেল তখন রাজার নামে ইউরেনাসের নামকরণ করেন জর্জের নক্ষত্র বা গ্রহ (সঠিকভাবে: Georgium Sidus)। রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে নাকি নামকরণের প্রথাগত ভিত্তি বদলে দেয়ার ইচ্ছা হার্শেলকে অনুপ্রাণিত করেছিলো বলা কঠিণ। অনেকেরই নামটি পছন্দ হয়নি; বলেন যে, গ্রহের নাম ‘জর্জ’? শ্রীহীন কেমন একটা নাম? নামে। শ্রী আনার জন্য হার্শেলের সমসাময়িক জ্যোতিবিদ ইয়োহান ইলার্ট বোড নতুন নামের চয়েস দেন। মিনার্ভা’ অথবা ‘ইউরেনাস’। জ্যোতিবিজ্ঞানমহল ‘ইউরেনাস’ নামটি পছন্দ করেন, এবং ১৮৫০ সালের মধ্যে ‘ইউরেনাস’ নামটি পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। কিন্তু ইউরেনাস নামে কোনো রোমক দেবদেবি নেই; গ্রিকদের আকাশ দেবতা ‘উরানোস’ (Ouranos)-য়ের যৎসামান্য পরিবর্তন করে ‘জর্জ’-য়ের স্কুলে গ্রিক ‘ইউরেনাস’ নামটি চালু হয়ে যায়। ইউরেনাস-য়ের ল্যাটিন সংকরণ হলো ‘কায়েলুস’ (Caelus)। ইউরেনাস-য়ের নামবিভ্রাটের সমাধান হয়, তবে ইউরেনাস-কে উচ্চারণ করার সমস্যা দেখা দেয়। বাংলায় ‘ইউরেনাস’ ভালোভাবেই উচ্চারণ করা যায়। আ-রো অনেক ভাষায়ও খুব একটা উচ্চারণগত সমস্যা হয় না। মোটামুটি

চলনসইভাবে করা যায়। কিন্তু ইংরেজি বলিয়েরা লোকপ্রিয় বা ‘পপুলার’ কায়দায় ‘your-AY-nuss’ উচ্চারণ করেন ফলে যে ঠাট্টাতামাশার সৃষ্টি হয় তা কিন্তু গ্রহটির রাজকীয়তা ও মর্যাদাকে ভিন্নমুখী বা বিক্ষিপ্ত করে। সৌভাগ্যক্রমে, উচ্চারণগত কমন বিকল্প একটি রয়েছে, এরকম: ‘YOOR-un-us’ এবং বিজ্ঞানীমহল এভাবে উচ্চারণ করে থাকেন, একে সরকারিভাবে গৃহীত উচ্চারণ বলা যায় বা হয়। (তবে ভাষাগত কারণে ‘ইউরেনাস’-য়ের আরো কয়েকটি উচ্চারণগত নাম রয়েছে: ‘উ-রাহ-নহস’ (00- rah-NOHSS), ‘ওহ-রাহ্-নস’ (oh-rah-NOS) বা ‘উ-রাহ্-নস’ (oo-rah-NOS): কখনো বা ল্যাটিন কায়দায় ‘সিলাস’ বা ‘সীলাস’ (Caelus or Coelus) ও শোনা যায়।)।

সূর্য থেকে ইউরেনাস গড়ে প্রায় দুই দশমিক আট (২.৮) বিলিয়ন কিলোমিটার বা প্রায় উনিশ অ্যাস্ট্রোনমিকেল ইউনিট দূরে অবস্থান করছে। সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হলো ‘এক অ্যাস্ট্রোনমিকেল ইউনিট’। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে উনিশ গুণ দূরে রয়েছে সে। এ-তোটা দূরত্ব অতিক্রম করে সূর্যালোককে ইউরেনাসে পৌছাতে সময় লাগে দুই ঘন্টা চল্লিশ মিনিট।

দুই গ্রহ: পৃথিবী-ইউরেনাসের তুলনামূলক সাইজ, পাবলিক ডমেইন

ইউরেনাস-কে নিজের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে, পৃথিবীর হিসেব মতো প্রায় সতেরো (১৭) ঘন্টা সময় লাগে। এবং কক্ষপথে থেকে সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে সময় নেয়, পৃথিবীর হিসেব অনুসারে চুরাশি (৮৪) বছর; অর্থাৎ এক ইউরেনীয়/ ইউরেনিয়ান বছর পৃথিবীর ৮৪ বছর। ইউরেনাসের আরেকটি অনন্যতা, যা নাকি সৌর মণ্ডলের বাকি সাত গ্রহের কারোরই নেই সেটি হলো যে তার বিষুবরেখা নিজের কক্ষপথে প্রায় সমকোণ করে অবস্থান করছে, এবং সাতানব্বই দশমিক সাতসাত (৯৭.৭৭) ডিগ্রি পরিমাণ ঝুঁকে আছে। অর্থাৎ, গতিশীল চলমান ইউরেনাস যেনোবা পাশ ফিরে কিছুটা বা অধোমুখ করে লণ্ডভণ্ডভাবে চলছে; হয়তবা বলা যায় যে কক্ষপথ ধরে সে ‘গড়িয়ে গড়িয়ে’ চলছে।

ইউরেনাসকে একবার সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসতে ৮৪ বছর সময় লাগে, সৌজন্যে। ইউনিভার্স ম্যাগাজিন

তবে একা ইউরেনাসই নয় কিন্তু, তার আংটিগুলোর এবং সবকয়টি চাঁদের কক্ষপথগুলোও শূন্যে মহাশূন্যে পাশ ফিরে ‘গড়িয়ে গড়িয়ে’ ভাসছে। ইউরেনাসের এমন হাল হলো কেনো? হতে পারে যে অ-নে-ক অ-নে-ক গুলো লাখ লাখ বছর পূর্বে, পৃথিবীর সাইজের অনুরূপ ব্য এমনকি আরো বড়ো সাইজের মহাজগতীয় বস্তুর সঙ্গে তার ভয়ানক রকমের সংঘর্ষ হয়েছিলো। অথবা এমনও হতে পারে যে বিশাল মাপের পূর্বেকার আংটি-সিস্টেম ইউরেনাসকে এপাশে-ওপাশে হেলেদুলে চলতে (wobble) বাধ্য করে (যেমন: আংটি-সিস্টেমের অভিকর্ষের মাধ্যমে), এবং তা করতে গিয়ে এক পাশে কাত হয়ে যায়। অর্থাৎ কোনো না কোনো কারণ গ্রহীয় বৈশিষ্ট্যকে বদলে দেয়, বাকি সাত গ্রহ থেকে ভিন্ন অনন্য হয়। কারণটি কি ছিলো জানতে পারলে সৌর মণ্ডলের গ্রহগুলোর জন্ম বিকাশ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানের বিকাশ হবে। আবার, বিশাল পরিমাণে ঝুঁকে থাকার কারণে, ইউরেনাসের ঋতু পরিবর্তন সর্বোচ্চ চরমতার সর্বোচ্চ বিন্দুতে রয়েছে। তার দিন-রাত্রির পরিবর্তনে স্বাভাবিকতা বলে কিছু নেই। টানা প্রায় বিয়াল্লিশ (৪২) বছর ধরে সূর্য যখন একটি মেরুকে বিরামহীন আলোকিত করে রাখে, অন্য মেরু তখন অন্ধকারে ডুবে থাকে। সূর্যালোকে আলোকিত হওয়ার জন্য দুই মেরুকে পালা করে লম্বা টানা প্রায় বিয়াল্লিশ (৪২) বছর অপেক্ষা করতে হয়। ভাবতেও কেমন এক স্বপ্নহীন বিষাদ ও হতাশার অনুভূতি হয়। তবে ভাগ্যিস তার বিষুব রেখা বরাবর দিন-রাত্রির পরিবর্তন ঘটে, হোক না তার স্থায়ীত্ব প্রায় সতেরো ঘন্টার: দিনের বেলা রোদ বা সূর্যালোক দিগন্তের উপরে বৃত্তাকারে ঘোরাফেরা করে, কখনোবা দিগন্তের পশ্চাতে হারিয়ে যায়।

ইউরেনাসসহ সৌর জগতের সবকয়টি গ্রহ একই দিক অনুসরণ করে সূর্যের চারদিকে পরিক্রমণ করছে। কিন্তু গ্রহগুলোর, যার যার তার তার অক্ষকে ঘিরে বা অক্ষের চারদিকে ঘুরবার সময়, ছয়টি গ্রহ যখন একই দিক নিয়ে নিজের নিজের অক্ষের চারদিকে ঘুরছে, ইউরেনাস, এবং শুক্র-ও, কিন্তু বিপরীত দিক ধরে অক্ষের চারদিকে ঘুরছে। এটি ইউরেনাসের আরেকটি অনন্যতা।

সৌর মণ্ডলের বাইরের দিকের সীমানা অঞ্চলে যে দুটো গ্রহ রয়েছে, তাদের একটি হলো ইউরেনাস (অন্যটি নেপচুন)। ইউরেনাসের মোট ভরের বি-শা-ল অংশ, আশি শতাংশ বা আরো কিছু বেশি হবে হিমশীতল জল, মিথেন ও অ্যামোনিয়ার ঘন ‘চুয়িড’ (অর্থাৎ গ্যাস ও তরল পদার্থের মতো) ছোটো আকারের শিলাজ কেন্দ্রের ওপরে বসে আছে। জল, মিথেন ও অ্যামোনিয়া। এই তিন ধরনের হিমশীতল উপাদান তার রয়েছে, আরো রয়েছে কিছু শিলা, এবং হাইড্রজেন-হিলিয়াম। অর্থাৎ ইউরেনাসের অধিকাংশ উপাদানই ভারি উপাদান বা হিলিয়ামের চেয়ে ভারি (জ্যোতিবিজ্ঞানে কোনো উপাদান হিলিয়ামের চেয়ে ভারি হলে সেটি ভারি উপাদান হিসেবে পরিগণিত হয়)। তার গ্যাস সর্বস্ব বায়ুমণ্ডলে রয়েছে কিছু হাইড্রজেন ও হিলিয়ামের অণু।

পৃথিবী ও পৃথিবীর চাঁদ এবং ইউরেনাসের চাঁদ মিরান্ডা-র তুলনামূলক সাইজ, ছবিতে নীচে বাদিকে মিরান্ডা, সৌজন্যে। পাবলিক ডমেইন

তবে এনআইএফএস (NIFS) স্পেকট্রোগ্রাফ ব্যবহার করে দেখা গেছে যে ইউরেনীয় বায়ুমণ্ডলের উচ্চতর স্তরে অন্যসব উপাদান ছাড়াও আরো রয়েছে হিম জমাটকৃত হাইড্রোজেন সালফাইড। পচা ডিমে যে পচা দুর্গন্ধ হয়, তার জন্য দায়ী এই হাইড্রোজেন সালফাইড। এ-তো দু-রে অবস্থিত গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে পৃথিবী-ভিত্তিক দুর্গন্ধসৃষ্টিকারি বস্তুর উপস্থিতি বেশ চমকপ্রদ কিন্তু। যাহোক, বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন যে বর্তমানে ইউরেনাস যে কক্ষপথে রয়েছে সেই কক্ষপথে তার জন্ম হয়নি। বাকি সব দানব গ্রহের মতো তারও জন্ম হয় সূর্যের কাছাকাছি নিকটের একটি কক্ষপথে। তারপর, অনেকগুলো লাখ লাখ লাখ বছর পূর্বে, এই আদি ‘ভিটামাটি’ ছেড়ে ইউরেনাস অভিপ্রয়াণ করে এখন যে কক্ষপথে রয়েছে সেই কক্ষপথের পথ ধরে। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা বলছেন যে দীর্ঘ অভিপ্রয়াণপথে কোথাও থেকে ‘সালফার’ নামক মৌলিক উপাদানটি বায়ুমণ্ডলের উচ্চতর অংশে ঠাঁই নেয় এবং সেখানে বিদ্যমাণ হাইড্রোজেনের সঙ্গে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় হাইড্রোজেন সালফাইডের। লক্ষণীয় যে ইউরেনাসের কেন্দ্রের কাছাকাছি জায়গায় তাপমাত্রার পরিমাণ প্রায় চার হাজার নয়শোবিরাশি (৪৯৮২) ডিগ্রি সেলসিয়াস। তারমানে, গ্রহের অভ্যন্তরটি খু-উ-ব-ই উত্তপ্ত।

আবার বৃহস্পতি ও শনি, এই দুই গ্যাস-দানবের ক্ষেত্রে আমরা দেখি হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের বি-শা-ল বি-পু-ল ছড়াছড়ি, এবং বুধ, শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গল চার শিলাজ গ্রহে আবার ভারিতর উপাদানের প্রাধান্য, সর্বত্র ভারিতর উপাদান বিদ্যমাণঃ ইউরেনাস গ্রহ এই দুই শ্রেণির গ্রহের মাঝখানে কোথাও স্যান্ডউইচ হয়ে অবস্থান করছে, মধ্য-ভর সম্পন্ন হয়ে নতুন শ্রেণির গ্রহের পত্তন ঘটিয়েছে।

ইউরেনাসের ব্যাস প্রতিবেশি গ্রহ নেপচুনের চেয়ে সামান্য বড়ো হলেও তার ভরের পরিমাণ নেপচুনের চেয়ে কম। ফলস্বরূপ, ঘনতা/ নিবিড়তার দিক দিয়ে ইউরেনাস সৌর মণ্ডলের দ্বিতীয় অতি অল্পতম গনতা সম্পন্ন গ্রহ, শনির পরেই তার স্থান। দুই গ্যাস-দানব বৃহস্পতি ও শনির মতো হিম-দানব ইউরেনাসেরও সত্যিকারের কোনো পৃষ্ঠদেশ নেই। আর থাকবেই বা কি করে? বন বন করে ঘূর্ণায়মান গ্রহের প্রায় সবটাই তো ‘ফ্লুয়িড (তরলও নয় গ্যাসও নয়)। তাই কোনো নভোযানকে যদি পাঠানো হয় সেটি ইউরেনাসের কোথাও ল্যাও করতে পারবে না। আবার বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে ‘জখমবিহীন’ থেকে ওড়াউড়ি করে আন্ত বেরিয়ে আসার সম্ভাবনাও নেই। চরম পরিমাণের চাপ ও তাপমাত্রা ধাতব নভোযানকে মুহূর্তের মধ্যে ফাংস করে দেবে। ইউরেনাসের বায়ুমণ্ডল প্রধানত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে গঠিত; এবং রয়েছে যৎসামান্য পরিমাণ মিথেন, অ্যামোনিয়া ও পানীয় জল (আমরা জানি যে মিথেনের উপস্থিতিই গ্রহটিকে নীলচে-সবুজাভ বা ‘ফিরোজা’ রঙে রঙিন করে রেখেছে)।

এখন পর্যন্ত মাত্র একটি নভোযান গ্রহটিকে খু-উ-ব কাছে থেকে দর্শণ করেছে। ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে ভয়েজার ২ ইউরেনাসের কাছ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় বা ‘ফ্লাইবাই’ করার সময় কয়েকটি মেঘকে বিচ্ছিন্নভাবে এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে, এবং আরো দেখেছে ‘গ্রেট ডার্ক স্পট’ (বৃহস্পতির গ্রেট রেড স্পটের অনুরূপ) ও ‘স্মল ডার্ক স্পট’ নামে পরিচিত মেঘের দুইটি ঘূর্ণাবর্ত। অতি সাম্প্রতিককালের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায় যে বিষুব রেখা অতিক্রমের দিনগুলোতে ইউরেনীয় বায়ুমণ্ডলের মেঘগুলো আরো গতিময়, উচ্ছল প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, সেই সঙ্গে আলোময় উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যগুলোও দ্রুত দৃশ্যমান হয়। (যেমন: বছরের প্রথম সূর্যালোক ইউরেনাসের যেসব অঞ্চলে এসে পড়ে, সেখানকার ব্যয়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয় ও শুরু হয় বসন্তকালীন দানবীয় ঝড়ঞ্জার।)। ১৯৮৬ সালে ভয়েজার ২-য়ের ফ্লাইবাইয়ের পরে ইউরেনাসকে সার্বক্ষণিকভাবে নজরে নজরে রাখে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। ২০১২ সালে ভয়েজার ২-য়ের দেখা সেই ‘গ্রেট ডার্ক স্পটে’ মেঘের ঘূর্ণাবর্ত প্রচণ্ড ঝড়ঞ্জায় ফেটে পড়ে, এই ঘূর্ণাবর্তের পরিমাণ ছিলো একহাজার সাতশো (১৭০০) কিলোমিটার থেকে তিন হাজার (৩০০০) কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। হাবলের টেলিস্কোপের চোখে সব ধরা পড়ে।

ইউরেনীয় বায়ুমণ্ডল সৌর মণ্ডলের বাকি সাতটি গ্রহের বায়ুমণ্ডলকে পরাজিত করে, শীতলতম বায়ুমণ্ডলের স্থানটি দখল করে আছে। অথচ, সূর্য থেকে দূরতম গ্রহ সে নয়, নেপচুনও তাকে হারাতে পারেনি। কারণ কি?

কারণ হলো যে, সৌর মণ্ডলের একমাত্র গ্রহ হিসেবে, সূর্য ও ইউরেনাসের মধ্যে তাপ থেকে উদ্ধৃত মোট শক্তি তথা মোট তাপীয় শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে না, তাদের মধ্যে তাপের বিনিময় হচ্ছে না। তার মানে হলো যে সূর্যের সঙ্গে ইউরেনাস ‘তাপীয় ভারসাম্য’ (thermal equilibrium) অবস্থায় রয়েছে। তাই সে শীতলতম গ্রহ। একটা কারণ হতে পারে যে ইউরেনাসের ভেতরে, অভ্যন্তরটি খু-উ-ব-ই উত্তপ্ত হলেও সেই তাপ বা গরম ভেতর থেকে গ্রহের বাইরে বেরিয়ে আসছে না, ভেতরেই থাকে। তার আর ঠান্ডা শীতল হওয়ার উপায় নেই। যার অর্থ হলো যে ভেতরটা উত্তপ্ত থাকছে তো থাকছেই, গ্রহের বাইরেটি হিমশীতল থাকছে। আরেকটি বিকল্প সম্ভাবনা হতে পারে যে যেমন কোনো অতিশয় বি-রা-ট মাপের সংঘর্ষের দরুন অথবা অজানা অজ্ঞাত কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইত্যবসরেই ইউরেনাসের আদি আদ্যকালীন তাপ হারিয়ে গেছে। আসলে আমরা সঠিক জানি না ইউরেনাস কেনো জমাট ঠান্ডা হিমশীতল। ইউরেনাসকে ঘিরে যতো অস্পষ্টতা বা রহস্য বা অনন্যতা রয়েছে জমাট হিমশীতলতা তার মধ্যে একটি।

আমাদের সৌর মণ্ডলে, একমাত্র মঙ্গল গ্রহ ছাড়া আর সব কয়টি গ্রহেরই চুম্বক ক্ষেত্র রয়েছে। ইউরেনাসেরও আছে। কাজেই তাদের চুম্বক মেরুও রয়েছে। ঠিক আমাদের পৃথিবীর চুম্বক মেরুর মতোই ইউরেনাসের চুম্বক মেরুও সঠিক স্থানে নেই বা যেখানে থাকলে সঠিকভাবে আছে বলে মনে করি আমরা, সেরকমভাবে সেখানে থাকে না। তাই ইউরেনীয় দক্ষিণ (চুম্বক) মেরু অবস্থান করছে ইউরেনাসের উত্তর গোলার্ধে, এবং উত্তর (চুম্বক) মেরু অবস্থান করছে দক্ষিণ গোলার্ধে। ইতিমধ্যে আবার ইউরেনীয় চুম্বক/চুম্বকীয় অক্ষ গ্রহের কেন্দ্রকে ছেদ করে (উত্তর-দক্ষিণমুখী) চলে যায়নি। ইউরেনাসের এমন বিচিত্র পরিস্থিতির জন্য মনে করা হয় যে তার চুম্বক ক্ষেত্রটির সৃষ্টি গ্রহের কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস থেকে হয়নি, কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সম্পর্কহীন গ্রহ সে। বরং গ্রহের বাইরের দিকের স্তরগুলো, যেখানে গ্রহীয় বস্তুর প্রবাহ অধিক, সেখানে সৃষ্টি হয়েছে ইউরেনীয় চুম্বক ক্ষেত্রের। তার মানে, ইউরেনীয় দিব্য বস্তুর কেন্দ্র থেকে প্রায় এক তৃতীয়াংশ দূরত্বে গ্রহটির চুম্বকীয় মেরু দুটো অবস্থান করছে।


ইউরেনীয়ান চুম্বকক্ষেত্র, সৌজন্যে। উইকিপিডিয়া, পাবলিক ডমেইন

পৃথিবী, বৃহস্পতি ও শনির মতো ইউরেনাসেরও উষামেরু (auroras) রয়েছে, তবে তাদের উষ্যমেরু-রা যেমন তাদের মেরু অক্ষের সঙ্গে সারিবদ্ধ হয়ে আবির্ভূত হয়, ইউরেনীয় উধ্যমেরুর আলোকচ্ছটা কিন্তু মোটেই তার মেরু অক্ষের সঙ্গে কখোনই সারিবদ্ধ হয় না। কারণ, ইউরেনাস পাশ ফিরে কাত হওয়া অবস্থায় থাকে বলে তার চুম্বক ক্ষেত্রও পাশ ফিরে থাকা অবস্থায় রয়েছে যে!

ইউরেনীয় উধ্যমেরু, সৌজন্যে। হাবল নভোটেলিস্কোপ, উহাকপিডিয়া, CC BY 40

ইউরেনাসের ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের আকার চেহারাও নিয়মবহিভূত, অনিয়মিত। পৃথিবীর ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের লেজ বা পুচ্ছের মতো ইউরেনীয় ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের লেজ বা পুচ্ছও, ইউরেনাসের পিছনে সূর্যের বিপরীতে শূন্যে বা মহাশূন্যে, লাখ লাখ লাখ….. কিলোমিটার দীর্ঘ অসম্ভব রকমের প্রাণবন্ত ও অপ্রতিসম পুচ্ছ শোভা প্রদর্শণ করে (দ্রষ্টব্য: মহাশূন্য প্রযুক্তি ও অনুসন্ধানের সন্ধানে, নাদিরা মজুমদার, বাংলা একাডেমি)। পূর্ববর্তী দুই জোভিয়ান গ্রহ, বৃহস্পতি ও শনির মতো ইউরেনাসেরও চাঁদ বা উপগ্রহ রয়েছে। সংখ্যায় আটাশটি। তার চাঁদগুলোর নামকরণে চলতি প্রথা অনুসরণ করা হয়নি; তথা গ্রিক বা রোমক পৌরানিক কাহিনির দেবদেবতার পরিবর্তে উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের ও আলেকজান্ডার পোপের সাহিত্য কীর্তিতে ব্যবহৃত চরিত্রদের নামে নামকরণ হয়েছে।

ইউরেনাসের পাঁচটি বৃহত্তম চাঁদ হলো, সাইজে ছোটো থেকে বড়োমুখি: মিরান্ডা (Miranda), এরিয়েল (Ariel), আমব্রিয়েল (Umbriel), টাইটেনিয়া (Titania) এবং ওবেরন (Oberon)। প্রায় পাশ ফিরে শুয়ে থাকা অবস্থায় ইউরেনাস সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, এবং তার বড়ো সাইজের সব কয়টি চাঁদ ইউরেনাসের বিষুবীয় প্লেন বা ক্ষেত্রের চারদিকে পরিক্রমণ করছে, তাদের উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধ পালাক্রমে বিয়াল্লিশ (৪২) বছর স্থায়ী দিন ও রাত্রিকাল যাপন করছে।

বৃহত্তম চাঁদগুলোসহ ইউরেনাস, চিত্রে। ‘পাক’ ও ‘পর্ণা’ হলো অভান্তর চাঁদ, সৌজন্যে। ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি, নাসা

এই পাঁচটি বৃহত্তম চাঁদ বা উপগ্রহের মধ্যে, বৃহস্পতির ইউরোপা চাঁদ ও শনির এনসেলাডাস চাঁদের মতো ওবেরন এবং টাইটেনিয়ার অভ্যন্তরে পানীয় জলের সাগর বা মহাসাগর রয়েছে, সেগুলো রয়েছে ‘কোর (মর্মবস্তু)-ম্যান্টেল’-য়ের সীমান্ত সৃষ্টিকারি এলাকায়। জেমস ওয়েব নভোটেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ অনুসারে এরিয়েলের অভ্যন্তরেও জলের মহাসাগর রয়েছে, এবং আমাদের বাড়তি জ্ঞানপ্রাপ্তি হলো যে সেখানে গভীর হিমে জমে বরফ হওয়া কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনো অক্সাইডও রয়েছে।

পাঁচটি ইউরেনীয়ান বা ইউরেনীয় চাঁদের পৃষ্ঠদেশই বহিবিশ্ব থেকে আগত বস্তু দ্বারা অনেকবার আহত ও ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। যেমন: ওবেরন এবং টাইটেনিয়ার পৃষ্ঠদেশ অসংখ্য সংঘর্ষে সৃষ্ট অসংখ্য গর্তে ছাওয়া। আবার, এরিয়েল-য়ের অপেক্ষাকৃত মসৃণ পৃষ্ঠদেশ প্রমাণ করছে যে তার পৃষ্ঠদেশটি নবীনতম, অপরদিকে, আমব্রিয়েল-য়ের নিদারুণভাবে অসংখ্য সংখ্যায় ক্ষতবিক্ষত পৃষ্ঠদেশকে মনে হবে বয়সের ভারে নযুক্ত চন্দ্রপৃষ্ঠ। মিরান্ডা-র পৃষ্ঠদেশও অসংখ্য আঘাতে শ্রীহীন ক্ষতবিক্ষত। ১৯৮৬ সালে ভয়েজার ২ কেবলমাত্র মিরান্ডা-র পৃষ্ঠদেশের এবং সৌর মণ্ডলের উচ্চতম শিখরের প্রতিচ্ছবি নিতে পেরেছিলো।

মিরান্ডা’-য় অবস্থিত সৌর মণ্ডলের উচ্চতম শিখর, উচ্চতা। ২০ কিলোমিটার, ছবি: ভয়েজার ২, জানুয়ারি ১৯৮৬ সাল, সৌজন্যে। নাস্য ফটোজার্নাল

তাছাড়াও, ইউরেনাসের তেরোটি (১৩) ‘অভ্যন্তর চাঁদ’ রয়েছে। তারা প্রায় সবাই ‘মিরান্ডা’ চাঁদের মাঝখানে থেকে নিজেদের কক্ষপথ পরিক্রমণ করছে। গ্রহ থেকে দূরত্ব অনুসারে, তারা হলো: কর্ডেলিয়া, ওফেলিয়া, বিয়াঙ্কা, ক্রেসিডা, ডেসডিমোনা, জুলিয়েট, পর্শা (Portia), রোজালিন্ড, কিউপিড, বেলিন্ডা, পেরডিটা, পাক এবং ম্যাব (Mab)। নামগুলো শেক্সপীয়ারের নাটকগুলোর চরিত্র থেকে নেয়া হয়েছে।

অভ্যন্তর চাঁদগুলো ইউরেনীয়/ইউরেনীয়ান আংটি বা রিং সিস্টেমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। কারণ, মনে করা হয় যে এক বা একাধিক অভ্যন্তর চাঁদের টুকরো টুকরো অংশ থেকে জন্ম হয়েছে আংটি সিস্টেমের। ইউরেনাস থেকে প্রায় একশো বাষট্টি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ‘পাক’ চাঁদটি বৃহত্তম অভ্যন্তর চাঁদ, এবং ভয়েজার ২, একমাত্র ‘পাক’-য়েরই পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিচ্ছবি নিতে পেরেছে। আবার, ‘পাক’ ও ‘ম্যাব’ ইউরেনীয় অভ্যন্তর চাঁদ সিস্টেমের সবচেয়ে বাইরের বা বাইরেরতম অভ্যন্তর চাঁদ। সব কয়টি ‘অভ্যন্তর চাঁদ’ গাঢ় রঙের। এগুলো সব জলজ বরফ হলেও কোনো গাঢ় রঙের জৈবিক পদার্থ দ্বারা দূষিত হয়েছে, এবং সম্ভবত ইউরেনীয় বিকিরণ তার জন্য দায়ী। অভ্যন্তর চাঁদ সিস্টেম এলোমেলো অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। ডেসডিমোনা ও ক্রেসিডার বা জুলিয়েট-য়ের মধ্যে কমপিউটর সিমিউলেমন করে দেখা গেছে যে আগামি একশো মিলিয়ন বছরের কোনো এক সময়ে এই অভ্যন্তর চাঁদগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হবে।

তাছাড়াও, ইউরেনাসের ফ্রানসিসকো, ক্যালিবান, স্টেফানো, ট্রিনকিউলো, সিকোর‍্যাক্স, মার্গারেট, প্রসপেরো, সেটেবস এবং ফার্ডিনান্ড ইত্যাদি নামধারি আরো কয়েকটি চাঁদ রয়েছে। এই চাঁদগুলোর নাম দেয়া হয়েছে শেক্সপীয়ারের নাটকের চরিত্রগুলো অনুসারে। এই চাঁদগুলোকে ‘অনিয়মিত চাঁদ’ বলা হয়। মনে করা হয় যে ইউরেনাসের জন্মের অব্যবহিত পর পরই, মুক্ত স্বাধীনভাবে পরিভ্রমণরত বস্তুরা ইউরেনাসের অভিকর্ষীয় ফাঁদে আটকা পড়ে যায় এবং ‘অনিয়মিত চাঁদ’-য়ের পরিচিতি পায়। ইউরেনাসের অনিয়মিত চাঁদগুলোর সাইজ প্রায় একশো পঞ্চাশ (১৫০) কিলোমিটার (সিকোর‍্যাক্স) থেকে আঠারো (১৮) কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত (ট্রিনকিউলো)। একমাত্র ‘মার্গারেট’ ছাড়া, ইউরেনাস তার কক্ষপথে থেকে যে দিক ধরে ঘুরছে বাকি সবকয়টি অনিয়মিত চাঁদ যার যার তার তার কক্ষপথে থেকে বিপরীত দিকে ঘুরছে, অর্থাৎ এসব অনিয়মিত চাঁদের কক্ষপথ বিপরীতমুখী বা রিট্রোগ্রেড’ সম্পন্ন।

বৃহস্পতি ও শনির মতো ইউরেনাসেরও আংটি বা রিং সিস্টেম রয়েছে। আটাশটি ইউরেনীয়ান চাঁদ আংটিগুলোকে এমনভাবে আড়াল করে রেখেছে যে ওদের দেখা পাওয়া ছিলো অসম্বব। সৌর মণ্ডলের সীমান্ত অতিক্রমের পূর্বে, ভয়েজার ২ নভোযান ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে ইউরেনাসকে যখন ‘ফ্লাই বাই’ করছিলো, সেসময়ে আংটি দেখে। আংটির প্রতিচ্ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়। প্রথমবারের মতো আংটির চাক্ষুষ প্রমাণ পাই আমরা।

ইউরেনাসকে ঘিরে থাকা কয়েকটি আংটি বা রিং, সৌজন্যে। জেমস ওয়েব নভোটেলিস্কোপ, পাবলিক ডমেইন

ভয়েজার ২ যখন ইউরেনাস-কে দর্শণ দেয় সেসময়ে গ্রহটির দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল চলছিলো। ২০০৭ সালে হাবল নভোটেলিস্কোপও আংটির প্রচুর ছবি তুলেছে। অবশেষে, আচার আচরণে প্রথাবিরুদ্ধ, তাই অনন্য ইউরেনাসের তেরোটি আংটির মধ্যে এগারোটি (১১) আংটির ছবি তোলা সম্ভব হয়। জেমস ওয়েব নভোটেলিস্কোপের ‘অবলোহিত দৃষ্টি’ (ইনফ্যারেড) লুকিয়ে থাকা আংটিগুলোকে সাফল্যের সঙ্গে পাকড়াও করে, ছবি তোলে। জেমস ওয়েবের লালচে দৃষ্টিতে যেমন গতিময় প্রাণবন্ত ও উদ্দীপ্ত আংটি, অনেকগুলো চাঁদ, ঝড়ঝড়া ধরা পড়েছে, তেমনি আবার উজ্জ্বল ঝলমলে উত্তর মেরুীয় ক্যাপের প্রতিচ্ছবিগুলোর সাবলীর সৌন্দর্য্য আমাদের উপলব্ধি বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। এইসব ইউরেনীয় আংটি, বাইরের দিকের দুটো ছাড়া, অত্যন্ত গাঢ় রঙের কণিকার সমাহারে গঠিত। আসলে রিংগুলো এতোটাই গাঢ় রঙের যে তাদেরকে হয়ত কাঠকয়লার সঙ্গে তুলনা করা যায়।

আকার আয়তন বা সাইজের দিক দিয়ে খু-উ-ব ছোটো, মাত্র মাইক্রোমিটার থেকে একমিটারের খন্ডাংশ দিয়ে তারা নির্মিত। অর্থাৎ আহামরি কিছু নয়, শনির আংটিগুলোর সমারোহপূর্ণ জৌলুস তাদের মোটেই নেই। তবু, বলতে হয় যে কি আশ্চর্য যে তিন জোভিয়ান গ্রহেরই আংটি রয়েছে। নেপচুনেরও কি আংটি রয়েছে? নেপচুন প্রসঙ্গে জানা যাবে।

সৌর মণ্ডলে গ্রহগুলোর ক্রম অবস্থান অনুসারে ইউরেনাসের নিকটতম প্রতিবেশি গ্রহ হলো শনি, এবং শনি থেকে সে এক দশমিক চারতিন (১.৪৩) বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে।

বর্তমানে, মোট তেরোটি (১৩) আংটির খোঁজ পাওয়া গেছে, বাইরের দুই আংটির মধ্যে একটির রং লালচে লালাভ, অন্যটির রং শনির ‘ই’ আংটির মতো নীল রঙের। দুটো সরু আংটি ছাড়া বাকিগুলো চওড়ায় কয়েক কিলোমিটার মাত্র।

ইউরেনাস থেকে দূরত্বের ক্রম অনুসারে, নামকরণ হয়েছে। জিটা, ৬.৫,৪, আলফা, বিটা, গামা, ডেলটা, ল্যাম্বডা, এপসিলন/ এপসায়লন, নিউ, এবং মিউ। আংটিগুলোর নামকরণেও কিন্তু বৈচিত্র লক্ষ্যণীয়, প্রধানত গ্রিক অক্ষর ব্যবহার হয়েছে, তিনটি আংটির নাম হয়েছে আরবি বা অ্যারাবিক সংখ্যা (৬,৫,৪) দিয়ে।

১৯৮৬ সালে, ফ্লাইবাইয়ের সময় ভয়েজার ২ ইউরেনাসের নতুন চাঁদগুলোর ও আংটির সন্ধান পায়, এবং ইউরেনাসের চুম্বক ক্ষেত্রের মাপজোক করে। চাঁদগুলো পাশ ফিরে পরিক্রমণ করছে বলে যে ট্র্যাজেক্টরিতে ভয়েজার ২ পরিক্রমন করছিলো সেটির পক্ষে কেবলমাত্র মিরান্ডা-কেই কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছিলো। ভয়েজার ২ তাই করেছে, অসংখ্য সংখ্যকবার সংঘর্ষে ক্ষত বিক্ষত মিরান্ডা-র পৃষ্ঠদেশ এবং যেনো বা নির্দয়ের মতো বার বার প্রহৃত পৃষ্ঠদেশে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ (২০) কিলোমিটার উঁচু হওয়ায় সৌর জগতের উচ্চতম শিখরকে আমাদের দৃষ্টিগোচরে নিয়ে আসে।

অতঃপর, ইউরেনাসকে মণিটর করার দায়িত্ব পালন করে হাবল নভোটেলিস্কোপ। হাবল অনেকগুলো বছর ধরে নিরলসভাবে গ্রহটির ঋতু-পরিবর্তন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, এবং ইউরেনীয় আবহাওয়ার প্যাটার্ণ সম্বন্ধে আমাদেরকে চমকপ্রদ পরিজ্ঞান অর্জনে সাহায্য করে। ভয়েজার ২-য়ের পরে আর কোনো নভোযানকে ইউরেনাস মিশনে পাঠানো হয়নি। ২০৩১/২০৩২ সালে ইউরেনাসের উদ্দেশ্যে নভোযান পাঠানোর চেষ্টা চলছে। যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে উৎক্ষেপণের তেরো/চোদ্দ বছর পরে নভোযানটি ইউরেনাসে হাজির হবে।

ইউরেনাসের উত্তর গোলার্থে মেঘ দেখা যাচ্ছে; সেখানে এখন বসন্তকালের শেষাশেষি সময় চলছে, বসন্তকাল শেষে গ্রীষ্মকাল আসবে ২০২৮ সালে, দক্ষিণ গোলার্ধে চলছে লম্বা টানা দীর্ঘ অন্ধকার, সৌজন্যে, পাবলিক ডমেইন

সূর্য থেকে বিশগুণ দূরে ইউরেনাস অবস্থান করছে। এ-ই দূরত্বে গ্যাস ও ধূলিকণার চাকতি থেকে সৌর মণ্ডল যখন রূপ নিচ্ছিলো, সম্ভবত ইউরেনাস খু-ব-ই হালকা পাতলা ছিলো (প্রায় চার দশমিক পাঁচ (৪.৫) বিলিয়ন বছর পূর্বে)। অন্যসব জোভিয়ান গ্রহের মতো হয়ত ইউরেনাসও সূর্যের কাছাকাছি ছিলো, পরে অভিকর্ষ তাকে ঠেলেঠুলে সৌরজগতের বাইরের দিকে পাঠিয়ে দেয়। সৌর মণ্ডলের জন্মের প্রারম্ভ পৃথিবীতে তখনো যখন প্রাণের আগমণ হয়নি, এমন এই কালটি কেমন ছিলো জানার কোনো উপায় আমাদের আছে কি? যদি আমরা সূর্যের কাছ থেকে সৌর জগতের প্রায় প্রান্তে ইউরেনাসের স্থানান্তরী হওয়ার কাহিনি জানতে পারি তবে প্রারম্ভকালীন সৌর জগতকে জানতে পারব।

 

নাদিরা মজুমদার

লেখক: অনন্যা ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024