মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫২ পূর্বাহ্ন

প্রকৃতিবিদের কাহিনী (কাহিনী-০৯)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

পিওতর মান্তেইফেল

নানা জাতের সংসার

একবার চিড়িয়াখানায় এল মেঠো বেড়ালের চোখ-না-ফোটা চারটে গুদে ক্ষুদে ছানা। এদের আমরা মানুষ করতে দিই ঘরে পোষা বেড়ালের কাছে, কিছুদিন আগে বাচ্চা হয়েছিল তার।

চিড়িয়াখানার কিশোর জীববিদরা জানত যে জন্তুরা দৃষ্টির চেয়ে গন্ধকে বিশ্বাস করে বেশি, তাই তারা জল-ভরা এক গামলায় বেড়াল-ছানাগুলোকে চুবায়, তারপর সেই জলেই চান করায় মেঠো বেড়ালের ছানাদের। আর সবকটাকেই একসঙ্গে দেয় বেড়ালের কোলে। বেড়ালটা প্রথমে ছটফটিয়ে ওঠে, কিন্তু একই জলে চান করায় মেঠো বেড়াল-ছানাগুলোর গা থেকেও ঘরোয়া বেড়ালের গন্ধ ছাড়ছিল, তাই পোষ্যদের সে টেনে নেয়, তাদের গা চাটে নিজের ছানাদের মতোই সমান যত্নে। দিন গেল। বড়ো হয়ে উঠল মেঠো ছানারা, স্নেহময়ী সৎ-মায়ের নিয়ত তত্ত্বাবধানে ঘরোয়া ছানাদের সঙ্গেই খেলত তারা।

এইভাবেই চিড়িয়াখানায় দেখা দিল একেবারেই পোষা মেঠো বেড়াল। নিজেদের জায়গা ছেড়ে বেশি দূরে তারা যেত না কখনো, যদিও অচেনা লোক দেখলে সর্বদাই ফোঁস-ফোঁস করত, লুকিয়ে পড়ত কোথাও। কিন্তু অনেক কিশোর জীববিদের ডাকেই তারা মুহূর্তে ছুটে আসত, সোহাগ কাড়ত নিজেদের ধরনে। বেড়ালটা যদি ই’দুর এনে আন্তে মিউ-মিউ করে তার পোষ্যদের ‘খাবারে’ ডাকত, তাহলে মেঠো ছানারাই ছুটে যেত সবার আগে, দখল করত খাবার।

একবার পোষা মেঠো বেড়ালেরা খেলা করছে, এমন সময় একটা শেয়াল তার খোঁয়াড় থেকে বেরিয়ে এসে তাদের দিকে এগুতে শুরু করে। ঠিক সময়ে যদি বেড়াল-মা তার পোষ্যদের না আগলাত, তাহলে এ শিকারের পরিণাম কী হত বলা যায় না। পিঠ বাঁকিয়ে প্রাণের মায়া না করে ভয়ঙ্কর চেহারায় সে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মেঠো বেড়ালের ছানাগুলোকে আড়াল করে শেয়ালটাকে খেদিয়ে দেয়। কিছু পরে আরেকটা চিত্তাকর্ষক পরীক্ষা চালাই আমরা।

ধেড়ে ই’দুরের গর্ত খড়ে কিশোর জীববিদরা দেখে, চোখ-না-ফোটা নয়টি ছোটো ছানা সেখানে ঘুমচ্ছে।

একটা ছানাকে আমরা নিয়ে যাই বেড়ালের কাছে, কিছুদিন আগে বাচ্চা দিয়েছিল সে। সঙ্গে সঙ্গেই বেড়ালটা চাঙ্গা হয়ে উঠল, কামড়ে ধরতে যাচ্ছিল তাকে। তাই ফিরিয়ে আনতে হল।

আগের মতো এবারেও আমরা একই জলে বেড়াল-ছানা আর নয়টা ইদুর- ছানাকে চান করাই। তারপর সবকটাকে দিই বেড়ালের কোলে। ভেজা বেড়াল- ছানাগুলো চি’চি’ করছিল, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল মাতৃস্নেহ। বেড়ালটা শুধু নিজের ছানাদের নয়, ই’দুর-ছানাগুলোরও গা চেটে দেয়, চানের পর তাদের গা থেকে বেড়াল-ছানার গন্ধ ছাড়ছিল।

রংবেরং বেড়াল-ছানাদের চেয়ে তিনগুণ ছোটো হলেও বেড়ালটা নেংটা ই’দুর- ছানাদের গ্রহণ করে নিজের সন্তান হিশেবে।

এমন অসাধারণ সংসারটা ছিল যে খাঁচায় সেখানে সর্বদাই ভিড় জমত দর্শকদের। অনেকে বলাবলি করত, শিগগিরই বেড়ালটার ‘মত পালটাবে’, শেষকালে খেয়ে নেবে তার পোষ্যদের। একদিন এক বুড়ি এসে, দেখে-শুনে থুতু ফেললে:

‘ছিঃ! মাগো, বেড়ালকে কী রকম নষ্ট করেছে!.’

আমরা মোটেই বুড়ির সঙ্গে একমত হই নি, বরং খুবই আনন্দ হয়েছিল পরীক্ষার সাফল্যে।

ধেড়ে ই’দুর-ছানারা বড়ো হয়ে উঠল। সৎ-মা আর তার বেড়াল-ছানাদের কাছে কোনোই সংকোচ বোধ করত না তারা। অবিশ্যি নয়টা ছানার সবকটিই টিকে থাকে নি। বেঁচে ছিল মাত্র পাঁচটি, তবে এই পাঁচটিরই ছিল সবচেয়ে বেশি সামর্থ্য, সহ্যশক্তি, জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা। মারা যায় অপেক্ষাকৃত দুর্বলেরা এবং যাদের মুখ বেড়ালের মাই টানার মতো যথেষ্ট বিকশিত হয় নি।

নিজের ছানা আর পোষ্যদের মধ্যে কোনো তফাৎ করত না বেড়ালটা, সমানভাবেই যত্ন করত তাদের। দূরে চলে যাওয়া ই’দুর-জানাদের সে সন্তর্পণে কামড়ে ধরে ফের নিয়ে আসত ঝুড়িটায়।

কালক্রমে ছানাগুলো হয়ে উঠল ধেড়ে ই’দুর; আগের মতোই তারা শাস্তিতে থাকত সৎ-মায়ের সঙ্গে, মা চিৎ হয়ে শুয়ে খেলা করত তাদের নিয়ে।

তবে বেড়ালের মাতৃস্নেহ আরো পারঙ্গম। একবার সাভিনো স্টেশনের রেল- কর্মীর স্ত্রী ভানেয়েডা আমায় চিঠি লিখে জানান কীভাবে মুরগী-স্থানা মানুষ করেছে বেড়াল।

মুরগী-ছানাগুলোর জন্ম হতেই তাদের মা মারা যায় এক দুর্ঘটনায়। এই বয়সে খাদ্য ছাড়াও তাদের দরকার তাপ।

ঠান্ডা বোধ করলেই তারা সে তাপ পেত বেড়ালের গা থেকে।

সদ্য ডিম ফুটে বেরনো পাঁচটা মুরগী-ছানাকে ভানেয়েভ্য রাখেন বেড়াল আর বেড়াল-ছানাদের বাক্সে। যা আশা করা যায় না, বেড়ালটা আশ্চর্য’ যত্ন নেয় মুরগী- ছানাদের, চি’চি’ করলে সস্নেহে গা চেটে দিত তাদের।

সবকটার মধ্যে টিকে থাকে কেবল একটা মোরগ। বেড়াল-ছানাগুলোর সঙ্গে তার ছিল সত্যিকারের বন্ধুত্ব। বেড়ালটা তার বাচ্চাদের জন্যে প্রায়ই নিয়ে আসত চড়ুই বা অন্য কোনো ছোটো ছোটো পাখি, অথচ মুরগী-ছানাটার ওপর কখনো সে হামলা করে নি।

ভেলভস্ক অঞ্চলে গারি গ্রামের এক চিঠিতে আছে আরো মজার এক ঘটনা।

ইনকিউবেটর যন্ত্রের মতো চুল্লিতে টুপির মধ্যে কতকগুলো ছেলেমেয়ে মুরগীর ডিম ফুটিয়ে তিনটে বাচ্চা করে। কার যেন মাথায় খেলে, বাচ্চাগুলো মানুষ করতে দেবে বেড়াল দীমুস্কার কাছে, সম্প্রতি বাচ্চা হয়েছে তার। দিনে বেড়ালের উপস্থিতিতেই মুরগী-ছানাদের রাখা হল সেখানে। করুণ স্বরে চি’চি’ করা হলুদ গুটলিগুলোকে চট করে শুকে একটা ছানাকে কামড়াতে যাচ্ছিল সে। কিন্তু ছেলেদের হাতে চড় খেয়ে সে এই অসাধারণ প্রতিবেশিত্ব মেনে নেয়।

প্রথম দিন ছেলেদের তত্ত্বাবধানে বেড়ালটার কাছে মুরগী-ছানাগুলো ছিল দু’ঘণ্টা। পরের দিন আরো বেশি। পরের দিন রাত্রের জন্যেও তাদের রেখে দেওয়া হয় বেড়ালের কাছে। সে পরীক্ষাটা পুরো সফল হয়।

এইভাবে কাটে তিন সপ্তাহ। বেড়াল ছানাগুলোর মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমাত মুরগী ছানারা, আর বেড়াল-মা তার নিজের বাচ্চাদের মতোই তাদেরও গা চেটে দিত সযত্নে। তবে চতুর্থ সপ্তাহে দেখা গেল দুটো মুরগী-ছানা মরা, বড়ো বেশি অসতর্কে দীমুংকা গা এলিয়েছিল ঝুড়িতে, তাতে হঠাৎ পিষে যায় তারা।

সকালে মরা ছানাদুটো দেখে ছেলেরা তা ছাড়ে ফেলে দেয়, কিন্তু শিগগিরই বেড়াল তার মৃত পোষ্যদের সন্ধান পায়, শোঁকার্শ্বকি করে, এপাশ-ওপাশ ওলটায়; এক-একবার চলে যায়, আবার ফিরে আসে, যেন ওর পেছ পেছ যাবার জন্যে ডাকছে। বেড়ালটার আকুলতা থামাবার জন্যে ওদের গোর দিতে হয় মাটিতে।

এইভাবে টিকে রইল কেবল একটা মুরগী-ছানা। বেড়ালের সঙ্গে পাশাপাশি তার কাটে দু’মাস, অবশেষে বেড়াল-ছানাগুলোকে বিলিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরেও বেড়ালের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব যায় নি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024