মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:০৪ পূর্বাহ্ন

বনমানুষ

  • Update Time : শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৪, ৬.৩৮ পিএম
আবু ইসহাক

নতুন চাকরি পেয়ে কলকাতা এসেছি। সম্পূর্ণ অস্থায়ী চাকরি। যে কোন সময়ে, বিনা কারণে ও বিনা নোটিশে বওয়াচ হওয়ার সম্ভাবনা। নিয়োগ-পরে এমন সময়ে, বিনা খাবড়াইনি একটুও। বন-বিভাগে চাকরি করতাম ষাট টাকায়। এখানে পাব একেশ তিরিশ টাকা। ডবলেরও বেশি। এমন সুবর্ণ সুযোগ কোন নির্বোধ পায়ে ঠেলে দেয় বলে আমার মনে হয় না। আর যা-ই হোক, আমি দু’পায়ে হাঁটি। জঙ্গলে যারা চার পায়ে হাঁটে, তাদের প্রতিবেশে থেকে আমার বুদ্ধিটা লোপ পেয়ে যায়নি। সত্তর টাকা বেশি পাব-এ কি যেমন-তেমন ব্যাপার। বিয়ে করেছি অল্প দিন। এখন ডবল টাকারই দরকার। তা ছাড়া জঙ্গল ছেড়ে এসেছি শহরে, হিংস্রালয় ছেড়ে লোকালয়ে, আঁধার ছেড়ে আলোকে। এরকম সভ্য সমাজে আসাটাও একটা মস্ত লাভ।

চাকরিতে যোগ দিয়েছি গতকাল। আজ দ্বিতীয় দিন, বৃহস্পতিবার। ন’টা না বাজতেই খেয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। মেসের খাওয়া। কি খেলাম বলব না। বলতে লজ্জা করে। তা ছাড়া খাওয়াটা গৌণকর্ম, নেহায়েতই রান্নাঘরের ব্যাপার। যা মুখ্য তা হচ্ছে আমাদের পোশাক। সাজ-পোশাকই আমাদের সভ্যতার মাপকাঠি। কোন রকমে শাকভাত খেয়ে বেঁচে থাকলেও এ দেহকে দুরস্ত খোলসে ঢেকে ভদ্রলোক সাজাতেই হবে। তাছাড়া উপায় নেই ভদ্র সমাজে বের হওয়ার। আমাদের মত খুদে অফিসারদের ব্যাপার আরো জটিল। কোট-প্যান্ট পরে, টাই বেঁধে দুরস্ত হওয়া চাই, নয় তো ওপরওয়ালা সায়েবদের সুনজর হবে না কোনদিন। তাঁদের কথা, ঘোড়ায় চড়ে না হোক, গাধায় চড়েও কেন আমরা তাদের অনুসরণ করব না? অফিসে তাই অনুকরণ ও অনুসরণের প্রতিযোগিতা বেশ উপভোগের হয়ে দাঁড়ায়।

মেসের এক সদস্যের সাহায্য নিয়ে গলগ্রন্থিটা কোনরকমে বেঁধে কোটটা গায়ে চড়িয়ে দিই। আয়নায় মুখ দেখে ভালো ভাগে না। দাড়িগুলোর কালো মাথা দেখা যাচ্ছে। অথচ গতকালই দাড়ি কামিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি ‘সেফটি রেজার’ বের করে ঐ অবস্থায়ই কয়েক পোঁচ টেনে নিই। কিন্তু কোটের কলারটায় সাবানের ফেনা লেগে যায়। তোয়ালে দিয়ে সেটা মুছে চুলে চিরুনি চালাই আর একবার। তারপর জুতো জোড়া পায়ে ঢুকিয়ে আর এক দফা আয়নায় মুখ দেখে বেরিয়ে পড়ি।

ন’টা বাজে। পথ সংক্ষেপ করতে গিয়ে একটা ছোট্ট গলিতে ঢুকি। গলি নয় ঠিক। দুই দেয়ালের মাঝখান দিয়ে সরু পথ। গা বাঁচিয়ে একজন যেতে পারে কোনমতে। মাঝ পথে গিয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াতে হয় আমাকে। একজন বুড়ো ভদ্রলোক আসছিলেন ওদিক থেকে। দেহের আয়তন তার নিতান্ত ছোট নয়। তাই কোলাকুলিটা আলোছায় ভালোভাবেই। তারপর একজন, আরো একজন, আরো একজন। কোলাকুলি হয়ে যায়ারায় যান তারা। কোলাকুলিটা যদিও সকলের সানোয় এরকমে না, তবুও মনে হয় মানুষে মানুষে হানাহানির এ সময়টায় অজানা-অচেনায় এরকম কোলাকুলি বড়

দুর্লভ। আর মাত্র কয়েক কদম পার হলেই বড় রাস্তা। দেয়াল ছেড়ে সবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি, দেখি এক ভদ্র মহিলা গলিটায় ঢুকে পড়েছেন। আমার সামান্য কয়েক কাদমের পথটুকু পার হবার সুযোগ না দিয়ে এগিয়েই আসছেন তিনি। এবার আর উপায় নেই। তাড়াতাড়ি পিছু হেঁটে শেষটায় উপায় করতে হয় আমাকেই।

দেয়ালে ঠেস্ দেয়ায় ছাতলা লেগেছিল কোটে। রুমাল বের করে ঝেড়ে আবার পথ দেখি আমি। এবার আর সোজা পথে নয়। সোজা পথটাই দেখছি কঠিন বেশি। বেনেপুকুর লেন ঘুরে, লোয়ার সার্কুলার রোড পার হয়ে ইলিয়ট রোডের মোড়ে এসে দাঁড়াই।

ধর্মঘটের জন্যে ট্রাম বন্ধ। আমাকে যেতে হবে ৮ নম্বর বাসে। এক-এক করে কয়েকটা বাস চলে যায়। কতবার হাতল ধরতে গিয়ে পিছিয়ে যাই। সাহসে কুলোয় না। লোকসব বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছে। নিরাশ হবার পাত্র আমি নই। দাঁড়িয়ে থাকি, দেখি অন্তত একটা পা রাখবার জায়গাও যদি মিলে যায়। একটা বাস এসে থামে। পা রাখবার জায়গা নেই। তবুও সব লোক ছুটোছুটি

করছে, কে কার আগে উঠবে। চাকরি ঠিক রাখার কি প্রাণান্ত চেষ্টা। একটা লোক নেমে যায় ড্রাইভারের কুঠরি থেকে। মহা সুযোগ! পাশের কয়েকজনকে টেক্কা মেরে চট করে উঠে পড়ি আমি। চাকরি গেলে আমার চলবে না। হঠাৎ আমার বুকে ধাক্কা মেরে একজন চেঁচিয়ে ওঠে, মানুষ, না জানোয়ার।

লোকটা কি গণক নাকি! গণকের মত ঠিকই তো বলেছে সে! আমি জঙ্গলেই তো ছিলাম এদ্দিন!

লোকটাকে ধন্যবাদ দেয়ার ইচ্ছে হয়। কিন্তু সাহস হয় না। ঘাড়টা নুইয়ে গায়ে গায়ে মেশামেশি হয়ে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু মেশামেশিটা আগের কোলাকুলির মত প্রীতিকর হয় না। আমি শেষে ঢুকে অনেকের অসুবিধে করেছি। ঠেলা-ধাক্কাটা তাই আমার দিকেই আসছে বেশি করে। পাঁজরার হাড়গুলো চাপ খেয়ে ভেঙে যাবে মনে হচ্ছে। আর দেরি এতক্ষণ দম বন্ধ হয়েছিল যেন। মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসকে সজীব করে

নয়, পরের স্টপে থামতেই আমি নেমে যাই। নিই খোলা বাতাসে। স্যুটটার দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। ভেতরের ঘামে আর ওপরের ঘষায় ইস্ত্রি ভেঙ্গে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। এবার পা দুটোকে সম্বল করেই ছুটব ঠিক করলাম।

কলকাতা এসেছিলাম অনেকদিন আগে একবার। পথ-ঘাট ভালো মনে নেই। পথ চেয়ে পথ চলি। কিন্তু তার চয়েও বেশি চেয়ে দেখতে হয় পথচারীদের পোশাকের দিকে।

এই পোশাক ছাড়া কার কি ধর্ম জানবার উপায় নেই। কারণ ধর্মের কথা গায়ে কিছু লেখা থাকে না। সব ধর্মধারীদের চেহারাই মানুষের চেহারা। আমার চেহারা দেখে কিন্তু কারো বুঝবার যো নেই আমার ধর্ম কি। কারণ আমার মানুষের শরীরটাকে আন্তঃধার্মিক পোশাকে ঢেকে নিয়েছি। তাই বলে কি আমি নিরাপদ? মোটেই না। আমার বিপদ বরং বেশি। আন্তঃধার্মিক পোশাকে মানুষের চেহারা হলেও যে কোন দিকের চাকু খাওয়ার ভয় আছে আমার। মুসলমান আমাকে হিন্দু ঠাওরালে, আর হিন্দু মুসলমান ঠাওরাওয়ার ভয় ছেয়ে বুকটা দুরুদুরু করে। মন ইতিমধ্যেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। একালেই হলগ টাকার চাকরিটার ভার ছেড়ে দিই পা দুটোর ওপর। শুধু তাই নয়, মনের বিরুদ্ধে সমস্ত দেহের ভারটাও। এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় পা দিয়ে থমেক দাঁড়াই। কাছাকাছি একটা প্রাণীও দেখছি না যে! বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে। সুমুখের একটা দোতলা বাড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখি, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কয়েকজন কি যেন দেখছে রাস্তার দিকে। ওপর থেকে নিচের দিকে চোখ নামাতেই চোখ ফিরে আসে, পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। গায়ের রোম কাঁটা দিয়ে ওঠে। চিনতে ভুল হয় না। মানুষ। হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে রক্তাক্ত মানুষ। রক্তের রাঙা স্রোত ড্রেনে গিয়ে মিশেছে। নিমেষে পেছন ঘুরে অন্য পথ ধরি। গাড়ির আওয়াজ পেয়েও তাকাই না ফিরে।

কিন্তু কে যেন গর্জে ওঠে , ঠায়রো।

*দু’জন সার্জেন্ট রিভলবার হাতে এগিয়ে আসে। আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে তারা। কিন্তু ফাঁসাতে পারে না। নিয়োগ-পত্রটা পকেটেই ছিল। সেটা দেখিয়ে রেহাই পেয়ে যাই।

এবার আরেকটা রাস্তা ধরে হাঁটি। হাঁটি সুমুখে পেছনে চেয়ে। মারটা নাকি পেছন থেকেই আসে। এক একজন লোক চলে যায় পাশ কেটে, মনে হয় এক একটা ফাঁড়া কেটে যায় আমার। আমার সতর্ক চোখ দুটো আড়চোখে তাকায় সবার দিকে। কিন্তু তারাও যে সতর্ক দৃষ্টি মেলে আমারই দিকে তাকায়! আমাকে-আমার হাত দুটোকেই বোধ হয় তাদের ভয়। তাদের ভীত চাউনি দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না। আমিও আমার অনুগত হাত দুটো ছাড়া আর কারো হাতকে বিশ্বাস করতে পারি না।

কিছুদূর আগে ডান দিকে একটা পাশগলি। গলির মুখে তিনটে লোক। তাদের পোশাক দেখে চমকে উঠি। তাদের ভাবগতিকও কেমন যেন সুবিধের মনে হচ্ছে না। আমার বুকের ভেতরটায় ঢিপঢিপ শুরু হয়েছে। আশেপাশে লোকজন নেই। পেছনে তাকিয়ে দেখি এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান তরুণী উঁচু-গোড়ালি জুতো পায়ে আসছে গাট্ করে। আমার মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে যায়। আমি পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে যাই। গলির মুখের লোকগুলোকে বোঝাতে চাই, আমি তরুণীটির জন্যেই অপেক্ষা করছি। তারই সাথী আমি। কিন্তু তারা বুঝতে চাইলে হয়। আমার যে রকম গায়ের রঙ! অবশ্য এরকম রঙের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের অভাব নেই কলকাতা শহরে।

আমার পোশাক দেখে লোকগুলো না হয় আমাকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ঠাওরাল। কিন্তু তরুণীটিকে কি বোঝাব? আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কি মনে করবে সে?

আমি উবু হয়ে বাঁ পায়ের জুতো খুলি। জুতোর ভেতর কাঁকর ঢুকেছে এমনি ভান করে জুতোটা উপুড় করে ঝেড়ে নিই কয়েকবার। তারপর আবার পায়ে ঢুকাই। তরুণীটি আমার কাছে এসে গেছে। জুতোর ফিতে বাঁধা শেষ করে এবার তার পাশাপাশি চলতে শুরু করি। এখন ঠিক মনে হচ্ছে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দম্পতি। অন্যের কি মনে হচ্ছে জানি না। আমার কিন্তু ওরকমই মনে হচ্ছে। এক পা, দু’পা করে গলির মুখ পার হয়ে যাই।

ফাঁড়া কেটে গেছে। আমার নীরব সঙ্গিনী একবার কটমট করে আমার দিকে তাকায়। তার চোখের দিকে চেয়ে আমার মনটা মিইয়ে যায়। কিন্তু তবুও তার সঙ্গ ছাড়তে ভরসা পাইনে। পাশাপাশি হেঁটে আরো কিছুদূর এগিয়ে যাই। হঠাৎ আমার দিকে ফিরে ইংরেজিতে বলে সে, আমার পিছু নিয়েছ কেন?

-না-না-। আমি থতমত খেয়ে যাই।

-না মানে। বহুক্ষণ ধরে আমি লক্ষ্য করছি। পুলিশ ডাকব?

-না-না, মানে-ইয়ে, মানে গুণ্ডার ভয়ে-

-গুণ্ডার ভয়ে।

-হ্যাঁ, তাই-তাই আপনার সাথে সাথে এলাম।

-অবাক করলে! এক জোয়ান পুরুষ, তাকে রক্ষা করবে মেয়ে মানুষ! আচ্ছা

কাপুরুষ তো! অবজ্ঞার হাসি তরুণীটির মুখে।

কিছুদূর গিয়ে মহিলা বাঁ’দিকে এক গলিতে ঢুকে পড়ে। আমি মোড় নিই ডান দিকে।

পাশ থেকে একটা হাত এগিয়ে আসছে না আমার দিকে!

‘উঃ ‘মাগো’ বলে লাফ দিয়ে সরে যাই কয়েক হাত। ফিরে দেখি একজন জটাধারী ফকির হাসছে আমার অবস্থা দেখে। এগিয়ে এসে সে বলে, ভয় পেলি নাকি? দু’দিন খেতে পাইনি। দুটো পয়সা দে।

রীতিমত ঘাম দিয়েছে আমাকে। মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। তবু হাতে চাকু না থাকার জন্যে ফকিরটাকে ধন্যবাদ দিই মনে মনে আর পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে তার দিকে ছুড়ে মারি।

চৌরঙ্গী এসে পড়েছি। একটা লোক হঠাৎ আমার পথ আগলে দাঁড়ায়। বলে,- ফটো তুলবেন? আসুন। এক টাকায় তিন কপি।

লোকটার কথার জবাব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। কিন্তু ভুল হয়ে গেল। মানুষের ভয়ে ভীত মানুষের ফটোটা তুলে রাখা উচিত ছিল আমার।

এক পয়সায় একটা ‘পাসিং শো’ সিগারেট কিনে রশির আগুনে ধরাতে যাব, হঠাৎ কার স্পর্শে শিউরে উঠি।

চেয়ে দেখি, আমাদের সুভাষ মুচকি হাসছে। সহপাঠী বন্ধুর আলিঙ্গনে বুকের ভেতরটা যেন ভিজে ওঠে। কিন্তু ওর বুকটা শক্ত লাগল না! জামার ওপর হাত রাখি। তাই তো!

সুভাস হেসে বলে, হাত দিয়ে দেখছিস কি?

-দেখছি, মানে-তোর বুকটা শক্ত লাগছে কি?

শক্ত লাগছে? হুঁ হুঁ হুঁ! এ জিনিষ দেখিস নি কখনো। লোহার তারের গেঞ্জি।

একেবারে নয়া আবিষ্কার!

-নয়া আবিষ্কার!

হ্যাঁ, এ বর্ম ভেদ করবে চাকু? উঁহু!

সুভাষের জামার ওপর হাত দিয়ে দিয়ে আঁচ করতে পারি, লোহার তার দিয়ে তৈরি হাতাকাটা গেঞ্জি। মন্দ জিনিষ নয়। সহসা আঘাত করে কিছু করতে পারবে না।

আমি হেসে বলি, কিরে চাকু-টাকু লুকোন নেই তো?

-নেই তো কি! নিশ্চয়ই আছে। এক্ষুণি তোর বুকে বসিয়ে দেব। তোর রক্ত দিয়ে ফোঁটা-তিলক কেটে কালী পূজো করব।

-এখানে কি করিস?

-পড়ি আর্ট স্কুলে।

-আর্ট স্কুলে! ঠিক আছে। শোন্ তোকে একটা ছবি আঁকতে হবে। মানুষের ভয়ে মানুষের চেহারা কেমন হয়, ফুটিয়ে তুলতে হবে সে ছবিতে। পারবি তো?

-তা দেখব চেষ্টা করে।

আরো দু’-এক কথা বলে বিদেয় হই তাড়াতাড়ি। দশ বছর এক সাথে পড়েছি, খেলাধুলো করেছি। আজ দশটা মিনিটও কথা বলবার ফুরসত নেই। গোলামী ঠিক রাখতেই হবে।

হোয়াইটঅ্যাওয়ের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠি। সাড়ে দশটা বাজে। আমারটা তা হলে বন্ধ হয়ে আছে? তাই তো! এই রে চাকরি বুঝি গেল! ডালহৌসী পর্যন্ত হেঁটে গেলে দেরি হয়ে যাবে অনেক। পকেট হাতড়ে আট আনা পয়সা পাওয়া যায়। বাস ভাড়া ও টিফিনের পয়সা। রিক্সা ডেকে উঠে পড়ি। টিফিন চুলোয় যাক। অফিসে পৌঁছে শুনি হাজিরা বই অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের ঘরে চলে গেছে। রোজ সোয়া দশটার সময় হাজিরা বই তাঁর ঘরে চলে যায়। যারা দেরিতে আসে, তাদের কৈফিয়ত আদায় করে হাজিরা বইয়ে সই করতে দেন তিনি।

অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের ঘরে ঢুকি। শ্বেতাঙ্গ সায়েব। কিছুক্ষণ আগে, অফিসের গেট পার হয়ে আসার সময় তাঁকে গাড়ি করে আসতে দেখেছি। আমাকে দেখে হাতঘড়ির দিকে চেয়ে ইংরেজিতে বলেন, এত দেরি করে এসেছ কেন? এখন এগারোটা বাজে। এরকম দেরি করে এলে চলবে না, বুঝলে?

অফিসে নতুন ঢুকেছি, তাই বোধ হয় বেশি কিছু শুনতে হয় না। কিন্তু আমার মেজাজটা ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বলতে ইচ্ছে হয়, আমার পায়ে তো আর চাকা লাগান নেই আপনার গাড়ির মত!

হাজিরা বইয়ে নাম সই করতে যাব, ফাউন্টেন পেনটার জন্যে ওপরের পকেটে হাত দিই। কই, নেই তো! এ পকেটে ও পকেটে খুঁজি। কিন্তু পাওয়া যায় না আর। সায়েবের টেবিল থেকে কলম তুলে হাজিরা বইয়ে সই করে বেরিয়ে আসি। পকেটগুলো হাতড়ে দেখি আবার। মেসে রেখে আসিনি। পকেটে তুলেছিলাম, স্পষ্ট মনে আছে। তা হলে? বাসের মধ্যে আমার বুকে ধাক্কা দিয়ে জানোয়ার বলেছিল যে মানুষটা তার কর্ম নয় তো?

আমার পোস্টিং হবে কোন এক শাখা অফিসে। অফিসের বড় কর্তা কতগুলো ফাইল দিয়েছেন। পোস্টিং না হওয়া অবধি কাজকর্ম বুঝে নিতে হবে। ফাইলগুলোয় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কলমটার বিচ্ছেদে মন বসে না। পাঁচ মাস বাড়িতে পাঁচ টাকা করে কম পাঠিয়ে পঁচিশ টাকায় কিনেছিলাম কলমটা। জোর করে কাজে মনঃসংযোগ করতে চেষ্টা করি, কিন্তু বারবার কলমটার কথাই মনে পড়ে।

আমি কথা বলি কম। জঙ্গলে তাই এদ্দিন টিকতে পেরেছিলাম। কিন্তু লোকালয়ে অনেকেই বোকা মনে করে। তার প্রমাণ অফিসের মাঝেও আজ পেলাম। নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশের মধ্যে ফাইল খুলে পড়ছি চুপচাপ। এমন সময় মিস্টার জাফর আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলেন, এ যোগগুলো করে দিন তো। দেখবেন, ভুল হয় না যেন।

লম্বা লম্বা যোগ। মনোযোগ দিয়ে না করলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা। একমনে যোগ করছিলাম। হঠাৎ মিহি হাসির শব্দে আমার মনোযোগ টুটে যায়। মাথা তুলে দেখি- মিস ঘোষের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ গল্প জমিয়েছেন মি. জাফর। বারে বাঃ!

যোগ করে মরছি আমি, আর যোগাযোগ করছেন উনি। আচ্ছা লোক তো! অনেকক্ষণ গল্প করে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন মিঃ জাফর, কদ্দূর

করলেন? হয়েছে?

অফিসে চুপচাপ বসে থাকলেও এর মধ্যে অনেককেই আমি চিনে নিয়েছি। মি: জাফরকে চিনি না, এমনি ভাব দেখিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে বলি, না স্যার, এখনো হয় নি। যোগাযোগের কাজে আমি খুবই কাঁচা। আর একটা কথা স্যার, মাফ করবেন! আপনার সাথে এখনো আলাপ হয় নি। আপনি কি চীফ অফিসার?

আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে মুখখানা হাঁড়ির মত করে চলে যান মি: জাফর। আমি জানি, জাফর আলী ষাট টাকার কেরানি। হেড অফিসের লোক কিনা, তাই সুযোগমত শাখা অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মচারীর ওপরও ছড়ি ঘোরাতে চায়।

পাঁচটা প্রায় বাজে। ফাইলপত্র আলমারিতে রেখে বেরিয়ে যাব, এমন সময় মিস ঘোষ ডাকেন, শুনুন তো।

মিস্ ঘোষ ষাট টাকা মাইনের টাইপিষ্ট। কাছে যেতে একটা ফাইল দেখিয়ে বলেন, -এটার মধ্যে কতগুলো টাইপ-করা কাগজ আছে। মি. জাফরকে নিয়ে এগুলো কম্পেয়ার করে রাখবেন। কাল আমার আসতে দেরি হবে।

অনুরোধ নয়, একেবারে আদেশ। আমার রাগ ধরে। এরা পেয়েছে কি? আমি নিরীহ বলেই কি এভাবে ফ্যাগ খাটতে হবে? কিন্তু নিরীহ হলেও সাপের মন্তর জানি আমি। বলি, মাফ করবেন, ম্যাডাম। আপনার সাথে এখনও পরিচয় হওয়ার সৌভাগ্য হয় নি। আপনি নিশ্চয় অফিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট।

মিস্ ঘোষ ঠাণ্ডা হয়ে গেছেন। তাঁর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বুঝতে পারছি, মন্তরটা একটু কড়া হয়ে গেছে। কিন্তু কি করা যাবে? হুকুম দেয়ার আগে ভেবে দেখা উচিত ছিল তাঁর।

অফিস থেকে বার হই। আবার সেই বাস, লোকজন, ভিড়। সেই পথ, পথচারীর ভীত চাউনি। মনটা দমে যায়।

হেঁটে হেঁটে চৌরঙ্গী পর্যন্ত আসি। কিন্তু পা আর চলে না। চলবার কোন হেতু নেই যে। ভোরে যা খেয়েছি, আর এ পর্যন্ত এক পেয়ালা চা-ও না। কার্জন পার্কে বসে পড়ি। হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। ভিড় কমলে বাসেই যাব।

সাড়ে ছ’টার সময় বাসে একটু জায়গা পাওয়া যায়। পঁ-প করতে করতে বাস ছুটছে। এত ভিড়, বাইরের কিছুই দেখা যায় না। বুঝতে পারছি না, কোন্ রাস্তা ধরে চলতে গাড়ি।

বুম-ম্-

আবার বুম্-ম্-

ভীষণ শব্দ। কানে তালা লেগে গেছে। শুনতে পাই না কিছু। শেয়ালের ভয়ে খাঁচার মোরগের মত করছি আমরা।

তারপর কোন দিক দিয়ে কেমন করে বাসখানা চলে এল, অত খেয়াল নেই। কয়েক জনের মুখে শুনলাম, বাসের পা-দানির ওপর থেকে দু’জনকে দু’পেয়ে শেয়ালে টেনে নিয়ে গেছে। আর অনেকের হাত-মুখ, নাক-কান ছিঁড়ে গেছে বোমার আঘাতে।

ঘরের কাছে এসেও আর একবার শিউরে উঠি। অক্ষত দেহে পৈতৃক-প্রাণটা নিয়ে ফিরে এসেছি আমি।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। শিথিল শরীরটাকে টেনে এনে বিছানায় ঢেলে দিই। মানুষের মাঝে একদিন চলেই মুষড়ে পড়েছি আমি। আমার সমস্ত রাগ ঘৃণা আজ মানুষের ওপর। চোখ বুজে ভাবছি-পদত্যাগ-পত্রটা প্রত্যাহার করার এখনো হয়তো সময় আছে। আমার জন্যে বন-বিভাগের চাকরিটাই ভালো। মানুষ তার মনুষ্যত্ব নিয়ে শহরে থাক। আমি বনে গিয়ে আবার বনমানুষ হব।

৪৯ বেনেপুকুর লেন, কলকাতা

২২ মাঘ, ১৩৫৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৭

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024