মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫৮ পূর্বাহ্ন

বিশ্ব জুড়ে গুপ্তসংঘ

  • Update Time : শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৪, ৮.০৫ এএম

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিশ্ব জুড়ে বেশ কিছু সিক্রেট সোসাইটি বা গুপ্তসংঘের নাম নানান সময়ে শোনা যায়। বর্তমানে কিছু উগ্র ধর্মীয় পরিচয়ের গুপ্তসংঘ প্রচারে এসেছে। যেমন এখন ইসলামিক স্টেট বা আইএস, আল কায়েদা ইত্যাদি নাম বেশি শোনা যায়।

সাধারণত এই ধরনের সংঘগুলোর প্রধান লক্ষ্য থাকে তাদের কল্পিত ‘আদর্শ’ ও নিয়মনীতির মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করা। নিজেদের ‘আদর্শ’কে তারা সবচেয়ে উপযোগী এবং ধ্রুব সত্য মনে করে। এর সদস্যরা নিজেদের মধ্যে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ থাকে এবং সংঘের চরিত্র অনুসারে সদস্য সংখ্যা কম বেশি হয়। তবে বেশির ভাগ সংঘের প্রকৃত সদস্য সংখ্যা তুলনামূলক কম হয়। কারণ এদের সদস্য পদ পেতে বেশ অনেক ধাপ পার হতে হয়। এসব ধাপ প্রচলিত সমাজের কাছে বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তাদের পোশাক হয়ে ওঠে কখনো কখনো ভীতিকর।

২.

সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ যারা নানান শ্রেণী, পেশা, বর্ণ, বয়সের হলেও সংঘগুলোর সদস্য হওয়ার পর তাদের পারস্পরিক বিশ্বাসে মৌলিক মিল পাওয়া যায়। যদিও সংঘের কর্মকাণ্ডের কথা দলভুক্ত নয়, এমন নিকট জনের কাছেও তারা প্রকাশ করে না। সংঘের ‘আদর্শ’ বজায় রাখতে তারা প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে। তারা এতো বেশি প্রভাবিত থাকে যে সংঘের প্রয়োজনে দলবদ্ধ ভাবেও যে কোনো বিষয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সমাজে তার স্বীকৃতি থাকুক বা না থাকুক। এসব সংগঠনের নেতৃত্বে যারা থাকেন তারা কখনো প্রকাশ্যে এলেও বেশির ভাগ সময় নেপথ্যে থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে আগ্রহী। তাদের কারো লক্ষ্য থাকে রাজনৈতিক, কারো সামাজিক, কারো ধর্মীয় বা কারো বিশেষ কোনো বিষয়। পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সিক্রেট সোসাইটিগুলোতে মূলত এই বিষয়গুলো সাধারণ ভাবে দেখা যায়।

এখনো গুপ্তহত্যা, অপহরণ, মাদক পাচার, ডাকাতি, বিকৃত যৌনতা, মানব হত্যা, বহুগামিতা ইত্যাদি নানান অপরাধে গুপ্তসংঘের দিকে ইঙ্গিত করা হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি নিউজপেপার পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর এক অনুষ্ঠানে এসব গুপ্তসংঘকে গণতন্ত্রের জন্য ‘গ্রেভ ডেনজার’ বা কবরের মতো ভয়ঙ্কর বলে মন্তব্য করেন। দুঃখজনক ভাবে এই মন্তব্যের এক সপ্তাহ পর তিনি অজ্ঞাত ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। অনেক বছর ধরেই সিক্রেট সোসাইটি বা গুপ্তসংঘের অস্থিত্বের কথা জানা যায়। আর ঠিক ততোদিন ধরেই সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাবের গুঞ্জন থেকেই যায়। কোনো একটি অর্ডার বা নিয়ম অনুসারী ধর্মীয় গোত্র, ক্লাব, প্যারা মিলিটারি কিংবা কখনো সন্ত্রাসী গ্র”প এই সব সংঘের অন্তর্ভুক্ত। এদের অনেকের দীর্ঘদিনের ইতিহাস আছে। রয়েছে নিজস্ব কর্মকাণ্ড।

এই সংগঠনগুলো নিয়ে জমা আছে অনেক ভয়। কখনো ভীষণ কৌতূহল। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ তারিখে আল কায়েদা কর্তৃক আমেরিকার টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনায় আবারো সিক্রেট সোসাইটির বিষয়টি আলোচনায় আসে। যদিও কেউ কেউ মনে করেন সিক্রেট সোসাইটি হলিউডের মুভি বা থ্রিলার বইয়েই শুধু থাকে। ২০০৬ সালের ‘দি গুড শেফার্ড’ মুভিতে দেখানো হয় যে ইয়েল ইউনিভার্সিটির সিক্রেট সোসাইটি ‘স্কাল অ্যান্ড বোনস’-এর মাধ্যমে কয়েক প্রজন্ম ধরে সিআইএ গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের সদস্যদের নিয়োগের ব্যবস্থা করে আসছে। এর আগে স্ট্যানলি কুবরিকের ‘আইজ ওয়াইড শার্ট’ মুভির প্রধান চরিত্র একটি সিক্রেট সোসাইটির পাসওয়ার্ড ভেঙ্গে ফেলে নিজের ও অন্যদের জন্য বিপদ ডেকে আনে।

সাম্প্রতিক সময়ে সিক্রেট সোসাইটির বিষয়গুলো আলোচনায় নিয়ে আসেন বেস্টসেলার লেখক ড্যান ব্রাউন। তার লেখা মেগা সেলিং ফিকশন ‘দি দ্যা ভিঞ্চি কোড’ বইয়ে দুটো চরমপন্থী বিপরীতমুখী গ্রুপ প্রাওরি অফ সিওন, যা মধ্য যুগে তৈরি হয়েছিল এবং ক্যাথলিক সংগঠন ওপাস দেই-এর মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ে আসেন। এই দুই সংগঠনের সিক্রেট গ্রেইল নিয়ে টানাপোড়েন উপন্যাসের মূল উপজীব্য। ১৯২৮ জোসেমারিয়া এসক্রিভার তার ভাবনায় ক্যাথলিক প্রিস্ট ও ধর্ম প্রচারকদের নিয়ে শুরু করেন ওপাস দেই। প্রথমে পোপের পছন্দের সংগঠন হলেও পরবর্তীতে তাদের উগ্র কর্মকান্ড ভ্যাটিকানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে। অনেক যাজক মনে করেন ওপাস দেই ক্যাথলিক অনুসারীদের জন্য ক্ষতিকর।

৩.

ড্যান ব্রাউনের আগের লেখা ‘অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডিমনস’ বইয়ে দেখা যায় পোপ পদপ্রার্থীদের একে একে নিহত হতে। অভিযুক্ত হিসাবে আসে অষ্টাদশ শতকের ইলুমিনাতি সংগঠনটির নাম। রাজনৈতিক ক্লাব হিসেবে শুরু হওয়া সংগঠনও বিতর্কিত হতে পারে তার বড় প্রমাণ ইলুমিনাতি। ১৭৭৬ অ্যাডাম হুইসাপট ‘সকল প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ও রাজনৈতিক শাসন থেকে বিশ্বকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে’ প্রতিষ্ঠা করেন ব্যাভারিয়ান ইলুমিনাতি সংঘ। ফরাশি বিপ্লবের প্রধান পরিকল্পনাকারী সংঘ হিসেবে ইলুমিনাতির নাম আসে নানান সময়। অষ্টাদশ শতকে যাত্রা করা এই সংঘের কার্যক্রম মূলত দেখা যায় ১৭৭৬ থেকে ১৭৮৫ পর্যন্ত। এরপর ধারণা করা হয় সংঘটি বিলুপ্ত হয়। কিন্তু ইলুমিনাতি আতংক দুই দশকেও কমে নি। এই সংঘের সদস্যদের উগ্র চিন্তা চেতনা ইওরোপিয়ান স্যালনগুলোতে বিপদজনক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকানরা ভয় পেত এই উগ্র সংঘটি এক সময় আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে তাদের দেশে ঢুকে পড়তে পারে ভেবে।

২০০৯ সালে প্রকাশিত ড্যান ব্রাউনের আরেক উপন্যাস ‘দি লস্ট সিম্বল’ বইয়ে দেখানো হয় প্রাচীন সিক্রেট সোসাইটি ফ্রিম্যাসন ও তাদের গোপন কার্যক্রমকে। এতে দেখানো হয়, আমেরিকার রাজনীতিতে ফ্রিম্যাসন কতোটা গভীর ভাবে সংযুক্ত। আমেরিকার ডিক্লারেশন অফ ইনডিপেনডেন্ট দলিলে স্বাক্ষরকারী ৫৬ জনের মধ্যে কমপক্ষে আটজন ছিলেন ফ্রিম্যাসন।

8.

প্রথম ১৭ জন আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মধ্যে জর্জ ওয়াশিংটনসহ ৬ জন সরাসরি ফ্রিম্যাসন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রাজধানী স্থাপনের শুরুতে ওয়াশিংটন ডিসির অধিকাংশ বড় স্থাপনাই ম্যাসনদের তৈরি করা। ঊনিশ শতকে ইটালির কারবোনারি সংগঠনটি বিপ্লবী আন্দোলনে জড়িত ছিল। এটির নানা ভাবে ফ্রিম্যাসনের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ আছে। ঢাকার পুরানা পল্টনেও এক সময় ফ্রিম্যাসনরা তাদের কার্যক্রম প্রকাশ্যে পরিচালনা করতো। বলা যায় এসব সংঘের কিছু এখনো খুবই প্রভাবশালী। চায়নিজ ট্রিয়াডস একটি প্রাচীন সংঘ। অপরাধপ্রবণ এই গুপ্তসংঘটি দুই হাজার বছর ধরে সরকারগুলো উৎখাত করতে সব সময়ই সচেষ্ট থেকেছে। বর্তমান সময়ে এই সংগঠন অনেক বেশি সংগঠিত, দক্ষ হয়ে ওঠেছে মাদকক পাচার ও সফটওয়্যার পাইরেসিতে। গুপ্তসংঘের রাজনৈতিক চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত থাকার আরো প্রমাণ পাওয়া যায় ২৫ খ্রীষ্টাব্দে। চায়নার দি রেড আই ব্রো সংগঠনটি ওয়াং ম্যাং-কে ক্ষমতাচ্যুত করতে সাহায্য করে।

মানব ইতিহাসে এ ধরনের ভ্রাতৃসংঘের নানা উদাহরণ আছে। কখনো কখনো তাদের সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে সংঘগুলোর বিষয়ে অনেক কথা ছড়িয়ে পড়ে যার সঙ্গে সত্যের মিল থাকে খুবই কম। প্রাচীন মিশরের দিকে তাকালে দেখা যায়, তখন থেকে ভ্রাতৃসংঘের ঘের অস্তিত্ব ছিল। প্রাচীন আর্টিজান বা কারিগরদের সংঘ ছিল তখন। রোমের কারিগরদের সংগঠন রোমান কলেজিয়া ছিল মধ্যযুগের ব্যবসায়ী ভ্রাতৃসংঘগুলোর আদর্শ। তারা ব্যবসা বা কাজের সূত্রগুলো গোপন রাখতো। প্রতিপক্ষের হিংসা ও প্রতিযোগিতার ফলে তারা বিভিন্ন চিহ্ন, পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতো। একে অপরকে চেনার জন্য গুপ্তসংকেত দিয়ে পরিচয় দিতো। গুপ্তসংঘগুলোর মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, তাদের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন ফ্রিম্যাসন বা ইয়েলভিত্তিক স্কাল অ্যান্ড বোনস সংঘগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা একাত্ম সম্পর্ক গড়ে তোলে, পারস্পরিক সহযোগিতা করে যা প্রতিযোগিতার বদলে দলবদ্ধভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করে। এসব ক্ষেত্রে গভীর আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টিও কাজ করে। এর ফলে সংঘের সদস্যদের মধ্যে সারাজীবনের জন্য সম্পর্কের জন্ম হয়।

৫.

১৮৩২ ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে উইলিয়াম এইচ. রাসেল দি অর্ডার অফ স্কাল অ্যান্ড বোনস প্রতিষ্ঠা করেন যা ব্রাদারহুড অফ ডেথ নামেও পরিচিত। ২০০০ জর্জ ওয়াকার বুশ তৃতীয় বোনসম্যান হিসেবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন। এর আগে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডাবলিউ বুশ সিনিয়র ও উইলিয়াম এইচ টাফট স্কাল অ্যান্ড বোনস-এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। বর্ণভিত্তিক গুপ্তসংঘ তৈরির নজির আছে অনেক। ১৯২৫ সালে ক্লু ক্লথ ক্লান সংগঠনটি ক্ষমতা অর্জন করে আশি লাখ শ্বেতাঙ্গ পুরুষকে সদস্য করে। এ বিষয়ে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার ও মনোবিদ্যা অধ্যাপক মার্ক গ্যালেনটার বলেন, ‘একে অপরের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ আচরণের বিষয়টি মানুষের ডিএনএ-র মধ্যে থাকে। একা থাকার চেয়ে সংযুক্ত মানুষেরা অনেক বেশি নিরাপদ মনে করে। অনেকের সঙ্গে যুক্ত থাকা হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়, এটা আমাদের অন্তর্গত স্বভাবেরই অংশ।’ সংঘের গোপনীয়তা বজায় রাখার মধ্যে দিয়ে মূলত নিজেকে নিরাপদ ও সংঘকে বিপদমুক্ত রাখার চেষ্টা থাকে সব সময়। এ কারণে কখনো কখনো নিজের চরম বিপদেও তারা সংঘের কোনো ক্ষতি হয় এমন কাজ করে না।

ধর্মীয় গোত্র, বিশ্বাস ভিত্তিক সংগঠনগুলো আরো কিছু কারণে নিজেদের বিষযগুলো গোপন রাখে। নিজেদের বিশ্বাসের জায়গাটি সবার সামনে উন্মোচন করে না। অনেক ক্ষেত্রে মূল ধর্মের সঙ্গে এই মতবাদগুলোর পার্থক্য থাকে চোখে পড়ার মতো। মৌলিক বিশ্বাসের জায়গায় এতো বেশি দূরত্ব থাকে যে নতুন মতের ধারকদের আর সেই ধর্মের অনুসারী বলা যায় না। নিউ আমেরিকান রিলিজিওন বা নতুন আমেরিকার ধর্ম বিশেষজ্ঞ জে. গর্ডন মেলটন জানান, পশ্চিমি ও পূর্বের শতাধিক গুপ্ত ধর্মীয় সংঘের ওপর কাজ করে দেখা গিয়েছে তাদের মূল বিশ্বাসের ব্যাপারটি সংঘের কোর টিম বা কেন্দ্রীয় কিছু সদস্যই কেবল জানেন। এ কথার পক্ষে উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, সায়েন্টোলজিস্ট সংঘের চার্চে মোট আটটি ধাপ আছে। যেখানে একজনকে ক্রমান্বয়ে পরিপূর্ণ মুক্তি অথবা সার্বিক জ্ঞান লাভের জন্য একের পর এক ধাপ নিজ যোগ্যতা প্রমাণের মাধ্যমে অতিক্রম করতে হয়। এল রন হার্বার্ড ১৯৫৪ সালে সায়েন্টোলজি গ্রুপের প্রথম চার্চ ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে প্রতিষ্ঠা করেন।

৬.

প্রায়ই এসব গুপ্ত ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সূত্র হয় বেশ জটিল ও অর্ন্তগত। কখনো কখনো তা পরিণত হয় আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে।

১৯৭৮ গায়ানার জোন্স টাউনে একটি ধর্মীয় সংঘের ৯০০- র বেশি সদস্য এক সঙ্গে আত্মহত্যা করে। ১৯৯৭ হেভেন’স গেট কাল্ট গ্র”পের প্রতিষ্ঠাতা মার্শাল অ্যাপল হোয়াইট এবং তার ৩৮ জন অনুসারী আত্মহত্যা করেন যা আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণআত্মহত্যার ঘটনা। কখনো সংঘগুলো ক্ষমতাধরদের হামলার শিকার হয়। ১১২৯ সালে নাইট টেম্পলার অর্ডার প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মরাষ্ট্রের ধর্মযাত্রীদের নিরাপত্তায় তারা শপথ নেন। তারা এক সময় ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হন এবং ইওরোপের ব্যাংক ব্যবস্থা তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। প্রথমে শাসকদের কাছে প্রিয় থাকলেও ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্থ ফিলিপ ১৩০৭ সালে নাইট টেম্পলারদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে পোপের সম্মতি ছিল। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও গোপন ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। তাদের হত্যার মাধ্যমে নির্মূল করা শুরু হয়।

১২৪৪ মনটসেগারে ভিন্ন ধর্মীয় মত অনুসারী সন্দেহে দুইশর বেশি ক্যাথারকে পুড়িয়ে মারা হয়।

আবার কখনো এই সংঘগুলো নিজেদের অস্থিত্ব প্রমাণ বা বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য ধ্বংসাত্মক কাজ করে। ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগন হামলা করে আল কায়েদা। কমপক্ষে তিন হাজার মানুষ নিহত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইএস এখন সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করছে একই মানসিকতা থেকে।

আবার সামাজিক ও বিকৃত আচরণেও এই ধরনের সংঘগুলোর কার্যক্রম চোখে পড়ে। উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠন মরমন সেক্ট প্রধান ওয়ারেন জেফস বহুবিয়ে এবং বহুগামিতার পক্ষে তার অনুসারীদের উৎসাহিত করেন। যদিও আমেরিকায় এসব নিষিদ্ধ ছিল। বহুগামিতা মরমন ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের অংশ। ওয়ারেন জেফস বর্তমানে আমেরিকার কারাগারে আছেন।

এর বাইরে অপরাধপ্রবণ গুপ্তসংঘ যেমন ইটালিতে জন্ম হওয়া ও আমেরিকায় বিস্তার লাভ করা মাফিয়া, চায়নার ট্রিয়াডস প্রভৃতি সংঘের মধ্যে এমন কিছু বিষয় প্রচলিত আছে যাতে তাদেরও ‘আদর্শবাদী’ ভ্রতসংঘ মনে হতে পারে। মারিও পুজোর উপন্যাস গডফাদার সেই ধারণার জন্ম দেয়। তারা প্রচলিত আইন ভেঙ্গে নিজের তৈরি ‘ন্যায় বিধান’ ব্যবহার করতে ভালোবাসে। যদিও অধিকাংশ সময় তা পরিণত হয় হিংসাত্মক ঘটনায়। মাফিয়ারা অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকলেও তারা চার্চের নৈতিক বিধান, বিয়ে ও পরিবারকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

চায়নিজ ট্রিয়াডস অপরাধের মধ্যে জড়িত থাকলেও তারা প্রাচীন চায়নিজ ঐতিহ্যকে তাদের কর্মকাণ্ডে অনুসরণ করে। সেই রীতি তারা মেনে চলে।

প্রাচীনকাল থেকেই এ ধরনের গুপ্তসংঘের কাজ দেখা যায়। নানা আদলে এই সংগঠনগুলো কাজ করে। কখনো তাদের বাহন হয় ধর্ম, কখনো সামাজিক কর্মকাণ্ড কখনো বা রাজনৈতিক সমীকরণ। তাই হঠাৎ গুপ্তসংঘের আবির্ভাব কোনো অভিনব ঘটনা নয়। এরা নানান পরিচয়ে মুখোশ পরে সামনে আসে।

যে মিথ্যা বিশ্বাস বা ভাবনার কথা তারা প্রচার করে তার

মোকাবেলা করার জন্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কোনো বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষ যদি সংঘবদ্ধ থাকে তবে এই ছোট গ্রুপগুলো সাময়িক সুবিধা পেলেও খুব বেশি সময় টিকে থাকতে পারে না।

কারণ হিংসা, সন্ত্রাস, বৈরিতা মানুষের সহজাত মানসিকতার বিপরীত বিষয়। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই এর বিরুদ্ধে এক সময় রুখে দাঁড়ায়।

লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024