মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫৮ পূর্বাহ্ন

প্রকৃতিবিদের কাহিনী (কাহিনী-২০)

  • Update Time : মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

পিওতর মান্তেইফেল

বিপদের সঙ্কেত
নিচু দিয়ে, চিড়িয়াখানার গাছগুলোর মাথা প্রায় ছাই-ছাই করে উড়ে যাচ্ছে এরোপ্লেন, পার্টিশনের ওপারে লাইনের ওপর দিয়ে ঘড়ঘড়িয়ে চলেছে ট্রাম, গোঁ-গোঁ করছে, হর্ন দিচ্ছে মোটর। কিন্তু চিড়িয়াখানার খোঁয়াড় আর খাঁচায় কোনোই চাঞ্চল্য নেই। এখানকার পোষ্য হবার পর সমস্ত প্রাণীই চট করে অভ্যস্ত হয়ে যায় শহরের কোলাহলে, সব রকমের চড়া শব্দে। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে যেসব শব্দ সাধারণত বিপদের আসন্নতা বোঝায়, তাতে বন্য জন্তুরা সর্বদাই সচকিত হয়ে ওঠে, এমনকি জন্ম থেকে যারা চিড়িয়াখানায় মানুষ হয়েছে তারাও।
কাক কাছে এলে ভূমিচর পাখির ছানাদের তেমন ভয় হয় না। কিন্তু হিংস্র জন্তু দেখলে কাক যে ধরনের কা-কা ডাক ছেড়ে নির্ভয়ে তার দিকে ঝাঁপিয়ে যায়, সে ডাক শোনা মাত্রই প্যাট্রিজ, হাঁস, তিতিরের ছানারা চট করে যেখানে পারে লুকিয়ে পড়ে। এইসব ছানাদের কিছুটা কাক ধ্বংস করে নিজেই, তাহলেও বেশির ভাগ ছানাদের সে বাঁচায় তার ডাক দিয়ে, তাতে যেন পক্ষিজগতকে সে সাবধান করে দেয় যে তাদের পক্ষে বিপজ্জনক কোনো নেকড়ে, শেয়াল বা বাজপাখি কাছিয়ে আসছে।
যদি শোনা যায় ছাতার পাখির বৈশিষ্ট্যসূচক ঝি’-ঝি’ ডাক, তাহলে বড়ো বড়ো জানোয়ারেরাও তাড়াতাড়ি আত্মগোপন করে, কেননা ছাতার পাখি সাধারণত এ হংশিয়ারি দেয় বনে মানুষ এলে।
টম-টিটের প্রায় শোনা যায় না এমন মিহি চি’চি’ শব্দও সবাই ধরে বিপদের সঙ্কেত ব’লে; শুধু গায়ক পাখিরাই নয়, উড-গ্রাউজও সে সময় ডালে এসে বসে থাকে নিশ্চল হয়ে। বাজপাখির হংশিয়ারি দেয় টম-টিটের চি’চি’। চিত্র-বিচিত্র কাঠ- ঠোকরাকেও বাঁচায় তা, নিজের কাজে একান্ত নিমগ্ন থাকলেও সঙ্কেত শোনা মাত্র সে চটপট আক্রমণ এড়ায়, কেননা টম-টিট সাধারণত পাক খায় তার ‘কামারশালার’ কাছেই।
নিশ্চিন্তে আঙিনায় চড়ছে গোটাদশেক হলদে-হলদে, রোঁয়া-রোঁয়া, অনভিজ্ঞ মুরগী-ছানা। এমন সময় মাথার দিতে লাগল চিল। তাকে দেখে প্রথম হুঁশিয়ারি দিল মোরগ ওপর পাক ‘খুউ-উ’, তারপর মুরগী ‘ক্রিউ!’ অমনি ছানার দল লুকিয়ে পড়ল ঝোপের মধ্যে কিংবা মায়ের ডানার তলে। কেন পরিত্রাণ লাভের চেষ্টা করে ছানাগুলো? শিকারী পাখির নখরের প্রচন্ড ছোঁ তো তারা আগে কখনো দেখে নি!
ডানাওয়ালা অথবা চতুষ্পদ উভয় রকমের হিংস্র শত্রুর বিরুদ্ধে পাখিদের আত্মরক্ষা করে আসতে হয়েছে বহু বহু হাজার বছর ধরে। এ সংগ্রামে টিকে থেকেছে কেবল তারা, যারা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে বিভিন্ন হিতকর গুণ উত্তরাধিকার হিশেবে রপ্ত করতে পেরেছিল। এক্ষেত্রে মায়ের প্রথম বিপদ-সঙ্কেতেই লুকিয়ে পড়ার প্রতিবর্ত’ ক্রিয়াটা হল সেই গুণ। আকাদমিশিয়ান ইভান পেত্রভিচ পাভলভ একে বলেছেন অনপেক্ষ প্রতিবর্ত’, কেননা নির্দিষ্ট কতকগুলি পরিস্থিতিতে তা প্রতিবার অবশ্যই ঘটবে, এবং এ আচরণ তার জন্মগত।
একবার চিড়িয়াখানার কিশোর জীববিদদের আমরা এটা দেখাই হাতে-কলমে। ৪৭ দিন ধরে ইনকিউবেটরে ছিল অস্ট্রেলীয় উটপাখি এমু’র ডিম। দু’দিন পরে তাদের ফোটার কথা। তখনই কান পেতে তাদের সমান তালের সামান্য নিঃশ্বাসের শব্দ ধরা যাচ্ছিল।
ডিমগুলোকে বার করে আমরা তা একটা কাচের ওপর রাখি। যেখানে রেখেছিলাম সেখানেই রইল তারা, শুধু মাঝে মাঝে অলক্ষ্যে কেপে কেপে উঠছিল। তখন আমি মন্দা এমু’র বিপদ-সঙ্কেতের ডাক নকল করে ছোট্ট একটু গর্জন করলাম:
‘বর-র-র’
অমনি কে’পে উঠে গড়াতে লাগল ডিমগুলো, কেননা ভেতরকার তখনো না- ফোটা বাচ্চাগুলো পা নাড়াতে শুরু করে, যেন ‘বিপদ’ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে ছুটছে।
‘সে কী?’ জিজ্ঞেস করলে ছেলেরা। ‘আমাদের এম-ছানাগুলো তো ইনকিউবেটরে ছিল, বাপ-মায়ের ডাক তো কখনো শোনে নি?’
বললাম, ‘সেই তো ব্যাপার! বাপ-মায়ের বিপদের সঙ্কেত শুনে ছানারা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়তে চায় এইজন্যে নয় যে তারা হিংস্র জন্তুর নখের বাদ আগেই পেয়েছে, ফলে বাস্তব অভিজ্ঞতা বা সাপেক্ষ প্রতিবর্ত’ গড়ে উঠেছে তাদের। না, এটা হল জন্মগত, অনপেক্ষ প্রতিবর্ত’, পেয়েছে তা বংশ ধারায়। এমু’র বংশধরদের টিকে থাকার জন্যে তা দরকার, ছানাদের আত্মরক্ষা প্রতিক্রিয়া এটা, প্রাকৃতিক নির্বাচনে তা বংশগতিতে নিহিত হয়ে গেছে।’
এখানে যে পরীক্ষাটার কথা বললাম, তা সবার পক্ষেই করা সম্ভব। বাচ্চা ফোটার দিন দুই আগে সাধারণ মুরগীর ডিম নিলেই চলবে। শুধু বিপদের সময় মুরগী-মা যে রকম ডাকে, সেই ডাকটি রপ্ত করতে হবে। ফল হবে এমু’র ডিমের মতোই।
তবে সময়মতো বিপদ-সঙ্কেতে কেবল পাখিরাই বাঁচে না। দল বেধে যারা থাকে এমন অনেক প্রাণীই সাড়া দেয় তাতে। কিছু দৃষ্টান্ত দিই।
আলতাই পাহাড়ে একজন শিকারতত্ত্ববিদ মারমটজাতীয় মুষিকদের আচরণ লক্ষ্য করছিলেন, ঘাস ছি’ড়ছিল তারা, নয়ত রোদ পোয়াচ্ছিল। বড়ো একটা পাথরের আড়াল থেকে জোরালো দূরবীনে তিনি দেখলেন যে একদল আরখার বা বড়ো বড়ো পাহাড়ী ভেড়া যাচ্ছে তাদের দিকে। মারমটদের কোনোই ভাবান্তর হল না তাতে। মারমট বসতির মাঝখানে গিয়ে ভেড়াগুলো শুয়ে পড়ল ঘাসের মধ্যে এবং অচিরেই আধমনী শিং সমেত মাথা মাটিতে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। সাধারণত আরখাররা ঘুমোয় না, কেবল ঝিমোয়, সর্বদাই থাকে সতর্ক; কান নাড়ায়, ঘাড় ঘোরায়, কেবলি জেগে জেগে ওঠে। এখানে কিন্তু ভেড়াগুলো ঘুমোতে লাগল একেবারে মরার মতো। শেষ পর্যন্ত জায়গাটা ছেড়ে যাবার সময় হল শিকারতত্ত্ববিদের আড়াল থেকে বেরতেই মারমটদের চোখে পড়ে গেলেন তিনি, অমনি তীক্ষ শব্দে ভরে উঠল বাতাস শিস দিতে লাগল গোটা বসতিটা। বিপদের এই সঙ্কেত
পেয়েই ভেড়াগুলো লাফিয়ে উঠে ছুটতে লাগল পাহাড়ের ওপর দিকে। বোঝা গেল, এই বন্য জীবগুলোর সত্যিকারের ঘুমের সুযোগ বিশেষ হয় না নেকড়ে, তুষার-চিতা প্রভৃতি জন্তুরা থাকে ওঁৎ পেতে। শুধু বিশ্বস্ত পাহারাদার মারমটদের মধ্যেই নিশ্চিন্তে ঘুমতে পারে তারা।
একবার সন্ধ্যায় আমি কালো থ্যাশের হুঁশিয়ারি ডাক শুনলাম ‘চেন-চেন- চেন ধীরে ধীরে বনের কিনারার দিকে এগুতে এগুতে সে যেন গোটা বনটাকেই সাবধান করে দিচ্ছিল। দ্রুত এবং নিঃশব্দে আমি হাওয়ার বিপরীতে বনের হাঁটা- পথে গিয়ে দাঁড়ালাম। কলরব কাছিয়ে আসছিল, বেশ ঠাহর হচ্ছিল রবিন পাখির ‘ক্রুদ্ধ’ কিচির-মিচির। মোড় থেকে ধীরেসুস্থে বেরিয়ে এল নেকড়ে, আর পাখিগুলো ডাল থেকে ডালে উড়ে আসছে তার পেছন পেছন। গুলি করতেই নেকড়েটা পড়ে গেল, শিগগিরই থেমে গেল বনের সোরগোল।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024