মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৪৯ পূর্বাহ্ন

বিপ্লব ২৪ ও শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্যকরণ

  • Update Time : শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.২২ এএম

কর্নেল মো: শাহ জাহান মোল্লা (অব:)


যেসময় বিজলি বাতি ছিলোনাসন্ধ্যায় হারিকেন বা কুপি জ্বালিয়ে ছোট ক্লাসের ছাত্ররা সুর করে উচ্চ স্বরে শিক্ষকের মর্যাদা কবিতাটি পাঠ করতো তখন তাদের সামনে ভেসে উঠতো বাদশা আলমগীরের ছবি। তিনি বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের অধিপতির উচ্চাসনের চাইতেও অনেক উচ্চতায় স্থান দিয়েছিলেন শিক্ষককে।

বাদশা একদিন দেখেন ভোরবেলায় শিক্ষক অযু করছেন আর রাজপুত্র পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে। শিক্ষক বাদশাহকে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। রাজপুত্রকে দিয়ে হেন কাজ করানোর জন্য আজ হয়তো তাকে শাস্তি পেতে হবে।

বাদশা আলমগীর শিক্ষককে তিরস্কার করলেন যে তিনি রাজপুত্রকে সঠিক শিক্ষা দিচ্ছেন না। সুশিক্ষা হলে রাজপুত্র শুধু পানি ঢেলে নয়নিজ হাত দিয়ে গুরুর পাদুটো ধুয়ে মুছে দিতো।

সেতো একজন মহান বাদশার কথা। গ্রামে গঞ্জের যেসব অভিভাবকদের গৃহ শিক্ষক রাখার সমর্থ ছিলো তারাও তাদের ছেলে মেয়েদেরকে শিক্ষকের হাতে তুলে দিতেন আর বলতেন ” মাস্টার সাহেবছেলেকে আপনার কাছে দিলাম। মানুষ করে দেবেন। হাড় আমারমাংস আপনার”।

সে শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা যারা পরিবার থেকে পেয়েছে তারা আজ পর্যন্ত কোন শিক্ষকের সাথে বেয়াদবি বা গায়ে হাত তোলার সাহস করে না। যা কিছু ২৪ বিপ্লবের পর ঘটেছে বা ঘটছে তা পারিবারিক শিক্ষার অভাবেই ঘটেছে । এর দায় সকল ছাত্র সমাজের নয়। বিপ্লবের ও নয়কিছু ব্যক্তি বিশেষের।

বিগত স্বৈরাচারী আমলে নেতা হবার সুবাদে অনেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্ণিং বডির কর্তা হয়ে নিজেইশিক্ষককে দাড় করিয়ে রাখতেন অথবা অপমান করতেন। মসজিদের ইমামদেরকেও তারা হেনস্থা করেছে।

আমাদের ছোট বেলার ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক ছিল ভীতির। এখনকার ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক বন্ধুত্বের। আমাদের ছোটবেলার গল্প ছিল আমেরিকা লন্ডনে ছাত্রদেরকে বেত্রাঘাত করা অপরাধ। আমরা ভাবতাম ইস আমরা কি অসভ্য। আমাদেরকে গরুর মত পেটায়। কবে আমাদের দেশটা আমেরিকার মত হবে?

জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ আমেরিকায় লেখাপড়া শেষ করে তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেছেনসেখানকার অভিভাবকদের এক বিশাল অংশ মনে করে যে আদর যত্ন করে লাভ নেইছাত্রদের বেতিয়ে চামড়া তুলে দেয়াটাই ঠিক ছিল।

আমার ছেলেকে ভর্তি করাতে মালয়েশিয়ার এক বিশাল আবাসিক স্কুলে গিয়েছিলাম। ভর্তির ইন্টারভিউ হবে। ছাত্রের সাথে পিতামাতাকে থাকতে হবে। একটা চারকোনা টেবিলে চারজন বসলাম। প্রিন্সিপাল সাহেব ছাত্রের সাথে হাই ফাইভ দিয়েই ইন্টারভিউ শুরু করেন। বিভিন্ন কথায় দুজন আড্ডা জমিয়ে ফেলেছে। কথার মাঝেই চলছে নাকলের ঠোকাঠুকি কিংবা হাই ফাইভ। অবাক হয়ে দেখছিলাম ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের ভিন্ন দিক।

বাংলাদেশ ও এগিয়ে গেছে। পেছনে নেই।

সেদিন জলসিড়ির দুটো স্কুলে গিয়েছিলাম। অধ্যক্ষদের সাথে কথা বলতে বলতে দেখলাম শিশুরা একজন দুজন করে আসছে। অধ্যক্ষের সাথে হাত মিলাচ্ছে। হাই ফাইভ দিচ্ছে। ভাণ্ডার থেকে চকলেট নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

এদেশ কি সত্যি এগিয়ে যাচ্ছেকর্তৃপক্ষের নির্দেশে বা আধুনিকতার ছোঁয়ায় স্কুলগুলিতে আন্তর্জাতিক মানোন্নয়নের চেষ্টা চলছে। ভালো কথা। এখানকার শিক্ষকগুলো একটু পরই স্কুল ছুটি হলে দৌড়াবেন কোচিং সেন্টারে। এ ছাত্রের অভিভাবকই আবার নিজ সন্তানকে নিয়ে একই স্কুলের শিক্ষকের কোচিং সেন্টারে যাবেন। শিক্ষার উদ্যেশ্য ব্যাহত করলো কেঅবশ্যই শিক্ষক এখানে কিছুটা দায়ী নন কি

শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিনোট বিক্রয়প্রশ্নপত্র ফাঁস এসব অভিযোগ ছাত্রদের গোচরেই ঘটে বলেইশিক্ষকের প্রতি ছাত্রের শ্রদ্ধার হানি হয়।

ক্ষমতা ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে শিক্ষকদের নতজানু ভাব তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। নেতাদের ছত্র ছায়ায় শিক্ষকরা দানব হয়ে ওঠে। তারা প্রভাবশালীদের সন্তানদের পক্ষে পরীক্ষার ফলাফল ও জালিয়াতি করেন। ক্লাস ফোরের ক্যাপ্টেন নির্বাচনে পোস্টার ছাপিয়ে ক্যাম্পেইন হয়েছিলো। সে স্কুলের শিক্ষকরা চক্ষু বুজে থাকেন।

জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ নিজে শিক্ষক ছিলেন বলেই শিক্ষকদেরকে মেরুদন্ডহীন বলতে পেরেছেন। অন্য পেশার কেউ বললে হয়তো শিক্ষকরা কাফনের কাপড় পরে প্রেস ক্লাবে চলে আসতেন। তার সূত্রে পাওয়া সত্য ঘটনা তুলে ধরছি।

একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের জনৈক ছাত্র বিয়ে করে দারোয়ানের চক্ষু ফাঁকি দিয়ে বউকে তার কক্ষে নিয়ে আসে। পিতামাতার অমতে বিয়ে। বউকে কোথাও রাখার স্থান পাচ্ছে না। নতুন বউ কক্ষেই রয়ে গেলো। কেউ এলে তাকে আলমারিতে লুকিয়ে রাখে। বাইরে গেলে ছাত্রটি কক্ষে তালা লাগিয়ে যায়। আসে পাশের ছাত্ররা কিছুটা অস্বাভাবিক চলাচল টের পেলে কথাটা হাউস টিউটরের কাছে পৌঁছালে ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। শাস্তি স্বরুপ ছাত্রকে হল থেকে বহিস্কার করা হয়।

একই হলে একবার এনএসএফ ( তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাএ গোষ্ঠী) এর ছাত্র নামধারী গুন্ডারা একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে এসে একটি রুমে নির্যাতন করতে থাকে। মেয়েটির চিৎকারে আশেপাশের ছাত্ররা কৌতূহল ছলে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিলো। গুন্ডাদের ভয়ে কেউ কিছু বলতেও পারছিলনা। এমন সময় হাউস টিউটর এলেন। তিনি বারান্দায় বিচরনরত ছাত্রদেরকে শাসিয়ে কক্ষে ফেরত যেতে বললেন। প্রশাসন বিষয়টি দেখবে ও ব্যবস্থা নেবে বলে জানালেন। অন্য ছাত্রদের মাথা ঘামানো নিষেধ।

শেষ পর্যন্ত এন এসএফ ছাত্রদের কিছুই হয়নি। কিন্তু বৈধ বিয়ে করা ছাত্রটি শাস্তি পেলো যার কারণে হুমায়ূন আহমেদ শিক্ষকদের মেরুদন্ডহীন বলেছিলেন।

যে ১০০ জন শিক্ষক ড: ইউনূসের নোবেল প্রাইজ বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তারা কোন মেরুদণ্ডের প্রাণীতাদের নোবেল প্রাইজ সম্পর্কে আদৌ কোন জ্ঞান নেই বলেই তা বাতিল করানোর উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। তারা আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিজ পদ পদবী ছেড়ে যুবলীগের সভাপতি হতে চেয়েছিলেন। আরো উচ্চশিক্ষিত স্যারদের কাহিনী বলে শেষ করা যাবে না।

দেশের ৬০ হাজার শিক্ষকের ভুয়া সার্টিফিকেট। থিসিস চুরি করে শিক্ষক পদে বসে আছেন অনেকেই। সার্বিকভাবে সুশিক্ষার অনুপস্থিতির দায়তো শিক্ষকরা সবটুকু এড়াতে পারেন না 

আমাদের ছোটবেলার একটা গল্প উল্লেখ করছি। মার্কিন সরকার একবার দুধচিনিগম ঘি অনুদান দিয়েছিল ছাত্রদেরকে দুপুরের খাবার তৈরি ও বিতরণের জন্য। রান্নার ব্যবস্থা না থাকায় কিছু সামগ্রী বিক্রয় করে রন্ধন সামগ্রী ক্রয় করা হলো। চললো দুপুরে উপাদেয় ও প্রোটিনযুক্ত পায়েশ পরিবেশন। বেশ কিছুদিন চললো। লেখাপড়ার বিঘ্ন হওয়ার অজুহাতে একসময় রান্না ও পায়েশ পরিবেশন বন্ধ হলো। রন্ধন সামগ্রী ও খাবারের উপকরণ ভাগাভাগি করে শিক্ষকরা বাড়ী নিয়ে গেলেন। ছাত্রদের পুষ্টির চাহিদা আর নেই। এ ছিলো শিক্ষার পরিবেশ ।

ছাত্রজনতার ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় সংগঠিত বিপ্লবে বিজয় এসেছে। ছকবাঁধা পরিবর্তন নয়। দুনিয়া কাঁপানো তারুণ্যের জয়ধ্বনি। স্বৈরাচারের মূলতপাটনের সাথে সাথে কর্মক্ষেত্রের সকল স্তরে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। স্বৈরাচারের দোসরদুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সবাই একাট্টা। প্রত্যেক অভ্যুত্থানযুদ্ধ ও পরিবর্তনের ফাঁক ফোকর দিয়ে কিছু লোক অনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়। এটা স্বাধীনতা যুদ্ধের পরও হয়েছিলো। এবারও হয়েছে। এবারে ছাত্রগন কর্তৃক শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করানোর ঘটনা বেশ আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। 

সোজা কথায় বলা যায় শিক্ষকদের লাঞ্ছনা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা ও ধরে নেই ছাত্রগণ এ কাজ করতে পারেনা বা করেনি। সোশাল মিডিয়ার কারণে যেসব ছবি এসেছে তাতে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্মে ছাত্রগণ শিক্ষককে ঘেরাও করে পদত্যাগে বাধ্য করছে। ছাত্র ছাড়াও কিছু শিক্ষকঅভিভাবক ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি লক্ষ করা যায় যারা ছাত্রদেরকে হীন কাজ করতে বাধা দিচ্ছেন না । তাহলে কি বলা যায় যে অন্যান্য উপস্থিত ব্যক্তিরা এ ঘটনার অংশীদার কিংবা সমর্থক অথবা কোন্দল সৃষ্টির সহায়ক যারা কোমলমতি ছাত্রদের দিয়ে স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টায় রত।

সমাজের সব পেশায় কোন্দল রেষারেষি লেগেই থাকে। এরা সময়ের সুবিধা নিয়ে স্বার্থ উদ্ধারে লিপ্ত হন । অনৈতিকভাবে অন্যকে সামনে রেখে পেছনে অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন।

সাম্প্রতিক শিক্ষক নিপীড়নের ঘটনা সমূহ বিচ্ছিন্ন ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধারের নিমিত্তে ঘটানো হয়েছে যা বিপ্লবের গৌরবকে ম্লান করার অপচেষ্টা। স্বৈরাচারী আমলে যারা শিক্ষককে নিগৃহীত করেছিলেন তারাআজ সোচ্চার হয়ে পোস্ট দিচ্ছে। এ সব ঘটনাই  তদন্ত করে সঠিক তথ্য উদঘাটন করে জনসমক্ষে প্রচার করা উচিত।

লেখক: কর্নেল মো: শাহ জাহান মোল্লা (অব:), কলামিস্ট ও  বীর মুক্তিযোদ্ধা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024