০৯:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২৪)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • 16

ফরিদপুর জেলা স্কুলে

একদিন আমার নামে এক নোটিস আসিল। শহরের পুলিশ সাহেব আমাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন। স্কুলের ঢেঙ্গা গোছের আরও সাত-আটটি ছেলের নামেও এরূপ নোটিস আসিল। নির্দিষ্ট দিনে হেডমাস্টার মহাশয় আমাদিগকে লইয়া পুলিশ সাহেবের বাসায় চলিলেন। আমরা তো ভয়ে কাঁপিতে লাগিলাম। আমাদের জীবনের ভবিষ্যৎ আজই চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গেল। পুলিশের খাতায় যখন নাম উঠিল, ইহা আর কখনও মুছিবে না। আমার এত শ্রদ্ধার শিক্ষক মহাশয় বিনা অপরাধে আমার উপর এই শাস্তির ব্যবস্থা করিলেন।

একটি কামরায় আমাদিগকে বসাইয়া হেডমাস্টার মহাশয় অনেকক্ষণ পুলিশ সাহেবের সঙ্গে কি আলাপ-আলোচনা করিলেন। এই সময়টা আমাদের কিছুতেই কাটিতেছিল না। হেডমাস্টারের সঙ্গে আলোচনা করিয়া পুলিশ সাহেব আমাদিগকে জেলেই পাঠাইবেন অথবা অন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করিবেন, আমরা এইরূপ জল্পনা-কল্পনা করিতেছি, এমন সময় পুলিশ সাহেব আমাদের সামনে আসিয়া ইংরেজিতে বলিলেন, “স্কুলের শিক্ষকের নামে এরূপ দেয়াল-পত্র রচনা করা খুবই খারাপ কাজ।

তোমরাই যে এ কাজ করিয়াছ তাহা না-ও হইতে পারে, ভবিষ্যতে এরূপ দেয়াল-পত্রের প্রতি পুলিশের নজর রহিল। যে এ কাজ করিবে তাহাকে ধরিয়া কঠিন শাস্তি দেওয়া হইবে। তোমরা এরূপ লোককে ধরিয়া দিতে চেষ্টা করিবে।

তোমাদের ডাকিয়া আনিয়া কষ্ট দিলাম। এজন্য আমি বড়ই দুঃখিত। তোমরা যার যার বাড়ি যাইয়া পড়াশুনা কর।” পূর্বেই বলিয়াছি আমার জীবনে নিরপরাধে বহুবার শাস্তি পাইয়াছি। এটাও তাহারই আর একটি দৃষ্টান্ত। ইহার পরে বসন্তবাবুর বাসায় যাওয়া ছাড়িয়া দিলাম। তাঁহার বাসায় গেলে তিনি সস্নেহে ক্লাসের পড়া শিখাইয়া দিতেন, আমার আজেবাজে কবিতাগুলি পড়িয়া উৎসাহ দিতেন, এই সুযোগের জন্য মন সর্বদা আকুলি-বিকুলি করিত।

‘সেবার ফরিদপুরে মনমোহন থিয়েটার আসিল। আমার তো বেশি পয়সা ছিল না। সকলের নিম্নের আট আনা দামের একখানা টিকিট ক্রয় করিয়া থিয়েটার দেখিতে গেলাম। ড্রপসিনের সময় আমার এক বন্ধুর খোঁজে ভিতর দিয়া সেকেন্ড ক্লাসে গেলাম। বন্ধুকে না পাইয়া সেখানকার গেট দিয়া বাহির হইয়া আসিতে আমাকে সেকেন্ড ক্লাসের গেট-পাশ দেওয়া হইল।

সেই পাশ লইয়া আমি ফোর্থ ক্লাসের গেটে ঢুকিব, অমনি বসন্তবাবু থাপা দিয়া আমার হাত ধরিয়া ফেলিলেন: “তুমি ফোর্থ ক্লাসের সিট কিনিয়া সেকেন্ড ক্লাসের পাশ লইয়া আসিলে কিরূপে? নিশ্চয়ই তুমি সেখানে যাইতে চেষ্টা করিয়াছিলে। তোমাকে সাধু বলিয়া জানিতাম। কিন্তু আজ তুমি বেশ সাধুতার পরিচয়ই দিলে।” আমি সমস্ত ঘটনা তাঁহাকে খুলিয়া বলিলাম। তিনি তাহা বিশ্বাস করিলেন না। থিয়েটারের পরবর্তী সময় আমার কাছে বিষে বিষময় হইয়া উঠিল।

 

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২৪)

১১:০০:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ফরিদপুর জেলা স্কুলে

একদিন আমার নামে এক নোটিস আসিল। শহরের পুলিশ সাহেব আমাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন। স্কুলের ঢেঙ্গা গোছের আরও সাত-আটটি ছেলের নামেও এরূপ নোটিস আসিল। নির্দিষ্ট দিনে হেডমাস্টার মহাশয় আমাদিগকে লইয়া পুলিশ সাহেবের বাসায় চলিলেন। আমরা তো ভয়ে কাঁপিতে লাগিলাম। আমাদের জীবনের ভবিষ্যৎ আজই চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গেল। পুলিশের খাতায় যখন নাম উঠিল, ইহা আর কখনও মুছিবে না। আমার এত শ্রদ্ধার শিক্ষক মহাশয় বিনা অপরাধে আমার উপর এই শাস্তির ব্যবস্থা করিলেন।

একটি কামরায় আমাদিগকে বসাইয়া হেডমাস্টার মহাশয় অনেকক্ষণ পুলিশ সাহেবের সঙ্গে কি আলাপ-আলোচনা করিলেন। এই সময়টা আমাদের কিছুতেই কাটিতেছিল না। হেডমাস্টারের সঙ্গে আলোচনা করিয়া পুলিশ সাহেব আমাদিগকে জেলেই পাঠাইবেন অথবা অন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করিবেন, আমরা এইরূপ জল্পনা-কল্পনা করিতেছি, এমন সময় পুলিশ সাহেব আমাদের সামনে আসিয়া ইংরেজিতে বলিলেন, “স্কুলের শিক্ষকের নামে এরূপ দেয়াল-পত্র রচনা করা খুবই খারাপ কাজ।

তোমরাই যে এ কাজ করিয়াছ তাহা না-ও হইতে পারে, ভবিষ্যতে এরূপ দেয়াল-পত্রের প্রতি পুলিশের নজর রহিল। যে এ কাজ করিবে তাহাকে ধরিয়া কঠিন শাস্তি দেওয়া হইবে। তোমরা এরূপ লোককে ধরিয়া দিতে চেষ্টা করিবে।

তোমাদের ডাকিয়া আনিয়া কষ্ট দিলাম। এজন্য আমি বড়ই দুঃখিত। তোমরা যার যার বাড়ি যাইয়া পড়াশুনা কর।” পূর্বেই বলিয়াছি আমার জীবনে নিরপরাধে বহুবার শাস্তি পাইয়াছি। এটাও তাহারই আর একটি দৃষ্টান্ত। ইহার পরে বসন্তবাবুর বাসায় যাওয়া ছাড়িয়া দিলাম। তাঁহার বাসায় গেলে তিনি সস্নেহে ক্লাসের পড়া শিখাইয়া দিতেন, আমার আজেবাজে কবিতাগুলি পড়িয়া উৎসাহ দিতেন, এই সুযোগের জন্য মন সর্বদা আকুলি-বিকুলি করিত।

‘সেবার ফরিদপুরে মনমোহন থিয়েটার আসিল। আমার তো বেশি পয়সা ছিল না। সকলের নিম্নের আট আনা দামের একখানা টিকিট ক্রয় করিয়া থিয়েটার দেখিতে গেলাম। ড্রপসিনের সময় আমার এক বন্ধুর খোঁজে ভিতর দিয়া সেকেন্ড ক্লাসে গেলাম। বন্ধুকে না পাইয়া সেখানকার গেট দিয়া বাহির হইয়া আসিতে আমাকে সেকেন্ড ক্লাসের গেট-পাশ দেওয়া হইল।

সেই পাশ লইয়া আমি ফোর্থ ক্লাসের গেটে ঢুকিব, অমনি বসন্তবাবু থাপা দিয়া আমার হাত ধরিয়া ফেলিলেন: “তুমি ফোর্থ ক্লাসের সিট কিনিয়া সেকেন্ড ক্লাসের পাশ লইয়া আসিলে কিরূপে? নিশ্চয়ই তুমি সেখানে যাইতে চেষ্টা করিয়াছিলে। তোমাকে সাধু বলিয়া জানিতাম। কিন্তু আজ তুমি বেশ সাধুতার পরিচয়ই দিলে।” আমি সমস্ত ঘটনা তাঁহাকে খুলিয়া বলিলাম। তিনি তাহা বিশ্বাস করিলেন না। থিয়েটারের পরবর্তী সময় আমার কাছে বিষে বিষময় হইয়া উঠিল।

 

চলবে…