সেবা-সমিতির সভ্য হিসাবে
ভুসী গাড়োয়ানের ছেলের কলেরা হইল। স্টেশন-মাস্টার বলিলেন, “হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করাই।” আমি হোমিওপ্যাথিকে বিশ্বাস করিতাম না। এখনও করি না। শুনিয়াছি, আমেরিকার কোনো কোনো প্রদেশে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিষিদ্ধ। পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই তো ভ্রমণ করিলাম। একমাত্র পাক-ভারত ব্যতিরেকে কোথাও কোনো হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার দেখিতে পাইলাম না। আমাদের দেশের লোকেরা যেমন ভূত, প্রেত, ওঝা, পীর ও ফকিরে বিশ্বাস করে তেমনি হোমিওপ্যাথিক ঔষধে বিশ্বাস করে। গ্রামদেশে ঘুরিয়া দেখিয়াছি, প্রায় অধিকাংশ গ্রামেই একজন আধজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার আছে। এদেশের লোক সব সময়ই কোনোকিছু বিশ্বাস করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া থাকে। যাহারা হোমিওপ্যাথিকে বিশ্বাস করে তাহারা বন্ধু সমাবেশে এই ঔষধের কার্যকারিতা সম্বন্ধে এমন সব রোমাঞ্চকর কাহিনী বানাইয়া বলে যে শ্রোতাদের মধ্যে কেহ যদি তাহা অবিশ্বাস করিতে চায়, তাহার পক্ষে সেখানে তিষ্ঠানো দায় হইয়া পড়ে। সেই গল্প যাহারা শোনে তাহারা আবার তাহাতে আরও কিছু রং চড়াইয়া অপরের কাছে বলে।
এমনি করিয়া আমাদের দেশে ভূতের গল্পগুলি প্রচলিত হইয়া পড়িয়াছে। হিন্দু দেবতারা বহু হস্ত এবং বহু মস্তকের অধিকারী হইয়াও বহু বৎসর ধরিয়া ভক্তমণ্ডলীর পূজা পাইয়া আসিতেছেন। দেশের জনগণের এই সহজ বিশ্বাসপ্রবণতার জন্য বহু পীর ও সাধু-সন্ন্যাসী নানা তুক-তাকের অবতারণা করিয়া সমস্ত দেশটাকে অবাধে শোষণ করিয়া চলিয়াছে। এমন রোগ আছে যাহা আপনা হইতেই সারিয়া যায়। এমনও রোগ আছে যাহা নিতান্তই মনের রোগ। যে-কোনো ঔষধ বা মন্ত্রে রোগীর বিশ্বাস হইলে সারিয়া যায়। এই ধরনের ব্যাধিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা কম নয়। তাহারা দু’এক ফোঁটা হোমিওপ্যাথিক ঔষধেই সারিয়া যায়। কিন্তু কলেরা, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, যক্ষ্মা প্রভৃতি ব্যারামের বর্তমান যুগে যেসব অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহার সুযোগ হইতে কয়েকটি গালগল্পের দ্বারা সরল দেশবাসীদিগকে যাহারা বঞ্চিত করিতেছে তাহাদের প্রতি আমাদের রাষ্ট্রের কি কোনো কর্তব্য নাই?
যাক এসব কথা। স্টেশন-মাস্টার মহাশয়ের সঙ্গে অনেক তর্ক-বিতর্ক করিয়া ভুসীর ছেলের জন্য অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করিলাম। আমার সেবা-কার্যের জন্য শহরের ডাক্তারেরা প্রায় সকলেই আমাকে ভালোবাসিতেন। কোনো গরিব লোকের জন্য ডাকিলে তাঁহারা ফি লইতেন না। কারণ গ্রামদেশে আমার এমনই সুনাম ছিল, আমি সমর্থন না করিলে আমাদের অঞ্চলে কোনো ডাক্তারের কল পাওয়ার উপায় ছিল না। আমার সেবাকাজে ডাঃ অমিয়কুমার মৈত্র মহাশয় আমার বড়ই সহায় ছিলেন। কত রোগীর বাড়িতেই যে তাঁহাকে বিনা ফিসে লইয়া গিয়াছি। কোনো কোনো রোগীর বাড়িতে যাইয়া তিনি অপদস্থও হইয়াছেন।
দুই-তিনদিন বিনা ফিসে তাঁহার চিকিৎসাধীনে থাকিয়া গ্রাম্য-টাউটের গালগল্পে রোগীর আত্মীয়েরা উপযুক্ত ফিস দিয়া কোনো কম্পাউন্ডার দিয়া রোগীর চিকিৎসা করাইয়াছে। তবু আমি ডাকিলেই তিনি কখনও বিনা পারিশ্রমিকে রোগী দেখিতে অস্বীকার করিতেন না। এই ভদ্রলোক এখনও ফরিদপুরে ডাক্তারি ব্যবসা করিতেছেন। হয়তো আগের মতোই গরিব রোগীদের তিনি বিনা পারিশ্রমিকে দেখাশুনা করেন।
এই অমিয়বাবুকে ভুসীর ছেলের চিকিৎসার ভার দিলাম। তিনি কয়েকটি পুরিয়া তৈরি করিয়া দিলেন। এই পুরিয়া ঈষৎ উষ্ণ পানিতে মিশাইয়া রোগীকে তিন ঘণ্টা অন্তর পার-রেকটাল ডুস দিতে আরম্ভ করিলাম। এই ডুস আবার খুব সাবধানে দিতে হইত। যাহাতে ফোঁটায় ফোঁটায় এই ঔষধ-পানি ধীরে ধীরে রোগীর শরীরে প্রবেশ করে সেদিকে লক্ষ রাখিতে হইত। ঘন ঘন পায়খানা ও বমি হওয়ার জন্য কলেরা রোগীর দেহ হইতে রক্ত পানি হইয়া বাহির হইয়া যায়। সেইজন্য এই ঔষধের মাধ্যমে কৃত্রিম লবণ-পানি রোগীর দেহে প্রবেশ করাইয়া রোগীকে গরম রাখা হয়। রোগীর নাড়ির ভিতর দিয়া এই ঔষধ প্রবেশ করাইলে আরও উপকার হয়। অশিক্ষিত সমাজে ইহা কেন কার্যকর হয় না সে কথা আগেই বলিয়াছি।
ভুসী ছেলের শিয়রে বসিয়া কাঁদিত। তার একটিমাত্র ছেলে। স্কুলে পড়াইবে বলিয়া সুদূর বিহার অঞ্চলের বাড়ি হইতে ছেলেটিকে কয়েক বছর আগে লইয়া আসিয়াছে। আসিবার সময় মা কত কান্নাকাটি করিয়াছে। ভুসী শোনে নাই। আজ যদি ছেলে ভালো হইয়া না ওঠে তবে ভুসী নদীর জলে ডুবিয়া মরিবে। “বাবুজি! আমার ছেলেটিকে ভালো করিয়া দাও।”
আমি বলিলাম, “ভুসী। আল্লাকে ডাক। আল্লাই তোমার ছেলেকে ভালো করিবেন।” ভুসীর সঙ্গে সঙ্গে আমিও আল্লাকে ডাকিলাম।
চলবে…..