মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:১৮ পূর্বাহ্ন

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-১)

  • Update Time : শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০২৪, ২.১৭ পিএম

শিবলী আহম্মেদ সুজন

যে কোন বস্ত্র বুননের তিনটি স্তর আছে-কার্পাস সংগ্রহ, সুতা কাটা এবং কাপড় বোনা। ঢাকাই মসলিনের বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, কার্পাস উৎপাদন থেকে আরম্ভ করে কাপড় তৈরী হওয়া পর্যন্ত সকল স্তরেই ঢাকা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, বিদেশের উপর নির্ভরশীল ছিলনা। ঢাকার মাটিতেই কার্পাস জন্মাত, ঢাকার তাঁতিরাই সুতা কাটত এবং বস্ত্র বুনন করত।

অনেক ক্ষেত্রে চাষী নিজেই তাঁতির কাজ করত এবং তাঁতি নিজেই সুতার মিস্ত্রির কাজ করে নিজের তাঁত তৈরী করত। তাঁত তৈরীর জন্যও কোন বিদেশী জিনিসের প্রয়োজন ছিলনা, কারণ তাঁতে ব্যবহারোপযোগী কাঠ-বাঁশও ঢাকার বুকেই জন্মাত। সামান্য লোহার প্রয়োজন হলেও দেশজ লোহা তার প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম ছিল, তবে ঢাকার তাঁত এত সাধারণ ভাবে নির্মিত হত যে কাঠ এবং বাঁশ এবং ছোট এক টুকরা লোহা তার প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট ছিল।

তাঁতের জন্য কোন দালান-কোঠারও দরকার ছিলনা, কারণ বছরের অর্ধেক সময় খোলা  জায়গাতেই তাঁতের কাজ চলত, প্রয়োজন অনুভূত হলে তাঁতির নিজ বাসগৃহে তাঁত সরিয়ে নেওয়া বিশেষ জটিল কাজ ছিলনা। মসলিনের যখন স্বর্ণযুগ, তখন প্রয়োজনের তাগিদেই মসলিন বুননের ছোটখাটো সকল কাজ বিভিন্ন শ্রেণীর দক্ষ কারিগরদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। মসলিনের প্রচুর চাহিদা পূরণের জন্য দক্ষ তাঁতিরা একমাত্র বুননের কাজ ছাড়া অন্য কোন কাজে মনযোগ দিতে চাইত না।

সুতরাং একদল লোক পরপর বেশী কার্পাস উৎপাদনে মনোযোগ দেয়, অন্যদের কেউ হয়তঃ সুতা কাটা বা তাঁত নির্মাণে বা কাপড় বুননে কাজ করে।ফলে কার্পাস থেকে আরম্ভ করে কাটা সুতা বা তাঁত ইত্যাদি সকল কিছুই বাজারে বেচাকেনার জন্য মজুত থাকত। যাই হউক, একথা উচিত নয় যে, ঢাকাই মসলিন পুরাপুরি দেশজ শিল্প ,একমাত্র রপ্তানী ছাড়া অল্প কিছুর জন্য ঢাকাই মসলিন বাইরের জগতের উপর নির্ভরশীল ছিলনা।

কার্পাস উৎপাদন ও সংগ্রহ

মসলিন বুননের উপযোগী সকল কার্পাস ঢাকা জেলা ও পাশের এলাকাতেই জন্মাত। সাধারণতঃ পূর্ব বাংলার সবখানেই কমবেশী কাপাস উৎপন্ন হত। এই সব কার্পাস দুই ভাগে বিভক্ত ছিল-ফুটী ও বয়রাতি। ফুটী কার্পাস বয়রাতি অপেক্ষা খুব ভালো ছিল। যদিও বয়রাতি কার্পাস দ্বারাও মসলিন বুনন করা হত, বেশি ভালো মসলিনের জন্য ফুটী কার্পাসই ব্যবহার করা হত।

কার্পাল ঢাকা জেলার অন্যতম প্রধান কৃষিজাত দ্রব্য ছিল, কিন্তু বেশি ভালো কার্পাস-এ সরু মসলিনের নিতান্ত অপরিহার্য উপকরণ ছিল, শুধু মেঘনা নদীর পশ্চিম তীরে সামান্য জমিতেই  ভাল জন্মাত। এই  জমির দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪০ মাইল এবং প্রস্থে প্রায় ৩ মাইল ব্যাপী বিস্তৃত ছিল এবং কেদারপুর, বিক্রমপুর, রাজানগর, কার্তিকপুর, শ্রীরামপুর ও ইদিলপুর নামক পরগণা সমূহ ফুটী কার্পাস উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল।

জন টেলরের মতে, এই জমিতে উৎপাদিত ফুটী কার্পাস পৃথিবীর যে কোন দেশে উৎপাদিত কার্পাস থেকে শ্রেষ্ঠ ছিল।তাছাড়া লখ্যা নদীর তীর ঘেঁষে  রূপগঞ্জ থানা এলাকায় প্রায় ১৬ মাইল দীর্ঘ  জমিতেও  ভালো মানের ফুটী কার্পাস উৎপাদিত হত।

কার্পাস বীজ বছরে দুইবার বপন করা হত, প্রথম ফসল সংগ্রহ করা হত বসন্তকালে এবং দ্বিতীয় ফসল শরৎকালে। কার্পাস গাছ সাধারণতঃ ৪/৫ ফুট দীর্ঘ ছিল। বসন্তকালে যে ফসল সংগ্রহ করা হত তাই ভালো ছিল। সুতরাং ঐ ফসলই  অনেক পরিমাণে চাষ করা হত। সাধারণতঃ ঐ ফসলের জমিতে বর্ষাকালে ধানের চাষ হত। আশ্বিন-কার্তিক মাসে ধানের ফসল  সংগ্রহ করার পর একই জমিতে কার্পাসের বীজ বপন করা হত।

কার্পাস বীজ অত্যন্ত যত্ন সহকারে রক্ষণ করা হত। তুলাসহ বীজ বাছাই করে মাটির পাত্রে রাখা হত। ঐ সব পাত্রগুলি ঘি অথবা তেলে ভিজিয়ে নেওয়া হত এবং বীজ ভর্তি পাত্র মুখ বন্ধ করে চুলার উপর ঝুলিয়ে রাখা হত যাতে করে রান্নার সময় ঐ পাত্রে চুলার ধোঁয়া লাগে। কার্পাস বীজকে আর্দ্রতা মুক্ত রাখাই এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল করিম-এর বইয়ের সহায়তায় এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

ঢাকায় কত প্রকারের মসলিন ছিলো (১ম কিস্তি)

ঢাকায় কত প্রকারের মসলিন ছিলো (১ম কিস্তি)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024