মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫০ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৫)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

জীবনকথা

তিনি বি এ পাশ করিলে স্কুলের হেডমাস্টারের পদ খালি হয়। বাজানই চেষ্টা-চরিত্র করিয়া গভরনিং বডির লোকদের বলিয়া কহিয়া তাঁহাকে এই কাজে নিয়োগ করান। কিন্তু হেডমাস্টারের পদ পাইয়াই কিছুদিনের মধ্যে তিনি তাঁহার ভোল বদলান। বাজান তাঁহাকে হেডমাস্টার বলিয়া অন্যান্য শিক্ষকদের মতো সমীহ করিয়া চলিতেন না। আগের মতোই তুমি বলিয়া সম্বোধন করিতেন। ইহা তিনি পছন্দ করিতেন না। স্কুলের কার্যনির্বাহক সমিতিতে তিনি বয়স বৃদ্ধি হেতু বাজানকে অবিলম্বে অবসর গ্রহণের সুপারিশ করিয়া এক প্রস্তাব পাঠাইলেন। কার্যনির্বাহক সমিতিতে বাজানের মতো আরও দু’একজন বৃদ্ধলোক ছিলেন। তাঁহাদের হস্তক্ষেপে সেবার তাঁহার প্রস্তাব বানচাল হইয়া গেল। সেই সভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। হেডমাস্টার মহাশয় তখন অভিযোগ করিলেন, আমার পিতা তাঁহাকে সম্মান করিয়া চলেন না। অনেক সময় তাঁহার কাজে প্রতিবাদ করেন। ইহাতে স্কুলের শৃঙ্খলা রাখা যায় না। কার্যনির্বাহক সমিতির একজন তরুণ সভ্য প্রস্তাব করিলেন, হেডমাস্টারের কাছে এজন্য বাজানের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আমি ভাবিয়াছিলাম এরূপ আত্মসম্মানহীন প্রস্তাবে বাজান রাজি হইবেন না। কিন্তু তিনি তৎক্ষণাৎ হাতে জোড় করিয়া গদগদভাবে বলিলেন, “দেখুন হেডমাস্টার মহাশয়। আমি বৃদ্ধ হইয়াছি। আপনি আমার ছেলের বয়সী। যদি আপনার নিকট কোনো অপরাধ করিয়া থাকি আমাকে ক্ষমা করিবেন।”

তখন অনেক কষ্টে আমি চোখের পানি রোধ করিলাম। কি সামান্য চাকরির জন্য আমার পিতাকে ওই অসভ্য অকৃতজ্ঞ হেডমাস্টারের নিকট এতটা নীচতা স্বীকার করিতে হইল। আমার পিতার সুদীর্ঘ জীবনে কখনও তাঁহাকে এরূপ করিতে দেখি নাই। একবার আমাদের বাড়িতে কবি নজরুল ইসলাম আসিয়া কিছুদিন থাকিলেন। গভর্নমেন্টের চাকুরিয়া আমার এক ভগ্নীপতি খবর পাঠাইলেন, নজরুল ইসলাম রাজনৈতিক দলের লোক। গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে কথা বলেন। আমাদের বাড়িতে জায়গা দিলে শ্বশুরবাড়ি আসা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব হইবে। ইহাতে আমার পিতা বড়ই খান্না হইয়া আমার সেই ভগ্নীপতিকে বলিয়া পাঠাইলেন তিনি যদি আমার বাড়িতে না আসেন, না আসিতে পারেন। কিন্তু বাঙালির এই প্রসিদ্ধ কবি তাঁহার কাছে বহু সম্মানের পাত্র, জামাতার অসুবিধার জন্য তাঁকে তিনি নিজের বাড়ি হইতে চলিয়া যাইতে বলিবেন না।

আরও একবার কোর্ট হইতে একটি মামলার বিচারের ভার বাজানকে দেওয়া হইয়াছিল। আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের একজন ঢেঙ্গাইত লোক বাজানকে ভয় দেখাইয়া খবর পাঠাইয়াছিল, তার লোকের পক্ষে যদি বাজান ডিক্রি না দেন তবে পথে-ঘাটে সে বাজানকে অপমান করিবে। বাজান বলিয়া দিয়াছিলেন কারও ভয়ে তিনি অবিচার করিবেন না। দুই পক্ষের সবকিছু জানিয়া শুনিয়া তিনি ন্যায় বিচার করিবেন। সেই মামলায় তিনি এই মাতব্বরের সমর্থনকারীর বিরুদ্ধে রায় দিয়াছিলেন। তাহার ভয়ে এতটুকুও বিচলিত হন নাই। নিজের বিবেক ও আত্মবিশ্বাসের প্রতি যাঁহার এতটা বিশ্বাস ছিল, কি করিয়া তিনি এমন অপমানজনক প্রস্তাবে রাজি হইলেন ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। আর কিছুদিন স্কুলে কাটাইবার জন্যই তিনি এইভাবে নিজেকে হেয় করিয়াছিলেন। ইহার কয়েকমাস পরে যখন স্কুলের বয়স্ক কর্মকর্তারা দুইজনই ফরিদপুরের বাহিরে ছিলেন, হেডমাস্টার মহাশয় সেই সময় গোপনে এক সভা ডাকিয়া বাজানকে স্কুল হইতে অপসারণের ব্যবস্থা করেন। বাজান খবর পাইয়া আকাশ হইতে পড়িয়া গেলেন কিন্তু কর্মপরিষদে একবার যাহা পাশ হইয়াছে তাহা আর বাতিল হইবার নয়। ধীরে ধীরে বাজানের বিদায়ের শেষ দিনটি চলিয়া আসিল। জীবনের সুদীর্ঘ ৩৫ বৎসর ব্যক্তিগত নানা অভাব-অভিযোগের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া যিনি এই স্কুলটিকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলেন আজিকার দিনে সে ইতিহাস কেহই স্মরণ করিল না। আজ এই বয়োবৃদ্ধ শিক্ষককে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্কুল হইতে অপসারণ করাইয়া স্কুলের কর্তৃপক্ষ তাঁর আজীবন ছাত্রসেবার উপযুক্ত পুরস্কার প্রদান করিলেন। মাত্র পনেরোটি টাকাই তো তিনি মাসে মাসে পাইতেছিলেন। স্কুলের দপ্তরিও তাঁর চাইতে বেশি মাহিনা পাইত। কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হইত তাঁকে আরও দুই-এক বৎসর স্কুলে রাখিলে! আমার পিতা বলিয়া নয়, তাঁর জীবনের সুদীর্ঘ ৩৫ বৎসর কত শত সহস্র ছাত্র তাঁর নিকট শিক্ষা পাইয়াছে। তাঁহারা সকলেই এক বাক্যে সাক্ষ্য দিবেন, তিনি কত ভালো শিক্ষক ছিলেন। তিনি ক্লাসে যে-পাঠ বুঝাইয়া দিতেন, বাড়ি যাইয়া ছাত্রদের তাহা না পড়িলেও চলিত। কিন্তু নূতনের জন্য পুরাতনকে স্থান করিয়া দিতেই হইল। কারণ পুরাতনের চাইতে নূতনেরা দলে ভারী। এমনি ঘটনা নিত্য নিত্য ঘটিতেছে। পুরাতনের আজীবনের অভিজ্ঞতার চাইতে নূতনের দু’একটি নতুন কথার জৌলুস বেশি। কাঞ্চন ফেলিয়া সমস্ত দেশ কাচের আদর করিতে শিখিয়াছে। এই ঘটনা শুধু ফরিদপুর হিতৈষী স্কুলের ঘটনাই নয়। দেশের শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, গভর্নমেন্টের অফিসে, কাছারিতে নিত্য নিত্য এমনি শত শত অবিচার চলিতেছে। কে তাহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইবে? যাহাদিগকে এমনি ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাকরি হইতে অপসারণ করানো হয়, দেখা গিয়াছে কর্মময় জীবন হইতে হঠাৎ বিচ্যুত হইয়া তাহারা অবিলম্বে মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়ে। যেসব কর্তৃপক্ষ এইভাবে শত শত লোকের মৃত্যু ঘটাইয়া তাহাদের পোষ্যবর্গকে পথের ভিখারি করিয়া দেয় তাহাদিগকে নরঘাতক আখ্যা দিলেও যোগ্য বিশেষণ হয় না।

বাজানের বিদায়ের দিন শুনিয়াছি তাঁহার প্রিয় ছাত্রেরা বহু ফুলের মালার সঙ্গে চোখের পানি মিশাইয়া নিজেরা কাঁদিয়া তাহাদের প্রিয় শিক্ষককে বালকের মতো রোদন করাইয়াছিল। আমরা আশঙ্কা করিয়াছিলাম, স্কুলের কাজ হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া বাজান খুবই ভাঙিয়া পড়িবেন। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। খবর পাইয়া আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলিয়া আসিলাম। বাজানের সঙ্গে সঙ্গে থাকিতে লাগিলাম। অবসর পাইলেই তাঁহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিতাম, স্কুলের কাজ ছাড়িয়া তিনি ভালোই করিয়াছেন। এখন হইতে তিনি প্রচুর পরিশ্রম করিতে পারিবেন। গ্রামের লোকদের জন্য এটা-ওটা ভালো কাজ করিতে পারিবেন। বাজান আমার এই বোঝানো পছন্দ করিতেন না। কোনো কোনো দিন শেষরাত্রে জাগিয়া তিনি বসিয়া থাকিতেন।

(চলবে)

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৪)

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৪)

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024