দিলরুবা আহমেদ
আমার স্কুল কলেজ ভার্সিটির অধিকাংশ বান্ধবীরাই এখন হয় দেশের বাহিরে থাকে বা ঢাকাবাসী অথবা সংসারবাসী। সংসারের যাঁতাকল থেকে মুখ তুলে আমাকে দেখে যে একটা হৃদয় নাড়ানো হাসি দেবে তার ফুসরত আমি ওদের দিলাম আর কই! অজানাই থাকলো তাদের কাছে এই আমার আসার খবর। ছেলেরা জেনে গিয়েছিলো ঢাকাবাসী কিছু বন্ধুর কারণে। তবে আমার বাল্য বান্ধবী জিনাত এলো, ও থাকে আগ্রাবাদ, আমি একা অতদূর যেতেও সাহস করলাম না অথচ এক সময় কত গিয়েছি, আজ মনে হচ্ছে সব পথ মিশে গেছে এটার সাথে ওটা, ওটার সাথে এটা।ও এলো ওর ছেলেকে নিয়ে।অল্প সময়ের ভিতরেই ওর সাথে একটু ঘুরলাম, খেলাম। আম্মা একা থাকলেন তার আবাস জুড়ে।
ফেরার পথে মিমিতে নেমে গেলাম, আমার অতীতের সেই অতি চেনা মার্কেটে না গিয়ে পারলাম না।মার্কেটে ঢুকেই নিয়ত গুনে বরকত হয়ে দেখা হয়ে গেলো আমাদের সবার বন্ধু আরিফের সাথে।আমি মার্কেটে ঢুকে ছিলাম আমাদের বাড়ির দারোয়ানের ছেলেটির জন্য কিছু একটা কিনার অজুহাতে, সাম্প বা সেন্ট জাতীয়ও কিছু। আমাকে দেখলেই তারা বলছে ’হ্যালো মেম’।তিন ছেলে তিন বয়সী। ৬, ১২ , ১৬ । খুবই ফিটফাট হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের বাড়িটির সর্বত্র।ওদের জন্য কিছু কেনার ইচ্ছে।তো দেখা হয়ে গেলো আরিফের সাথে। আমিও অবাক। সেও।ওদের সাথে দেখা করতে সময় দিতে পারছি না অথচ মার্কেটে ঘুরছি! বড়োই লজ্জাকর পরিস্থিতি। সে-ই সাত তাড়াতাড়ি বললো, চলো রুবা একটা সেলফি তুলি।কি বলবো না বলবো ভেবে বের করার আগেই সোজা সমাধান, চলো একটা সেলফি তুলি। যে যুগে যেটা। সেলফির যুগে আমাদের আবার দেখা হয়েছে। আমরা যখন ছাত্র ছাত্রী ছিলাম তখন সেল ফোনও ছিল না, পুলিশের হাতে মনে হয় ওয়াকিটকি দেখতাম।আম্মা ভেটো দিয়েছে বলে আমাদের সকলের একত্রিত হাওয়ার সম্ভাবনাটা এবারের মতন যে বাতিল হয়ে গেলো তাই জেনে বললো, আমরা এখনো মায়েদের কথা শুনি, আমাদের ছেলেমেয়েরা কি আমাদের কথা অতটা শুনে!! আরো বললো, এরপর থেকে আন্টিকেও দাওয়াত করবো।আমিও বললাম, তাই করো, আম্মাদের একা একা পিছনে ফেলে রাখা ঠিক নয়।ঘরে বসে একা একা জগৎ সংসারের তাবৎ দুশ্চিন্তা করার চেয়ে তাদের সাথী করাই শ্রেয়। এসে দেখুক আমাদের বন্ধুত্বের জগৎ কত মমতাময় আলোকিত। জানালাম, আগামী কালকে ১৩ তারিখে ঢাকায় ফিরে যাবো। পরের বার সবার সাথে দেখা হবে ইনশা আল্লাহ।
মিমি থেকে বের হয়ে চিটাগং মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে বাসায় আসতে আসতে ভাবলাম, আমার জন্ম দিনেই আমি চলে যাচ্ছি, আমার জন্ম হয়েছিল যেই শহরে সেই শহর থেকে হয়তোবা আরো ২০/২২ বছরের জন্য চলে যাচ্ছি। আমি জন্মেছিলাম ওই চিটাগং মেডিকেল কলেজে। তারপর কোলে পিঠে হেটে অনেক শহরে অনেক জায়গায় ঘুরে স্কুলের শেষের দিকে আবার চট্টগ্রামে। তারপরে একসময়ে চলে গিয়ে আবার ২২ বছর পরে এই আসা, হয়তোবা শেষ আসা, হয়তোবা তাই শেষ আশা একবার অতীত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখার।আমার বেড়ে উঠার বেশিটুকু সময় যে আমি এখানেই কাটিয়েছিলাম।
দরজার মুখেই ছিল আমাদের দারোয়ানের বড়ো ‘ফোয়া”টি, যে কিনা আসতে যেতে আমাকে দেখলেই বলছে ‘হ্যালো’। আমি চেয়ে দেখেছি, জবাব দেইনি।ওকে আমার বেশি বেশি স্মার্ট মনে হয়েছে। আমাকে অবাক করে আজ বললো, বদ্দি, গম আছেন্নি! আমি এবার অবাক হলাম, হেসেও দিলাম। যদিও আমি এখন আমার বসবাসের জায়গার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অনেক বেশি পরিচিত ‘হ্যালো ‘-র সাথে। কিন্তু ওকে কাছে টানলাম আন্তরিকতায় যেন খাঁটি সরিষার তেলের গন্ধে।বলা বাহুল্য, ছেলেটির মাথায়ও প্রচুর সরিষার তেল মাখা। প্রথম দিন থেকেই এটি পাচ্ছিলাম।এতো ফিট ফাট হয়ে মাথায় সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে তারা, ঘুরছে তারা, কি রকম যেন বড়ই অদ্ভুত। আমার সামনে যাতে তাদেরকে চমৎকার দেখায় তাই এতো আয়োজন।ওরা আমাকে আগে কখনো দেখেনি। প্রথম দেখা। দুই দিন আগেই যে রাতে এসে পৌছালাম সেদিনই দারোয়ানের বৌ জানিয়েছিল তার তিনটা ছেলেই এই বাড়িতে জন্মেছে, তাই তারা মাতৃভূমির মতন করে এই বাড়ি আগলাচ্ছে। আম্মা রেখেছিলেন একজন দারোয়ান, আমি এসে দেখলাম ওরা সদলবলে পাঁচজনের এক সেনাবাহিনী হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। বাইশ বছর পরে আসবা আর ভাববা একজন একজনই থাকবে, সেটা ঠিক না, একজন পাঁচজন হয়ে গেছে। একতলা পুরাপুরি তাদের দখলে। আমাদের নিজেদের এতো বছরের যে পুরাতন সংসার ছিল একতলা দোতলা জুড়ে তাতে গিয়ে আর কখনোই থাকা হবে না সম্ভবত আমাদের।আমার মাথার ভিতর কবিতাটি আবারো শাখা গজালো। বাড়িটির উদ্দেশে, শুনালাম বাড়িটাকেই, আপন মনে নিভৃতে, বললাম,
তোমার সাথে আমার একটা প্রেম ছিল,
ভালোবাসার গল্প ছিল,
পদ্ম পাতায় পদ্য ছিল,
সাতকাহনের বারান্দাও ছিল।
ছিল না যে কেবল বাড়িটায় থাকা! আমার ঘরটায় আরেকটা বার শোয়া!
হয়নি সেটা। হয়নি ঠিকটা। শেষটা।
প্রেমটা হারালো ঠিক ঠিকানাটা।
হেই বাড়িটা, তোমার সাথে আমার অসীম একটা প্রেম ছিল।
মনে হলো বাড়িটি হেসে গড়িয়ে গেলো বাম দিকে।
সে হাসিতে কিছুটা লজ্জাও যেন ছিল।লাজুক লতার মতন করে বললো, এতো বয়সে এইসব কি বলো আমাকে।আমিও মনে মনে ভাবী, আরে তাইতো! বেচারা বাড়িটি জানে না, আমি চট্রগ্রাম শহরের সব কিছুকেই বলে যাচ্ছি ওই এক কথা, ‘তোমার সাথে আমার একটা প্রেম ছিল’।নিজেদের বাড়িতে থাকলাম তবে চারতলাতে, আমাদের নিজেদের বসবাসের ডুপ্লেক্স অংশে (একতলা ও দোতলা) থাকা হলো না তাই যেন মনে হতে লাগলো থাকা হলো না আমাদের ঘরে। এলাম এতো দূর থেকে। দূর থেকেই যেন দেখে চলে গেলাম।
আমি চট্রগ্রাম শহরে গিয়ে বেশি কোথাও যায়নি, গিয়েছি কেবল আমার নিত্যদিনের চেনা পথে ঘুরে আসতে।যে পথে বহু বছর আগে বহুবার গিয়েছি সেই পথেই আবার একবার গিয়েছি, এতেই আমার আনন্দ ছিল যেন।পতেঙ্গায় সমুদ্রের পাশে বসে আমার সমুদ্রের স্রোত দেখা হয়নি, আমার দেখা হয়ে গেছে ব্রিসবেনের গোল্ড কোস্ট (অস্ট্রেলিয়া) থেকে সাউথ পাদ্রে আইলেন্ড (আমেরিকা) পর্য্যন্ত কতকি সমুদ্র, মহাসমুদ্র।আমাকে টানেনি রাঙামাটির পাহাড়।ডাকেনি কাপ্তাইয়ের হ্রদ।কিংবা ফয়েজ লেকের সবুজ প্রকৃতি।আমি কেবল থাকতে চেয়েছি আমারদের সেই ফেলে আসা সময়ের নিত্য দিনের জীবনে।ভার্সিটিতে ট্রেনে করে যেতে পারলে খুব ভালো লাগতো।ওটাও আমার ছিল প্রতিদিনের সঙ্গী। অনেক কিছু হয়ে উঠে না, এটাও হয়নি হওয়া।হওয়ার জন্য, যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় ছিল না আমার।মাত্র দুই/ তিনদিনে আর কতটুকুই-বা সম্ভব।তবে সত্যিই হে চট্ট্রলা, তোমার সাথে আমার একটা প্রেম ছিল।
রাত গভীর হতে থাকলো।
অনেক রাতে ঘড়িতে ১২টা বাজতেই মেসেজ আসা শুরু হয়েছে।জন্মদিনের শুভেচ্ছা। যান্তিক এই যুগে কে আর মনে রাখে কি, সবাই যন্ত্র থেকে রিমাইন্ডার পায়। তাই জানায়। আমারও তাই এই নিয়ে কোনো ভাবান্তর হলো না। এই দিনে চট্রগ্রামে মায়ের পাশে শুয়ে আছি এটাই আমাকে আনন্দ দিলো।জীবনের বহু সময় পার করে বহু দেশ ছুঁয়ে আবার এসে সেই মায়ের সাথে আমার জন্মদিনের রাতে চট্রগ্রামে এই আমি, কেমন কাকতালীয় যেন, এটাই আমাকে ভাবাচ্ছে ভাসাচ্ছে বহু ভাবনাতে , ভালোলাগার স্মৃতিতে। আম্মা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কাল সকালেই হয়তো ওনার মনে পরবে ওনার মা হওয়ার ঘটনাটা। তারপর জানি ঢাকায় ফিরে যেতে যেতে আমাকে অনেকবার বলবেন, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। সে আবার এটা বেশ সুর করে গায়ও। আমার হাসি পেলো। ঘুমন্ত মায়ের দিকে চেয়ে দেখলাম। বাতি জ্বলছে। বাতি জ্বালিয়ে রেখেই সে ঘুমাবে। সন্ধ্যা রাতের দিকে কারেন্ট চলে গিয়েছিলো যথারীতি। তারপর সে সবাইকে এ নিয়ে অনেক বকাবকি করছে দেখলাম। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে শুরু করে সবাইকে, কেও বাদ নেই।ভাগ্যিস, আমার পরিচিতজনদের কেও-ই ওই বিদ্যুৎ বিভাগে কাজ করে না, তাহলে আমার আম্মার অভিশাপে কাল সকালেই সে অন্ধ হয়ে গেছে শুনতাম। কখনো যদি দেখেন বিদ্যৎ বিভাগের কোনো একজন লোক অন্ধ তবে সাথে সাথেই বুঝে নেবেন এটার কারণ কি। কেও কারসাজি করে সব বিজলি বাতি ফু দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে এই আঁধারের কান্ড বাধিয়েছে কিনা তা নিয়েও উনি সন্দিহান হয়েছেন। তার এই সন্দেহের তালিকাও বেশ বড়। কারসাজি যে করেছে তার সাথে যোগসাজশকারী হিসাবেও অভিযুক্ত কম না।আপনারা যে তাতে নেই তা বোঝানোর জন্য আপনাদের জানাবো বলে মনে রাখতে চেষ্টা করলাম নামগুলো, কিন্তু তাঁর শেষের দিকে আসতে আসতে দেখি প্রথম অংশের নামগুলো ভুলে গেছি। আমাদের সাথে যে বডি গার্ড আনা হয়েছে, যে গত দুইদিন ছিল পার্শবর্তী এক হোটেলে তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য।তাকে বলা হয়েছে কারও সাথে একটাও যেন কথা না বলে।কথা বললেই ইনি-ও হয়তোবা সেই অচেনা অদেখা যোগসাজোশকারীদের সাথে যোগ দেওয়ার ইন্ধন পাবে। আমাকে বলা হয়েছে, আমি যেন লক্ষ্য রাখি নজরে রাখি এই রুল সে মেনে চলছে কিনা।এবং বহুবার বললেন তিনি, দেখেছো, কি ভালো করেছো দাওয়াতে যাওনি, একা একা তো তোমার চিন্তায় এই অন্ধকারে আমি তখন পাগল হয়ে যেতাম।আমি অবশ্য বললাম না যে আম্মা তোমার মেয়ে এখন বুড়ি হয়ে গেছে, ওকে নিয়ে ভেবো না, আম্মা তাহলে খুবই ভাবনায় পড়বেন উনি তাহলে কি এই নিয়ে। বুড়ির উপরে কি আছে আমি আবার সেটাও জানি না।আম্মা অবশ্য তার মমতাগিরি সবার উপর জারী রাখলেন, বললেন, পরের বার এলে ওদের সবাইকে ওই ছেলেগুলোকে বাসায় দাওয়াত করে দিয়ো।ওরা তো সবাই কত এসেছে আমার বাসায় ছোট বেলায়। কে কবে এসেছিলো এই বাসায় মনে নেই আমার তা এখন আর।তবে বলে গেলাম হ্যা হ্যা, বলবো বলবো।আমি যেন আমার আম্মার ‘ ইয়েস মিনিস্টার’।যা বলেন সব কিছুতেই বলি, ওকে, ঠিক আছে, নো ওরিস।
ঘুমের মাঝে আমার আম্মা অনেক রাতে বিড় বিড় করে বলতে লাগলেন, তোমাদের সবাইকে নিয়ে আমি যদি আবার কোনোদিন এই বাড়িতে থাকতে পারতাম।তোমার আব্বু আর তোমরা তিন ভাইবোন নিয়ে যে ছিলাম সেই সময়টা আবার যদি ফিরে আসতো।
আমি ভান করলাম আমি কিছুই শুনিনি। ঘুমায়ে গেছি।কোনো দুঃখকে আমি বাতাস দিতে চাইনা, এতে দুঃখ বাড়ে। যার জনক নেই সেই শুধু জানে, এই না থাকা যে কত বড় না থাকা। হ্যা, ঠিক তাই , যার জনক নেই সেই শুধু জানে এই না থাকা যে কত বড় এক না থাকা।আর যার স্বামী নেই, গেলো ২৪ বছর যে একা, তার নিঃসঙ্গতার নির্মমতা বুঝবার বা ভাববার দুঃসাহসও দেখাতে আমার সাহস হলো না। আমার কেবলই মনে হতে লাগলো বাংলা ভাষার সব চেয়ে নির্মম নির্দয় নিষ্ঠুর শব্দ হলো ‘বৈধব্য”। আমি কেবল হাত বাড়িয়ে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে ছোট বেলাকার মতন ঘুমিয়ে পরতে চাইলাম।
আমার প্রিয় শহরে সম্ভবত এটাই আমার জীবনের শেষ রাত। হয়তোবা। হয়তোবা নয়। হয়তোবা আবার কোনোদিন আসা হবে। হয়তোবা নয়।মন বলছে হয়তোবা নয়- ই হবে।
তবে তাতে কি !
“দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব
বাঁধনবিহীন সে যে বাঁধন-অকারণ
মায়াবন বিহারীনি ”